এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০১৩

১৭ই রমজানের শিক্ষা

১৭ই রমজানের ইতিহাস আমার জীবনে এক বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল ।
আমি বাস্তববাদী মানুষ , তবু কল্পনায় ভেসে ওঠে একটা কাফেলা । এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত শপথ নিয়ে – মোকাবেলা করতে হবে একটা পিশাচ বাহিনীর । যারা এগিয়ে আসছে আল্লাহর দেয়া বিধানের অনুসারী কয়েকশ মানুষকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে । ‘মদীনা’ নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে চিরতরে বিলুপ্ত করতে ।

তিনশ জনের কাফেলার সবাই অনাহারে আছেন । এখন রমজান মাস । এইতো এ বছরেই সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নির্দেশ এসেছে- রমজান মাসে সুবহে সাদিক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে হবে অনাহারে । শুধু খাদ্য নয়- যেকোন রকম ভোগ-আরাম থেকে সংযমী হতে হবে । আল্লাহর মনোনীত দূত যেভাবে বলেন – সেভাবে জীবন পুনর্গঠন করতে হবে ।

কাফেলা এগিয়ে চলেছে সামনে । মাঝে মাঝে শব্দ আসছে- ‘আল্লাহু আকবার’ । কাফেলার নেতা এমন একজন মানুষ- যিনি মানবজাতির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত অনন্য একজন । নাম – মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (সাঃ) ।

বিকেল হয়ে আসছে । সুর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে । আর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই অনাহারের সমাপ্তি হবে । ইফতার করা যাবে । আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দার এই কষ্টের প্রতিদান নিজে দেবেন । যত ইচ্ছা দেবেন । আলহামদুলিল্লাহ । ১৭ তম সাওম আজ শেষ হয়ে যাবে ।

#বদর নামক স্থানে এসে পৌছেছে কাফেলা । সিদ্ধান্ত হয়েছে এখানেই তাঁবু খাটানো হবে । পানির উৎস পাওয়া গেছে । সেটাকে দখলে রাখতে হবে । মক্কা থেকে কুরাইশ-কাফিরদের উদ্ধত বাহিনী এই স্থান থেকে আর বেশি দূরে নাই । হয়তো কাল এখানেই যুদ্ধ হবে । চূড়ান্ত হবে- পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান মানার মত কেউ থাকবে নাকি থাকবে না , মদীনা নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি থাকবে কি থাকবে না ।

হঠাৎ কানাকানি শুরু হলো । অধিনায়ক, সৃষ্টিকর্তার মনোনীত পুরুষ, রাসুল (সাঃ) বলেছেন রোযা ভেঙ্গে ফেলতে হবে । কেন ? আর তো সময় বেশি নেই । এইসময় #রোযা ভাঙ্গার কী দরকার ? কারো বুঝে আসে না । অনেকেই ইতস্তত করতে লাগলেন ।

অধিনায়ক এবার নিজেই বললেন- আমাকে খেজুর দাও । তিনি খেজুর খেলেন । সঙ্গীরা বাধ্য হয়ে রোযা ভাংলেন । এই ব্যক্তির অনুসরণ করাটাই তো তাঁদের জীবনের পরম পাওয়া ।

আল্লাহু আকবার ।

এমনিভাবে আরো একবার রোযা ভাঙ্গা হয়েছিল ৮ম হিজরিতে । মক্কা অভিযানের সময় ।

আল্লাহ তায়ালা বলেন -

﴿يُرِيدُونَ أَن يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَن يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ﴾
৩২) তারা চায় তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে ৷ কিন্তু আল্লাহ তার আলোকে পূর্ণতা দান না করে ক্ষান্ত হবেন না, তা কাফেরদের কাছে যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন ৷ (সুরা- তাওবা)
.

পৃথিবীর সুচনালগ্ন থেকে আজও সারাবিশ্বে তাগুত শক্তি চায় যেকোন মূল্যে আল্লাহ্‌র দ্বীনের বিজয় ঠেকাতে, মানুষকে আল্লাহ্‌র দ্বীনের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে । এই মুহুর্তে বাংলাদেশ এবং মিশরে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে তাগুতি শক্তি । তারাই আবার বলে- রমজান মাসে প্রতিবাদ করলে নাকি রমজানের পবিত্রতা নষ্ট হয় ! বলি রমজান মাসে গুলি করে মানুষ হত্যা করছো কেন ? রমজান মাসে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে জেলে আটকে নির্যাতন করছো কেন ? কত পরিবারকে ঈদের দিন কাঁদতে হবে জাননা ?

#রমজান মাস শুধু সেহরী আর ইফতারের জন্য নয় । দীর্ঘ সময়ের নামাজ, উপবাস এই সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনের জন্য #ট্রেনিং । তাগুতের বিরুদ্ধে লড়াই করার ট্রেনিং । রমজান মাস তাগুত শক্তির পরাজয়ের মাস । রমজানের শিক্ষা বদর যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার #শিক্ষা । রমজানের শিক্ষা মক্কা বিজয়ের শিক্ষা । যদি আমরা রোযার ট্রেনিং ধারণ করে মাঠে নেমে যাই , দ্বিতীয় হিজরীর মত, অষ্টম হিজরীর মত আবু জেহেল ও তার বংশধররা আজও পরাজিত হবেই হবে ইনশাআল্লাহ ।


৩০-০৭-২০১৩ 

বিপ্লবীর রুপান্তর

বিপ্লবের নেশা একবার রক্তে ঢুকে গেলে তা টগবগ করতেই থাকে । বিপ্লবীকে সংগ্রামের মাঠ থেকে দূরে থাকতে দেয় না । সহযোদ্ধার পিছুটান, বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা নেতৃত্বের মোনাফেকি কখনো কখনো বিপ্লবীকে হতবিহবল করে দেয় । যে #বিপ্লবী শত্রুর বুলেটের সামনে অটল দাঁড়িয়ে থাকে, সহযোদ্ধার বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা নেতৃত্বের চিন্তাধারার দুর্বলতা , আপোষকামিতা ও ভুল সিদ্ধান্ত, তাঁকেও মাঝে মাঝে কুপোকাত করে ফেলে । যে প্রেরণা, যে চেতনা তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করতে শিখিয়েছিল – সেই চেতনাই তাঁকে আবার বিক্ষুব্ধ করে তোলে বিপদের সময় এগিয়ে না আসা সহযোদ্ধারও বিরুদ্ধে ।

শত্রুর বুলেট হয়তো বুক ভেদ করবে, হৃৎপিণ্ড ভেদ করবে । কিন্তু অন্তর থাকবে অমলিন , নিষ্কলুষ । কিন্তু সহযোদ্ধার অসময়ে পিছুটান , নেতৃত্বের ওয়াদার খেলাপ অন্তরকেই ছিন্নভিন্ন করে দেয় । বিপ্লবীরা দিয়াশলাইয়ের মত । দিয়াশলাইয়ের কাঠি আগুন জ্বালানোর কথা জালিমের মসনদে । শত্রুর তাঁবুতে । কিন্তু অন্তরের আগুন দিয়াশলাইকেই জ্বালিয়ে দেয় ।

হাজারো বিপ্লবী তাই রণাঙ্গনের পাশে বসে জ্বলে যাওয়া অন্তরকে মেরামত করে । আবার যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত করে । নতুন করে বিশ্বাসকে সাজায়- রণাঙ্গনেও বিশ্বাসঘাতকতা আছে, ওয়াদার খেলাপ আছে, নেতৃত্বের #আপোষকামিতা আছে । ষড়যন্ত্র শুধু শত্রু একাই করে না , সহযোদ্ধাও করতে পারে । মীরজাফরও সেনাপতি ছিল । সেনাপতিও হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন মীরজাফরের মত । সবকিছু পবিত্র নয়, এখানেও আছে অপবিত্রতা । তবুও চলতে হবে পথ- যতটুকু বিশুদ্ধতা আছে ততটুকু নিয়েই । তবুও লড়তে হবে ন্যায়ের পথে- যে ক’জন আছে বিশুদ্ধ সৈনিক- তাঁদেরকে নিয়েই । বিপ্লবী নতুনভাবে অন্তরকে গড়ে কঠিন বাস্তবতায়, সব কিছু মোকাবেলার জন্য । এবার আর কেউ জ্বালাতে পারবে না ।

অন্তরে #শপথ ধীরে ধীরে দীপ্ত হয়- আবার যুদ্ধে যাবো । ঝিমিয়ে পড়া হাতের দিকে তাকিয়ে বিপ্লবীর কন্ঠে আসে কবিতা –

যদি কোনদিন আসে আবার দুর্দিন
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবেনা প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙ্গে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার ।


 ৩০-০৭-২০১৩

সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩

বৃষ্টি

শাহবাগের উদ্দেশ্যে মহাখালি থেকে বাসে উঠলো জনি । মহাখালি গিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটা কাজে । এমবিবিএস পাস করার পর কিছুদিন বেশ দৌড়াদৌড়ি করতে হয় । সার্টিফিকেট তোলো , বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নাও, এখানে ওখানে কাগজপত্র দাও এইসব । অবশ্য এইসব কাজ করতে একধরণের আনন্দও আছে ।

কিন্তু আজকে জনি যে কাজে গিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সেটা নিয়ে সে একটু বিরক্ত । এই দেশে কোনকিছুই নিয়মমাফিক হয় না । রাজনৈতিক সুপারিশ আর টাকা ছাড়া কোন কাজ হয় না । কিন্তু জনি এর কোনটাতেই নেই । সে বিরোধী দলের কর্মী, আর টাকা দিয়ে কোন কাজ করার ইচ্ছা তার নেই । কিন্তু এখন একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে । এখানে থাকতে হলে হয় জায়গামত টাকা পয়সা দিয়ে কাজ করাতে হবে, নাহয় আজীবন নিগৃহীত হয়েই থাকতে হবে । বিকল্প নাই ।

জনি ভাবছিল, মেডিকেল কলেজে পোস্টিং পাওয়াটা তার ন্যায্য অধিকার । কেন তাঁকে পোস্টিং দেয়া হচ্ছে না ? তাহলে কি কিছু টাকা খরচ করবে এবার ? এটা কি নীতিবিরুদ্ধ হবে ? কেন হবে ? বিপদে পড়লে শুকরের গোশতও খাওয়া জায়েজ । আল্লাহই ভালো জানেন , কিন্তু এসব আর সহ্য হয় না ।

মাঝে মাঝে ভাবে- বিদেশে চলে যাবে । কিন্তু বাবা- মা, ছোট ভাইটাকে রেখে যেতে হবে- মনে হলেই সে ইচ্ছাটা উবে যায় ।

বিসিএস দেয়ার পর সে বছরেই এফসিপিএস পার্ট ওয়ান পাস করে জনি । চার বছর হয়ে গেল- আজো সে গ্রামে পড়ে আছে । এর মাঝে ট্রান্সফারও হয়েছে কয়েক বার । পটুয়াখালি, কুড়িগ্রাম, খাগড়াছড়ি- প্রত্যন্ত সব এলাকা । নাগরিক সুযোগ সুবিধা বলতে কিছু নেই । তার জুনিয়ররা পোস্টিং নিয়ে আসে, মাস দুমাসের মধ্যেই আবার চলে যায় । মেডিকেল কলেজে পোস্টিং পায় । কেউ কেউ বলেছিল, জনি ভাই- এভাবে আর কতদিন থাকবেন ? কিছু একটা করেন ।

বয়স ত্রিশ হয়ে যাচ্ছে, বিয়েটাও করা হল না । এবার একটা এস্পার কি ওস্পার করতেই হবে । সেই ভেবে আজ গিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে । কিন্তু নাহ- কিছু হলো না ।

জানালার পাশে একটা সিটে বসেছে জনি । চোখে কালো সানগ্লাস । সানগ্লাসটা খুলে হাতের ওপর রাখলো । মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ।

ডাক্তার হবার ইচ্ছেটা কি ভুল ছিল ? কেন যেন ছোটবেলা থেকেই মনে হত ডাক্তার হতে হবে । মনে আছে – ও যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেল, বাবা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন । জনি বৃত্তি পেয়েছে । সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায় । সে সবার দোয়াপ্রার্থী । একই কাজ বাবা করেছেন এসএসসির রেজাল্টের পরও । সেই একই কথা- জনি এ প্লাস পেয়েছে । সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায় । সে সবার দোয়াপ্রার্থী ।

পেপার কাটিং গুলো এখনো বাবার ড্রয়ারে সংরক্ষিত আছে । জনিরও তখন ভালোই লেগেছিল । পত্রিকায় ছবি এসেছে- খারাপ কি ? বিজ্ঞাপনের পাতা হাতে নিয়ে বাবার সেকি উচ্ছাস ! চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলার জোগাড় । আমার ছেলের ছবি পত্রিকায় ! অথচ তিনিই টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন । জনির মনে পড়লে একটু হাসিও পায় । বড় মানুষরাও কীরকম ছেলেমানুষি যে করে ! বিশেষ করে বাবারা ।

বিজ্ঞাপন দেয়ার আগে বাবা কিন্তু জনিকে জিজ্ঞেস করেননি সে কী হতে চায় । তিনি নিজেই লিখে দিয়েছেন- জনি ডাক্তার হতে চায় । অবশ্য পত্রিকায় আরো যতজনের ছবিসহ বিজ্ঞাপন সে দেখেছিল- প্রায় শতভাগের কথা ছিল তারা ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায় । জনির মনে হয়েছিল- ডাক্তার হওয়াটাই বুঝি ভালো ছাত্রদের জন্য দরকার ।

কথাটা ভুল নয় । আসলে এটা একটা মধ্যবিত্ত চেতনা । মধ্যবিত্তরা সম্মানের কাঙ্গাল । তারা সম্মান চায় । অসম্মান করলে তারা খুব কষ্ট পায় । তারা নিজেরা অন্যদের খুব সম্মান করে । ডাক্তাররা সম্মানের পাত্র, সেই ভেবে মধ্যবিত্ত বাবা মা-রা তাঁদের সন্তানকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখেন ।

কিন্তু বেশিরভাগ ডাক্তারের জীবন হতাশার । অন্তত একটা বয়স পর্যন্ত । ছোটবেলা থেকে কঠিন পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে- ভার্সিটিতে উঠে একটু রিল্যাক্স থাকবে , খুব আশা থাকে মনে । কিন্তু না , তা আর হয় না । মেডিকেল কলেজে পরীক্ষার ওপর পরীক্ষা । আইটেম-কার্ড-টার্ম-প্রফ । প্রতিটা সাবজেক্টে পাচ-ছয়টা পার্ট । পাস করার জন্য পেতে হবে প্রতি অংশে সিক্সটি পার্সেন্ট মার্কস । বিশাল মার্কস ভাইভায় । স্যার ম্যাডামদের কোনভাবেই সন্তুষ্ট করা যায় না । গাধার খাটুনি খেটে পড়াশোনা, ওয়ার্ড ডিউটি, স্যার ম্যাডামদের বকাবকি । শীতকালীন-গ্রীষ্মকালীন ছুটি নেই । যেন এক বিভীষিকাময় জীবন । হতাশার শুরু হয় সেখানেই ।

তারপর আবার বিসিএস , এফসিপিএস, এমডি । বিসিএসএর জন্য আবার বাংলা ব্যাকরণ খোল- সমাস কাহাকে বলে পড় । সুদ-কষার অংক কর । বান্দর তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে কতটা উঠতে পারলো হিসাব করো । সংজ্ঞা মুখস্ত কর- নদী কাহাকে বলে । পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সেনাপতি কে ছিল, সোমালিয়ার প্রেসিডেন্টের নাম কি এইসব হাবিজাবি । ডাক্তারির সাথে এগুলোর কী সম্পর্ক একমাত্র সরকার বাহাদুরই জানে , আর ঐ পিএসসিই জানে । তার ওপর যদি কোটা ভুক্ত না হয় তাহলে তো চান্স কমে যায় একলাফে প্রায় শতকরা ষাট ভাগ । কারণ নানান কোটায় মোট বিসিএস এর পঞ্চান্ন ভাগ খেয়ে ফেলেছে । এর ওপর আছে রাজনৈতিক প্রভাব । জায়গামত মন্ত্রী ফোন না করলে ভাইভায় আউট । সরকারি দল না হলে এই সেই ভেরিফিকেশনের নামে বাতিল করা হয় গেজেট । অন্ততপক্ষে নন-ক্যাডার করে রাখা হয় ।

আবার বিসিএস হলে অজপাড়াগায়ে পোস্টিং । বছরের পর বছর সেখানে পড়ে থাকা । ক্লাসের পেছনের বেঞ্চের বন্ধুটি আজ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে , মাস শেষে মোটা অংকের বেতন পায় । বউ বাচ্চা নিয়া মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে । অন্য সব ক্যাডারের পোস্টিং মিনিমাম উপজেলা শহরে । আছে গাড়ী, কোয়ার্টার সুবিধা । একমাত্র ডাক্তারদের পোস্টিং আছে ইউনিয়ন-গ্রামে । নেই কোয়ার্টার, নেই গাড়ী , নেই পিয়ন-আর্দালি, নেই বডিগার্ড, নেই প্রটোকল । ডিগ্রি নেয়ার জন্য কোথাও যাবারও উপায় নেই, আবার ডিগ্রি না নিতে পারলে কোনদিন প্রমোশনও হবে না ।

ইন্টার্ণশিপ করার সময় একদিন সার্জারির সহকারী অধ্যাপক স্যার বলেছিলেন, জনি মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগে । আমার কত জুনিয়ররা আজ সহযোগী অধ্যাপক হয়ে গেছে- আর আমি আজও সহকারী অধ্যাপক রয়ে গেলাম । আমার ছাত্ররা আজ আমার সাথে এক কাতারে , সহকারী অধ্যাপক । এই আমাদের দেশ । নেতাদের পিছনে ঘুরঘুর করো, জায়গামত টাকা ঢালো- তোমার প্রমোশন হবে । নাহলে সারাজীবন পঁচে মরো, দেখার কেউ নেই ।

বাস এসে থেমেছে ফার্মগেট খামারবাড়ি মোড়ে । জনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল । কিছুক্ষণের মধ্যেই জানালার পাশে আরো বাস এসে থামলো । জ্যাম লেগে গেছে । জ্যামের কারণে ঢাকা শহরে চলাফেরা করাটাই দায় । এক ঘন্টার পথ তিন ঘন্টা লাগে । পল্টন থেকে শ্যামলী যেতেই কোন কোন দিন আড়াই ঘন্টা লেগে যায় । উত্তরা থেকে শাহবাগ আসতে লাগে তিন ঘন্টা । মহা মুশকিল । এই জ্যাম যে কতক্ষণে ছুটবে আল্লাহ মালুম ।

জনি বাসের ভেতরে দৃষ্টি ফেরালো । সাথে সাথে চোখটা নামিয়েও নিতে হল । মহিলা সিটে একটা মেয়ে বসে আছে । মেয়েটা বেশ মায়াবী চেহারার । একবার চোখ পড়লে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে যে কারো । এবং সেটাই হচ্ছে । বেশ কিছু লোক তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে । জনি চোখ নামিয়ে নিয়েছে । সে জানে, পুরুষের পর্দা হলো চোখ । আমাদের সমাজে শুধু মহিলাদের পর্দার ব্যাপারে কথা বলা হয়, পুরুষেরটা বলা হয় না ।

কিন্তু অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে, চোখ সামলানো অত সহজ না । রাস্তাঘাটে চলাফেরা করাটাই দায় হয়ে পড়েছে । কতক্ষণ চোখ সংরক্ষণ করা যাবে ? সর্বত্র বেপর্দা, সাজুগুজু করে বের হওয়া মেয়েদের কথা যদি বাদও দেয়া হয়- মরার ওপর খড়ার ঘা হয়ে আছে যেখানে সেখানে বড় বড় বিলবোর্ড । সকল বিলবোর্ডেই মেয়েদের ছবি । বিজ্ঞাপনের জন্য বেপর্দ হয়ে ছবি তোলা- এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে মডেলিং । গাড়ি, রড, আইসক্রিম, এমনকি প্রকাশ্যে কনডমের বিজ্ঞাপনও দেয়া হচ্ছে বিলবোর্ডে । রাস্তার মোড়ে মোড়ে, রোড ডিভাইডারের ওপর । সব সময় তো আর চোখ নামিয়ে চলা যাবে না , তাহলে তো টেম্পু-সিএনজি মেরে দিয়ে যাবে । ওগুলো একেকটা বদ ।

এই মেয়েটাকে অবশ্য বেপর্দা বলা যায় না , কিন্তু ঠিকমত পর্দা করেছে তাও বলা যায় না । পর্দার উদ্দেশ্য যে ব্যাহত হয়েছে তা তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ।
সমস্যা হলো মেয়েটা জনির দিকে তাকিয়ে ছিল । জনিও এমন জায়গায় বসেছে , চোখ তুললেই মেয়েটার ওপর চোখ পড়ছে । বাস থেকে বের হয়ে যাবে কিনা ভাবছিল জনি । দরজার দিকে তাকাতেই আবারো চোখ পড়ল । এবার তো চোখাচোখিই হয়ে গেল ।

মহা মুশকিল । বাইরে আবার এরই মধ্যে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে । খোলা জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে দিল জনি । বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে মাথায় । ভিজে যাচ্ছে ঝাঁকড়া চুল ।
বৃষ্টি দেখলেই জনির বৃষ্টিবিলাসী মন উথাল পাথাল করে । বৃষ্টিতে না ভিজলে ভালো লাগে না । অন্তত দু হাতের পাতা হলেও একবার ভেজাতে হবে ।

জ্যাম ছুটতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে ! এখান থেকে হেঁটে ফার্মগেট যেতে পারলেই ওপাশের বাসে উঠে পড়া যাবে । ভিজলে ক্ষতি কী ? ও আচ্ছা , মোবাইল আর মানিব্যাগ সমস্যা । ওগুলো তো ভিজে যাবে । কন্ডাকটারকে ডাকলো জনি- এই একটা পলিথিন দাও ।
বাসে পলিথিন রাখা হয় । বাসে উঠে বাচ্চা কাচ্চারা- কখনো বড়রাও বমি করে । বাস যেন নোংরা না হয় সে জন্য পলিথিনের ব্যবস্থা রাখা হয় ।

সবাই একবার জনির দিকে তাকালো । এই ছেলে বমি করবে নাকি ? জনি মোবাইল ও মানিব্যাগ বের করে পলিথিনে মুড়িয়ে নিলো । তারপর উঠে দরজা দিয়ে নেমে গেল ফুটপাতে । বৃষ্টি পড়ছে । ক্যাটস এন্ড ডগস নয়, টাপুরটুপুর । কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি থেমে যাবে পুরোপুরি । হালকা বৃষ্টির সাথে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া আসছে দমকে দমকে । জনির শরীরে একবার শিহরন খেলে গেল ।

একশ গজের মত এগিয়েছে , হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনতে পেল – ‘জনি ভাই ! আমি বৃষ্টি !’
পেছন ফিরে জনি অবাক । ঐ মেয়েও বাস থেকে নেমে পড়েছে । সে পেছনে এসেছে কেন ?
বৃষ্টি... কোন বৃষ্টি ? সে কীভাবে জনিকে চেনে ? দাঁড়িয়ে থাকা বাসের জানালা দিয়ে লোকজন তাকিয়ে আছে । জনি এখন কী করবে ?

