আমাদের দেশের মানুষের একটা ধারণা জন্মেছে যে ‘ফ্রি হেলথ ক্যাম্প’ একটা খুবই উত্তম ও মহৎ কাজ ।ডাক্তারদের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে । অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে- মনে হয় যেন স্বাস্থ্যসেবা সবারই ফ্রি পাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু পাচ্ছে না, আর এর দায় দায়িত্ব ডাক্তারদের ! মাঝে মাঝে ফ্রি হেলথ ক্যাম্প করে ডাক্তারদের সেই দায় মেটাতে হবে !
আমি যত্রতত্র সবার জন্য উন্মুক্ত ফ্রি হেলথ ক্যাম্পের পক্ষে নই । প্রথম কথা হচ্ছে, ফ্রি হেলথ ক্যাম্প থেকে কী সেবা দেয়া হয়? কাকে দেয়া হয় ? ফ্রি ক্যাম্পে মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে । আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা থাকে ‘গা ম্যাজ ম্যাজ করে, খাবার রুচি নাই, গ্যাসের সমস্যা (বাংলাদেশের মানুষের পেট যেন গ্যাসের খনি) । এর মধ্যে অল্পকিছু মানুষের প্রকৃত সমস্যা থাকে এবং তাদেরকে পরামর্শ দেয়া যায় । বাকি সময় ও শ্রমটা হয় আসলে ‘ভুতের বেগার খাটা’ ।
স্বাস্থ্যসেবা ফ্রি হবে নাকি নিয়ন্ত্রিত ব্যয়ের খাত হিসেবে থাকবে সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব সরকারের ।স্বাস্থ্যখাতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হওয়া উচিৎ সরকারকে পরামর্শ , প্রস্তাবনা ও সহযোগিতা দেয়া । ফ্রি ফ্রি রব তোলাটা যৌক্তিক নয় । আমরা হলাম আলকাতরা জাতি । ফ্রি পেলে আলকাতরাও খাই । এই ব্যাপারটা চিন্তায় রাখা দরকার । একদিন দুদিনের ফ্রি হেলথ ক্যাম্প থেকে দেশের দরিদ্র মানুষের কতটুকু উপকার হয় ? বারোমাসই তো তাদের হুড়হাঙ্গামা করে আউটডোর থেকে সীমিত সাপ্লাইয়ের অষুধে জীবন কাটাতে হয়। এমন অভিযোগও আছে, সরকারী হাসপাতালের ফ্রি ঔষধ মিথ্যা অসুখ দেখিয়ে নিয়ে যায় মানুষ । তারপর সেগুলো গুড়ো করে মুরগীকে খাওয়ানো হয় !
তাই ফ্রি হেলথ ক্যাম্প নয়, দেশের মানুষের জন্য দরকার ‘হেলথ এডুকেশান’ । মানুষকে স্বাস্থ্যসমস্যা, স্বাস্যসেবার নানান দিক সম্পর্কে জানানো দরকার । কী সমস্যা হলে তারা ডাক্তারের কাছে যাবে, ডাক্তারদের কোথায় কখন পাওয়া যাবে, অষুধ কীভাবে খেতে হবে, অন্তত এইসব ছোটখাটো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার ।
এখনো মানুষ বিশ্বাস করে হেকিমী চিকিৎসায় হেপাটাইটিস ভালো হয় ! ক্যান্সার ভালো হয় ! এইসব ট্যাবু ভাংতে না পারলে দুএকদিন ফ্রি চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদে কোন সুফল বয়ে আনবে না ।
স্বাস্থ্যখাতে দালাল ব্যবসা চরম ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে । মানুষ ডাক্তারের ফি ১০০/২০০/৫০০ টাকা দিতে চায় না, কিন্তু দালালকে ঠিকই হাজারে হাজারে টাকা দিয়ে দিচ্ছে । দালালের হাত ধরে রোগী যাচ্ছে কোন একটা ক্লিনিকে, সেখানে ডাক্তার রোগীকে শারিরীক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ৩০০-৫০০ টাকা , আর অশিক্ষিত দালাল ক্লিনিকের মালিকের কাছ থেকে নিচ্ছে ২০০০ টাকা । এরপর সেই ডাক্তারের নাম ভাঙ্গিয়ে এইসেই বলে ক্লিনিকের ব্যবসায়ী মালিক-ম্যানেজার বিল ধরাচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা । ডাক্তার তাঁর মেধা ও শ্রম দিয়ে পেলেন ৩০০ টাকা, আর দালাল ও ক্লিনিক ব্যবসায়ী লুটে নিল সাড়ে চার হাজার টাকা । রোগী জানলেন সব টাকা ডাক্তার নিয়েছে !
সরকারী হাসপাতালের অলিতে গলিতে দালাল । লিফট ম্যান দালাল, ওয়ার্ড বয় দালাল, দারোয়ান দালাল, হাসপাতাল চত্বরের রিক্সাওয়ালা দালাল । সরকারী হাসপাতালের বদনাম করে হেনতেন বুঝিয়ে রোগীদের নিয়ে যাচ্ছে নামকাওয়াস্তে ক্লিনিকে । পেয়ে যাচ্ছে তার দালালি ফি- হাজার টাকা ।
এখনো মানুষের কাছ থেকে সরকারী হাসপাতালে ‘সিট’ ম্যানেজ করে দেবার কথা বলে টাকা নেয় হাসপাতালের ভেতরের দালালরা। মানুষ সচেতন নয় মোটেও । তারা ওয়ার্ডবয়কে টাকা দেয় ঠিকই, তারপর বলে- 'ডাক্তাররা কত খারাপ, সিট দেয় না !!'
একদিন ফ্রি চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দরকার মানুষকে সচেতন করা । স্বাস্থ্য সচেতনতা, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিস্তার জরুরী । একদিন নয়, প্রতিদিন মানুষ পাক তার প্রাপ্য যথার্থ চিকিৎসা । যারা একেবারে নিঃস্ব, শুধুমাত্র তাদেরকেই খুঁজে বের করে ফ্রি চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে।