এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

অপরাধী

আমাকে অপরাধী করে দেয় তোমাদের ভালোবাসা।
সহসাই মহীরুহ হয়ে ধরা দেয় চোখে-
যত অক্ষমতা,
যত দারিদ্র‍্য আমার।

আমাকে অপরাধী করে দেয় তোমাদের ভালোবাসা।
অপাত্রে ঢেলে ঢেলে
কী নিদারুণ অপচয় হচ্ছে তোমাদের হৃদয় আবেগ !!
অথচ, কে না জানে-
আমি এর মোটেও যোগ্য নই,
কখনোই ছিলামও না।

#অপরাধী

রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

জন্মদিনের আত্মজিজ্ঞাসা

গতকাল ছিল আমার আটাশতম জন্মদিন। অর্থাৎ, সাতাশ বছরের জীবন কাটিয়ে দিয়েছি পৃথিবীর আলো বাতাসে।
সাতাশ বছর মোটেও কম সময় নয়। যদি এভাবে ভাবি- আজ থেকে সাতাশ বছর আগে যারা একইদিনে জন্মেছিলো, তারা সবাই কি আজও বেঁচে আছে? নেই। এমনকি আরো পরে যাদের জন্ম, তারাও অনেকেই বেঁচে নেই।

আল্লাহর ইচ্ছায় আমি বেঁচে আছি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে ফিরে এসে আজও বেঁচে আছি। তার মানে, আমি অনেক মানুষের তুলনায় অলরেডি এক দীর্ঘ জীবন পেয়েছি।

বয়স হলো সাতাশ। সাত বছর বাদ দিতে হয়, কারণ সাত বছর বয়সের আগে আসলেই কিছু বোঝার মত বয়স ছিলনা। তবু বিশ বছরেই এত এত ভিন্ন মাত্রার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, মাঝে মাঝে নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই। শরীরের বয়স যাই হোক, আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী মনের বয়স যে কত হয়েছে ঠাওর করতে পারিনা।
আমি জন্মদিন উদযাপন করিনা। ছুটির দিন থাকে, ঘুমিয়েই কাটাই। প্রশ্ন হলো- জন্মদিন কি আসলে আনন্দের সাথে উদযাপন করার বিষয়? নাকি এই ভেবে কষ্ট পাওয়া উচিৎ যে- নির্দিষ্ট হায়াতের হিসাব থেকে আরো একটি বছর কমে গেল! মহাকালের মহাশুন্যতায় অন্তর্ধানের দিকে আরো অনেকটা এগিয়ে গেলাম!!

জন্মদিনে অনেকেই আমাকে শুভেচ্ছা জানান। আমিও জানাই। যেকোন শিশুর জন্মই আনন্দের উপলক্ষ্য। হয়তো আমারটাও তাই। কিন্তু সেই শিশু যখন বড় হয়- তখন সে আর সবার জন্য আনন্দের কারণ থাকে না।

জন্মদিনের সবচেয়ে বড় আত্মজিজ্ঞাসা হলোঃ যখন শিশু ছিলাম, তখন হয়তো স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জন্য আনন্দের কারণ ছিলাম। এখন এই পরিণত বয়সেও আমি কি সত্যিই মানুষের জন্য আনন্দের উৎস হতে পেরেছি?

মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৬

সাজেকঃ মেঘের ওপর বাড়ি

গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ... 
 
চট্টগ্রামে যখন পা রাখলাম তখনো সূয্যিমামার মুখ দেখা যায় নি। পৌষের প্রথম সকাল। বাস থেকে নেমেই শীতের আমেজ টের পাওয়া গেলো। চাঁদর জড়াতে হলো গায়ে। বাসায় কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়েই ভ্রমণপিপাসুদের বিশেষ গ্রুপ "ভ্রমরের" কয়েকজন তরতাজা যুবক রওয়ানা হলাম "অক্সিজেনে"র উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাটায় সকাল আটটা পেরিয়ে গেছে। মানুষের পদচারণায় চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড়ের বাতাসে তখন অক্সিজেনের তুলনায় কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। 
আমাদের বাসে উঠতে হলো ঠিক সাড়ে আটটায়। গন্তব্য... রাঙ্গামাটি.... তবে আপাতত রাঙ্গামাটি নয়। যাচ্ছি খাগড়াছড়ির পথ ধরে সাজেকের সবুজ উপত্যকায়। সাজেক পড়েছে রাঙ্গামাটি জেলায়, কিন্তু পুরোটা পথ পড়বে খাগড়াছড়ির মাটিতে।

চান্দি গরম!!
 
ভ্রমর গ্রুপের দু'জন সদস্য আগের দিন বিকেলেই শান্তি পরিবহনের টিকেট কাটতে এসেছিলেন। তাদেরকে বলা হয়েছিলো সামনের দিকে কোন সিট খালি নেই। অতএব বাধ্য হয়ে তারা পেছনের দিকের কয়েকটি সিটের টিকেট কিনে নিয়ে যান। কিন্তু সকালে এসে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র!! হেল্পার চিৎকার করে ডাকছে... আসেন খাগড়াছড়ি... সিট খালি... এবং দেখা গেলো এইমাত্র এসে অনেকেই বাসের সামনের সিট পেয়ে যাচ্ছেন!! শান্তি পরিবহনের চট্টগ্রাম কাউন্টারের এই প্রতারণায় আমরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাম। এই শীতের সকালে আমাদের চান্দি গরম গেল। ব্যাটাদের একহাত দেখে নেয়া দরকার। কাউন্টারে যে দুজন বসা ছিল তাদের সাথে বেশ উচ্চবাচ্য হলো। ওদেরকে বেশ করে শাসিয়ে দিলাম। বাসে উঠলাম ঠিকই, কিন্তু যাত্রার শুরুতেই শান্তি পরিবহনের এই প্রতারণামূলক আচরণ যে অশান্তির সৃষ্টি করলো তার শেষ কোথায় কে জানে!!

জানালায় ভোরের আলো 
 
চারজন অলস বাস মিস করেছে। অতএব চারটা সিট খালি। অলসরা পরের বাসে পারলে আসবে। না পারলে নাই। ব্যাকপ্যাক গুলো খালি সিটে রেখে আয়েশ করে বসলাম আমরা। আর বাস ছুটলো গন্তব্যের টানে। হাটহাজারী, নাজিরহাট, মানিকছড়ি... পথের দুপাশে সবুজ গাছের সারি। কখনো কাটা ধানের ক্ষেত। শহর ছেড়ে আমরা গ্রামের আলোহাওয়ার ভেতর এগিয়ে চলেছি। ততক্ষণে সূর্য তার আলো ছড়াতে শুরু করেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে গায়ে। যেন আলতো করে মুখে চোখে বুলিয়ে দিচ্ছে উষ্ণ পরশ।

এই পথ যদি না শেষ হয়? 
 
মানিকছড়ি পার হলে শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা। দু'পাশে পাহাড়, টিলা। টিলার ঢালে সবুজের সমারোহ। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। এরকম পথে চলতে আমার এত ভালো লাগে, এজন্যই আমি শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে বারবার ফিরে আসি পাহাড়ের কোলে। অদ্ভুত সুন্দর আঁকাবাকা আর উঁচুনিচু এইসব নির্জন রাস্তায় এলেই গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে হয়- এই পথ যদি না শেষ হয়!! তবে কেমন হত, তুমি বলতো!! (তবে শেষ পর্যন্ত গলা ছাড়লাম না। নিজেকে কন্ট্রোল করেছি আরকি! বিকজ, আমার গানের গলা এতই মধুর যে, সুরের মূর্ছনায় রাস্তার সবকিছু থেমে যেতে পারে, ইউ নো!!)

টেনশন টেনশন!!
 
