এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪

সবই আসলে আপাতদৃষ্টিতে

আমরা যা কিছু করি যা কিছু দেখি সবই আসলে আপাতদৃষ্টিতে । একদিন যেটাকে ঠিক মনে করে জানপ্রাণ দিয়ে দেই , সময় গেলে হয়তো মনে হয় 'এতবড় ভুল আমি কীভাবে করলাম ?' 
মারাত্মক ভুল ভেবে যা থেকে দূরে থেকেছি, সময় গেলে মনে হয়- 'ইস্ ! ঐ কাজটাই তো করা উচিত্‍ ছিল ! কেন যে করলাম না !' 
দিনশেষে এইসব আফসোস কখনো কখনো 'কষ্ট' নামে অভিহিত হয় । অথবা কষ্ট পেলে আফসোস আসে । 'ইস ! ঐ ব্যাপারটা যদি এভাবে না হয়ে ওভাবে হত?' 
তারপর আরো সময় গেলে মনে হয়, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে । ঐ ঠুনকো বিষয়ে তখন এতটা কষ্ট পাওয়া মোটেই উচিত্‍ হয়নি । ব্যাপারটা, এতটা কষ্ট পাওয়ার মত কিছুতো ছিলনা ! 

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

বিরাট ডাঃ SACMO !

একটা প্রেস্ক্রিপশন হস্তগত হয়েছিল কয়েকদিন আগে । তথাকথিত চিকিৎসকের (!) নামের সামনে লাল কালিতে 'ডাঃ' লেখা । নামের নিচে বড় করে লেখা- মেডিকেল অফিসার । আর খুব ছোট করে পাশে লেখা উপঃ সহঃ । তারপর আবার লালকালিতে বড় করে লেখা -অভিজ্ঞ চিকিৎসক, হাড় ভাঙ্গা রোগ !!
সহজ ভাষায় এরা হলেন- SACMO. ডাক্তারকে সহযোগিতা করার জন্য যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা এখন নিজেরাই বিরাট ডাক্তার সেজে বসেছে । একেবারে 'অভিজ্ঞ চিকিৎসক !!!' অপারেশন থিয়েটারে দুইচারদিন ঘোরাফেরা করে অভিজ্ঞ সার্জন !!
দুই চারটা ওষুধের বাজারী নাম জানাকেই এরা ডাক্তারি মনে করে । হায় মেডিকেল সায়েন্স ! ডাক্তারদের শতশত বছরের সাধনার ফসলকে এরা এভাবেই অবমূল্যায়ন করে চলেছে । আর মানুষকে সামান্য ব্যাথার জন্য Tab. Rolac 2+2+2+2 খাইয়ে চিকিৎসার নামে মানুষের শরীরের বারোটা বাজাচ্ছে ।
বিএমডিসি রুলস অনুযায়ী এদের 'ডাঃ' লেখাটা অপরাধ । তার ওপর অভিজ্ঞ চিকিৎসক সেজে এরা মানুষের সাথে প্রতারণা করেই যাচ্ছে । এই প্রতারকদের প্রতিহত করা জরুরী । 

রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

আহা কেউ যদি মশারিটা টাঙিয়ে দিত !!

আহা কেউ যদি মশারিটা টাঙিয়ে দিত !!
আলোচ্য বাক্যাংশটুকু মশার কামড়ে অতিষ্ঠ অলস ছেলেদের স্বগতোক্তি হইতে চয়ন করা হইয়াছে । ইহা ব্যাচেলর ছেলেদিগের বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশের একটি মার্জিত রুপ ।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই কথাটার মাধ্যমে কী ধরণের মানসিকতা প্রকাশ পায় ?
ঠাট্টাচ্ছলে বলা হলেও এই কথাটা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি । এর একটা ঐতিহাসিক পটভূমি আছে । হাজার বছর ধরে উপন্যাসে চিরায়ত বাংলার একটা চিত্র আছে । তিরিশ চল্লিশ বছর আগেও বাংলাদেশের গরীব, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারে স্ত্রীদের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল স্বামীর পা টিপে দেয়া । স্বামী মানে স্বামীই, সংসারের সত্যিকার রাজা । তাঁর একমাত্র কাজ উপার্জন করা আর সংসারের খরচ জোগানো । আর স্ত্রীর কাজ স্বামীর সেবা করা । মশারি টাঙানো সেখানে আরেকটি রুটিন কাজ মাত্র ।
এমন অনেক পুরুষ তাদের জীবন পার করে দিয়েছেন, জীবনে একদিনও মশারি টাঙান নি ।
আহা, কেউ যদি মশারিটা টাঙিয়ে দিত ! পুরুষের মনে এই ভাবনাটা সেই চিরাচরিত স্বামীসুলভ চেতনা থেকে উঠে আসে ।
[এটা হয়তো ক্ষতিকর কিছু নয় । তবে এই চিন্তাটার অর্থ যদি এই হয় যে পুরুষ তার সংসারে কোন সাংসারিক কাজই করবেন না, সব কাজ সবসময় স্ত্রীকেই করতে হবে সেটাকে নিশ্চয়ই ঠিক বলা চলে না । একদিন দুদিন মশারি টাঙালে নিশ্চয়ই পুরুষের মান ইজ্জত চলে যায়না !!]

বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৪

মহামানব !

লৌকিকতার বেদীমূলে প্রচন্ড কুঠারাঘাত করে  
আসছে মাঘের ভরা পুর্ণিমায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো আমি 
লোহালক্কড় কাঁধে নিয়ে এখন ছুটছি কামারের সন্ধানে-  
লম্বা হাতলওয়ালা একটা শক্তপোক্ত কুঠার 
বানিয়ে নিতে হবে শিগগির । 

তারপর, তোমাদের এইসব তথাকথিত সামাজিকতার পচনোন্মুখ শিকড়ে প্রচন্ড কুঠারাঘাত করে 
আসছে মাঘের ভরা পূর্ণিমায় হয়তো চলে যাবো আমি 
অনন্ত আহ্বানে । 
কেঁদেকেটে আটকাতে পারবেনা কেউ । 
কারণ, কারো অশ্রুর পরোয়া করা- মহামানবের পক্ষে 
শোভনীয় নয় । 

রবিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪

জীবন সংজ্ঞার সন্ধানে

আমার ঔদাসীন্য নিয়ে বড্ড শংকিত তোমরা? আচ্ছা,  
বলতে পারো- জীবন ও জগত্‍ নিয়ে কতটা উদাসীন হলে পরে তাকে  
বৈরাগ বলা যায় ?  
বলতে পারো- অর্থ, খ্যাতি ও নারীর লালসায়  
কতটা ব্যস্তসমস্ত হলে একজন মানুষকে  
বলা চলে দুনিয়াপুজারী ? 
কোন্‌ এককে, কোন্‌ তুলাদন্ডে মাপা চলে আমাদের মানবিক স্বত্ত্বা ?
বলো, জীবনের স্বার্থকতা কি মোটা মানিব্যাগে? 
তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট, ঝকঝকে টাইলসে মোড়া প্রশস্ত বেডরুম ? 
পিতৃদত্ত নামের সামনে পেছনে কয়েকটি প্রচলিত পদবী- 
এই কি সাফল্যের মাপকাঠি তোমাদের অভিধানে? 
এইখানে বড্ড গোলমেলে ঠেকছে জীবনের প্রতিশব্দ । 
চললাম আমি । সাফল্য সুখ ও জীবনের- 
প্রকৃত সংজ্ঞার সন্ধানে ।
 

শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

গন্তব্য

পৃথিবীর পথগুলো বড় আঁকাবাঁকা ।  
যতটুকু আছে সরলরেখার মত , সেখানেও রাশ টেনে রাখে  
মানবীয় দৃষ্টির সীমা । চর্মচক্ষে তাই  
তাকানো যায় না বেশিদূর । 
.
তবু পা বাড়াই । তবু হেঁটে চলি অবিরাম । তবু চালিয়ে যাই জোরসে কদম, 
মনে রেখে ক্ষীণ আশা - 
যদি কোনদিন কোন এক পথের বাঁকে  
অথবা ক্ষীণাঙ্গি কোন এক নিস্তরঙ্গ নদীর কিনারে  
যদি কাশফুলের ভেতর হঠাৎ কোথাও  
গন্তব্যের দেখা মেলে !  
তখনো কি থামতে পারবো ? নাকি আবার ছুটতে হবে  
নতুন কোন গন্তব্যের সন্ধানে ? 

মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

বিকল্প

কলম ও কবিতার গলা টিপে ধরেছে বেরহম সময় !  
কাজ, ব্যস্ততা, বাস্তবতা, জীবন সংগ্রাম । এইসব অনাকাঙ্খিত শব্দের ঘেরাটোপে  
হাঁসফাঁস করছে কোমলমতি অনুভূতিরা। আফসোস ! কঙ্কাবতীর ডাকে এখন আর  
আকাশে ওড়েনা কোন পঙ্খিরাজ ! ডালিম কুমারও এখন খুব খুব ব্যস্ত ! তবে কি-  
সোনার কাঠি রুপোর কাঠি অযতনে পড়ে রবে অতল দীঘিতে ? অচেতন অনুভূতিগুলো  
বন্দী থেকে যাবে নিষ্ঠুর রাক্ষসের বুকের খাঁচায় ? ভোমরার প্রাণসংহার ছাড়া  
আর কোন বিকল্পই কি নেই ?  
 

আমি যেন রই মানবিক

কেউ না ডাকুক আমি যেন 
একলা একাই ফিরে আসি  
কেউ না বলুক আমি যেন 
একাই বলি 'ভালোবাসি' । 
সভ্যতা ও যুগের হাওয়া  
যাক চলে যাক যেমন যেদিক  
ভালো মন্দ সকল সময়  
আমি যেন রই মানবিক । 

সময় বড় বেরহম হয় !

যখন শরীর ভেঙ্গে আসে নিদারুন নিদ্রায়  
জীবনযুদ্ধে ব্যর্থ অথবা ক্লান্ত এক বৃদ্ধপুরুষ 
কিংবা হাল ভাঙ্গা নাবিকের মত হাল ছেড়ে রাত্রির হাতে  
গোড়াকাটা কলাগাছের মত ভেঙ্গে পড়ি 
অগোছালো শয্যায় । 
এক বুক আশা নিয়ে সার বেধে তবু আসে সাদাকালো স্বপ্নেরা 
উৎকট সজ্জার দেহপসারিনীর মত-  
ঘুমন্ত চোখের সামনে রাতভর উদ্দাম ক্যাটওয়াক সেরে রাত শেষে ওরা  
বিফল মনোরথে ফিরে যায়  
যার যার আস্তানায় ।  
আহা ! পুওর ড্রিমস ! রঙবেরঙের নর্তনকুর্দন করেও এখন আর  
এতটুকু মনস্তাপ জাগাতে পারেনা আমার কর্নিয়ায় !  
কেন, কেন এমন হলো ?  
কী এমন পরিবর্তন এসেছে আমার ভেতর ? জিজ্ঞেস করলে  
একটাই সান্তনা দিতে পারি আমি- 
'সময় বড় বেরহম হয় !' সময় ! হা সময় !  

সোমবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

কত গাধা পিটিয়ে মানুষ করলাম !

কত গাধা পিটিয়ে মানুষ করলাম !! এইটা ছিল পুরনো আমলের স্যারদের কথা । আর সামনের দিনে যা শুনতে হবে তা হলো- 'কত গাধা পিটিয়ে ডাক্তার বানালাম !'
হ্যা । সেদিন হয়তো আর বেশিদূরে নয় । বেসরকারি মেডিকেল এসোসিয়েশন দাবি করেছে, ভর্তি পরীক্ষায় ২০ নম্বর পেলেই যেন তাকে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় । তারা মনে করে ডাক্তার বানানোর জন্য ভর্তি পরীক্ষায় এর বেশি পাওয়ার দরকার নেই । যারা ভর্তি পরীক্ষায় ১০০র মধ্যে ২০ নম্বর পেয়েছে তাদেরকে তারা যোগ্য দক্ষ ডাক্তার বানাতে সক্ষম ! মারহাবা মারহাবা ! গত বছর তো ১০ মার্ক পাওয়াদেরও ভর্তি করেছে । মারহাবা ! কিছুদিন পর হয়তো তারা আর্টস কমার্সের স্টুডেন্টদেরও ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখবে !!!
ভালো তো, ভালো না ?
[স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবার নির্ধারণ করেছে, ভর্তি পরীক্ষায় সর্বনিম্ন 40 পেলে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি হতে পারবে । আমি মনে করি কমপক্ষে ৫০ হওয়া উচিত্‍ ।]

শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

আমাদের রোগীর কী অবস্থা?