..............................
বৃষ্টি / ২৯-০৭-২০১৩

শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০১৩

বিদেহী প্রিয়তমার অপেক্ষায়

দিঘীর শান্ত জলে আমার চঞ্চল চোখ স্তব্ধ চেয়ে থাকে
বাতাসের কানাকানিতে ভ্রুক্ষেপ নেই
বিজলির ঝিলিকেও স্থির চোখের তারা
মেঘের গর্জনেও চমক নেই
শান্ত । যেন সে এক- হাজার বছরের ধ্যান ।

জানিনা কতটুকু মুহুর্ত কিংবা কতটা শতাব্দী পেরিয়ে যায়
আমার স্তব্ধ চোখ তবু নিষ্পলক । ক্ষুদ্র কড়ে আঙ্গুলে উঠে আসে
ঘাটের শ্যাওলার ভেতর বেড়ে ওঠা বেগুনী ঘাসফুল
তোমার খোঁপার কথা মনে আসে । আবার হারিয়ে যায়
শান্ত দিঘীর জল ইশারা দেয়- কথা বলো না ।

অনন্ত কাল হয়তো এখানে বসে থাকবো, এই ঘাটে
সম্বিত ফিরে পাবো শুধু তোমার ঘুঙুরের শব্দেই ;
বালিকা বঁধূ । এই চোখে চঞ্চলতা আসবে ফিরে – যদি মনে হয়
চোখ ফেরালেই হয়ে যাবে চোখাচোখি তোমার ,
কাজল গভীর নয়নে ।

………………………..............
বিদেহী প্রিয়তমার অপেক্ষায় / ২৬-০৭-২০১৩

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৩

মৃত্যর সাথে প্রেম

কোথায় যাবে কী পাবে ?
কখন ?
তুমি নিশ্চিত নও ?

কিন্তু
তুমি মৃত্যুকে অথবা
মৃত্যু তোমাকে পাবে ,
এ তো মহাসত্য সৃষ্টির আদি
কিংবা তারও আগে হতেই !

আমি তাই
মৃত্যুকে সাজাই
নিরন্তর । হৃদয় নিংড়ে পাওয়া –
সবটুকু মাধুরী ঢেলে । প্রিয়তমে ললনার মত ।
একটু পরেই
এক অলৌকিক বিয়ের আসরে
তার হাত ধরে আমি পদার্পণ করবো
অনন্ত যৌবনে ।

মৃত্যুকে তোমরা ভয় পাও ?
হা হা হা ! বড্ড হাসি পাচ্ছে !
তোমরা মৃত্যুকে মনে করো
কুৎসিত ঝগড়াটে বৌ !
মৃত্যুতে তোমরা খুঁজে পাও
অপুরণীয় ক্ষতি !

অথচ
মৃত্যু আমার প্রেমময় সুন্দরীতমা
এক পলকেই যার ওপর ঝাপিয়ে পড়া যায়
অদম্য তাড়নায় ।

মহিমান্বিত মৃত্যু !
সেতো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ।
তার সাথেই আমার
আজন্ম সহবাস ।

....................................
মৃত্যুপ্রেম / ২৫-০৭-২০১৩

সোমবার, ২২ জুলাই, ২০১৩

তিন প্রহরের বিল

গল্প কবিতা খুব একটা পছন্দ করে না ইমরান । এগুলোকে সে বেহুদা কাজ মনে করে । সে কঠিন কঠিন প্রবন্ধ পড়ে । পত্রিকার কলাম পড়ে । কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন তাঁর মাথায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাটা ঢুকে যায় স্কুলে থাকতেই । এরপর হঠাৎ হঠাৎ কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করতো সে । টেনশন করার মত পরিস্থিতি দাঁড়ালে তখনো তাঁর মুখে শোনা যেত কবিতাটা ।

এমনিতে ইমরান খুবই শান্ত শিষ্ট ভদ্র ছেলে । কারো সাথে কোন ঝামেলায় সে কখনোই জড়াত না । চেহারা নাদুস নুদুস । একজন আদর্শ পড়ুয়া ছাত্র ।

স্কুলে অংকের মনির স্যার ছিলেন খুব রাগী । একদিন স্যার ক্লাসে এলেন । স্যারের মেজাজ কোন কারণে আগে থেকেই বিগড়ে ছিল । এদিকে হোমওয়ার্কের খাতা দেখতে চাইলে দেখা গেল অনেকেই হোমওয়ার্ক করে আসেনি । ইমরানও তাদের মধ্যে একজন । আসলে ইমরান হোমওয়ার্ক ঠিকই করেছিল । কিন্তু ঝামেলাটা হয়েছে অন্য জায়গায় । স্কুলে আসার সময় মামাতো বোন রুনার খাতার সাথে খাতা পরিবর্তন হয়ে গেছে । রুনা পড়ে ক্লাস থ্রিতে , ইমরান নাইনে ।

যাদের হোমওয়ার্ক করা হয়নি তাদের দাঁড়াতে বললেন মনির স্যার । হাতের উল্টোপিঠে বেত দিয়ে পেটানো ছিল মনির স্যারের বিশেষ স্টাইল । ইমরানের সামনে এসে স্যার দেখলেন- টেবিলে গণিত খাতা । খাতার ওপরে লেখা ‘রুনা’ ।
স্যার কী মনে করলেন কে জানে- তিনি ইমরানের ওপর ক্ষেপে গেলেন । ইমরানের দুহাতের উল্টোপিঠে পেটাতে লাগলেন । ইমরান এ অবস্থায় সুনীলের কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলো ।

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি ।
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো ? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

স্যার থেমে গিয়েছিলেন । স্যার হয়তো নিজেও এরকম আশা করেননি ।

রুনা ইমরানের মামাতো বোন । মামার বাসা পাশেই হওয়ায় রুনাকে স্কুলে নেয়ার দায়িত্ব প্রায়ই পালন করতে হত ইমরানকেই । মামা মামী দুজনেই কর্মজীবি । তাঁদের একমাত্র মেয়ে রুনা । রুনার স্কুল ছিল ইমরানের স্কুলে যাওয়ার পথেই । রুনাকেও এই কবিতাটাই শোনাতো ইমরান । রুনা একবার জিজ্ঞেস করেছিল- ইমরান ভাইয়া, তুমি তিন প্রহরের বিল দেখেছ ? ইমরান বলেছিল সে দেখেনি । তবে শুনেছে দাদাবাড়ির গ্রামে একটা বিল আছে । রুনা বলেছিল- আমাকে নিয়ে যাবে একদিন ? আমিও বিল দেখবো । ইমরান বলেছিল- একদিন নিয়ে যাবে বিল দেখাতে ।

সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা । প্রায় বছর দশেক । এর মধ্যে কত কিছু হয়ে গেছে ।

ইমরান বসে আছে মামার বাসায় , বেডরুমে । মামী কফি বানিয়ে এনেছেন । কফির মগে চুমুক দিচ্ছিলো ইমরান । রুনার ছোট ভাইটা আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল । ওর বয়স ছয় । ক্লাস ওয়ানে পড়ে । মোবাইল পাগলা । ইমরানের মোবাইল নেয়ার জন্য ঘোরাফেরা করছে । মামী থাকায় সুবিধা করতে পারছে না ।
মামী বললেন- ‘বাবা, অনেকদিন পর এলি । আমাদের ভুলেই গেছিস । তোর মা-টাও চলে গেল, আর যোগাযোগটাও কমে গেল’ ।

ইমরান কী বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না । মায়ের সাথে মামীর সম্পর্ক ছিল প্রাণের বান্ধবীর মত । সাধারণত পরিবারে ননদ-ভাবী একটা দ্বন্দ্ থাকে , কিন্তু ইমরানের মায়ের সাথে মামীর সম্পর্ক ছিল গলায় গলায় । ইমরানের একটাই মামা । মায়ের ছোট ভাই ।

তখন ইমরানদের বাসা এদিকেই ছিল । সময় পেলেই মা ইমরানকে নিয়ে মামার বাসায় আসতেন ।
ঐ বয়সেও তারা লুডু খেলতেন । ইমরান আর ওর মা একপক্ষে, মামী আর রুনা একপক্ষে । দারুণ উত্তেজনাকর খেলা হত । মাঝে মাঝে বিকেল বেলা পার্কে ঘুরতে যেতেন দুজনে । ইমরান আর রুনাও সাথে থাকতো ।
কথায় কথায় মা মামীকে বলতেন , তোর মেয়েটাকে আমি নিয়ে যাবো ।
মামী বলতেন- তা হতে দেবো না । আপনার ছেলেটাকে আমি নিয়ে আসবো ।
আমার ছেলেকে আমি ঘরজামাই হতে দেব ভেবেছিস ? মা বলেন ।

দুজনে হাসতেন খুব । হাসি রোগ ছিল তাঁদের । হাসি শুরু করলে সহজে থামে না । চোখে পানি না আসা পর্যন্ত হাসেন ।

ইমরান স্কুল কলেজ পেরিয়ে মেডিকেল কলেজে চান্স পেল । ঢাকা ছেড়ে যেতে হবে চট্টগ্রামে । সবকিছু গোছগাছ করা হচ্ছে । ছেলেটা হোস্টেলে কীভাবে থাকবে, কী খাবে এসব নিয়ে মায়ের চিন্তার শেষ নেই । কলেজে নাকি মারামারিও হয় । ছেলেটা তো বেশি দৌড়াতেও পারবে না । ও একটু মোটাসোটা । কী যে করবে । ওকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই ।

ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হবার দুদিন আগে সবকিছু গোছগাছ করা হল । মা সারাদিন ধরে ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন । কোনকিছু বাদ পড়লো কিনা দেখলেন । চিড়াভাজার বয়াম দিলেন, আচারের বয়াম দিলেন । একটু পরপর ইমরানকে ধরে মুখে কপালে চুমু দিলেন । ঐদিন যে মা কতবার ইমরানকে চুমু দিয়েছিলেন গুনে শেষ করা যাবে না । ইমরানেরও মনটা খুব খারাপ ছিল সারাদিন । বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে । অচেনা শহর, অচেনা মানুষজন । সে কি পারবে মানিয়ে নিতে ?

রাতের বেলা আব্বার সাথে বেরিয়ে পড়লো ব্যাগ নিয়ে । বাস পর্যন্ত মা এগিয়ে দিয়ে গেলেন । মা লং জার্নি করতে পারেন না । তাঁর কোমড়ে ব্যথা হয়, আর মোশন সিকনেস । বমি হয় । নাহলে তিনিও সাথে যেতেন ।

সকালবেলা চট্টগ্রামে নেমে হোস্টেলে গেল ইমরানরা । হোস্টেল অফিসে কথা বলতে গেল । সেখান থেকে রুম বরাদ্দ হবে । হোস্টেলে বিভিন্ন সংগঠনের ছেলেরা এসে তাঁদেরকে অনেককিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো । হোস্টেলের রুম নাকি কলেজের নিয়ন্ত্রণে নাই । ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের শক্তি অনুযায়ী ভাগ করে নিয়েছে । যাদের রুমে উঠবে- তাদের লোক হয়ে যাবে । মহা ফ্যাসাদের ব্যাপার । কেউ কেউ সিগারেট খাচ্ছিল- সিগারেট খেয়ে খেয়ে ঠোঁট কালো করে ফেলেছে । রংচটা জিন্স পড়া , নিচের দিকে ছেড়া । এরা কেউ জাতীয়তাবাদের কথা বলে, কেউ আবার মুক্তিযুদ্ধ চেতনার কথা বলে । তারা বারবার মৌলবাদী গোষ্ঠীর ব্যাপারে সতর্ক করছিল । ওরা আপনার ছেলেকে জঙ্গী বানিয়ে ফেলবে । মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার বই পড়ে আপনার ছেলেকে মৌলবাদী হয়ে যাবে ।

ইমরানের আব্বা চিন্তা করলেন – এ কেমন চেতনা ? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি সারাদিন সিগারেট ফোঁকা ? কেউ কেউ বললো- এরা মদ গাঁজাও খায় । অবশ্য দেখেই বোঝা যায়- নামাজ কালামের ধার ধারে না । নামাজী ছেলের চেহারা এরকম হয় না ।

কিছু ছেলে এসে সুন্দর করে সালাম দিয়ে কথা বলেছিল । তারা কারো বিরুদ্ধে বিষোদগার না করে সমস্ত পরিবেশ পরিস্থিতি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছিল । তাঁদের কথার সাথে পরিবেশের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন ইমরানের বাবা । সবকিছু ভেবেচিন্তে তিনি এরকম একজন ভদ্র নামাজী ছেলের রুমে ছেলেকে তুলে দিয়েছিলেন ।

সেদিন বিকেল বেলা ফোন এলো । ইমরানের আম্মা খুব অসুস্থ । অনেক বেশি জ্বর উঠেছে । বমি করেছেন । এখন অজ্ঞান হয়ে গেছেন । মামা মামী তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন ।

ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে আবার ঢাকা যাওয়ার জন্য বের হলো ইমরান ও তাঁর আব্বা । ইমরানের রুমমেট ছেলেটা কীভাবে কীভাবে ইন্সট্যান্ট একটা বাসের টিকেট করে ফেললো । ভালো সিটের ব্যবস্থা করে দিল । বাসে উঠে ইমরান নীরবে কাঁদতে লাগলো ।
মধ্যরাতে ঢাকায় পৌঁছে হাসপাতালে গিয়েছিল ইমরান ও আব্বা । মায়ের জ্ঞান ছিল । দুর্বল হাতে তিনি ইমরানকে কাছে টেনে মাথায় চুমু দিয়ে বলেছিলেন – আমার বাবা, তুই আমাকে ফেলে কোথাও যাবি না ।

ইমরান কোথাও যায়নি, কিন্তু সকালবেলা মায়ের ঘুম আর ভাঙ্গেনি । তিনি ইমরানকে রেখে চলে গেছেন ।

ইমরান এক সপ্তাহ কোন কথা বলেনি । সারাক্ষণ চুপচাপ । রুমের দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে ।
তারপর একসময় বাস্তবতা মেনে নিয়ে চলে গিয়েছিল চট্টগ্রামে । পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । ঢাকায় ওরা বাসা চেঞ্জ করে । মামার বাসায় আর তেমন একটা যাওয়া হয় না । মামী মাঝে মাঝে ফোন করতেন । কথা হত ।

ইমরান যখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় রুনা তখন ক্লাস সেভেনে । মাঝে মাঝে রুনা চিঠি লিখত । ইমরান খুব একটা উত্তর দেয়না । ধীরে ধীরে রুনাও একসময় চিঠি লেখা বন্ধ করে দেয় । দুবছর আগে রুনা এসএসসি পাস করার পর মামী ইমরানের সাথে পরামর্শ করেছিলেন- রুনাকে কোথায় ভর্তি করানো যায় । রুনা ভালো রেজাল্ট করেছিল । রুনাকে হলিক্রস কলেজে ভর্তি করানো হয়েছিল ।

ইমরান এমবিবিএস পাস করে , ইন্টার্ণশিপ শেষ করে এখন ঢাকায় । থাকে বন্ধুদের সাথে শাহবাগে এক বাসায় । মেডিকেলের উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একটিই । বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়- বিএসএমএমইউ । শাহবাগে । সারাদেশ থেকে তরুণ ডাক্তাররা পোস্টগ্রাজুয়েশনের নেশায় ঢাকা ছুটে আসে । তারা এসে ভিড় জমান বিএসএমএমইউ- এর আশেপাশে । শাহবাগের গণ্ডিতেই শত শত বাসায় ব্যাচেলর ডাক্তাররা থাকেন । দিনরাত পড়াশোনা করেন । সবার ধারণা- বিএসএমএমইউ-র আশেপাশে থাকলে বুঝি পড়ালেখা ভালো হবে ! অবশ্য আরো একটা কারণ আছে- বিএসএমএমইউ-র লাইব্রেরিতে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করা যায় । এসি আছে ।

কয়েকদিন থেকে মামী ফোন করছেন । বাসায় যেতে বলছেন । ইমরান এফসিপিএস পার্ট- ওয়ান পরীক্ষা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল এ কয়দিন । সময় করে উঠতে পারেনি । নাক ডুবিয়ে পড়াশোনা করেছে । তার ফলও পেয়েছে । পার্ট-১ এ পাস করে ফেলেছে সে । একজন ডাক্তারের জন্য এ এক বিশাল রিলিফ ।
সামনে আবার বিসিএস ভাইভা আছে । এখন কিছুদিন রেস্ট নেয়ার চিন্তা করেছে ইমরান । বিসিএস নিয়া এত চিন্তা নাই ।

আজ সকালবেলাটা ঘুমিয়ে বিকেলে বের হয় মামার বাসায় আসার জন্য । পথে হলিক্রস কলেজ পার হবার সময় রুনার কথা মনে পড়েছিল । রুনা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে । রেজাল্ট এখনো হয়নি । পড়াশোনা করছে মেডিকেল- ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার জন্য ।
ছোটবেলায় রুনাকে স্কুলে নিয়ে যাবার স্মৃতিগুলোও মনে পড়ে যাচ্ছিল । ছোটবেলায় রুনা দেখতে খুব কিউট ছিল । এখন কেমন হয়েছে কে জানে !

..........................................

মামীর সাথে কিছুক্ষণ আলাপ হলো । স্মৃতিচারণ । মায়ের কথা, ইমরানের ছোটবেলার কথা । কথা বলতে বলতে মামীর চোখ ছলছল করে ওঠে । ইমরানের মনটাও উদাস হয়ে যায় ।
রুনাকে একবার দেখা গেল দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে । রুনা কি আড়ালে থেকে কথা শুনছে নাকি ? এই বয়সের মেয়েদের এই একটা বদভ্যাস । আড়ালে থেকে বড়দের কথা শোনে ।

কফি শেষ করতে না করতেই মামা চলে এলেন । সাথে ইমরানের আব্বাও । ইমরান অবাক হয়ে গেল । আব্বা এসময় এখানে আসবেন – এমনটা তো কথা নয় ।
মামা বললেন- অবাক হচ্ছিস কেন ? তোর বাবাকে আমিই ডেকেছি ।

চা এলো । চা খেতে খেতে আব্বা বললেন- বাবা ইমরান, একটা জরুরী বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি এসেছি । তোর মামীর খুব ইচ্ছে- তোর সাথে রুনার বিয়েটা দিয়ে দেন । তোর মামার এবং আমারও মত আছে । তোর মাও একথা বলতো । আমাদের ইচ্ছা- এ সপ্তাহেই বিয়েটা সেরে ফেলি । তোর মতামত টা জানার জন্যই এখানে এসেছি । তুই কি বলিস ? রুনা মা খুব ভালো । তুই তো জানিস, তোর মা ওকে কতটা পছন্দ করতেন ।

ইমরান সবার দিকে তাকালো । মামীর চোখ ছলছল করছে ।
ইমরান এমনটা আশা করেনি । তাঁর অমত নেই, বরং মনে মনে এমন একটা ইচ্ছা যে তারও জাগেনি তা নয় ।
তবু আমতা আমতা করে বললো- কিন্তু ও তো এখনো ছোট ।

পিচ্চি ভাইটা এসময় ইমরানের চেয়ারের কাছে এসে ইমরানের হাতে একটা নীল কাগজ ধরিয়ে দিল ।
ইমরান খুলে দেখলো তাতে লাল কালিতে লেখা –

নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো ? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?
-(রুনা) ।
...............................
তিন প্রহরের বিল / ২২-০৭-২০১৩

রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৩

বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর মহা আবিস্কার

ইন্টারন্যাশনাল সাইকিয়াট্রিস্ট সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলন । সম্মেলনে মিলিত হয়েছেন সারা বিশ্বের সেরা সাইকিয়াট্রিস্টগন । বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছেন ডঃ আব্দুল্লাহ । সম্মেলনের দুইটি অংশ । প্রথম অংশ জার্মানির ‘বন’ শহরে পরশু শেষ হয়েছে । দ্বিতীয় অধিবেশন বসছে নেদারল্যান্ডের ‘হেগ’ শহরে । এ নিয়ে আজ সকালে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ডঃ আব্দুল্লাহর বাসায় । বাংলাদেশের পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে – ‘ বাংলাদেশের মনোবিজ্ঞানী ডঃ আব্দুল্লাহ গতকাল বন থেকে হেগে গেছেন’ ।
ডঃ আব্দুল্লার সাত বছর বয়সী ছেলে খবর দেখে তার মাকে প্রশ্ন করেছে- মাম্মি, বাবা কেন বনে পায়খানা করতে গেছেন ? তুমি না বলো- যেখানে সেখানে পায়খানা করলে ডায়রিয়া হয় ?