খাগড়াছড়ি নেমে নামায আর খাওয়া সেরে আমরা উঠলাম পাহাড়ী পথের জন্য বিশেষ জীপ- চান্দের গাড়িতে। শুরু হলো চান্দের গাড়ির দুরন্ত গতির সাথে আমাদের রোমাঞ্চকর যাত্রা। আমরা জানতাম যে দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকর্ট টীম সাজেক যায় বিকেল সাড়ে তিনটায়। কিন্তু খাগড়াছড়িতে নেমে জানা গেল সময়টা এখন এগিয়ে আনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর টীম যাবে পৌনে তিনটায়। অর্থাৎ এর মধ্যে দীঘিনালা পৌঁছতে না পারলে আজ আমাদের সাজেক যাওয়া হবে না। বাস মিস করা সেই চারজন অলস পরের বাসে রওনা দিয়েছিল। তারা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে আরো কিছুটা দেরি হয়ে গেল। সবাই কিছুটা টেনশন বোধ করতে লাগলাম। তবে কি তীরে এসে ডুবে যাবে তরী?
অবশেষে ঘুমকাতুরে অলসরা এসে পৌঁছলো। আর দেরি নয়। উল্কার বেগে ছুটলো চান্দের গাড়ি। গন্তব্য সাজেক, যেখানে মেঘের ওপর বাড়ি। 

পথে পথে চেকপোস্ট! 
 
আমাদের গাড়ি যখন আর্মি ক্যাম্পের কাছে পৌঁছলো, ততক্ষণে অন্যসব গাড়ি নিয়ে সেনাবাহিনীর টিম রেডি হয়ে গেছে। আর পাঁচ মিনিট দেরি করলেই মিস হয়ে যেত আজকের এসকর্ট। পর্যটকদের নিয়ে ৩৮ টি গাড়ির দীর্ঘ বহর এগিয়ে চললো সাজেকের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ পাহাড়ী পথ। আর পথে পথে চেকপোস্ট। কখনো সেনাবাহিনীর, কখনো বিজিবির, কখনো পুলিশের। মাঝে মাঝে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিলো, এ কি নিজের দেশে আছি? এখনো এতটা অনিরাপদ রয়ে গেছে পার্বত্য অঞ্চল! 
কিছুদূর এগিয়েই উঠে পড়লাম গাড়ির ছাদে। হাওয়ার বেগে ছুটছে গাড়ি। আর হাওয়ায় উড়ছে আমাদের মন।



উড়ু উড়ু মন নিয়ে চান্দের গাড়ির ছাদে

দীঘিনালা পেরিয়ে বাঘাইহাট। পথে কাচালং নদী, কাচালং বাজার, মাসালং বাজার। আঁকাবাকা আর উঁচুনিচু রাস্তা, তবে বান্দরবানের মত অতটা ভয়ংকর নয়। বলতে গেলে, সত্যিকারের এডভেঞ্চারারদের কিছুটা খারাপও লাগতে পারে। বিশেষ করে যারা আগেই বান্দরবানের গহীনে ঘুরে এসেছেন তাদের কাছে সাজেকের পথ হয়তো নতুন কোন অনুভূতি জাগাবে না। নতুন যা, রাস্তার পাশে প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উপজাতি শিশুরা আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াচ্ছিলো। ওরা কী বলছিলো শোনা যায় নি। তবে আমরা নিজেরাই ভেবে নিলামঃ নিশ্চয় ওরা বলছে- "ডিয়ার ট্রাভেলার্স, ওয়েলকাম টু সাজেক"!!!



সতর্কবানী


পাহাড়চূড়ায় পূর্ণিমা স্নান
 
সাজেকে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবি ডুবি করছে। রুইলুই পাড়ায় আমাদের জন্য বুক করা কটেজ "মেঘালয়" তে ব্যাগপত্তর রেখে বেরিয়ে পড়লাম দূর পাহাড়ের দেশে অস্তগামী সূর্যকে বিদায় জানাতে।



সাজেকের প্রবেশমুখ

আরো উত্তরে হেঁটে গেলে পাওয়া গেল মসজিদ। সেখানেই মাগরিব এবং এশার নামাজ পড়লাম। পুবের আকাশে তখন অন্য দৃশ্য। ভোরের সূর্যের মত লাল হয়ে উঠে আসছে পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ, তার ওপরে চাঁদ।

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রাত ন'টা পর্যন্ত চললো আমাদের খুনসুটি আড্ডা। ধীরে ধীরে আরো উজ্জ্বল, আরো সুন্দর, আরো মোহিনী রুপ ধারণ করলো চাঁদের আলো। হাজার ফুট উপরে, পৌষের প্রথম রাতে হিম হিম বাতাসে, এ যেন অদ্ভুত পূর্ণিমা স্নান। এ যেন মুগ্ধতার নতুন মাত্রা।

মেঘের ওপর বাড়ি
 
রাতে খেয়েদেয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিনের ভ্রমণের ক্লান্তি আর পাহাড়ের নীরব নিস্তব্ধতায় জম্পেশ ঘুম হলো। ভোরে উঠেই দৌড়। মসজিদে ফযরের নামায পড়ে আমরা উঠে এলাম সাজেকের হেলিপ্যাডে। দু'পাশে পাহাড়ী খাদ মেঘে মেঘে ভরে আছে। প্রথমবার মেঘের ওপরে উঠেছিলাম বিমানে। এবার মেঘের ওপর উঠেছি পায়ে হেঁটে!! ভাবতেই অন্যরকম অনুভূতি হলো।




হেলিপ্যাডের নিচে জমাট বেঁধে আছে সাদা মেঘের দল

সূর্যের তাপ আরেকটু বাড়লে আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম আরো উত্তরে কংলাক পাড়ার উদ্দেশ্যে। আরোহন করলাম কংলাক পাহাড়ে। অনেকেই হাঁপিয়ে উঠলো, কিন্তু কেওক্রাডং বিজয়ী পর্বতারোহী হিসেবে আমার কাছে এ যেন ছিল নিতান্তই ডালভাত!! বিনাক্লেশে উঠে পড়লাম কংলাক চূড়ায়। সেখানে লুসাই উপজাতির দুয়েকটা বাড়ি আছে। বাড়ির আঙিনায় তখনো জমাট মেঘ!! এ যেন সত্যিকারের- মেঘের ওপর বাড়ি।



মেঘের ওপর বাড়ি


ফেলে আসি নীলাকাশ 
 
সকাল দশটায় সাজেক থেকে ফিরতি যাত্রা। আবার সেনাবাহিনীর একটি টিম আমাদের সাথে নিয়ে যাবে দীঘিনালা পর্যন্ত। মূলত আমরাই যাবো ওদের সাথে। সেনাবাহিনীর এসকর্ট ছাড়া যাওয়া আসা করা যায় না। এবার আর ছাদে নয়। বসেছি গাড়ির পেছনের দিকে মুখ করে। সূর্যের তাপ বাড়ছে। আকাশে কোন মেঘ নেই। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর নীল আকাশ। এমন দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ বহুদিন দেখা হয়নি।
ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে পাহাড়ী পথ, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি শহুরে জীবনে।



পেছনে ফেলে আসি নীল আকাশ

বিকেলে ঘুরলাম আলুটিলার রহস্যময় গুহায়। দিনের শেষ মুহূর্তগুলো কাটিয়ে দিলাম রিসাং ঝর্ণার গান শুনে।



রিসাং ঝর্ণার গান

সূর্য ডুবে গেলে সাঙ্গ হলো এবারের খেলা। অন্ধকারে ডুবে গেল পাহাড়, মেঘ, ঝর্ণা আর দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ।

রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

অনারারীর অমানবিকতা

১।
হাসপাতালের ক্যান্টিনে ঢুকতেই আমার চোখ গেল কর্নারের টেবিলে। একা বসে আছেন ডাঃ বকুল। খুবই শান্ত শিষ্ট নিরীহ মানুষ। তবে আজ মনে হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি গম্ভীর। বেশ বিমর্ষ চেহারা।
গিয়ে বসলাম পাশে।

-কী ব্যাপার বকুল ভাই, মন খারাপ?
-জ্বি ভাই। আজকে একজনের সাথে একটু রুড আচরণ করে ফেলেছি। এখন মনটা খারাপ লাগছে। লোকটা ডাক্তারদের ব্যাপারে নিশ্চয় একটা খারাপ ধারণা নিয়ে গেলো। মানুষ কষ্ট নিয়েই হাসপাতালে আসে, কিন্ত ভাই সবসময় মেজাজ ঠিক রাখা যায় না। রাখতে পারি না। আর যারা এক লাইন বেশি বোঝে তাদের আমি কেন যেন সহ্য করতে পারি না।
ডাঃ বকুল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনারারী মেডিকেল অফিসার। সোজা বাংলায় ইনি একজন ডাক্তার যিনি তার শ্রমের বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক পান না। ডাক্তার হয়েছেন বছর খানেক আগেই। একটা ক্লিনিকে চাকরি করেন। একদিন তাঁর মনে হলো, শুধু ক্লিনিকের চাকরি করে দিনকে দিন মেডিকেল নলেজের ধার কমে আসছে। ট্রেনিং করা দরকার। আবারো পড়ালেখায় নামা দরকার। তাছাড়া ভবিষ্যতের বাজারে টিকে থাকার জন্য একটা পোস্ট গ্রাজুয়েশান ডিগ্রীও করা দরকার।