-'স্যার/ডক্টর, আমাদের রোগীর কী অবস্থা? কোন উন্নতি কি বুঝতে পারছেন?'
একজন ডাক্তারের জীবনে সবচেয়ে বেশিবার শোনা প্রশ্ন । অত্যন্ত কঠিন হলেও এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা ডাক্তারের দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব ডাক্তাররা পালন করে চলেছেন প্রতিনিয়ত । কিন্তু কখনো কখনো এই প্রশ্নটাই ডাক্তারের কাছে চরম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
অসুস্থ মানুষ এবং তাঁর নিকটাত্মীয়রাই বোঝেন তাদের কতটা অসহায় লাগে । একটা ভালো সংবাদ, একটু আশার বাণীই এইসময় অনেক অনেক কিছু । তৃষ্ণার্ত চাতকের মত সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে একটু ভালো ইঙ্গিতের । প্রিয়জনের আরো বেশি ক্ষতির আশঙ্কায় সবসময় বুক ধুকপুক করে । বারবার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে -স্যার, এখন কী অবস্থা ?
দীর্ঘদিন এইসব অবস্থাকে মোকাবেলা করে থাকতে থাকতে ডাক্তারের অনুভূতি নিশ্চয়ই রোগীর স্বজনের মত তীব্র থাকেনা । খুব স্বাভাবিক । তবুও বেশিরভাগ ডাক্তারই রোগীর ব্যাপারে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল থাকেন । কিন্তু যখন একজন রোগীর জন্য একের পর এক ভিন্ন ভিন্ন লোক এসে জিজ্ঞেস করে- ডক্টর , আমি রোগীর কাজিন । কী অবস্থা এখন ? ডক্টর , আমি রোগীর ভাবী, কী অবস্থা এখন ? স্যার , আমি রোগীর পাড়াতো ভাই, কী অবস্থা এখন ? তখন ডাক্তারের ভালো লাগেনা, তিনি বিরক্ত হন । হওয়াটাই স্বাভাবিক । যেকোন লোকই বিরক্ত হবে । তাছাড়া এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটাই ডাক্তারের একমাত্র কাজ নয় । তার আরো অনেক কাজ থাকে । তার আরো অনেক রোগী থাকে । তার নিজের পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব আছে । তার অন্য অনেক কাজ আছে ।
অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়া, সাহায্য সহযোগিতা করা সওয়াবের কাজ । মানবিকও । কিন্তু তাই বলে বিনাকারণে যখন তখন রোগীর আশেপাশে ভীড় করা, নির্ধারিত সময়ের বাইরে দেখতে যাওয়া, একই প্রশ্ন ডাক্তারকে বিভিন্নজন বারবার জিজ্ঞেস করা মোটেও ঠিক নয় ।

বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

ফ্রি হেলথ ক্যাম্পের যৌক্তিকতা কী ?