সকালে স্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে । ডঃ আব্দুল্লার স্ত্রীর নাম মিমু । মিমু তো ঘটনা বলে হাসতে হাসতে কথাই বলতে পারছিল না । এদিকে ডঃ আব্দুল্লার মেজাজ খারাপ । বাচ্চা ছেলেটা বাবার সম্পর্কে কী একটা খারাপ ধারণা পেয়ে গেল । দেশে সাইকিয়াট্রিস্টদের পাগলের ডাক্তার বলা হয় । বিদেশি পাগলের ডাক্তারগুলার ওপর ডঃ আব্দুল্লাহ মহা বিরক্ত হলেন । শালারা সম্মেলন আয়োজনের জন্যে ‘বন’ আর ‘হেগ’ ছাড়া পৃথিবীতে আর জায়গা পেল না ?

প্রথম অধিবেশনে বিশ্বের মানুষের মনস্তাত্বিক অবস্থার ওপর বিস্তর আলোচনা হয়েছিল । নানারকম সমীক্ষা, গবেষণা পত্র উত্থাপন করা হয়েছিল । দিন দিন মানুষের মনস্তত্ব জটিলতর হচ্ছে । মানুষ বেশি মাত্রায় মানসিক চাপে ভুগছে । বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের মানুষেরাই বেশি মানসিক চাপে ভুগছেন । পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতাও বাড়ছে । পরিবার , বন্ধন এই শব্দগুলো কেমন যেন সেকেলে হয়ে যাচ্ছে ।
ডঃ আব্দুল্লাহ প্রথম অধিবেশনে শিশুদের মানসিক অবস্থা নিয়ে একটা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন । এতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে শিশুদের ওপর ছোটবেলা থেকেই নানামুখি চাপ সৃষ্টি করছে পরিবেশ । শিশুরা নিজেদের ভেতর মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে না , খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না, চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছে না । স্কুল, টিউটর , পরীক্ষা , প্রতিযোগিতা... শিশুরাও এখন মহাব্যস্ত ......

এইসব কথাবার্তা বলেছিলেন প্রায় ঘন্টাখানেক । তিনি নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়েই প্রথম অধিবেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন । মনে মনে কিছুটা অস্থিরতাও বোধ করছিলেন । কখন তাঁর আবিস্কার উপস্থাপন করবেন সে নিয়ে টেনশন বোধ করছিলেন । তিনি আশা করেন – এই আবিস্কার দেখে সবাই টাস্কি খেয়ে যাবে ।

অবশেষে ‘হেগ’ এ শুরু হলো ইন্টারন্যাশনাল সাইকিয়াট্রিস্ট সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্ব । এই অধিবেশনে মনোবিজ্ঞানের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হবে । পরিকল্পনা হবে । নতুন পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হবে । এছাড়া মনোবিজ্ঞানের উন্নয়নে বিশ্বের সাইকিয়াট্রিস্ট গণ কী করেছেন তা নিয়ে পর্যালোচনা হবে ।

অনেকেই অনেক জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুরু করলেন । বেশিরভাগই চিকিৎসা সংক্রান্ত । বেশ কিছু নতুন ড্রাগের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা হলো । সিজোফ্রেনিয়া, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার , হিস্টিরিয়া, ম্যানিয়া , ফোবিয়া এইসব নিয়ে কথাবার্তা । কোন ড্রাগ কোন রোগে ভালো কাজ করছে- এইসব আবিস্কার আরকি ।

একসময় এলো ডঃ আব্দুল্লাহর পালা । তিনি তাঁর প্রেজেন্টেশন শুরু করলেন । সবাই উৎসুক হয়ে তাঁকিয়ে রইলো প্রোজেক্টরের দিকে । বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানী একটি ‘মানসিক অবস্থা পরিমাপক স্কেল’ আবিস্কার করেছেন ।
ডঃ আব্দুল্লাহ বলছিলেন- দেখুন বিশ্বে অনেক কিছু নিয়ে স্কেল আবিস্কৃত হয়েছে । পদার্থ-রসায়ন বা গণিতের কথা বাদ দিলে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বেশ কিছু স্কেল প্রচলিত আছে । ব্রেইন ফাংশান বোঝার জন্য গ্লাসগো কোমা স্কেল , মেটাবলিক অবস্থার জন্য বডি মাস ইনডেক্স স্কেল............ ইত্যাদি । কিন্তু আমাদের এই সেক্টরে তেমন কোন সহজ স্কেল এখনো চালু হয়নি ।

কারো মানসিক অবস্থা যাচাই করার জন্য আমি একটি স্কেল আবিস্কার করেছি । এই ক্ষুদ্র ডিভাইসটি সহজেই একজন মানুষের মানসিক অবস্থা নির্ণয় করবে এবং এটিকে একটি গ্রেডে প্রকাশ করবে ।

এই স্লাইডে দেখুন – এই ডিভাইসটি যে স্কেলে মানুষের মানসিক অবস্থা প্রকাশ করবে সেটির নাম দিয়েছি ‘মখা স্কেল’ । ‘মখা’ স্কেলে শুন্য থেকে একশ পর্যন্ত গ্রেড আছে । এখানে সর্বনিম্ন অবস্থা জিরো । সর্বোচ্চ একশ । যার গ্রেড যত কম তাঁর মানসিক অবস্থা ততটা ভালো । ‘একশ’ গ্রেডটি যে অবস্থা নির্দেশ করে তা আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মানসিক অবস্থা । তিনি বলেছেন- কয়েকজন মানুষ ইচ্ছে করলেই ধাক্কা দিয়ে একটি নয়তলা বিল্ডিং ধ্বসিয়ে দিতে পারে । একজন মানুষকে ইনসেন বা পাগল বলার জন্য তার মখা স্কেল গ্রেড অবশ্যই সত্তরের উপরে হতে হবে ।

এই স্কেলের প্রতি গ্রেডকে বলা হবে মখাটিভিটি বা মখাত্ব । ধরুন আপনার অবস্থা নির্দেশ করছে ষাট । তাহলে আপনার মখাটিভিটি বা মখাত্ব ষাট । আপনার অবস্থা খারাপের দিকে ।

বিপুল হাততালি হতে লাগলো হলরুমে । হাততালির শব্দে ডঃ আব্দুল্লার আওয়াজ আর শোনা গেল না ।

..............................

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে একবছর আগের কথা ভাবছিলেন ডঃ আব্দুল্লাহ । ঐ সম্মেলন ডঃ আব্দুল্লার আবিস্কারকে যুগান্তকারী আবিস্কার বলে ঘোষণা করেছিল । সেদিন সারাবিশ্বের মনোবিজ্ঞানীরা তাঁদের মখাটিভিটি জেনেছিলেন । সৌভাগ্যক্রমে সবার অবস্থাই মোটামুটি ভালোই ছিল । কারো মখাটিভিটি বিশ গ্রেড অতিক্রম করেনি ।

বিশ্বের বিখ্যাত পত্রপত্রিকাগুলিতে ডঃ আব্দুল্লাহর যুগান্তকারী আবিস্কারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয় । তাঁর ছবিসহ বিশাল বিশাল ফিচার ছাপানো হয়েছিল । তিনি ভেবেছিলেন দেশে ফিরে বিশাল সংবর্ধনা পাবেন । কিন্তু বিধি বাম । বিমানবন্দরে নামার সাথে সাথে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় । তাঁর এই আবিস্কারে বাংলাদেশ সরকারের মখানুভূতিতে আঘাত লাগে । স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে মামলা করেন ।

ইতোমধ্যে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে মখা স্কেল । বাণিজ্যিক ভাবে বিশেষ ডিভাইস বাজারজাত করা হয়েছে । মানুষ সবাই সাথে মখা স্কেল বহন করছে এবং কোন কাজ করার আগে নিজের মখাত্ব নির্ণয় করে নিচ্ছে ।

বাংলাদেশে মখা স্কেল এখনো নিষিদ্ধ । ধারণা করা হচ্ছে মখা স্কেল বাংলাদেশে চালু হলে দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক হোমরা চোমরার মখাটিভিটি বা মখাত্ব গ্রেড সত্তর অতিক্রম করবে । এরকম লোকদেরকে জনগন কোনভাবেই নিজেদের নেতা হিসেবে মানতে চাইবে না ।

জেল সুপারকে দেখা যাচ্ছে হাতে কিছু কাগজ নিয়ে ডঃ আব্দুল্লাহর সেলের দিকে এগিয়ে আসছেন । ওমা একি – তাঁর সাথে তো জাপানের মনোবিজ্ঞানী হাগুতো মুতিয়াটা কে দেখা যাচ্ছে । কাহিনী কি ?

জেল সুপার এসে সালাম দিলেন । ডঃ আব্দুল্লাহ , আপনাকে অভিনন্দন । নোবেল কমিটি আপনাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দিয়েছে । আপনার আবিস্কারের ফলে সারাবিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । অপরাধ অনেক কমে গেছে । সবাই তাঁদের মখাত্ব নির্ণয় করে কাজ করায় কাজকর্ম সুচারুরুপে সম্পন্ন হচ্ছে । বিশ্বের অনেক নেতার মখাত্ব গ্রেড সত্তরের ওপরে হওয়ায় তারা অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন । আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আপনার মুক্তির জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিয়েছেন । এছাড়া বাংলাদেশেও মখা স্কেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছে । আসুন বেরিয়ে আসুন । বাইরে আপনার জন্য বিশেষ বিমান অপেক্ষা করছে ।

ডঃ আব্দুল্লাহ হতবাক হয়ে গেলেন । বাইরে পা দিয়ে মনের অজান্তে গান গাইতে লাগলেন তিনি-

‘আমরা সবাই মখা আমাদেরই মখার রাজত্বে
নইলে মোদের মখার সনে মিলবে কি সত্বে......’

ভ্রু কুঁচকে গেল জাপানের মনোবিজ্ঞানী হাগুতো মুতিয়াটার । তাঁর কাছে থাকা ‘মখা স্কেল’ লাল বাতি নির্দেশ করছে । গ্রেড সিক্সটি । অবস্থা ভালোনা ।

ব্যাপার দেখে ডঃ আব্দুল্লাহ মুচকি হেঁসে আবার শুরু করলেন-

‘আমরা সবাই মখা আমাদেরই মখার রাজত্বে
নইলে মোদের মখার সনে মিলবে কি সত্বে
আমরা সবাই মখা.........’

...........................
বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর মহা আবিস্কার / ২১-০৭-২০১৩

শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০১৩

হুমায়ুন কথন

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অন্তত ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা জানেন তিনি নিম্নবিত্তের জীবনবোধ ও মনস্তত্ব কতটা গভীর ভাবে বুঝতেন । আমি মনে করি শুধুমাত্র ঐ গল্পটিই তাঁকে একজন ‘অসাধারণ’ কথাশিল্পী হিসেবে চিত্রিত করার জন্য যথেষ্ট ।

মানিক বন্দোপাধ্যায় যেভাবে নিম্নবিত্ত শোষিত শ্রেণীর জীবনকে বুঝতেন, হুমায়ুন আহমেদ ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনধারাকে বুঝতেন । গত কয়েক দশকে তাঁর মত এত সহজ সুন্দরভাবে মধ্যবিত্তের জীবনকে সাহিত্যে তুলে আনতে সম্ভবত কেউ পারেননি ।
তিনি লিখেছেন জীবনের বাস্তবতা নিয়ে, জীবনের রহস্য নিয়ে, জীবনের বৈরাগ্য নিয়ে ।

কেউ ভালোবাসে হিমুকে , কেউ মিসির আলীকে । আর আমি ভালোবাসি ‘মধ্যাহ্ন’ ।
আমি ভালোবাসি ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নন্দিত নরকে’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘তেঁতুল বনে জোছনা’, ‘নলিনী বাবু বিএসসি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কবি’ ...... সবকিছুর ওপরে আমি স্থান দেই মধ্যবিত্তের জীবনধারাকে গভীর থেকে সুচারুরুপে তুলে আনার তাঁর অসাধারণ দক্ষতাকে ।

হুমায়ুন আহমেদের লেখাগুলোকে নির্দিষ্ট কোন ক্রাইটেরিয়াতে আবদ্ধ করা সহজ নয় । তাঁর একই লেখায় হাসি কান্না একসাথে খেলা করে । সবকিছু নিয়ে হাসি তামাশা করার এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য তাঁর ভেতর লক্ষ্য করা যায় । আবার হাসির মাঝেই গুরুতর তত্বকথা এবং দর্শনকে তুলে আনতে দেখা যায় । ‘এনায়েত আলীর ছাগল’কে নিয়ে হাস্যরসকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যান, আবার বাকের ভাইকে ফাঁসি দিয়ে মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেন ।

হুমায়ুন আহমেদ তাঁর লেখায় সততা বজায় রেখেছেন । তাঁর ভাই জাফর ইকবালের মত অসততা তিনি করেননি । তাঁর কোন লেখায় তিনি কোন ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন নি । দাড়ি টুপি ওয়ালা মানেই রাজাকার – তাঁর লেখায় এই মিথ্যাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি । বরং ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ একজন ঈমামকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তুলে এনেছেন ।
রাজাকার মানেই যুদ্ধাপরাধী নয়, আবার মুক্তিযোদ্ধা মানেই ফেরেশতা নয়- তাঁর লেখায় এই সত্যটিও স্পষ্টভাবেই উঠে আসে । তাঁর নানা রাজাকার ছিলেন , মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি রাজাকারের আশ্রয়ে ছিলেন - সে কথাও তিনি স্বীকার করেন অকপটে ।

জীবনকে হেসেখেলে কাটিয়ে দিয়েছেন হুমায়ুন । জীবনের শেষবেলায় তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে বিতর্ক হয়- তিনি আস্তিক নাকি নাস্তিক । আমি এই বিতর্ককে প্রয়োজনীয় মনে করিনা । প্রথম আলো এবং ঐ ধারার মিডিয়া গোষ্ঠীর একটা সাধারণ প্রবণতা হলো- খ্যাতিমান ব্যক্তিদের যেকোনভাবে নাস্তিকতা ও কম্যুনিজমের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রমাণ করার চেষ্টা । হুমায়ুন আহমেদের ক্ষেত্রেও তারা সেই প্রচেষ্টা চালিয়েছে ।

ঈমানের ভিত খুব বেশি শক্ত না হলে সাহিত্যিকরা প্রায়শই সংশয়বাদিতায় ভোগেন । তাঁরা মানুষ নিয়ে চিন্তা করেন, মানুষের জীবন নিয়ে ভাবেন, লেখেন । ঈশ্বর নিয়ে কতটা ভাবেন সেটা অজানা । কিন্তু বেশিরভাগ লেখকই দিনশেষে আস্তিক, ঈশ্বরে বিশ্বাসী প্রমাণিত হন ।

সরকারি - বেসরকারি চাকুরে, আইনজীবি, পুলিশ, ডাক্তার, শিক্ষক সবার জীবনকেই তিনি ভালোভাবেই বুঝেছেন । মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণের অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাঁর ।
‘তেঁতুল বনে জোছনা’র সাইকেল ডাক্তার সবার মন ছুঁয়ে যায় ।
তবে ‘কোথাও কেউ নেই’ এবং ‘আজ রবিবার’ এর ডাক্তার চরিত্রগুলি একটু যেন বেখাপ্পা মনে হয়েছিল ।

‘রুপালি রাত্রি’র নায়িকা ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল । ‘চান্নি পসর’ গানটা শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল । হুমায়ুন কি জানতেন- তাঁকেও একদিন পরাজিত করবে সর্বনাশা ক্যান্সার ?

গুন্টার গ্রাস, অরহান পামুক- আরো অনেক নোবেলবিজয়ীর লেখা পড়েছি । হুমায়ুনের বইগুলি ইংরেজীতে খুব একটা অনুবাদ হয়নি । তাঁর বইগুলি অনুবাদ করা উচিৎ । আমরা বিশ্বাস করতে চাই- একদিন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীদের তালিকায় আমাদের হুমায়ুন আহমেদের নামটাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে ।

........................................................
হুমায়ুন কথন / ১৯-০৭-২০১৩

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০১৩

দুখু

সুর্য এখনো ওঠেনি । ঠান্ডা বাতাস বইছে । রাস্তায় নামতেই শরীরটা জুড়িয়ে গেল আব্দুল লতিফ বিএসসি সাহেবের ।
সকালবেলা আব্দুল লতিফ সাহেব আধাঘন্টা হাঁটাহাঁটি করেন । মসজিদে ফজরের নামাজ শেষ করে হাঁটতে বের হন । আশেপাশে আধাঘন্টার মত হাঁটেন । কখনো কখনো এক দেড় ঘন্টাও লেগে যায় । এলাকার লোকজনের সাথে দেখা হয় , নানান বিষয়ে কথা হয় । লোকেরা তাঁর সাথে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পরামর্শ করে । দেশের অতীত ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা হয় । রাজনীতি নিয়ে কথা হয় ।

বয়স প্রায় ষাটের কোঠায় । কিন্তু শরীর এখনো শক্তপোক্ত । ছেলেবেলা থেকেই কঠিন পরিশ্রম করে বড় হয়েছেন । এখনো পরিশ্রম করেন । জীবনে কাজ করতে হবে । ভালো কাজের মাধ্যমে জীবন শেষ করাই সার্থকতা । সবাইকে মরতে হবে । কেউ অল্প বয়সে, কেউ বেশি । দুনিয়ায় সবাই সমান পরিবেশ , সমান সুযোগ-সুবিধা পায় না । প্রেসিডেন্ট হওয়াকে কেউ সফলতা মনে করতে পারে । কিন্তু প্রেসিডেন্ট কয়জন হবে ? তাহলে বাকিরা কি ব্যর্থ ?
যতটুকু সময় পাওয়া যাবে, যতটুকু সুযোগ পাওয়া যাবে, ভালো কাজ করে যেতে হবে । ওতেই সফলতা ।

আব্দুল লতিফ সাহেব জেলার সবচেয়ে প্রাচীন স্কুল- পাইলট হাইস্কুলের হেডমাস্টার । তিনি তাঁর মেধা দিয়ে আরো অনেক ওপরে যেতে পারতেন । কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে , ছোট ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে গ্রামেই রয়ে গেছেন ।
হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে পুরণো দিনগুলির কথা ভাবেন ।

বাবা ছিলেন কৃষক । বাবা বলতেন , আমার ছেলেদের আমি লেখাপড়া শেখাবো । আমার মত কৃষক বানাবো না । সেসময় কাছেপিঠে কোন স্কুল ছিল না । সবচেয়ে কাছের স্কুলটি ছিল বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে । ছোট্ট লতিফকে একদিন বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । স্কুলের কাছে এক গেরস্ত বাড়িতে লজিং এর ব্যবস্থা করে দিলেন । সেখানে তিন বেলা খেতে দেয় । রাতে থাকার জন্য একটা চৌকি । গেরস্ত বাড়ির টুকটাক কাজ করে দিতে হয় । বাবা প্রতি সপ্তাহে এসে দেখে যান । চিড়া মুড়ি দিয়ে যান । মাসে একবার কি দুবার গরুর গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে যান ।

প্রাইমারিতে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলেন আব্দুল লতিফ । সরকারি বৃত্তি পেয়েছিলেন । ছোট্ট আব্দুল লতিফকে নিয়ে বাবা সেদিন এলাকার সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দোয়া চেয়েছিলেন , ছেলে যেন অনেক বড় কিছু হয় । সেকথা মনে পড়লে আজও নিজের অজান্তে চোখ ভিজে আসে ।