অতঃপর সিনিয়র ভাইদের পরামর্শে ডাঃ বকুল ঢুকে পড়লেন অনারারী ট্রেনিং এ। হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের অদ্ভুত হেলথ সিস্টেমের এক কিম্ভুত সদস্য, একজন বিনে পয়সার কামলা।

গতকাল রাতে তাকে ক্লিনিকে ডিউটি করতে হয়েছে। রাতটা বেশ 'খারাপ'ই গেছে বলতে গেলে। ক্রিটিকাল পেশেন্ট ছিল, ডেথ ডিক্লেয়ার করতে হয়েছে দু'জনের। ঘুমানোর কোন সুযোগই হয়নি। সকালে উঠে আবার ট্রেনিং-এর নামে বিনেপয়সার কামলাগিরি করতে এসেছেন।

সকালে এমনিতেই কাজের চাপ বেশি থাকে। নতুন ভর্তি রোগীর হিস্ট্রি রিভিউ, ফলো আপ, ইনভেস্টিগেশান প্ল্যান, ট্রিটমেন্ট রিভিউ, পুরনো রোগীদের ফলো আপ, ট্রিটমেন্ট এডজাস্ট করা, ছুটি দেয়া, রাউন্ড, ক্লাস, সেমিনার ইত্যাকার নানা কাজ। দম ফেলা মুশকিল।

এরই মধ্যে যখন এক পেশেন্টের এটেন্ড্যান্ট বিরুপ মন্তব্য করে বসলো তখন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন নি। কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন । তারপর থেকে বেচারার নিজেরই মন খারাপ।
আমারও খারাপ লাগলো। ডাঃ বকুল এবং সেই এটেন্ড্যান্ট উভয়ের জন্যই খারাপ লাগলো। কিন্তু আমি কোনভাবেই ডাঃ বকুলকে দোষ দিতে পারলাম না। আমি জানি, ডাঃ বকুল অকারণে মেজাজ খারাপ করার লোক নন। আসলে ডাঃ বকুল এমন এক অমানবিক সিস্টেমের শিকার, যে সিস্টেম তার মত নিরীহ মানুষকেও আজ রুঢ় করেছে। যে সিস্টেম তার যৌবনের সোনালি সময়কে সিস্টেমের মারপ্যাচে ফেলে অপব্যবহার করে যাচ্ছে। এর কিছুটা বিরুপ প্রভাব অন্যদের ওপরও পড়বেই, এখন আর এতে খুব একটা অবাক হই না।

আমি জানি, ডাঃ বকুলকে যদি আলাদাভাবে ক্লিনিক ডিউটি করতে না হত, তাকে যদি পেটের চিন্তায় মগ্ন থাকতে না হত, তার কর্মঘন্টা যদি নির্দিষ্ট থাকতো এবং ওয়েল পেইড হত, তাহলে তিনি কখনোই মেজাজের খেই হারাতেন না।
You haven't given him a sound sleep, how can he give you a good smile??


২।
এই অংশটুকু বিশেষত নন-মেডিকেল পাঠকদের উদ্দেশ্যে। আপনার মনে যে প্রশ্নটি চলে এসেছে তাহলো- ট্রেনিং তো ডাক্তাররা করছেন তার নিজের জন্য, নিজের ডিগ্রীর জন্য। এর জন্য সরকার ভাতা দেবে কেন? এত কথা কেন?