আমাদের দেশের মানুষের একটা ধারণা জন্মেছে যে ‘ফ্রি হেলথ ক্যাম্প’ একটা খুবই উত্তম ও মহৎ কাজ ।ডাক্তারদের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে । অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে- মনে হয় যেন স্বাস্থ্যসেবা সবারই ফ্রি পাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু পাচ্ছে না, আর এর দায় দায়িত্ব ডাক্তারদের ! মাঝে মাঝে ফ্রি হেলথ ক্যাম্প করে ডাক্তারদের সেই দায় মেটাতে হবে !
আমি যত্রতত্র সবার জন্য উন্মুক্ত ফ্রি হেলথ ক্যাম্পের পক্ষে নই । প্রথম কথা হচ্ছে, ফ্রি হেলথ ক্যাম্প থেকে কী সেবা দেয়া হয়? কাকে দেয়া হয় ? ফ্রি ক্যাম্পে মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে । আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা থাকে ‘গা ম্যাজ ম্যাজ করে, খাবার রুচি নাই, গ্যাসের সমস্যা (বাংলাদেশের মানুষের পেট যেন গ্যাসের খনি) । এর মধ্যে অল্পকিছু মানুষের প্রকৃত সমস্যা থাকে এবং তাদেরকে পরামর্শ দেয়া যায় । বাকি সময় ও শ্রমটা হয় আসলে ‘ভুতের বেগার খাটা’ ।
স্বাস্থ্যসেবা ফ্রি হবে নাকি নিয়ন্ত্রিত ব্যয়ের খাত হিসেবে থাকবে সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব সরকারের ।স্বাস্থ্যখাতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হওয়া উচিৎ সরকারকে পরামর্শ , প্রস্তাবনা ও সহযোগিতা দেয়া । ফ্রি ফ্রি রব তোলাটা যৌক্তিক নয় । আমরা হলাম আলকাতরা জাতি । ফ্রি পেলে আলকাতরাও খাই । এই ব্যাপারটা চিন্তায় রাখা দরকার । একদিন দুদিনের ফ্রি হেলথ ক্যাম্প থেকে দেশের দরিদ্র মানুষের কতটুকু উপকার হয় ? বারোমাসই তো তাদের হুড়হাঙ্গামা করে আউটডোর থেকে সীমিত সাপ্লাইয়ের অষুধে জীবন কাটাতে হয়। এমন অভিযোগও আছে, সরকারী হাসপাতালের ফ্রি ঔষধ মিথ্যা অসুখ দেখিয়ে নিয়ে যায় মানুষ । তারপর সেগুলো গুড়ো করে মুরগীকে খাওয়ানো হয় !
তাই ফ্রি হেলথ ক্যাম্প নয়, দেশের মানুষের জন্য দরকার ‘হেলথ এডুকেশান’ । মানুষকে স্বাস্থ্যসমস্যা, স্বাস্যসেবার নানান দিক সম্পর্কে জানানো দরকার । কী সমস্যা হলে তারা ডাক্তারের কাছে যাবে, ডাক্তারদের কোথায় কখন পাওয়া যাবে, অষুধ কীভাবে খেতে হবে, অন্তত এইসব ছোটখাটো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার ।
এখনো মানুষ বিশ্বাস করে হেকিমী চিকিৎসায় হেপাটাইটিস ভালো হয় ! ক্যান্সার ভালো হয় ! এইসব ট্যাবু ভাংতে না পারলে দুএকদিন ফ্রি চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদে কোন সুফল বয়ে আনবে না ।
স্বাস্থ্যখাতে দালাল ব্যবসা চরম ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে । মানুষ ডাক্তারের ফি ১০০/২০০/৫০০ টাকা দিতে চায় না, কিন্তু দালালকে ঠিকই হাজারে হাজারে টাকা দিয়ে দিচ্ছে । দালালের হাত ধরে রোগী যাচ্ছে কোন একটা ক্লিনিকে, সেখানে ডাক্তার রোগীকে শারিরীক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ৩০০-৫০০ টাকা , আর অশিক্ষিত দালাল ক্লিনিকের মালিকের কাছ থেকে নিচ্ছে ২০০০ টাকা । এরপর সেই ডাক্তারের নাম ভাঙ্গিয়ে এইসেই বলে ক্লিনিকের ব্যবসায়ী মালিক-ম্যানেজার বিল ধরাচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা । ডাক্তার তাঁর মেধা ও শ্রম দিয়ে পেলেন ৩০০ টাকা, আর দালাল ও ক্লিনিক ব্যবসায়ী লুটে নিল সাড়ে চার হাজার টাকা । রোগী জানলেন সব টাকা ডাক্তার নিয়েছে !
সরকারী হাসপাতালের অলিতে গলিতে দালাল । লিফট ম্যান দালাল, ওয়ার্ড বয় দালাল, দারোয়ান দালাল, হাসপাতাল চত্বরের রিক্সাওয়ালা দালাল । সরকারী হাসপাতালের বদনাম করে হেনতেন বুঝিয়ে রোগীদের নিয়ে যাচ্ছে নামকাওয়াস্তে ক্লিনিকে । পেয়ে যাচ্ছে তার দালালি ফি- হাজার টাকা ।
এখনো মানুষের কাছ থেকে সরকারী হাসপাতালে ‘সিট’ ম্যানেজ করে দেবার কথা বলে টাকা নেয় হাসপাতালের ভেতরের দালালরা। মানুষ সচেতন নয় মোটেও । তারা ওয়ার্ডবয়কে টাকা দেয় ঠিকই, তারপর বলে- 'ডাক্তাররা কত খারাপ, সিট দেয় না !!'
একদিন ফ্রি চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দরকার মানুষকে সচেতন করা । স্বাস্থ্য সচেতনতা, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিস্তার জরুরী । একদিন নয়, প্রতিদিন মানুষ পাক তার প্রাপ্য যথার্থ চিকিৎসা । যারা একেবারে নিঃস্ব, শুধুমাত্র তাদেরকেই খুঁজে বের করে ফ্রি চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে।