হাইস্কুলে যেতেন উল্টোদিকে দশ কিলোমিটার দূরে । হেঁটে হেঁটেই যেতে হত , হেঁটেই আসতে হত । ফযরের কিছু পরপরই পান্তাভাত খেয়ে হাটা দিতেন । এলাকার আরো দুএকজন পড়াশোনা করত, কিন্তু বছর খানেক যেতে না যেতেই আর কেউ থাকলো না । তখন একা একাই এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হত ।

আই.এ পাস করার পর পরই বাবা মারা গেলেন । বড় ছেলে হিসেবে সংসারের হাল ধরতে হল । সব পরীক্ষাতে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলেন , বেশ কিছু সাবজেক্টে লেটার মার্কস ছিল । আশা ছিল ভার্সিটিতে ভর্তি হবেন, কিন্তু তা আর হলো না । জেলা শহরের ডিগ্রি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হলেন । অল্প ফি তে স্কুলের ছেলেদের পড়াতে লাগলেন, গণিত , ইংরেজী , পদার্থ, রসায়ন । জমিজমা যা ছিল ধান পাট আবাদ করতে শুরু করলেন ।

বিএসসি পাস করে হাইস্কুলে মাস্টারি শুরু করলেন বিএসসি শিক্ষক হিসেবে । কীভাবে কীভাবে যে জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল – মনে হয় এই সেদিন স্কুল পাস করলেন । সময় এত দ্রুত যায় । এখন তিনিই সেই স্কুলের হেডমাস্টার । ভাবলে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ।

ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালেন হেডমাস্টার সাহেব । দুখু আরেকটা অচেনা কুকুরের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে । এই এক বদ-স্বভাব তার । অচেনা কুকুরকে তার এরিয়ার ভেতর সে সহ্য করেনা । কুকুরদের একটা স্বভাবই হলো ঝগড়া করা, নিজেদের ভেতর কামড়াকামড়ি করা । এই কাজ না করলে তাদের যেন কিছু হজমই হয় না । এটাকে ডগ হ্যাবিট বা বাংলায় কুত্তা স্বভাব বলা যায় ।

আব্দুল লতিফ সাহেব পাত্তা না দিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলেন ।

দুখু আব্দুল লতিফ সাহেবের পোষা কুকুর । সবসময় আশেপাশে থাকে । রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয় । কুকুরটা বেশ বুদ্ধিমান । একবার তো হাতে নাতে চোর ধরিয়ে দিয়েছিল । চোরকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে । কিন্তু পালাতে দেয় নি ।
বাড়িতে পশ্চিম দিকের ঘরটা গোলাঘর । দক্ষিণের ঘরে আব্দুল লতিফ সাহেব ও তাঁর স্ত্রী থাকেন । ঐ ঘরের আলমারিতে গয়না পাতি ছিল । সেদিন তাঁরা সবাই গেছেন এক আত্মীয়ের বিয়েতে । বাড়ি সম্পুর্ণ ফাঁকা । রাতের বেলা চোর এসে সিঁদ কেটে ঢুকেছে । দুখু কোথায় ছিল কে জানে , আশেপাশের কয়েক বাড়ির কুকুর মিলে তারা চোরের ওপর হামলে পড়েছিল । বেচারা চোর পালাতেও পারেনি ।

দুখু নামটা আব্দুল লতিফ সাহেবের দেয়া । বছর সাতেক আগের কথা । তখন পাকা রাস্তা দিয়ে বাস ট্রাক চলাচল করা শুরু হয়েছে । লতিফ সাহেব মোটরসাইকেলে করে স্কুলে যান । একদিন সকালবেলা তিনি স্কুলে যাচ্ছেন । তাঁর চোখের সামনেই ঘটে গেল ঘটনাটা । একটা ট্রাক বেশ স্পিডে চলছিল । হঠাৎ রাস্তার পাশে দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা কুকুর কীভাবে কীভাবে জানি চাপা পড়ে গেল । ঘটনাস্থলেই মারা গেল কুকুরটা । দেখা গেল রাস্তার পাশে একটা কুকুরের বাচ্চা – কালো সাদা ডোরাকাটা শরীর । বাচ্চাটা নিশ্চয়ই ঐ কুকুরটিরই হবে । মা মরা বাচ্চাটাকে দেখে খুব মায়া হলো আব্দুল লতিফ সাহেবের । তিনি একটা ব্যাগে করে বাচ্চাটাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন । নাম রেখে দিলেন – দুখু ।

দুখু তখন থেকে সবসময়- যতক্ষণ আব্দুল লতিফ সাহেব বাড়িতে থাকেন আশেপাশে ঘুরঘুর করে । সকালবেলা যখন হেডমাস্টার সাহেব হাঁটতে বের হন , তখনো সে পিছে পিছে হাঁটতে থাকে ।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছেন হেডমাস্টার সাহেব । এর মধ্যে বেশ কয়েকবার মোবাইলে কথা বললেন । উপজেলা শহরে আজ একটা বিক্ষোভ মিছিল হবে । গোটা উপজেলার মানুষজনকে খবর দিতে হবে । সরকার মুসলমানদের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করেছে । সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পরিপুর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস – এই কথাটা একজন মুসলমানের ঈমানের মৌলিক কথা । সংবিধানের একটা মূলনীতি হিসাবে এই কথাটি ছিল । কিন্তু সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে এই কথাটুকুও তুলে দিয়েছে । এর প্রতিবাদ করা ঈমানদারদের দায়িত্ব । পথে অনেকের দেখা হলো । অনেকের সাথে এই বিষয়ে আলোচনাও করলেন তিনি । বিকালের প্রতিবাদ মিছিলে যাওয়ার জন্য বললেন সবাইকে ।

আব্দুল লতিফ সাহেব পাইলট স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র । কোন রাজনৈতিক দলের নেতা না হলেও তাঁর প্রভাব অনেক । বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি জনগনকে নিয়ে রুখে দাঁড়ান । একবছর ধরে এই অঞ্চলে টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন করে যাচ্ছেন তিনি । কোন সমাবেশে তিনি যখন কথা বলেন – জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে । টিপাইমুখ বাঁধ যে বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কার মত আরেকটা মরণফাঁদ , তিনি জনগনকে এটা ভালোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন । হাজার হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন ।

এবার ঈমান নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে । জনগনকে নিয়ে আবার নামতে হবে । সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে – বাংলাদেশের মানুষ ঈমানদার । ঈমান নিয়ে টানাটানি তারা সহ্য করবে না ।
আব্দুল লতিফ সাহেব ফিরতি পথ ধরলেন । আজ অনেকক্ষণ হাঁটা হয়েছে ।

....................................

বারবার গোঁফে হাত দিচ্ছেন রোস্তম খান । তিনি সরকারি দলের উপজেলা সভাপতি । বোঝা যাচ্ছে, তিনি বেশ টেনশনে আছেন । আগামী সংসদ নির্বাচনে তাঁর এই আসন থেকে প্রার্থী হবার কথা । সেজন্য সব দিকে তাঁকে কড়া নজর রাখতে হচ্ছে । বিশেষ করে সরকার বিরোধী যেকোন ব্যাপার । মৌলবাদীরা অপপ্রচার করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলছে । ভারত একটা বড় দেশ । তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সাহায্য করেছে । তারা তাদের স্বার্থে , চিরশত্রু পাকিস্তান ভাঙ্গার স্বার্থে যুদ্ধে এসেছে সেটা ঠিক । কিন্তু আমাদের সাহায্য তো হয়েছে । এখন তারা কিছু প্রতিদান তো পেতেই পারে । যুদ্ধের পরপর তারা অনেক কিছু লুট করে নিয়ে গেছে । সেটাতো তারা করতেই পারে । এখন তারা উজানে একটা বাঁধ দিচ্ছে- তো দিক না । এই নিয়ে এত চিল্লাফাল্লা করার দরকার টা কি ? বিরোধীদল ষড়যন্ত্র করছে ।

সামনে ট্রানজিট ইস্যু আসছে । ভারত একটু আমাদের দেশের ওপর দিয়ে যাওয়া আসা করতে চায় – এটা এমন খারাপ কি ? বিরোধীদল এসব ইস্যুকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে কাজে লাগাচ্ছে । আর ঐ হেডমাস্টার আব্দুল লতিফ, না বুঝে আন্দোলন করছে । জনগনকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে । আর জনগন পেয়েছেটা কি তাঁর মধ্যে ? হেডমাস্টার ডাকলেই দেখি সব পিপড়ার মত চলে আসে । শ্লোগান দেয় ।

এবারের ইস্যুটা তো আরো মারাত্মক । সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে । আল্লাহর ওপর আস্থা- এই সাম্প্রদায়িক মূলনীতি তুলে দিয়ে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি সংযোজন করা হয়েছে । ঠিকই তো আছে । কিন্তু হেডমাস্টার নাকি আবার আজকে মিছিল সমাবেশ করবে । উনি নাকি বলেছেন- এটা মুসলমানের ঈমান নিয়ে খেলা । আরে বাবা- এতে ঈমানের কী হলো ? ঈমান থাকবে মনের ভিতর । সব বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র ।

আরো একটা খবর কানে এসেছে রোস্তম খানের । বিরোধীদল নাকি হেডমাস্টারকে দলে নেয়ার চেষ্টা করছে । হেডমাস্টারকে এবার নমিনেশন দিয়ে আসনটা তারা দখল করতে চায় । আর এই হেডমাস্টার দিন দিন বিপদজনক হয়ে উঠছে । উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় হেডমাস্টার বিরোধীদলের প্রার্থীকে সমর্থন দিল । অনেক কারচুপি করেও দলীয় প্রার্থীকে জেতানো গেল না ।

রোস্তম খানের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো । তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগলেন । গতকাল রাতেই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি । পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে হবে । হেডমাস্টারকে আর বাড়তে দেয়া যায় না । এভাবে চলতে থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতির কবর হয়ে যাবে এখানে । একজনকে খবর দিয়েছেন । জুম্মন গুন্ডা । এতক্ষণে সে চলে আসার কথা । তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হবে । আর বিষয়টা যেন কাকপক্ষীও না জানে । কাজ শেষ করেই সে চলে যাবে । অর্ধেক টাকা এখন পাবে । বাকি অর্ধেক কাজ সমাধা হলে ।

ড্রয়ার খুলে টাকার প্যাকেটটা দেখে নিলেন রোস্তম খান । বেশি কথা বলার দরকার পড়বে না । জুম্মন গুন্ডা পেশাদার । দলের নিজস্ব লোকও বলা যায় । তাকে দিয়ে এর আগেও দলের অনেক নেতাই কাজ করেছে । কাজ সে ভালোই করে ।

দরজায় নক হলো । রোস্তম খান দরজা খুলে জুম্মন গুন্ডাকে ভেতরে নিয়ে এলেন । এই বাসায় কেউ নাই । তাকে বোঝানো শুরু করলেন- আজ বিকেলে ওরা একটা মিছিল করবে । রাতে হেডমাস্টার তাঁর বাড়িতে থাকবে । খোঁজখবর নেয়া আছে । জানালা খোলাই থাকে । জানালা বরাবর তাঁর খাট । খাটে ঘুমন্ত অবস্থায় মাথা বরাবর দুইটা গুলি করতে হবে । বন্দুকের আওয়াজ যেন বেশি না হয় । ঠিক ঐসময় একটা ট্রাক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে বলে । দৌড়ে এসে ট্রাকে উঠলেই শেষ । সোজা ঢাকায় নিয়ে যাবে । ট্রাকের ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছে । ওদের কিছু বলতে হবে না । যা বলার আমিই বলে দিয়েছি । বাকি টাকা ট্রাকের ড্রাইভারের কাছে পেয়ে যাবে ।

জুম্মন গুন্ডা টাকার প্যাকেট নিয়ে চলে গেল ।

...........................

গভীর রাত । ডিম লাইটের নীলচে আলোয় হেডমাস্টার আব্দুল লতিফ বিএসসির মুখটা দেখা যাচ্ছে । জানালার দিকে মুখ । পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ডান কাত করে শুয়েছেন তিনি । রাতের দ্বিতীয় প্রহরের ঘুম খুব গাঢ় হয় । দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস আসছে । ওই দিকটাতে বাঁশঝাড়, বেশ কিছু আম কাঠাল ও নিম গাছ আছে । সব সময় বেশ ঠান্ডা থাকে । বাতাস পাওয়া যায় ভালোই ।

আজ বেশ ধকল গেছে হেডমাস্টার সাহেবের । বিকেলে গিয়ে দেখেন স্কুল মাঠ লোকে লোকারণ্য । স্কুল মাঠ থেকেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু হবে । মাইকের ব্যবস্থাও করেছে লোকজন । তিনি বক্তৃতা করলেন । এই বাংলাদেশ , ঈমানদার মুসলমানদের বাংলাদেশ । তিতুমীর শরীয়তুল্লার বাংলাদেশ । শাহ মখদুম খান জাহানের বাংলাদেশ । এখানে নব্বই ভাগ মানুষ ঈমানদার । এদেশের সংবিধানে ঈমানের কথা থাকতে হবে । দেশের সংবিধান থেকে ঈমানের কথা তুলে দেয়া হয়েছে । এই অন্যায় মানা যায় না । অবিলম্বে সংবিধানে ঈমানের কথা , সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমাদের বিশ্বাসের কথা পুনর্বহাল করতে হবে । হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই আমরা মিলেমিশে থাকব । সবাই যার যার ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করবে । কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন সংবিধানে থাকতে হবে ।

সমবেত মানুষজন গর্জে উঠেছিল । সাগরের ঢেউয়ের মত মিছিল শুরু হয়েছিল । প্রায় ছয় সাত কিলোমিটার মিছিলের সাথে হাঁটতে হয়েছে । পুলিশ এসেছিল বাধা দিতে । এটা একটা বদভ্যাস হয়ে গেছে ওদের । জনগনের আন্দোলনে বাধা দেয় । পুলিশ বাধা দিতে এসেছে শুনে যুবকদের অনেকেই মারমুখি হয়ে উঠেছিল । অনেক কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে । হেডমাস্টার সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে- বাংলাদেশের মানুষের ঈমানে হাত দিয়ে কেউ টিকে থাকতে পারবে না ।

রাত সোয়া দুইটা । পা টিপে টিপে বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো জুম্মন গুন্ডা । চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো । কেউ কোথাও নেই । পকেট থেকে রিভলবার বের করে চেক করলো । সব ঠিক আছে । ঠিক দুইটা বিশ মিনিটে ট্রাক এসে রাস্তায় দাঁড়ালো । সময় হয়ে গেছে ।

জানালার নিচে দাঁড়িয়ে শিক ধরে মাথাটা উঁচু করলো । হ্যা , হেডমাস্টারের মাথাটা দেখা যাচ্ছে । রিভলবার তাক করে নিশানা ঠিক করে নিল । ট্রিগারে চাপ দিয়ে বসলো জুম্মন ।

সাথে সাথেই মুখ দিয়ে আহ শব্দ বের হয়ে এলো তার । হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল জুম্মন । ট্রিগারে চাপ দেয়ার সময়ই নিচ থেকে পায়ে কামড় দিয়েছে একটা কুকুর । গায়ে সাদা কালো ডোরাকাটা । গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেছে ।

দ্বিতীয় গুলিটা করলো কুকুরটাকে । এটা আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না । গুলি লাগলো কুকুরের পেটে । নাছোড়বান্দা কুকুরটা তবু কামড়ে আছে । গুলি খেয়ে দুর্বল হয়ে গেল কুকুরটা । হাত দিয়ে কোনমতে ছুটিয়ে নিয়ে রাস্তার দিকে দৌড় লাগালো জুম্মন । কিন্তু ট্রাকের কাছে পৌঁছার আগেই আরো পাঁচ ছয়টি কুকুর কোত্থেকে এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রিভলবার । দুতিনজন লোককেও দেখা গেল লাঠি হাতে বের হয়ে এসেছে । ছুটে আসছে তারা । অবস্থা বেগতিক দেখে ট্রাক ছেড়ে দিল ড্রাইভার । মাটিতে পড়ে গিয়ে কুকুরের কামড় থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে জুম্মন ।
....................................

ঝনঝন শব্দে আয়না ভেঙ্গে পড়ায় লাফ দিয়ে উঠলেন হেডমাস্টার সাহেব । বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে । আশেপাশের বাড়ি থেকেও লোকজন জেগে উঠেছে । হইচই হচ্ছে । তিনি লাইট জ্বালিয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকালেন । ঐদিক থেকেই এসেছে গুলিটা ।

জানালার নিচে সাদাকালো চেহারাটা দেখেই চিনতে পারলেন তিনি । দুখুর নিথর শরীর পড়ে আছে । রক্তে লাল হয়ে উঠেছে তার দেহ । শিশুর মত ডুকরে কেঁদে উঠলেন আব্দুল লতিফ বিএসসি সাহেব ।

.......................................
দুখু / ১৮-০৭-২০১৩

শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৩

অমানুষ

শামীমের সামনে কেউ সিগারেট ধরাতে এখন আর সাহস করে না । অথচ দু’মাস আগেও এরকম ছিল না । শামীম বাসায় এলে স্কুলের মাঠে বন্ধুরা বসে আড্ডা দিত । বন্ধুরা একেকজন একেকরকম । স্কুলে সবাই একসাথে পড়েছে, স্কুলের কত কথা কত স্মৃতি । একসাথে কতকিছু করেছে । এখন কেউ ব্যবসা শুরু করেছে , কেউ চাকরি করছে, কেউ কেউ এখনো ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে । একমাত্র শামীমই মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিল । ডাক্তার হিসেবে বন্ধুমহলে শামীমের একটা আলাদা অবস্থান আছে । সবাই শামীমকে ভালোবাসে । শামীম একটু চুপচাপ ধরণের ছেলে হওয়ায় সবাই মনে মনে ওকে একটু সমীহ করে ।

শামীম নাকি ডাক্তারি পাশ করে হাসপাতালে ইন্টার্ণশিপ করছিল । কী নাকি ঝামেলা হয়েছে , একমাস থেকে সে বাসায় ।
কাউকে সিগারেট ধরাতে দেখলে শামীমের চোখ কেমন যেন লাল হয়ে ওঠে । রেগে গিয়ে বলে, ওই বেটা, সিগারেট ফেল । নাইলে চান্দি ফাডাই দিমু ।
বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন স্মোকার । তবে রফিক ও আসগর একটু বেশি । চেইন স্মোকার হয়ে গেছে । প্রতি ঘন্টায় একটা করে সিগারেট না ফুঁকলে ওদের চলে না ।
একটু আগে আসগর ভুলে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছিল । শামীম রেগে গেল । ঐ তুই পাইছস কি ? আবার আমার সামনে সিগারেট ধরাইছস । ক্যান, মনে থাকে না ক্যান ?
আসগর মন খারাপ করে উঠে গিয়েছিল । এখন অবশ্য আবার ফিরে এসেছে ।

কদিন আগেও শামীম এরকম ছিল না । শামীমের মত ভদ্র ছেলে ব্যাচে কমই ছিল । চুপচাপ, কথাবার্তা কম বলে । বেশিরভাগ সময় শুধু শোনে । তবে কথা কম বললেও সে সবসময় গ্রুপের বিভিন্ন পরিকল্পনায় অংশ নিত ঠিকই । সেজন্যে তাকে একেবারে আঁতেল ও বলা যেত না ।

শামীমরা বসেছে স্কুলের বারান্দায় । ডেমরার এই স্কুলটি ইদানিং বেশ নাম করছে । রেজাল্ট আগের চেয়ে অনেক ভালো করছে । শামীম, রফিক, আসগর, হেলাল, বকর , রন্টু সবার বাসা স্কুলের এক কিলোর ভেতরেই । ওরা সবাই এই স্কুলের ছাত্র ছিল । একই ব্যাচের ।
শামীম জিজ্ঞেস করলো - রন্টু , জামশেদ স্যারের খবর কিরে ?
আসগর জানালো - জামশেদ স্যার রিটায়ার করেছেন । এখন খুবই অসুস্থ । হাঁটাচলা করতে পারেন না ।

জামশেদ স্যার খুব বদরাগী ছিলেন । ক্লাসে খুব মারধোর করতেন । সপ্তাহে একদিন সবাইকে জামশেদ স্যারের পিটুনি খেতে হত । কিন্তু অবাক করার ব্যাপার ছিল- কেন যেন কেউ স্যারের ক্লাস মিস করত না । ক্লাসের বাইরে স্যার খুব ভালো । একদিন শামীম আর রফিক কী একটা কাজে শাহবাগে গেছে । হঠাৎ দেখে জামশেদ স্যার । তারা চেষ্টা করছিল কীভাবে স্যারের চোখ এড়িয়ে চলে যাওয়া যায় । কিন্তু ততক্ষণে স্যার ওদের দেখে ফেলেছেন । জামশেদ স্যার ওদের ডেকে বললেন, কিরে আমাকে দেখে পালাচ্ছিস কেন ? আমাকে ভয় লাগে তাইনা ? কী খাবি বল । আয় তোদের ফুচকা খাওয়াই ।
স্যার ওদের দুজনকে ফুচকা খাওয়ালেন । তারপর দুটো মাচো আইসক্রিম কিনে দিলেন ।

আরেকদিনের কথা কোনদিন ভোলা যাবে না । রন্টু মাথা ন্যাড়া করেছিল । সেজন্য সে একটা ক্যাপ মাথায় দিয়ে স্কুলে এসেছিল । স্যার দেখে বললেন - কিরে রন্টু , মাথায় ক্যাপ কেন ? ক্যাপ খোল । আমার সামনে ক্যাপ মাথায় দিয়ে বসে আছিস বেয়াদব ।
ক্লাসে কয়েকজন ছেলে মাথায় টুপি পড়ে আসত । ওদের একজনের দিকে আঙ্গুল তুলে রন্টু বলেছিল – স্যার , ওদেরও তো মাথায় টুপি আছে । ওদেরকে তো খুলতে বলেন না । তাহলে আমাকে বলছেন কেন ?
স্যারের কী হল কে জানে, স্যার বেত হাতে এগিয়ে এসে রন্টুকে পেটাতে লাগলেন । রন্টুটাও শক্ত হয়ে থাকলো । তেমন একটা আহা উহু পর্যন্ত করলো না । স্যার কিছুক্ষণ পিটিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলেন । পুরো ক্লাস তো থ ।
খানিক বাদে রন্টু স্যারের কাছে গিয়ে ক্যাপটা খুলে টেবিলে রাখল । হঠাৎ স্যারের পায়ে হাত দিয়ে কেঁদে ফেললো । স্যার আপনাকে অনেক ভালোবাসি স্যার । বেয়াদবি করে থাকলে মাফ করে দিবেন স্যার ।
জামশেদ স্যারও হু হু করে কেঁদে উঠলেন । জামশেদ স্যারের মত মানুষ এভাবে কেঁদে ফেলবে শামীমরা কোনদিন ভাবেনি । জামশেদ স্যারের নতুন নাম হলো ‘নারিকেল স্যার’ । নারিকেলের খোলসটা শক্ত , কিন্তু ভেতরে সুস্বাদু পানি ।

শামীম বললো- স্যারের বাসার ঠিকানা কেউ জানিস ? স্যারকে দেখতে যাবো ।

পরদিন স্যারের বাসায় গিয়ে স্যারকে দেখে আসলো শামীমরা । স্যার ওদের দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন । সবার খোজখবর নিলেন । অতীতের অনেক স্মৃতিচারণ করলেন । স্যার অনেকটা নিঃসঙ্গ মানুষ । শামীমদের পেয়ে যেন ছাড়তেই চাচ্ছিলেন না । ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল ।

রন্টু শামীমকে ছাড়লো না । বললো – দোস্ত চলনা একটু বসি কোথাও । তোর সাথে একটু আলাপ করি ।
বন্ধুদের গ্রুপের ভেতরেও শামীমের সাথে রন্টুর সম্পর্কটা একটু বেশি গভীর । নিজের অনেক কথা তারা দুজনে শেয়ার করে । মনের কথা ।
শামীমের আচরণ নিয়ে রন্টু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল । শামীম একমাসের মত বাসায় বসে আছে । প্রথমে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোন বড় ধরণের কারণ আছে ।
ওরা দুজনে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে একটা দেয়ালের ওপর বসলো । এই দিকটাতে অনেকেই প্লট কিনে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে ।
শামীম বুঝতে পারছিল রন্টু কী জানতে চায় । কিছু কিছু সময় কেউ কিছু না বললেও সবকিছু স্পষ্ট টের পাওয়া যায় ।

.................................

শামীম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে নতুন একটা পরিবেশ পেয়েছিল । অনেক বড় হোস্টেল । একসাথে কত ছেলে থাকে । হোস্টেলের ভেতরেই মসজিদ, ক্যান্টিন , রিডিং রুম , লাইব্রেরি , কমন রুম । হোস্টেলের সামনে ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট, ভলিবলও খেলা যায় । শর্টপিচ ক্রিকেটও খেলা যায় । ক্রিকেট অবশ্য হোস্টেলের করিডোরেই খেলত ওরা । বল তিনতলা থেকে নিচে পড়লেই আউট । সবসময় একটা আনন্দমুখর পরিবেশ । হোস্টেলের ছাদটা শামীমের খুব প্রিয় জায়গা ছিল । বিকেলে এবং রাতে একবার করে ছাদে ওঠাটা তার রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল । পুর্ণিমা রাতগুলো যেন শামীমের হৃদয়টা শুন্য করে দিয়ে যেত । ঘণ্টার পর ঘন্টা ছাদে শুয়ে কাটিয়ে দিত শামীম আকাশের দিকে তাকিয়ে । হোস্টেলের পাশের কিছু গাছে হুতুমপেঁচা এসে বসতো । হুতুমপেঁচার ডাকে গা ছমছম করে উঠতো । কিন্তু হুতুমপেঁচা না ডাকলে ভালোও লাগত না ।

সবকিছুই ভালো, শুধু একটা বিষয় শামীমের খারাপ লাগত । ছাত্রদের মধ্যে কত বিভেদ । রাজনীতির কারণে হোস্টেলের এত সুন্দর পরিবেশ মাঝে মাঝে বিষাক্ত হয়ে ওঠে । ছাত্ররা মারামারি করে । একদল আরেকদলের ওপর অত্যাচার করে । বই-পুস্তক কাপড়-চোপড় পুড়িয়ে দেয় । সরকারদলীয় সংগঠনের ছেলেরাই বেশি অত্যাচার করে । বিরোধী দলের ছেলেরা মার খায় ।

অনেক সংগঠন আছে । কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, কেউ ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলে, কেউ সমাজতন্ত্রের কথা বলে, কেউ বলে রাজনীতির দরকার নাই- নামাজ রোজা করবো, সরকারের কথামত চলবো । ব্যস । দুনিয়া আখেরাত উভয় জায়গাতেই সুবিধা ।
শামীম সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে । কথা ও কাজে মিল দেখে । সালভাদর আলেন্দে পাঠাগার থেকে বই নিয়ে কম্যুনিস্টদের তত্ব পড়ে । আবার ইসলামপন্থিদের পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়ে । নিজের মত করে দুইটার ভেতর পার্থক্য করার চেষ্টা করে । কোনটা সঠিক বোঝার চেষ্টা করে । বই নিয়ে সহপাঠি, সিনিয়র দুএকজনের সাথে মাঝে মাঝে আলোচনা হয় ।

শামীম দেখে – যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে তাদের কোন সাহিত্য নাই । এরা সুবিধাবাদী । সরকারের পক্ষে কথা বলে সুবিধা নেয়াই উদ্দেশ্য । চাঁদাবাজি, মাদকাসক্তি, লবিং করে পাস করা এসবই তাদের কাজ । আবার সরকার পরিবর্তন হলে এদের চেতনা উলটে যায় ।
সেই তুলনায় কম্যুনিস্ট এবং ইসলামপন্থিদের চিন্তাধারা অনেক উন্নত । তাদের একটা সুনির্দিস্ট আদর্শ আছে । আচার ব্যবহারের দিক থেকেও তারা উন্নত ।

মুসলিম হিসেবে এমনিতেই ইসলামকে পুর্নাংগ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে জানতো শামীম । কিন্তু ইসলামের অর্থনৈতিক সমাধান, রাজনৈতিক কাঠামো , সামাজিক শৃংখলার বিধান এইসব বিষয় নিয়ে খুব একটা ধারণা ছিল না । বই পড়ে পড়ে সেসব বিষয় সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়তে লাগলো । কার্ল মার্ক্সের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার চেয়ে ইসলামের সমাধান তার কাছে মনে হলো বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ । একজন মুসলিম হিসেবে গর্ব করার মত মানসিকতা তৈরি হল ধীরে ধীরে । স্থায়ী শান্তির জন্য ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ থাকলো না । স্বাভাবিকভাবেই মনে মনে ইসলামপন্থী সংগঠনের প্রতি সমর্থন তৈরি হলো তার ।

রাজনৈতিক ভাবে সে ততটা সক্রিয় হয় নাই । মাঝে মাঝ দুয়েকটা মিছিলে – র্যা লিতে গেছে । পেছনে থেকেছে । এতটুকু সমর্থন না দিলে ঈমান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হত তার ।

পাঁচ বছরের ক্যাম্পাস লাইফে কখনো কারো সাথে ঝগড়া ঝাটি তো দূরে থাক, কটু কথাও বলে নি শামীম । সিনিয়র জুনিয়র সবার কাছে সে ছিল একজন শ্রদ্ধার পাত্র । নিরীহ, ভদ্র, শান্তশিষ্ট ছাত্র হিসেবে সবাই তাকে ভালবাসত ।

একসময় পাস করে ইন্টার্ণশিপ শুরু করে শামীম । এদিকে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ও সরকারী বাহিনীর ব্যাপক অত্যাচারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ক্যাম্পাসের ইসলামপন্থি সংগঠনটি । তারা ক্যাম্পাস ছাড়া হয় । ডাক্তার হিসেবে শামীম হাসপাতালে দায়িত্ব পালন চালিয়ে যেতে থাকে । হোস্টেলে সে আর থাকে না । তিন-চারজন ডাক্তার মিলে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে । ব্যাচেলর ডাক্তার ।

সেদিন ইভেনিং শিফটে ডিউটি ছিল শামীমের । ডিউটি শেষ করে মোবাইলটা অন করেছে । ডিউটিতে এত চাপ থাকে –রোগীর ভিড় । মোবাইল খোলা রাখলে ঝামেলা হয়ে যায় । মোবাইলটা অন করেছে ফেসবুকে একটু ঢুঁ মারবে । এরই মাঝে এক বন্ধু কল দিল । কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামলো শামীম । লবিতে নেমেছে , এমন সময় সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা , দুইজন শামীমেরই ব্যাচমেট শামীমকে ধরে ফেললো । সোহেল এবং মফিজ । মোবাইলটা কেড়ে নিল । তাকে টেনে নিয়ে গেল ক্যাম্পাসের একটা অন্ধকার কোণে ।

রাজাকার, মৌলবাদী , ছাগল এগুলো সহ অনেক অকথ্য অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো । লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগলো । একজন এসে দাড়ি ধরে বললো – ‘শালা ছাগলের মত দাড়ি রাখছে, পুরাই ছাগু’ ।
ইট দিয়ে মুখেও মারলো তারা, লাঠি দিয়ে গুতা দিল । নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল- দাড়িওয়ালা ছাগু পিটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করছিল ওরা ।

শামীম দাতে দাঁত চেপে সহ্য করার চেষ্টা করেছিলো । সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা । মাথা ঘুরছে । দুপুরে বাসায় খেয়ে এসেছিল হাসপাতালের ওয়ার্ডে । আট ঘণ্টা কিছু খায় নি । একের পর এক রোগী এসেছিল সেদিন । ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে করতে নাস্তা করারও সুযোগ হয়নি । ক্ষুধায় এমনিতেই শরীর নেতিয়ে আসছিল ।

জুনিয়র ব্যাচের একজন হিন্দু ছাত্র, সেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে এলো জ্বলন্ত সিগারেট হাতে । দুজন মিলে জাপ্টে ধরে রাখলো শামীমকে দেয়ালের সাথে । সিগারেটের আগুন এগিয়ে আসতে লাগলো শামীমের চোখের সামনে । শামীম চোখ বন্ধ করলো । ধীরে ধীরে গালের ওপর চেপে বসলো আগুন । শামীমের সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে কেঁপে উঠলো

কথা বলতে বলতে শামীমের গলা ভারী হয়ে আসে । রন্টুর চোখে পানি । এতক্ষণ সে বাকরুদ্ধ হয়ে শুনছিল প্রিয় বন্ধুর ওপর অত্যাচারের কাহিনী । আকাশে চাঁদ উঠেছে । চাঁদের আলো এসে পড়েছে শামীমের মুখে । অস্পষ্ট আলোতেও শামীমের মুখের কালচে দাগটা স্পষ্ট দেখতে পেল রন্টু । আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে দুজনেই চুপচাপ বসে রইলো ।

একটু পরে শামীম নীরবতা ভেঙ্গে ধরা গলায় বলতে লাগলো- দোস্ত, এখন কারো মুখে সিগারেট দেখলে সেই দৃশ্যটা চোখে ভাসে । সহ্য করতে পারিনা । মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে । একদিন আমি ওদের গালেও সিগারেটের ছ্যাকা দেব । বুঝিয়ে দেব, কেমন লাগে ।

........................

একবছর পর ।
শামীম আবার হাসপাতালে কাজে যোগ দিয়েছে । রোগীদের সেবা করে যাচ্ছে পরম মমতায় । সরকার পরিবর্তন হয়েছে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সৈনিকরা এখন চেতনা ভুলে গেছে । অনেকেই ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছে ।

শামীম নাইট ডিউটিতে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ঢুকেছে , একজন জুনিয়র খবর দিল- ভাইয়া, বিজয় কুমারকে পাওয়া গেছে । ঐযে আপনাকে মেরে সিগারেটের ছ্যাকা দিয়েছিল । সে গোপনে ক্যাম্পাসে ঢুকেছে লিয়াজো করার জন্য । যেখানে আপনাকে মেরেছিল, সেখানেই ওকে নিয়ে গেছে জুনিয়ররা ।
শামীম যন্ত্রচালিতের মত সেদিকে এগিয়ে চললো । তার মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণাটা ফিরে এলো । মুখের কালো দাগটা এখনো আছে । নিজের অজান্তে হাতটা চলে গেল সেখানে । ব্যাগের পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল, সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা ঠিকমত আছে কিনা । শামীম তার ব্যাগে সবসময় একটা লাইটার আর এক প্যাকেট সিগারেট রাখে । একদিন এটা কাজে লাগাবে । হয়তো আজই সেই দিন ।

শামীম গিয়ে দেখে সেই সন্ত্রাসীটাকে জুনিয়ররা ঘিরে রেখেছে । চড় থাপ্পড় মারছে । সে সবার পায়ে পড়ে মাফ চাচ্ছে ।
শামীমকে দেখে সে কেঁদে উঠলো । শামীম ভাই, আমারে মাফ কৈরা দেন ।
একজন বললো , তখন মনে আছিলো না ? শামীম ভাইর মত মানুষকে তুই সিগারেটের ছ্যাকা দিছিলি । এই ছিল তোদের মুক্তিযুদ্ধ ? দশজনে মিলে একজনরে ধইরা আইনা খুব মুক্তিযুদ্ধ করছিলি না ? তোরা মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করেছিস ।
মুক্তিযুদ্ধ হইছিল অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে । আর তোরা মুক্তিযুদ্ধের নাম বেইচ্যা জুলুম অত্যাচার করছিস ।
শামীমের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে । চোখ লাল হয়ে উঠছে । লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়েছে । এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী বিজয় কুমারের মুখের দিকে । ঠিক যেভাবে সে একদিন সিগারেটের আগুন এগিয়ে এনেছিল শামীমের মুখের দিকে । দৃশ্যটা শামীম এখনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ।

জ্বলন্ত সিগারেট বিজয় কুমারের মুখের সামনে নিয়ে থেমে গেল শামীম । এক মুহুর্ত চিন্তা করলো সে । তারপর সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিল ।
মুখটা বিকৃত করে উচ্চারণ করলো – কুত্তার বাচ্চা কুত্তা ।

শামীম উঠে দাঁড়ালো । এ কাজ সে করতে পারবে না । তার মনে হলো- এই শয়তানটার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার , এর মুখে সিগারেটের ছ্যাকা দেয়াই দরকার । কিন্তু শামীমের পক্ষে সেটা সম্ভব নয় । এই শয়তানটা সেই কাজটা করেছিল । আসলে এদের মত অমানুষ শয়তান ছাড়া আর কেউ এমন কাজ করতে পারে না ।

....................................
অমানুষ / ১৩-০৭-২০১৩

বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৩

খাটাশ


মাসুম যখন নানাবাড়ির গ্রামে পৌঁছল , তখন সেখানে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গিয়েছে । নানাবাড়ির উঠানে বিশাল জটলা । এলাকার বাচ্চা-কাচ্চা –কিশোরদের সংখ্যাই বেশি । ছোটমামা আছেন , আর কয়েকজন অপরিচিত লোককে দেখা যাচ্ছে ।

একটা মাদী খাটাশ ধরা পড়েছিল ধানক্ষেত থেকে । ছেলেপেলেরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে । সেটাও সমস্যা ছিল না । মেরে ফেলার ঘণ্টাখানেক পরে ধানক্ষেতে তিনটি খাটাশের বাচ্চা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে । বাচ্চাগুলিকে কেউ মারেনি, ধরে নিয়ে আসে মৃত খাটাশটার কাছে । বাচ্চাগুলো ক্ষুধার্ত ছিল । মৃত মা খাটাশের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে বাচ্চা তিনটি । এতে এক করুণ দৃশ্য সৃষ্টি হয় । যারা খাটাশটাকে পিটিয়ে মেরে এতক্ষণ বাহাদুরি করছিল, তাদেরও খারাপ লাগে । আহা , বাচ্চাগুলোর এখন কী হবে ? বাচ্চাগুলো দেখতে বিড়ালের বাচ্চার কাছাকাছি । দেখে আদর করতে ইচ্ছে করে । লোকেরা ভেবে পায় না, খাটাশের বাচ্চা সুন্দর হবে কেন ?

খবর পেয়ে স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক এসেছেন দুজন । দৈনিক ঝিনাইদহ বার্তার  আবিদুর রহমান, দৈনিক মেঘনার আব্দুল হক । তারা ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন ।  বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কী করা যায় ? সাংবাদিকদের সাথে পরামর্শ করে উপজেলা পশুসম্পদ কার্যালয়ে খবর দিয়েছিলেন মামা । উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা দুজন কর্মচারিকে নিয়ে চলে এসেছেন ।   সিদ্ধান্ত হয়েছে, খাটাশের মৃতদেহটাকে মাটিতে পুতে ফেলা হবে , আর বাচ্চাগুলোকে তিনি নিয়ে যাবেন । চিড়িয়াখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন তিনি ।

গ্রামের মানুষজন খাটাশটার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল । প্রায়ই এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে হাঁস, মুরগী, কবুতর ধরে নিয়ে যাচ্ছিল খাটাশ । মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও জঙ্গলের আশপাশ থেকে মুরগীর বাচ্চা ধরে নিয়ে যেত । নানাবাড়ির পশ্চিম পাশে একটা জংলা বাশবাগান আছে । সবাই ভেবেছিল ওখানেই হয়তো আছে খাটাশটা । একদিন ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে অভিযানে নেমেছিল , কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজে জংলায় গর্ত পাওয়া গেলেও খাটাশটাকে পাওয়া যায়নি । জংলার পাশেই ধানক্ষেত । এতদিনে রহস্য উদ্ধার হলো । খাটাশটা একজায়গায় থাকতো না । কয়েক জায়গায় থাকতো । বাচ্চাদের জন্য হয়তো ধানক্ষেতের গর্তকেই নিরাপদ ভেবেছিল । কিন্তু দুর্ভাগ্য । সকালবেলা কামলারা ধান কাটতে নামলে গর্তটা একজনের চোখে পড়ে । সবাই মিলে কাস্তে, বস্তা হাতে গর্তটার চারপাশে ঘিরে ফেলে । খাটাশটা বিপদ টের পেয়ে হঠাৎ বের হয়ে দৌড় দেয় । প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু একজনের ছুড়ে মারা কাস্তে পায়ে লাগায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে । ধরে বস্তায় ঢুকানো হয় তাকে ।

খবর পেয়ে অনেকেই আসে । ‘তুই আমরার মুরগী খাইছিস’ , ‘হাঁস খাইছিস’ বলে পেটাতে থাকে । বস্তার ভেতরেই মৃত্যু হয় খাটাশটার ।

রিক্সা থেকে নেমে মাসুম জটলা ভেঙ্গে ভেতরে যায় । মামার সাথে কথা বলে । মাসুমের সাথে ওর আম্মাও এসেছে । আম্মা বাড়িতে ঢুকে গেছেন । মামা অবশ্য আগে থেকেই জানতেন । মাসুম ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুলে নেয় । তারও খারাপ লাগে । যদিও খাটাশ জাতের ওপর ওর রাগও কম নয় ।

উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা  সবার উদ্দেশে বক্তৃতা করা শুরু করলেন । তিনি বললেন, আপনারা যে খাটাশটা মেরে ফেলেছেন, এর নাম গন্ধগোকুল । এরা ছোট খাটাশ । এই প্রজাতির খাটাশ এখন বিলুপ্তির পথে । আগের মত এদেরকে দেখা যায় না । অল্প যে দুয়েকটা কোনমতে বেঁচে আছে সেগুলোও ঝুঁকির মুখে । মাঝে মাঝে মানুষজন এদের মেরে ফেলে । অথচ এরা নিরীহ প্রাণী । খাদ্যের অভাবে তারা মাঝে মাঝে হাঁস মুরগী চুরি করে ।
এরপরে যদি কখনো খাটাশ ধরেন , দয়া করে মেরে ফেলবেন না । আমাদের খবর দিলে আমরা নিয়ে যাব । অথবা আমাদের কার্যালয়ে পৌঁছে দেবেন ।

মাসুম যখন ছোট , ক্লাস ওয়ানে পড়ে তখন মামা তাকে একটা টিয়া পাখি উপহার দিয়েছিলেন ।  মাসুমরা শহরে থাকে । টিয়াপাখিটা ছিল মাসুমের সর্বক্ষণের সঙ্গী । স্কুলে যাবার আগে, স্কুল থেকে ফিরে টিয়াপাখিটাকে খাবার দিত, টিয়ার খাচা পরিষ্কার করতো, টিয়ার সাথে কথা বলতো । টিয়া পাখিটাকে মামা যখন দিয়েছিলেন, তখন সেটা কথা বলতে পারতো না । একবছর পরে দেখা গেল টিয়াটা মাসুমের সাথে কথা বলে । বাসায় কেউ আসলে বলে ওঠে ‘আসসালামু আলাইকুম’ । ছোট ছোট ছড়াও বলতে পারে ।

আতা গাছে তোতা পাখি ,
ডালিম গাছে মৌ ।
এত ডাকি তবু কথা
কয়না কেন বৌ ?

মৌমাছি মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াওনা একবার ভাই 
ঐ ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় যে নাই !

বাসায় কোন মেহমান এলে মাসুম টিয়ার ছড়া শোনাত । মাসুম এক লাইন বলে টিয়ার দিকে তাকালে টিয়া শুরু করত । অস্পষ্ট কথাগুলি মাসুম মেহমানকে বুঝিয়ে দিত । মেহমানরা মাসুমের টিয়ার খুব প্রশংসা করতেন ।

ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে নানাবাড়ি এসেছিল মাসুম । টিয়া ছাড়া কি সে থাকতে পারে ? টিয়ার খাঁচাটাও কোলে করে নিয়ে এসেছিল । টিয়ার কথা শুনে নানাবাড়ির সবাই তো মুগ্ধ । পাড়ার সব ছেলেমেয়ে টিয়ার ছড়া শুনতে এসেছিল । সবার মুখে মুখে মাসুমের টিয়ার প্রশংসা । মাসুম খুশিতে বাগবাগ ।

মাসুমের মনে পড়ে, নানী আঙ্গিনায় বসে গল্প বলা শুরু করেছিলেন । টুনটুনি ও রাজার গল্প । এক দেশে ছিল এক রাজা । রাজার নাম কাক্কাবোক্কা । রাজার অনেক ধন । রাজার কোষাগারে সোনার মোহরের স্তুপ । রাজা তাঁর মন্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই মোহর গুলো গুনতেন । একদিন দেখলেন, মোহরগুলো ময়লা হয়ে গেছে । ধুয়ে শুকোতে দিয়ে হবে ।
রাজার ছাদে উজ্জ্বল আলো দেখে এগিয়ে যায় টুনটুনি । মোহরগুলো বস্তায় ভরে নেয়ার সময় একটা মোহর ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়ে । টুনটুনি সেটি নিজের বাসায় নিয়ে যায় ।
টুনটুনি ছড়া কাটে-

রাজার ঘরে যে ধন আছে ,
টুনির ঘরেও সে ধন আছে ।
রাজার ঘরে যে ধন আছে,
টুনির ঘরেও সে ধন আছে ।

রাজার পেয়াদা শুনতে পেয়ে রাজার কাছে নালিশ করে ।
রাজার হুকুমে টুনটুনির বাসা থেকে মোহরটা নিয়ে যায় পেয়াদারা । টুনটুনি তখন নতুন ছড়া বানায়-

রাজা বড় ধনে কাতর,
টুনির ধন নিল ঘরের ভিতর ।
রাজা বড় ধনে কাতর,
টুনির ধন নিলো ঘরের ভিতর...

বাচ্চারা সুলতানা বিবিয়ানা খেলছিল । টুনটুনি তাদেরকে নতুন ছড়াটি শিখিয়ে দেয়......

গুল্প শুনতে শুনতে নানীর কোলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মাসুম জানে না । টিয়ার খাঁচাটা কেউ একজন ঘরে ঢুকিয়ে রেখেছিল । সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে টিয়া নেই । টিয়ার পালক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘরের ভেতর । খাঁচার দরজাটা রাতে বন্ধ করা হয়নি । খাটাশে নিয়ে গেছে মাসুমের টিয়া । মাসুম সকালে কিছু খায়নি । সারাদিন কেদেছিল । মামা বারবার বলেছিলেন , বাবা এর চেয়ে সুন্দর টিয়া তোকে কিনে দেব । কাঁদিস না । কিন্তু কিছুতেই মাসুমের কান্না থামেনা ।
ঐ টিয়াটির কথা মনে পড়লে আজও মাসুমের কান্না আসে ।

মামা ঠিকই আরেকটি টিয়া কিনে দিয়েছিলেন । সেটিও কথা বলা শিখেছিল , কিন্তু আগেরটার মত হয় নি । মাসুম যখন ক্লাস সেভেনে, তখন টিয়াটি অসুখে মারা গিয়েছিল ।
আজ যে খাটাশটা মারা হয়েছে , হতে পারে এই সেই । কে জানে !
........................

নানী আজ আর বেঁচে নেই । মামাবাড়ির পেছনে পারিবারিক কবরস্থানে শুয়ে আছেন তিনি । অনেকদিন পর এবার মামাবাড়ি এলো মাসুম । আম্মা খুব জোড়াজুড়ি করছিলেন । মাসুমেরও ইচ্ছা হলো আত্মীয়দের বাড়িতে একবার ঘুরে আসতে । বিশেষ করে নানা নানীর কবরটা জিয়ারত করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল । মাসুম এখন একজন তরুণ ডাক্তার । ডাক্তার হওয়ার পর একবার যদি মামা খালাদের বাড়িতে না যাওয়া হয় – কে কী ভাববে ?

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে । মাগরিবের নামাজ পড়ে ল্যাপটপ খুলে বসেছে মাসুম । মোবাইলের বদৌলতে এখন গ্রামেও ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় । মাসুম খাটাশটার ছবি আপ্লোড করেছে । অনেকেই কমেন্ট করছে । কিরে তুই কই ? এইটা তুই মারছোস ? কেউ লিখেছে- তুই এত নিষ্ঠুর ? আহা । কেউ কেউ লিখেছে- খাটাশটা মারছে ভালোই হইছে !
মাসুম কমেন্টগুলোর উত্তর দিচ্ছিলো । আম্মা এসে বললেন , ড্রয়িং রুমে আয় । তোর মামার বন্ধু এসেছে , তোকে দেখতে চায় । চুলটুল একটু ভালো করে আঁচড়িয়ে আসবি ।

মাসুম একটা হাফ শার্ট পড়ে , আয়নায় একটু মুখটা দেখে চুল আঁচড়িয়ে নিলো । ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে আম্মা, মামা, মামী, মামার বন্ধু এবং একজন তরুণী বসে আছে । সবাই গল্প করছিলেন । মাসুম সালাম দিল । আম্মা এবং মামার মাঝখানে বসলো । সে একটু ইতস্তত করছিল । মামা তাকে টেনে বসালেন ।

মাসুমের হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন মামা । ‘আমার বন্ধুর সাথে যে মেয়েকে দেখছিস, ওর সাথে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে । ভালো করে দেখে নে’ ।
মাসুমের বুকটা ধ্বক করে উঠলো । সে এরকম পরিস্থিতিতে পড়বে- কল্পনাও করেনি ।

মামার সাথে মাসুমের সম্পর্ক অনেক খোলামেলা । মামা অনেক দেরিতে বিয়ে করেছিলেন । ওদিকে মামার বন্ধু, যার মেয়ে এখন মাসুমের সামনে বসে আছে- তিনি অল্পবয়সেই বিয়ে করেছিলেন ।

মামা এবার একটু আনুষ্ঠানিকভাবেই বললেন , ‘মা রিয়া, এ হচ্ছে আমার ভাগ্নে মাসুম । ডাক্তারি পাশ করেছে’ ।
আর মাসুম, ও হচ্ছে রিয়া, আমার দোস্তের বড় মেয়ে । কেসি কলেজে অনার্স পড়ছে । কোন সাবজেক্ট যেন মা ?’
মাসুম ও রিয়া দুজনে চোখ তুলে একে অপরের দিকে তাকালো । চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের । কিছুক্ষণ কেউই চোখ নামালো না । রিয়া কী ভাবছিল কে জানে, কিন্তু মাসুমের মনে হলো , হৈমন্তী গল্পের নায়কের মত ‘পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম’ ।

মাসুম আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল , হারানো টিয়াপাখির স্মরণে সে তার বউকে টিয়া বলে ডাকবে । মাসুমের বুকের ভেতর যেন ঢাকঢোল বাজতে লাগলো - ‘টিয়া, আমার টিয়া !’

আম্মা মামার বন্ধুকে বললেন, ‘আমার মাসুমকে আমি যা বলবো ও তাই করবে । রিয়া মাকে আমার খুব ভালো লেগেছে । ভাইসাহেব, মাসুমকে আপনাদের পছন্দ হয়েছে কিনা, কবে কখন কীভাবে কী করা যায় আমার ভাইয়ের সাথে আলাপ করবেন’ ।
মাসুম তুই এখন যা ।

মাসুম ভেবেছিল , রিয়ার দিকে আর তাকাবে না । কিন্তু উঠতে উঠতে কেন যেন  আরো একবার চোখাচোখি হয়েই গেল !

........................
খাটাশ / ১০-০৭-২০১৩ 

মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০১৩

উড়ে যায় হংসপক্ষী


সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির দিকে প্যাডেল চালালো  অপু । যতই বাড়ির কাছাকাছি হতে লাগলো, ততই তার চোখ ঝাপসা হতে লাগলো । বাড়ি থেকে আধা কিলো উত্তরে রাস্তার পাশে বিল । চারধারে উঁচু করে বাধানো । একপাশে একটা বাঁশের সাঁকো আছে । পশ্চিমের রাস্তায় উঠতে হলে সাঁকোটা পার হতে হয় ।

চোখ বেয়ে অশ্রুবিন্দু গালের ওপর এসে পড়েছে ।  অপু সাইকেল থেকে নেমে পড়লো । সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বাঁশের সাকোর একপাশে স্ট্যান্ড করিয়ে রাখলো । পা ঝুলিয়ে বসলো সাঁকোর ওপর । এখন সুর্য পাটে নেমে গেছে । পাখিগুলো যার যার নীড়ে ফিরে যাচ্ছে । মা পাখি বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে ।

শুন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো অপু । এই গ্রাম, এই সাঁকো । কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে ।

অপু তাদের গ্রামের স্কুলে পড়তো । বাড়িতে মা ওকে পড়াতেন । প্রথম থেকেই অপু ভালো রেজাল্ট করতে লাগলো । ক্লাস ফাইভে বৃত্তিও পেল । অপু হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলো ।  যেদিন বৃত্তির রেজাল্ট হলো, সে তখন স্কুলে । বিকালে ফিরে এসে দেখে আঙ্গিনায় একটা লাল টুকটুকে সাইকেল । মা এসে অপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন , আর বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলেন ।
সাইকেলটা হাতে ধরিয়ে মা বলেছিলেন, ‘বাবা সোনা, এই সাইকেলটা তোর জন্য কিনেছি । তোর পছন্দ হয়েছে ?’  অপু সাইকেলটা খুঁটে খুঁটে দেখেছিল । সাইকেলের নাম  ‘হিরো’ ।
একবছর ধরে টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন মা । সকালে অপুর বৃত্তির রেজাল্ট শুনেই সাইকেল কেনার ব্যবস্থা করেন ।

সাইকেল পেয়ে অপুর খুশি আর ধরে না । সাইকেল চালানো সে আগেই শিখেছিল ইলিয়াস চাচার কাছে । চাচার একটা ফোনিক্স সাইকেল আছে । ইলিয়াস চাচা অপুকে খুব আদর করেন । অপু যখন ছোট্ট ছিল তখন থেকেই ইলিয়াস চাচা বিকেলে সাইকেলে করে অপুকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন । ধানক্ষেত, বিল, নদী , নদীর ওপর বেইলি ব্রিজ এইসব দেখিয়ে আনতেন । অপু কান্নাকাটি করলে তার একমাত্র অষুধ ছিল ইলিয়াস চাচার সাইকেল । সাইকেলে চড়িয়ে ঘুরিয়ে আনলেই অপু শান্ত হয়ে যেত ।

একবছর অপু ইলিয়াস চাচার কান ঝালাপালা করে দিয়েছিল । ‘চাচা আমি সাইকেল চালাবো’ । চাচা বলেন, বাবা আরেকটু বড় হও । অপুর জেদাজেদিতে ইলিয়াস চাচা তাকে সাইকেল চালানো শেখাতে বাধ্য হন । চাচা পেছনে ক্যারিয়ার ধরে রাখেন , অপু ‘হাফ প্যাডেল’ মারে । চাচা মাঝে মাঝে হাত ছেড়ে দেন , অপুর সাইকেল কাত হয়ে গেলে আবার ধরে ফেলেন । ধীরে ধীরে অপু শিখে ফেলে । কিন্তু ইলিয়াস চাচার সাইকেল অনেক বড় । হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে হয় অপুকে ।
 সাইকেলের  ত্রিভুজাকৃতি ফ্রেমের ভেতর প্যাডেল চালাত অপু । হ্যান্ডেলের নিচ দিয়ে সামনে তাকাতে হত ।

মায়ের দেয়া ছোট সাইকেল অপুর হাতে যেন পুরো পৃথিবী । এখন সে সাইকেলের সিটে বসে চালাবে । সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাবে । স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে যাবে । ওদের কয়েকটা ধানী জমি ছিল বেশ দূরে । সেগুলোও দেখতে যেতে পারবে ।
বিকেলে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ঢোকার আগে অপু বাঁশের সাঁকোটার ওপর এসে বসতো । সাঁকোটা খুব সরু । দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটতেও কষ্ট হয় । অপুর মাথায় খেয়াল চাপে একদিন সাইকেলে চড়েই সাঁকোটা পার হতে হবে ।
স্কুল থেকে ফিরে সাঁকো পার হবার প্র্যাকটিস করতে শুরু করলো অপু । প্রথমে সে মাঠের সরু আইল ধরে চালানো শুরু করলো । বেশ কিছুদিন চালিয়ে যখন মোটামুটি সাহস হয়ে গেল , একদিন বিকেলবেলা সাইকেল নিয়ে এসে দাঁড়ালো সাঁকোর কাছে । আশেপাশে কেউ নেই দেখে দু-তিনশ গজ দূর থেকে সাইকেলে উঠে গতি বাড়িয়ে নিলো । নিঃশ্বাস বন্ধ করে সাইকেল তুলে দিল সাঁকোর ওপর । সাঁকো দুলতে লাগলো ।  সাইকেল লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো । তিনভাগের দুইভাগ পার হয়েছে এমন সময় সামনের চাকাটা স্লিপ করে গেল । টাল সামলাতে পারেনি অপু । সাইকেল সহ পড়ে গিয়েছিল খালের পানিতে ।

.......................................

অপু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল । জ্ঞান ফিরলে দেখে সে হাসপাতালে । তার হাতে পায়ে বেশ কয়েকটা ব্যান্ডেজ । কান্না ভেজা চোখে মা বসে আছেন মাথার কাছে । ওকে চোখ খুলতে দেখেই মা কেঁদে উঠলেন । আমার বাবা, আমার সোনা । বাবা আমার, এখন কেমন লাগছে বাবা ? ব্যথা করছে ? সব দোষ আমার, আমি কেন তোকে সাইকেল কিনে দিলাম ?’
অপু জিজ্ঞেস করলো, ‘মা, আমার সাইকেল কোথায় ? সাইকেলটা ঠিক আছে তো ?’
ইলিয়াস চাচা এসে ঢুকলেন রুমে । বললেন, তোর সাইকেলের রিং বাঁকা হয়ে গেছে । চিন্তা করিস না , আমি ঠিক করে দেবো ।
অপু যখন সাঁকো থেকে পড়ে যায় , ইলিয়াস চাচা তখন মূল রাস্তা ধরে বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন । হঠাৎ সাঁকোর দিক থেকে শব্দ শুনে তিনি এগিয়ে এসে দেখেন অপু পড়ে গেছে । তিনি তাড়াতাড়ি খালের পানিতে লাফ দিয়ে অপুকে উদ্ধার করেন ।
সেবার অপুর বাম হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল । প্রায় দুইমাস তাকে ঘরে বসে থাকতে হয়েছিল ।

সাঁকোর ওপর বসে মায়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো অপুর । মা কেন এভাবে চলে গেল ?
অপু ক্লাস এইটেও বৃত্তি পেয়েছিল । প্রাইমারিতে সাধারণ গ্রেডে পেলেও জুনিয়র বৃত্তিতে ট্যালেন্টপুল পেয়েছিল । ভালোয় ভালোয় এসএসসি পরীক্ষাও দিল । এসএসসি পরীক্ষার শেষদিকে মায়ের শরীরটা কেমন শুকনো শুকনো হয়ে যেতে লাগলো । মা প্রতিদিন পরীক্ষা দিতে যাবার আগে নিজ হাতে অপুকে দুধভাত খাইয়ে দিতেন । অপু জিজ্ঞেস করে – তোমাকে এমন শুকনো লাগছে কেন মা ? মা বলেন, ও নিয়ে তুই চিন্তা করিস না বাবা । আমি ভালো আছি । তুই ভালো করে পরীক্ষা দে । এ প্লাস পেতে  হবে কিন্তু ।
অপু বলেছিল, তোমার দোয়া থাকলে এ প্লাস আমি পাবোই মা ।
কে জানতো, জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে ! শুন্য হয়ে যাবে । মায়ের শরীর আরো খারাপ হতে লাগলো । একদিন বাবাসহ মাকে নিয়ে উপজেলা হাসপাতালে গেল অপুরা । ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন । সেগুলো করানোর পর ডাক্তার পরামর্শ দিলেন বড় হাসপাতালে নেয়ার । এখানে কিছু করার নেই ।

মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেল অপু ও বাবা । সেখানে আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা হল । ডাক্তারের সাথে কথা বলে বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন । বাবার মুখ শুকিয়ে গেল । অপু জিজ্ঞেস করে – বাবা, কী হয়েছে মার ?
বাবা বলেন, কিছু হয়নি বাবা । সামান্য অসুখ । কদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে ।
বাবার চোখ ছলছল করে । অপুর কাছে তিনি আড়াল করেন ।

মাকে নিয়ে ঢাকায় গেল ওরা । বাবা তাঁর মুদি দোকান বিক্রি করে দিলেন । ধানী জমি বিক্রি করে দিলেন । চিকিৎসা চলতে লাগলো । কিন্তু মায়ের অবস্থা আরো খারাপের দিকেই যেতে লাগলো । মাথার চুল পড়ে গেল । সুন্দর গোলগাল মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে চুপসে গেছে ।

অপু সবসময় মায়ের কাছে বসে থাকে । মায়ের কাপড় চোপড় ধুয়ে দেয় । খাবার খাইয়ে দেয় । কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে । মা বলেন, কিচ্ছু লাগবে না বাপ । তুইই আমার সব । তুই কাছে থাকলে আমার আর কিচ্ছু লাগবে না । অপুর মন খারাপ দেখে সবসময় বলেন, বাবা দেখিস, আমি কিছুদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবো । তোকে ছাড়া কি আমি থাকতে পারি ?
অপুর মন মানে না । মাঝে মাঝে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে । নামাজ পড়ে দোয়া করে । চোখ মুছে মায়ের কাছে ফিরে আসে ।

মা কথা রাখেন নি । অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল । বাবা আর গোপন করেন নি । অপুকে বলে দিয়েছেন, তোর মায়ের ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে বাপ । ও বাঁচবে কিনা জানিনা ।

এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হবার দিন  মায়ের কাছে বসে ছিল অপু । ইলিয়াস চাচা স্কুলে টেলিফোন করে রেজাল্ট জেনে এসেছেন । অপু এ প্লাস পেয়েছে । সেবছর চতুর্থ বিষয়ের পয়েন্ট যোগ হয়নি । রেজাল্ট শুনে মার শুকনো চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো । মা বললেন , বাবা আমি বোধহয় আর থাকতে পারবো নারে । তুই ভালো করে লেখাপড়া করিস । আমি সবসময় তোকে দোয়া করবো । শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হবি । আশা ছিল তোকে ডাক্তার বানাবো । তুই ডাক্তার হবি । আমার কথা ভেবে রোগীদের চিকিৎসা করবি ।

রানু খালাকে ডেকে নিলেন মা । খালার মেয়ে মিলিকে আদর করলেন । খালাকে বললেন, রানু- মনে আশা ছিল তোর মেয়েটাকে আমার বাড়ির বৌ বানাবো । আমার অপুর জন্য ওকে নিয়ে আসব । আমি বোধহয় থাকবো নারে । তুই ওর সাথে মিলির বিয়ে দিস ।
অপু অঝোরে কাঁদছিল । মা তাকে ডেকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলেন । বললেন , বাবা , কষ্ট নিস না । আমি তোর সাথেই থাকবো । তোর জন্য আমি মিলিকে পছন্দ করে দিয়ে গেলাম ।
অপুর মুখে কথা ছিল না । ও শুধু মা মা করেছিল । আসরের আজানের সময় মা ওকে একা রেখে চিরবিদায় নিলেন ।

...................................................