এই প্রশ্ন যদি সত্যিই আপনার মনে এসে থাকে তাহলে সেটা বড়ই আফসোসের কথা। পর্যাপ্ত ডাক্তার নিয়োগ দেয়া এবং ডাক্তারদের ভাতা দিয়ে ভালো করে ট্রেনিং করানোর দাবি আপনাদের পক্ষ থেকেই তোলা উচিত। কারণ, ডাক্তার দক্ষ না হলে এর কুফলটা আপনাকেই ভোগ করতে হবে। সরকারি হাসপাতাল বলেন আর বেসরকারি বলেন, কোথাও পর্যাপ্ত ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়না। ফলে অল্প ক'জন ডাক্তারকে অতিরিক্ত চাপ নিতে হয়। ডাক্তার নাহয় শায়েস্তা হলো, কিন্তু আপনি কি পূর্ণ মনোযোগ পান? না পেলে আপনি কী করেন? ডাক্তারকে গালিগালাজ করেন? নাকি ডাক্তারের নামে অভিযোগ করেন? কখনো কি কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেছেন- এতজন রোগীর জন্য একজন ডাক্তার কেন? কখনো কি দাবি তুলেছেন- এত টাকা বিল দিলাম, ডাক্তারের বেতন এত কম কেন? নাহ। তা করেন নি।
ডাক্তারদের ভালো ট্রেনিং এর ব্যবস্থা আপনাদের নিজেদের স্বার্থেই করতে হবে। বিকজ, দে ডিলস উইথ ইওর লাইফ এন্ড ডেথ। তাদের আপডেটেড নলেজ এন্ড স্কিল না থাকলে দিনশেষে আপনিই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপনার বাবা মা, আপনার সন্তান। হয়তো ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে ভাংচুর করবেন, হয়তো পত্রিকায় নিউজ হবেন। কিন্তু যদি কোন ক্ষতি হয়েই যায়, তা কি ফিরে পাবেন?

ডাক্তারদের পেটের চিন্তা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। বিকজ, দে হ্যাভ টু লিভ দা মোস্ট স্ট্রেসফুল লাইফ। পেট এবং মাথা দুই জায়গায় চাপ নিয়ে ভালো সেবা দেয়া যায় না। আর এ কারণেই উন্নত বিশ্বে ডক্টরস আর অলওয়েজ হাইলি পেইড। আমার দেশে একটা সরকারী হাসপাতালের একটা ওয়ার্ড চালানোর জন্য যতজন ডাক্তার দরকার, আমার সরকার নিয়োগ দিয়েছে তার এক চতুর্থ বা পঞ্চমাংশ। আর সেই জায়গা পুরণের জন্যই জিইয়ে রাখা হচ্ছে এই অমানবিক সিস্টেম। ডিগ্রীর মুলো ঝুলিয়ে বিনেপয়সায় খাটিয়ে শোষণ করা হচ্ছে তরুণ ডাক্তারদের সোনালি সময়। একটা দিনও যদি এই ডাক্তাররা কাজ না করেন, তাহলেই হাসপাতাল অচল হয়ে পড়বে।

আপনি এই সিস্টেমকে সমর্থন করেন? যদি করেন, তাহলে আপনি ভালো ব্যবহার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আপনি যদি এই সিস্টেম পরিবর্তনের দাবি না তোলেন, তাহলে আপনি আন্তরিক চিকিৎসা পাবার আশা করতে পারেন না।

আপনি ঘোড়াকে ক্রমাগত চাবুক মারবেন, সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপাবেন, আর বিনিময়ে সে আপনাকে মুচকি হাসি দিবে, তা হয় না।

সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬

বাঙালির জীবনে ভাত খাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর নাই

১.
- চাচা, বুকে ব্যথাটা কখন থেকে?
- চাচীঃ রাইতের বেলা খাইতে বসছে, গরুর গোশ দিয়া ভাত খাইছে। হের পরে হের বুকত চিলিক মাইরা উঠছে।\

২.
- শ্বাসকষ্টটা কখন শুরু হইছিলো ভাই?
- ভাবীঃ হ্যারে বাজারে পাঠাইছিলাম। বাজার থাইকা আসি দুপুরে খাইতে বসছে। বুঝছেন ভাই! এর ঘন্টা দুই ঘন্টা পরে খানিক শ্বাসকষ্ট শুরু হইছে।