ইংলিশ মিডিয়াম ও মাদক

মাঝে মাঝে একটা সাইকিয়াট্রি ক্লিনিকে ডিউটি করতে যেতাম । অনেক রোগীই আসে । তাদের জীবনের কাহিনী নানান রকম । সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভর্তি থাকেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভর্তি থাকেন, অলী আউলিয়া থাকেন, WHO প্রধান থাকেন, জাতিসংঘের মহাসচিব থাকেন । তারা সবাই বিভিন্ন মানসিক রোগে ভুগছেন ।
মানসিক রোগের বাইরে থাকে মাদকাসক্ত রোগীরা । বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার মানুষ বিভিন্ন রকম নেশায় আসক্ত । তাদের জীবন একপ্রকার ধ্বংস হয়ে গেছে । তারা হয়ে উঠেছে পরিবারের দুঃখ ।
সব মাদকাসক্তদের নিয়ে আজ বলতে চাইছি না, বলতে চাইছি এদের একটা অংশের কথা- যাদের বয়স ২০ এর নিচে । এরা স্কুল কিংবা কলেজের ছাত্র-ছাত্রী । এই বয়সেই তারা শিকার হয়েছে মাদকের মরণ ছোবলের ।
এদের সংখ্যা বলে দেয়- মাদকের থাবা ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকার অনেক স্কুলে-কলেজে । গাজা আসক্ত আছে অনেকেই, তবে ইয়াবাই সবচেয়ে বেশি । এই দুটোই এখন কিশোর-তরুণদের প্রধান নেশা । আর বলাবাহুল্য- যারা নেশা করে, সিগারেট তাদের সবার জন্য কমন আছেই ।
আরো স্পেসিফিক করে বললে বলতে হয়, এই মাদকাসক্ত ছেলে-মেয়েদের প্রধান অংশটা আসে ইংলিশ মিডিয়াম থেকে । এ লেভেল, ও লেভেলের স্টুডেন্ট । ইংলিশ মিডিয়ামে বাচ্চাকে পড়ানো- এখন একটা স্টাটাসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের কাছে । সকাল বেলা স্কুলে দিয়ে আসে, আর বিকাল বেলা নিয়ে যায় । ছেলে বড় হয়ে গেলে অথবা বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত হলে দায়দায়িত্ব ড্রাইভারের কাঁধে । টাকাপয়সা দেয়া হয় চাহিদামত । ব্যস, খুলে যায় মাদকের দরজা । ড্যাসিং সিনিয়র ভাই কিংবা বন্ধুর পাল্লায় পড়ে একদিন দুদিন শখের বশে সুখটান দিতে দিতে একসময় তারা পুরোপুরি ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যাচ্ছে ড্রাগে । ফেরার সুযোগ নেই ।
[ইংলিশ মিডিয়াম মূল সমস্যা না – বরং সবকিছু ইংলিশ মিডিয়ামে হওয়া দরকার । কারণ, উচ্চশিক্ষার সব কিছুই রয়ে গেছে ইংরেজী মাধ্যমে । সেক্ষেত্রে শুধু শুধু একটা পর্যায় পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়িয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটা বাধা তৈরি করে দেয়া হচ্ছে । সমস্যা হচ্ছে সিলেবাসে । প্রতিষ্ঠানের পরিবেশে । ইংলিশ মিডিয়ামের কারিকুলাম কী ? সেখানে কতটুকু ধর্ম-মানবিকতার শিক্ষা থাকছে ? দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকছে কতটুকু ? আচার ব্যবহার শিক্ষার কিছু থাকছে কি ? ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলের পরিবেশ কেমন ? সেটা কী শিক্ষা দিচ্ছে ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরী]
অন্ধভাবে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া খুবই দরকার । ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট পেলে আমি একটু বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করি । দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা না জানতে পারছে ভালো বাংলা, না ভালো ইংরেজী। না দেশের কথা, না দশের কথা । মাঝখান থেকে কেউ কেউ হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত । নষ্ট হচ্ছে মেধা, মনন, ভবিষ্যত ।