অপু শহরে গিয়ে সরকারি কলেজে ভর্তি হল । বই কেনার জন্য সাইকেলটা বিক্রি করে দিল । এইচএসসিতেও ভালো রেজাল্ট করলো । একটা কোচিং এ ফ্রিতে ভর্তি হলো । কোচিং এর বড় ভাইরা তাকে খুব স্নেহ করতেন । সে কোচিং এর পরীক্ষায় ভালো করতে লাগলো ।
মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিল । চান্স পেল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ।
আজ মায়ের স্বপ্ন পুরণ হয়েছে । অপু ডাক্তার হয়েছে । কিন্তু মা নেই । মায়ের দেয়া  সাইকেলটা নেই । খুব বিপদে পড়েই ওটা বিক্রি করেছিল অপু । তাছাড়া মা নেই, সাইকেল রেখে কী লাভ ? এমন ধারণাও করেছিল তখন । কিন্তু সাইকেলটা বিক্রি করার পর সেই রাতে অঝোরে কেঁদেছিল সে ।

কয়েকদিন থেকে বাবা ফোন করছেন বাড়িতে আসার জন্য । খালাও ফোন করেছিলেন । অপু ধারণা করছে, হয়তো তার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করছেন বাবা ।  খালার বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হত না অপুর । গত সাত-আট বছরে দুবার কি তিনবার গিয়েছে । মিলি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে । দেখতে নাকি খুব সুন্দর হয়েছে । অপু খুব একটা খোজখবর নেয়নি কখনো । বাবা মাঝে মাঝে নিজে যেঁচে মিলির কথা বলতেন । অপুর লজ্জা করতো । বাবা সম্ভবত অপুকে মায়ের শেষ ইচ্ছার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেন । ইলিয়াস চাচা জানিয়েছে, দুই পরিবারের মধ্যে সব কথাবার্তা-প্রস্তুতি সম্পন্ন । এবার অপু বাড়িতে এলেই বিয়েটা ঘরোয়াভাবে সেরে ফেলবে । কোন ধুমধাম হবে না ।

বাড়িতে আসার আগে মায়ের দেয়া সেই সাইকেলটার কথা স্মরণ করে একটা সাইকেল কিনেছে অপু।  সাইকেলটা বাসের ওপর উঠিয়ে নিয়ে এসেছে । বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে সাইকেলে চড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল সে । সাইকেল নিয়ে  রাস্তায় নেমে শুধু মায়ের কথা মনে পড়ছিল । পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছিল । চোখটা ভিজে যাচ্ছিল । চিন্তাভাবনাগুলো কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল ।

আকাশে বক উড়ে যাচ্ছে । দূর আকাশে কয়েকটি চিল উড়ছে । জীবনানন্দের কবিতা মাথায় এলো-

‘‘হায়  চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; ......’’

সাঁকোর নিচ দিয়ে প্যাক প্যাক করতে করতে কয়েকটি রাজহাঁস সাতার কেটে গেল । অপুর মাথায় এলো- উইড়া যায়রে হংস পক্ষী পইড়া রয়রে মায়া ...

সাঁকোর গোড়ায়, যেখানে সাইকেল রেখেছে অপু,  সেদিক থেকে টুং করে শব্দ হলো । সাঁকোটাও যেন একটু কেঁপে উঠলো । ঝাপসা চোখে সেদিকে তাকালো অপু । অবাক হয়ে দেখলো- সাঁকোর ওপর উঠে হেঁটে হেঁটে তার দিকে এগিয়ে আসছে  মিলি । গোধুলীর লাল আলো তার মুখে এসে পড়েছে ।

...........................
উড়ে যায় হংসপক্ষী / ০৯-০৭-২০১৩

সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৩

দাঁত তুলে ফেলবো


দরজা বন্ধ করে ফারিহা বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো । দরজার বাইরে মা হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন । কি জানি কী হলো ? ছেলে কি ওর পছন্দ হয়নি ? পছন্দ না হলে বলুক , কান্নাকাটির কী দরকার ? মেয়েটা বড্ড ছিঁচকাঁদুনে । সেই ছোটবেলা থেকেই । কিছু না পেলেও কাঁদে, কিছু পেলেও কাঁদে । বড্ড আবেগী ।

একটাই মেয়ে রেহানা বেগমের । ছোট্ট পুতুলের মত জন্ম হয়েছিল ওর । সারাক্ষণ বুকে-পিঠে জড়িয়ে রাখতেন । এক মুহুর্ত চোখের আড়াল করতেন না । রান্নার সময়ও পিঠে বেঁধে রাখতেন । ও যেন নিজের দেহেরই একটা অংশ । মেয়েটাও ছিল মায়ের ন্যাওটা । সারাক্ষণ আঁচল ধরে থাকত ।

ধীরে ধীরে বড় হল মেয়ে । শরীরের অংশটা যেন শরীর থেকে আলাদা হতে লাগলো । কলেজ পড়া পর্যন্ত মেয়েকে চোখে চোখে রেখেছিলেন রেহানা । স্কুলে নিয়ে যাওয়া, স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত গার্ডিয়ান টেন্টে বসে থাকা । অন্য বাচ্চাদের মায়ের কাছে ফারিহার গল্প করা । এভাবেই কেটে গিয়েছিল দিনগুলি । সে কম সময় নয় , এক যুগেরও বেশি ।

একটু একটু করে মেয়ে বড় হল, আর শরীরের অংশও যেন একটু একটু করে দূরে সরে গেল । একসময় মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করলো । বিভিন্ন ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিল । চান্স পেল ঢাকা ডেন্টাল কলেজে । মেয়েকে রেখে আসতে হল ঢাকায় । রেহানার সেদিন মনে হয়েছিল যেন তাঁর নিজের জীবনটাই ঢাকায় রেখে যাচ্ছেন । বিদায়ের আগ মুহুর্তে মা-মেয়ে সেকি কান্না । সেসব কথা কি কোনদিন ভোলা যায় ?

ফারিহার বাবা ব্যাংকার । অনেক চেষ্টা করেও ঢাকায় পোস্টিং নিতে পারেন নি । আর যে বেতন পান- সেই বেতনে জেলা শহরে ভালোভাবে থাকা যায় , কিন্তু ঢাকা শহরে সম্ভব না । বাসা ভাড়াতেই তো সব চলে যাবে । ফারিহাকে ঢাকায় একা রেখে আসতে বুক ফেটে গেলেও তাই ঢাকায় থাকার চিন্তাটা বাদ দিতে হয়েছিল ।

প্রথম প্রথম মেয়ে প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে আসত । ধীরে ধীরে সেটাও কমে গেল । মেয়ের পড়াশোনার খুব চাপ । মাসে-দুমাসে একবার করে আসে । রেহানাও তখন আরেকটা ছেলে পুতুল পেয়েছেন । তাঁর একাকীত্বটাও ততটা নেই আর । ফারিহার শুন্যতা পুরণ করেছে জীয়ন । মেয়ের সাথে মোবাইলে কথা হত প্রতিদিন ।

আজ আবার সেই পুরনো অনুভুতিটা বোধ করছেন রেহানা । ফারিহাকে ঢাকায় রেখে আসার সময় যে শুন্যতা বুকে চেপে বসেছিল , আজ হঠাৎ সেই শুন্যতাটা যেন ফিরে আসছে । কীই বা করার আছে ? মেয়ের পড়াশনা শেষ । বাসায় বসে আছে ছয় মাস । বয়স ২৪ হয়ে গেছে । বিয়ে তো দিতেই হবে ।

কাউকে পছন্দ আছে কিনা ফারিহা কখনো বলে নি । মাঝে মাঝে বিয়ের প্রসঙ্গ তুললে সে এড়িয়ে যেত । ‘মা , এই প্রসংগটা বাদ দাওতো । অন্য কথা বল । আমাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে ইচ্ছে করছে তোমার ? তাহলে বল, আমি কালকেই কোথাও চলে যাব’ । এরপর আর কথা চলে না ।

গতকাল রাতে রেহানার ছোটভাই মন্টু এসেছে । সে একটা ছেলের ছবি নিয়ে এসেছে । ছেলের চাচার সাথে একই অফিসে কাজ করেন । পুরনো কলিগ । কলিগের ভাতিজাও ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে পাস করেছে । ফারিহার এক বছর সিনিয়র । রাতে ভাইয়ের সাথে এসব নিয়ে কথা হয় রেহানার । সকাল বেলা টিভি দেখার ফাঁকে ফারিহাকে ছবিটা দেখায় তাঁর মামা । ছবির নিচে নামও লেখা ছিল, ফারহান । এরপর ফারিহা হঠাৎ উঠে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিল । এখন ফুঁপিয়ে কাঁদছে । কী হলো কিছুই বুঝতে পারছেন না রেহানা ।

.............................................

‘মা , তুমি যাও । দরজার সামনে বসে থাকার দরকার নেই’ ।
দরজা খুলে কথাটা বলেই আবার দরজা বন্ধ করে দিল ফারিহা । তাঁর নিজস্ব ড্রয়ারটা খুলে একটা জন্মদিনের কার্ড বের করলো । কার্ডের উপরে বড় অক্ষরে লেখা- ফারিহাকে ফারহান । ব্রাকেটে লেখা ‘দাঁত তুলে ফেলবো’ ।

ফারহানের সাথে প্রথম দেখার দিনটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো । ওরা ক্যাম্পাসে আসার মাসখানেক পরে নবীণ বরণ অনুষ্ঠান হয় । অনুষ্ঠানে উপস্থাপক ছিল সেকেন্ড ইয়ারের ফারহান । ফারিহার একটা গান গাওয়ার কথা । মাইকে ঘোষণা করলো ফারিহার নাম । ফারিহা স্টেজে ওঠার সময় ফারহান বললো- এই পিচ্চি, গান ভালো না হলে কিন্তু দাঁত তুলে ফেলবো ! ফারিহা তো অবাক । নতুন একজনকে প্রথম বার কথাতেই কেউ এরকম কথা বলে নাকি ? দাঁত তুলে ফেলবো !

পারফর্মেন্স ভালো হয়েছিল । কিন্তু ফারিহা সেই কথাটা ভুলতে পারেনি । একদিন ক্যান্টিনে দেখা হল ফারহানের সাথে । ফারিহা বললো- ভাইয়া , দাঁত তুলে ফেলবেন না ? ফারহান বললো- ‘নাহ ! গান ভালোই গেয়েছ । এখন দাঁত তুলে ফেলার দরকার নেই । তবে আমার সাথে কখনো বেয়াদবি করলে কিন্তু ঠিকই দাঁত তুলে ফেলবো’ ।
হিহি করে হেসে ফেলে ফারিহা । ফারহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে । হাসিটা তাঁর ভালো লেগেছিল । পরে একদিন ফারহান বলেছিল- ‘ফারিহা, তোমার হাসিটা না খুব সুন্দর । তোমার দাঁত আমি কখনোই তুলতে পারবো না’ ।

এরপর থেকে ঘন ঘন দেখা হয় । কীভাবে কীভাবে যেন একটা কমন রুটিন তৈরি হয়ে যায় । দুজনে একই সময়ে ক্যান্টিনে আসে । টুকটাক কথা হয় । ফার্স্ট প্রফে ফারহান ভালো মার্কস পেয়েছিল । ফারিহা ওর কাছে বিভিন্ন পরামর্শ নেয় । ধীরে ধীরে কথার পরিমাণ বাড়তে থাকে । মোবাইল নাম্বার বিনিময় হয় । কে আগে মোবাইল নাম্বার নিয়েছিল ? মনে পড়ে, প্রথম কলটা ফারিহাই করেছিল ফারহানকে । কী একটা বিষয়ে যেন পরামর্শ নেয়ার জন্য । ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে । ক্যাম্পাসের ভেতরেও দুজনকে একসাথে দেখা যায় । ক্যাম্পাসের গন্ডি পেরিয়ে তা একসময় চাইনিজ রেস্তোরাঁয় গড়ায় ।

ক্যাম্পাসে কানাকানি হয় । বন্ধুরা খাতার ওপর লিখে দেয় – ফারহান + ফারিহা । নামের মিলটাও খুব ভালো লাগে ওদের । কীভাবে এই মিলটা হলো ওরা ভেবে পায় না । কিন্তু মনে করে- তাদের জুটিটা আসলে পারফেক্ট । সারাজীবন ওরা একসাথে থাকবে ।

এক বছর খুব ভালোই ছিল । হাসি ঠাট্টা , মোবাইলে কথা , চিঠি, গিফট বিনিময় । মিরপুরের সব জায়গায় ওদের পা পড়েছে । সারাদিন একজন আরেকজনের কথা ভাবে । ফারিহা তো ফারহানের গল্প করতে করতে বান্ধবীদের কান ঝালাপালা করে দিয়েছিল । ফারহান কথায় কথায় বলে – দাঁত তুলে ফেলবো !

ছোটবেলায় একবার ডাঙ্গুলি খেলতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে মারামারি হয়েছিল ফারহানের । তখন বয়স আট কি দশ । দুধদাঁত পড়ে গিয়ে পার্মানেন্ট দাঁত ওঠার বয়স । ফারহান ওর বন্ধু মিন্টুকে একটা ঘুষি মেরেছিল । ঘুষিটা মিন্টুর গালে লাগে । মিন্টুর মুখে রক্ত চলে আসে । থুতু ফেললে দেখা যায় , মিন্টুর একটা দাঁত পড়ে গেছে । সবাই বলতে লাগলো – ফারহান ঘুষি মেরে মিন্টুর দাঁত ফেলে দিয়েছে । আসলে মিন্টুর একটা দাঁত আগে থেকেই নড়বড়ে ছিল । কিন্তু কে শোনে কার কথা । পাড়ায় বাচ্চাদের মাঝে খবর রটে গেল , ফারহান ঘুষি মেরে দাঁত ফেলে দেয় । বাচ্চারা একজন আরেকজনকে ভয় দেখাতে লাগলো – ফারহান ভাইয়াকে ডাকবো ? ঘুষি মেরে তোর দাঁত ফেলে দিবে ! ফারহান হিরো হয়ে গেল । সে তখন এই ডায়লগটা দেয়া শুরু করলো – ‘দাঁত তুলে ফেলবো’ । পরে সে যখন ঢাকা ডেন্টাল কলেজে চান্স পেল – তাঁর মনে হল , এটাই ভাগ্যে ছিল । ভবিষ্যতে আসলেই তাকে দাঁত তুলতে হবে । টুথ এক্সট্রাকশন । বিশেষ করে থার্ড মোলার । যাকে বলে আক্কেল দাঁত । ডায়লগটা সে আর ছাড়েনি । কিছু হলেই বলে – ‘দাঁত তুলে ফেলবো’ !

...........................

ফারিহার ফার্স্ট প্রফ পরীক্ষার রেজাল্ট হয়ে গেছে । ফারিহা প্লেস করেছে । নাইন্থ প্লেস । কিন্তু ফারহানের মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল সে কিছুদিন ধরেই । আগের মত অতটা উচ্ছাস দিয়ে কথা বলে না , সহজে দেখা করতে চায়না । দেখা করতে বললে একা না এসে সাথে আরেকজন বন্ধুকে নিয়ে আসে । আগে রংচঙ্গা টি-শার্ট, ছেড়া জিন্স এসব হাল ফ্যাশনের কাপড় পড়ত । এখন অনেকটা ফরমাল কাপড়চোপড় পড়ে । দেখতে অবশ্য অনেক স্মার্ট দেখায় । মনে হয় – আগের চেয়ে এখনকার পোষাকেই ওকে বেশি ভালো লাগে । আগে জিন্সের প্যান্ট যেন রাস্তায় ঝাড়ু দিত । এখন প্যান্ট একটু উপড়ে থাকে । ছোট ছোট দাড়িও রেখেছে । দেখতে আগের চেয়ে একেবারে প্রায় ভিন্ন, কিন্তু অনেক ভদ্র, আরো বেশি সুন্দর, হ্যান্ডসাম লাগে ।

একদিন ফারহান ফারিহাকে ফোন করে দেখা করতে বললো । একা । মিরপুর-১০ এ । অনেক দিন পরে ফারহান এভাবে দেখা করতে ডাকলো । ফারিহা অনেক খুশি মনে গিয়েছিল । গিয়ে দেখে রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে ফারহান গম্ভীর মুখে বসে আছে । আইসক্রিম আর জুসের অর্ডার দিল ফারহান ।

‘ফারিহা , আজ আমি তোমাকে কিছু খুব গুরুত্বপুর্ণ কথা বলবো । তুমি মনকে শক্ত কর’ ।
ফারিহার বুক কেঁপে ওঠে । কী বলতে চায় ফারহান ? ব্রেক আপ ?
‘ফারিহা, তুমি আমাকে কতটা ভালোবাস ?’
‘তোমাকে কতটা ভালোবাসি আমি বোঝাতে পারবো না’ । কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেছিল ফারিহা ।
‘ফারিহা, আমিও তোমাকে ভালোবাসি । সেজন্যেই আমি চাইনা তোমার কোন ক্ষতি হোক । তুমি কি চাও আমার কোন ক্ষতি হোক ?’
‘কী বলছ তুমি ? তোমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবার আগে যেন আমার মরণ হয় !’
‘দেখ ফারিহা , তুমি কি জান- এইযে আমরা দুজনে এভাবে দেখা করি, কথা বলি এতে আমাদের দুজনেরই ক্ষতি হয় ? আমরা মুসলিম । আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ । তিনি আমাদের সৃষ্টি করে দুনিয়াতে এমনিতেই ছেড়ে দেননি । আমাদের জন্য ম্যানুয়াল দিয়েছেন । টিউটর দিয়েছেন । তুমি জান সেটা কি ? ম্যানুয়ালটি হচ্ছে আল কুরআন । আর টিউটর হলেন নবী । তুমি নিশ্চয়ই আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, রাসুলকে আল্লাহর প্রেরিত বার্তাবাহক, এবং কুরআনকে আল্লাহর বাণী বলে বিশ্বাস কর ?
’‘হু, করি’ ।
‘সমাজের মঙ্গলের জন্য , মানব জাতির মংগলের জন্য এতে বিধান দেয়া হয়েছে । বিয়ের আগে আমাদের এভাবে দেখা করা , যোগাযোগ রাখা, অবাধে মেলামেশা করা ইসলামে নিষেধ আছে । এতে আমাদের পাপ হচ্ছে, গুনাহ হচ্ছে । আল্লাহ অসন্তুষ্ট হচ্ছেন । আল্লাহ ক্ষমা না করলে এর জন্য আমাদের পরকালে শাস্তি পেতে হবে । আমাকে শাস্তি পেতে দেখলে , আগুনে পুড়তে দেখলে তুমি খুশি হবে ?’
‘না । তার আগে আমি আগুনে পুড়বো’ ।
‘কিন্তু আমি চাইনা তুমি আগুনে পোড় । মুসলিমরা চায় সকল মানুষের জন্য মৃত্যুর আগে এবং পরে সবসময়ের জন্য শান্তি’ ।
‘তাহলে চল আমরা বিয়ে করে ফেলি’ ।
‘ফারিহা, সেটা এখনই সম্ভব নয় । আমার এখনো গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি । তোমারও হয়নি । তোমার এবং আমার কোন পরিবারের কেউই রাজী হবে না । বাবা-মা’র অমতে বিয়ে করলে জীবনে সুখি হবনা আমরা । আর এখন আমার কী আছে বলো ? তুমি তো আমার অবস্থা জানো’ ।
‘আমি অতকিছু বুঝিনা । তুমি আমার কাছ থেকে সরে যেতে পারবে না’ ।
‘ফারিহা, আমি তোমাকে ভালবাসি, তুমি আমাকে ভালবাস । কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, আমাদের বাবা মা আমাদেরকে এরচেয়েও বেশি ভালবাসেন । তাঁদেরকে কষ্ট দেয়া ঠিক না । আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো । গ্রাজুয়েশন শেষে আমি মোটামুটি গুছিয়ে নিতে পারলেই আমরা বিয়ে করবো । তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না ?’