৩.
- চাচাজান, রোগী কখন থেকে অজ্ঞান?
- রুগী পুরাপুরি ভালা আছিলো ছার। কথা কইছে। রাইতে ভাত খাইছে। খাইয়া ঘুমাইছে। তারপরে হঠাৎ দেখি হাত পায়ে খিচ মারতাছে। অজ্ঞান হই গেছে।

 ঘটনা যাহাই হউক, বাঙালির সকল ইতিহাস শুরু হয় 'ভাত খাওয়া'র পর থেকে। যিশুর জন্মের বছর হতে যেমন খ্রিষ্টীয় সাল গণনা শুরু করা হয়, তেমনি রোগীর যেকোন সিম্পটম (রোগ-লক্ষণ) এর বয়স গণনা শুরু হয় 'ভাত খাওয়া'র মুহূর্ত থেকে। বাঙালির জীবনে ভাত খাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর নাই!!!!!!

বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

মিথোজীবিতা

১.
জন্মেছিলাম পরিপূর্ণ এক পরজীবি হয়ে।
তারপর শুরু হলো শৈবালের মত
স্বভোজী হবার নিরন্তর লড়াই।
জীবনচক্রে এখন লেগেছে ভাটির হাওয়া
এতোদিনে বুঝে গেছি
স্বভোজী হওয়াই সুখ নয়। স্বনির্ভরতা মানেই নয়
সাফল্যের চূড়া।
২.
এখন আমি দীক্ষা নিচ্ছি প্রতিদিন
মিথোজীবিতার পাঠ।

সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

কয়েদী কথামালা

না বলতে বলতে-
সব কথা জমে যাচ্ছে বুকের ভেতর।
বেরোবার পথ নেই বলে ওখানেই ওরা
গাইছে, খেলছে, হাসছে, কাঁদছে... আর
বংশবৃদ্ধি করছে ক্রমাগত মিয়োসিস প্রক্রিয়ায়!

না বলতে বলতে-
বুকের ভেতর জমে যাচ্ছে কথার পাহাড়।
দিনকে দিন তেতে উঠছে কয়েদী কথামালা,
শীঘ্রই মুক্তি না দিলে
একদিন তারা সব বিদ্রোহী হবে!
একদিন তারা হবে
জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি ! কিশোর তরুণেরা সব 
হয়ে যাবে বোমাবাজ সন্ত্রাসী ।


পাঁজরের সব হাড় চূর্ণ করে
একদিন তারা হবে মুক্ত স্বাধীন;
একদিন তারা সব
পাখা মেলে উড়ে যাবে - শুন্য হাওয়ায়।

রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

রিফিল

এই শীতে কোনো এক উদাসী বিকেলে
আমি আবার হেঁটে যাবো
সরষে ক্ষেতের আল ধরে দিগন্তের দিকে।
দখিন হাওয়ায় উড়িয়ে দেবো পুরনো রুমাল
যত দুঃখ যত অবসাদ
ছড়িয়ে দেবো আমি সরিষার ক্ষেতে,
হলুদ মাঠের ভেতর।
তারপর-
পড়ন্ত সূর্যের স্বর্ণাভ আভা
আর সরষে ফুলের হলুদাভ রঙ গায়ে মেখে
আবার রাঙ্গিয়ে নেবো-
জীর্ণ হৃদয়।

বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬

দেয়াল

আজীবন ডুবসাঁতার কাটবো বলে
জন্মলগ্ন হতে হাত পা ছুঁড়ছি অবিরাম।
শিখছি সাঁতারের যতসব অদ্ভুত কৌশল,
আর
ক্রমাগত ভেদ করছি জলের সীমানা।
জলপথের এই দীর্ঘ যাত্রায়
আজো কোন ডুবোচরে আটকেনি হৃদয় আমার।
গহীন জলের হাজারো মরিচীকা
আর জলজ লতার হাতছানি পায়ে ঠেলে
তীরে এসে মুখোমুখি হয়েছি এক
দুর্লঙ্ঘ্য দেয়ালের।
কী করে পেরোব বলো বাধার পাহাড়?
আমি দক্ষ এক সাঁতারু বটে -
পর্বতারোহী তো নই!!