ফারিহার চোখ ভিজে গিয়েছিল । সে কী বলবে ? ফারহান আরো বলেছিল – ‘ফারিহা, যদি তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাক তাহলে অপেক্ষা করো । এটা আমাদের দুজনেরই ভালবাসার পরীক্ষা । সময় হলে , আমি প্রথমে তোমাকেই খুজবো । যদি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারো, তাহলে আমরা সারাজীবনের জন্য একসাথে থাকবো’ । ফারিহার রুমাল চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছিল । ফারহানের চোখেও জল টলমল করছিল । কিন্তু ও খুব শক্ত ছিল । হয়তো ফারহানও কেঁদেছিল তাঁর রুমে ফিরে । গোপনে, নীরবে ।

তাদের আর কথা হয়নি । যতদিন ক্যাম্পাসে ছিল, মাঝে মাঝে করিডোরে চোখাচোখি হত । ফারিহা জিজ্ঞেস করতো- ‘কেমন আছেন ?’ ফারহান হয়তো মাথা নাড়ত, অথবা ছোট্ট করে উত্তর দিত –আলহামদুলিল্লাহ্‌ । তুমি ভালো আছ ? তারপর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেছে । ফারিহা অপেক্ষা করেছে । জসীমউদ্দিনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কবিতায় সোনাই যেভাবে অপেক্ষা করেছিল রুপাইর জন্য , ফারিহা সেভাবেই অপেক্ষা করেছে । ফারহান তার কথা রেখেছে । তার চাচার কলিগ, ফারিহার মন্টু মামার মাধ্যমে তার ছবি পাঠিয়েছে । আসলে বিয়ের প্রস্তাবই পাঠিয়েছে ।

...................................................

বিকেলে মামাকে নিয়ে বিলের ধারে বেড়াতে গেল ফারিহা । মামাকে বললো, এই প্রস্তাবে তার কোন অমত নেই । মামার কাছে খোজখবর নিল- মামা ফারহানকে দেখেছে কিনা , তাকে মামার পছন্দ হয়েছে কিনা এইসব । ফারহানের কাছে পৌছানোর জন্য একটা খাম দিল ফারিহা । এনগেজমেন্টের দিন যেন এটা নিয়ে আসে । খামে একটা এক লাইনের চিঠি আছে ।

তিনদিন পর । ফারিহাদের বাড়িতে ছোটখাট আয়োজন করা হয়েছে । ফারিহা জানে , আজ এনগেজমেন্ট হবে । ফারহান তার বাবা-মা ভাই বোন সবাইকে নিয়ে এসেছে । আংটি পড়ানোর সময় ফারহানের আব্বা বললেন – ‘আমরা কিন্তু কাজী সাথে করেই নিয়ে এসেছি । ফারিহা মা রাজি থাকলে আজই কবুল করে ফেলতে চাই’ ।
ফারিহা ফারহানের দিকে তাকিয়ে বললো – ‘আজই’ ?
ফারহান ফারিহার দেয়া খামটা খুলে চোখের দিকে চেয়ে নিচুস্বরে বললো – ‘দাঁত তুলে ফেলবো’ !

..............................
 দাঁত তুলে ফেলবো / ০৮-০৭-২০১৩

শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৩

আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে

জায়গাটা বেশ নির্জন । রেললাইনের দুপাশে গাছগাছালিতে ভরা । সেজন্য এদিকটা সবসময় ঠান্ডা থাকে ।
হু হু করে বাতাস বইছে । মাথার চুল উড়ছে ইকবালের । সে পড়েছে একটা গেরুয়া রঙের ফতুয়া । উদাস কন্ঠে বললো – ‘রিনা, কেমন লাগছে ?’ ।
কখনো এরকম জায়গায় তো আসোনি তাইনা ?’
রিনা শুধু বলল –‘হু’ ।

রিনা এমনিতে খুব চঞ্চল হাসিখুশি ধরনের মেয়ে । কিন্তু মাঝে মাঝে চুপচাপ হয়ে যায় । আজকের পরিবেশটা যেন রিনাকে বলছে , বেশি কথা নয় । হাতে হাত রেখে চুপচাপ হেঁটে যেতে হবে । ইকবালের বাম হাত ধরে রেখেছে রিনা । দুজনে হাঁটছে পাশাপাশি । মাঝে মাঝে মাথার ওপর খুব কাছে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কিছু পাখি । দোয়েল , শালিক আর টুনটুনি । কিচিরমিচির করছে পাখিগুলো ।

এক সপ্তাহ হল- বিয়ে হয়েছে ইকবাল ও রিনার । একমাসের ছুটি নিয়েছে ইকবাল । ঠিক
করেছে, বিকেল বেলা করে তারা হাঁটতে বের হবে । রিনাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাবে, তাঁর প্রিয় জায়গাগুলিতে । অনেক কথা বলবে তারা ।

ইকবাল সরকারি ডাক্তার । তাঁর পোস্টিং হয়েছে ভোলার মনপুরায় । ডাক্তারদের জন্য বিসিএস হলো দিল্লিকা লাড্ডু । খাইলেও পস্তাতে হয়, না খাইলেও পস্তাতে হয় । বিসিএস হয়ে গেলে পোস্টিং দেয়া হয় দূর দুরান্তের গ্রামে । ইউনিয়ন সাবসেন্টারে । দেখা যায় - শুধু একটা ঘর আছে , আর একজন ডাক্তার আছেন । নার্স নাই, হেলথ এসিসটেন্ট নাই , ফার্মাসিস্ট নাই , ওটি এসিসটেন্ট নাই । অষুধপত্র নাই, ছোটখাট অপারেশনের যন্ত্রপাতি নাই । ডাক্তারের থাকার জায়গা নাই । বসার চেয়ারটার হাতল ভাঙ্গা । ফ্যান নাই । শুধু একজন ডাক্তারকে গ্রামে পাঠিয়েই সরকার বাহাদুর খালাস । কিছুদিন পরপর মন্ত্রী এমপিরা বুলি ঝাড়েন- ‘ডাক্তারদের গ্রামে যেতে হবে’ ।

আবার বিসিএস না করলেও বিপদ । কলুর বলদের মত ভূতের বেগার খাটতে হয় । স্পেশালিস্ট হওয়ার জন্য পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী নিতেই হবে । করতে হবে দুই থেকে তিন বছর ট্রেনিং । আট থেকে ষোল ঘন্টা ডিউটি । সম্পুর্ণ বিনা পয়সায় । জীবন চলবে কীভাবে ?
উপজেলা শহরে ইকবালের চেম্বার আছে । এলাকায় সবাই তাঁকে চেনে ‘ম্যাজিক ডাক্তার’ হিসেবে । তাঁর দেয়া ভালো চিকিৎসা , সুন্দর ব্যবহার সবকিছুই ম্যাজিকের মত কাজ করে । শুধু তাই নয় – ইকবাল আসলেই ম্যাজিক জানে । কার্ডের ম্যাজিক, পয়সার ম্যাজিক, দড়ির ম্যাজিক , টাকার ম্যাজিক, আংটির ভেতর আংটি ঢুকানো । বাচ্চা রোগী অথবা কিশোরদের মাঝে মাঝেই ম্যাজিক দেখিয়ে চমকে দেয় সে । বাচ্চা ভয়ে অস্থির, ব্যাথায় অস্থির । ইকবাল একটা ম্যাজিক দেখিয়ে দিল । এইযে দেখ একটা টাকা । হাত নাড়াতেই চোখের সামনেই টাকাটা গায়েব ! আবার সেই টাকা আরেকজনের পকেট থেকে বের করে ফেললো । বাচ্চা পুরো হিপনোটাইজড ।

মাঝে মাঝে নতুন রোগী চেম্বারে ঢুকে ভড়কে যায় । রোগী চেম্বারে ঢুকে বসেছে, ডাক্তার সাহেব
একগাদা কার্ড বের করে শাফল করলেন । রোগীকে বললেন শাফল করে দিতে । এরপর যেকোন একটা কার্ড টেনে লুকিয়ে রাখতে বললেন । আবার শাফল করে একটা কার্ড বের করে দেয় ইকবাল । দেখা গেল – দুটি কার্ডই এক ! রোগী অবাক হয় । আবার খুশিও হয় । মুহুর্তেই আপন হয়ে যায় ইকবাল । অষুধ দেয়ার
আগেই রোগী অর্ধেক সুস্থ !

ফাইনাল প্রফ পরীক্ষার পর হঠাৎ ইকবালের খেয়াল চাপে ম্যাজিক শেখার । ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিকের ট্রিক্স কাউকে শেখাতে চায় না । অনেক খুঁজে একজন ওস্তাদের সন্ধান পেয়েছিল সে । বলা ভালো- ‘ওস্তাদ পটিয়েছিল’ ! তাঁর কাছে ম্যাজিকের তালিম নিয়েছিল ইকবাল । ওস্তাদ বলতেন – ইকবাল, জীবনটাই একটা ম্যাজিক । সব ধান্দা, বুঝলা - সব ধান্দা । চোখের ধান্দা, মনের ধান্দা । ধান্দার জীবন নিয়া কখনো দুঃখ করবা না । চক্ষু খুইললে যেটা সইত্য, চক্ষু বুইজলে সেইটাই মিথ্যা । খোলা চোখের সামনে যা দেখ, তারও সবকিছু সইত্য না ।
ইকবালের মাঝে মাঝে মনে হয়- মানুষের রোগও বোধহয় একধরনের ধান্দা । আসলে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস ক্যান্সার কোষ ব্যাথা বেদনা কিছু নাই । সব ধান্দা ।

ছোটভাইকে নিয়ে ম্যাজিক ডাক্তারের চেম্বারে এসেছিল রিনা । রিনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্সের ছাত্রী । ডাক্তারের কথা শুনে আর ম্যাজিক দেখে ছোটভাইয়ের সাথে সেও হিপনোটাইজড । আরেকটা বিষয় তাঁর নজরে এসেছিল- সে যথেষ্ট সুন্দরি হওয়া সত্বেও ম্যাজিক ডাক্তার একবারের বেশি তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকায়নি । বাসায় গিয়ে দুভাইবোন ম্যাজিক ডাক্তারের খুব প্রশংসা করেছিল । রিনার বাবাও একবার কথা বলে গিয়েছিলেন , ইকবাল অবশ্য জানতো না যে তিনিই রিনার বাবা । রিনার বাবা ইকবালের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা-মা র সাথে কথা বলে এসেছেন । ইকবালের অজান্তেই বাবা মাও রিনাকে দেখে গেছে । পরে একদিন আনুষ্ঠানিকভাবে দেখাদেখি হল । উভয়ের বাবা মার জোড়াজুড়িতে একমাসের মধ্যেই বিয়েটা হয়ে গেল ।

ইকবাল বললো – ‘রিনা, একটা কবিতা শুনবে ?’
‘হু’ ।
ইকবালের কন্ঠ ভালো । আবৃত্তির ভঙ্গিও ভালো । কবিতা আবৃত্তি করতে তাঁর ভালোই লাগে । আবৃত্তি করার সময় কবিতার প্রতিটি অক্ষর যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে । কবিতা লিখেন কবি , কিন্তু আবৃত্তি করার সময় সেটা হয়ে যায় সম্পুর্ণ নিজের ।

‘‘আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি ।
শোনো ।
পাহাড়টা , আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিলো মেঘকে
আর মেঘ কি ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা......’’

‘কবিতাটা কার ?’ রিনা জিজ্ঞেস করলো ।
‘পুর্ণেন্দু পত্রী’ ।
তোমার ভালো লাগছে ?
‘হু’ ।

রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এসেছে নদীর পাড়ে । নদীটা কেমন নিশ্চুপ । ছোটবেলায় মাঝে মাঝে এদিকে আসত ইকবাল । খুব বেশি আসা হত না । বাড়ি থেকে বেশ দূর । নদীর ওপর রেল ব্রিজ । রেল ব্রিজে যখন রেলগাড়ি যায় তখন একটা কেমন অদ্ভুত ঝম ঝম শব্দ হয় । সেই শব্দটা শোনার জন্যই আসতো ইকবাল । তাঁর খুব ভালো লাগতো ।
‘রিনা, তুমি জানো রিনা শব্দটাকে উল্টালে কী হয় ?
‘বলো’ ।
রিনা জানে, তবুও ইকবালের মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছে । সে যখন বলতে চাচ্ছে, বলুক ।
‘নারী’ হয় । কবিরা কী বলে জান ?’
‘কী বলে ?’
‘বলে, নারীরা নাকি নদীর মত । ও নদীর কূল নাই, কিনার নাইরে । আমি কোন কূল হতে কোন কূলে যাবো কাহারে শুধাইরে......’
‘কাউকে শুধানোর দরকার নেই । চলো, রেলব্রিজটা হেঁটে পার হই । এখন আমরা এই কূল হতে ওই কূলে যাবো’ ।

রেলব্রিজে উঠতে ইকবালের ভয় হয় । ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় একবার এই রেলব্রিজে উঠেছিল ইকবাল । রেলব্রিজটা বেশ লম্বা । পা টিপে টিপে মাঝপথে গিয়েছে এমন সময় রেললাইন কাঁপতে লাগলো । পেছন থেকে একটা ট্রেন আসছিল । পেছনে ফেরারও উপায় নেই , সামনে যাবারও উপায় নেই । এর মধ্যে ট্রেন এসে পড়বে । চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল ইকবালের । ব্রিজের মাঝামাঝিতে যে পিলার আছে , তার কিছুটা অংশ দেখা যায় । সে ওখানে নেমে গিয়েছিল । ট্রেন যাবার সময় অবস্থা এমন হয়েছিল –যাকে বলে ‘আত্মারাম খাঁচাছাড়া’ ।

রিনার কথায় কিছুক্ষণ চিন্তা করলো ইকবাল । কী করা যায় ? না বলে দেবে ? নাহ । রিনা কাপুরুষ ভাববে । রিনা যখন সাহস করেছে, তারও করা উচিৎ । নতুন বউয়ের কাছে এভাবে অপমান হওয়া ঠিক হবেনা । হয়তো দেখা গেল রিনা আসলে রেলব্রিজ পার হবে না । তাকে টেস্ট করার জন্যই বলেছে কথাটা । দেখা যাক কী হয় ! আল্লাহ ভরসা ।
‘আমাদেরকে দ্রুত হেঁটে তাড়াতাড়ি পার হতে হবে । এর মধ্যে ট্রেন আসলে কিন্তু মহাবিপদ হয়ে যাবে’ ।
রিনাকে সতর্ক করলো ইকবাল ।

ইকবালের বুক ধুকধুক করতে লাগলো । ইস্টিশনের রেলগাড়িটা, মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা, কখন বাজে বারোটা , কখন বাজে বারোটা । মাথায় ঘুরছিল পুরনো গানের কথা । এখন - কখন আসে ট্রেন , কখন আসে ট্রেন অবস্থা । মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে লাগলো যেন ভালোয় ভালোয় পার হতে পারে রেলব্রিজটা ।

‘আউ’ !
ব্রিজে কেবল উঠতে যাবে - তখনই, ব্রিজের গোড়ায় দুলাইনের মাঝখানের পাটাতনের একটা ভাঙ্গা অংশ দিয়ে রিনার পা টা দেবে গেল । পা টা মচকেও গেছে কিনা কে জানে ! ইকবালের মনের ধুকপুকানি বেড়ে গেল । এখন কী করবে সে । আশেপাশে কোন লোকজনও নেই । হু হু করে বাতাস বইছে । বসে পড়েছে রিনা । পা টা বের করার চেষ্টা করছে ইকবাল । কিন্তু কোনভাবেই বের করা যাচ্ছে না । বেকায়দা ভাবে আটকে গেছে ।
কিছুক্ষণের মধ্যে রেললাইনের ভেতর শো শো আওয়াজ হতে লাগলো । ট্রেন আসছে । এক কিলোমিটারের মত দূরে আছে । তাড়াতাড়ি পাটা বের করতে হবে । চেষ্টা চালাতে লাগলো দুজনেই । কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা । আধা কিলোর মধ্যে চলে এসেছে ট্রেন ।

উস্তাদ রহমত উল্লাহর বয়স এখন ৫৫ ।
বিশ বছর ধরে সিলেট চট্টগ্রাম রুটে ট্রেনের চালক হিসেবে কাজ করছেন তিনি । এই রুটের নাড়ি নক্ষত্র তাঁর মুখস্ত । মাঝে মাঝে মনে হয় – চোখ বন্ধ করেও ট্রেন পৌঁছে দিতে পারবেন সিলেট থেকে চট্টগ্রাম । চট্টগ্রাম থেকে সিলেট । বিশ বছরে অভিজ্ঞতাও কম হলোনা । রেলগাড়ির জগতটা যেন একটা আলাদা জগত । রেলগাড়ি, রেললাইন, যাত্রী , টিটি, গার্ড । সবাইকে নিয়ে একটা বৃহৎ সংসার ।

কতবার রেলে ডাকাতি হলো । এক্সিডেন্ট হলো । বগি লাইনচ্যুত হল । অনেক ইতিহাস । ডাকাতি এখন কমে গেছে । কিন্তু একটা বিষয় তাঁকে খুব কষ্ট দেয় । রেললাইনের ওপর শুয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে । বেশিরভাগই কমবয়সী ছেলে মেয়ে । রহমত সাহেব পত্রিকায় দেখেন । যেদিন তাঁর নিজের ট্রেনের নিচে পড়ে কেউ মারা যায় – পরের কয়েকটি দিন তাঁর খুব খারাপ লাগে । নিজেকে খুনি খুনি মনে হয় । মাঝে মাঝে ভাবেন , অবসর নিবেন । কিন্তু ছাড়তে ছাড়তেও ছাড়া হয়না । ট্রেনের ওপর মায়া পড়ে গেছে ।

চালকের আসনে বসে রহমতুল্লাহ সাহেব সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পথে যাচ্ছিলেন ট্রেন নিয়ে । অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ছিল । বিশেষ করে ছোটবেলার সেই ঘটনাটি ।
বয়স যখন দশ ,রেলের সাথে তাঁর জীবন জড়িয়ে যায় তখনি । তিনি মাঠে গরু চড়াচ্ছিলেন । কোমড়ে লাল গামছা বাঁধা ছিল । হাতে লাঠি । লাঠি হাতে থাকলে গরু রাখালকে ভয় করে । নাহলে দুয়েকটা বদমাশ গরু মাঝে মাঝে তেড়ে আসে । গরুগুলোকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে বটগাছের নিচে বসে বাঁশি বাঁজাতেন রহমতুল্লাহ । মাঝে মাঝে রেললাইনের ওপর বসেও বাঁশি বাঁজাতেন । সেদিনও রেললাইনের ওপর বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন । গামছাটা ভেজা থাকায় লাঠির মাথায় বেঁধে লাঠিটাকে রেললাইনের পাটাতনের ফাঁকে গুজে খাড়া করে শুকাতে দিয়েছিলেন । একটা গরু অন্যদিকে চলে যাওয়ায় লাঠিটা ওখানে রেখেই গরুর পেছনে ছুটেছিলেন তিনি ।

হঠাৎ রেলের হুইসেল শুনে গামছা নেয়ার জন্য দৌড় দেন । কিন্তু ততক্ষণে ট্রেনটা থেমে গিয়েছিল । তাঁর রেখে যাওয়া গামছার একটু দুরেই রেলের দুতিনটা স্লিপার খোলা ছিল । ট্রেনের চালক এসে জিজ্ঞেস করলেন, লাল গামছা কার । ভয়ে ভয়ে তিনি বলেছিলেন – আমার গামছা । চালক রহমত উল্লাহর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন- তুই আজ অনেক মানুষের জীবন বাচাইছিস রে বাপ । তোরে আমি ট্রেনের চালক বানামু ।
সেই চালকের নাম ছিল আব্দুল করিম খাঁ । একদিন এসে বাড়ি থেকে রহমতুল্লাকে নিয়ে যান তিনি । তারপর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে । রহমতুল্লাহ সাহেবকে তিনি ঠিকই ট্রেনের চালক বানিয়েছেন । রহমতুল্লাহ সাহেব ট্রেনের চালক হবার তিন মাসের মাথায় ইন্তেকাল করেন আব্দুল করিম ।

তিনি ছিলেন রহমতুল্লাহ সাহেবের উস্তাদ । বাবার মত স্নেহ করতেন । তাঁর কথা মনে পড়লে এখনও চোখে জল আসে রহমতুল্লাহ সাহেবের । আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি । ভাবতে ভাবতে তাই চোখটা ভিজে উঠেছিল তাঁর । তিনি চোখ মুছে সামনের দিকে তাকালেন । সামনেই একটা রেলব্রিজ আছে । রেল ব্রিজ পার হবার সময় একটু বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন । ব্রিজের ওপর থেকে বগি লাইনচ্যুত হলে বেশি মানুষ মারা যাবে ।

সামনে চোখ দিতেই নজরে আসলো রেলব্রিজের ওপ্রান্তে লাইনের ওপর যেন একটা লাল পতাকা দুলছে । দুজন মানুষের আবছা অবয়ব চোখে পড়ছে । রহমতুল্লাহ সাহেব ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা করলেন । নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে । ব্রিজের ওপর ওঠার আগেই ট্রেন থামাতে হবে ।
ট্রেনের গতিবেগ কমতে লাগলো । কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হলো না । ট্রেন থামতে থামতে ইঞ্জিন বগিটা ব্রিজের ওপর উঠে গেল । রহমতুল্লাহ সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন , একজন যুবক ও লাল শাড়ী পরা একজন মেয়ে রেললাইন থেকে উঠে দাঁড়ালো । ট্রেনের দিকে একবার তাকিয়ে তারা হেঁটে হেঁটে সরু রাস্তা ধরে চলে যেতে লাগলো । মেয়েটির শাড়ির লাল আঁচল তখনো দমকা বাতাসে পতাকার মত উড়ছে ।

ইকবাল যখন রিনার পা বের করতে সক্ষম হয় , ট্রেনটা তখন ব্রিজের ওপর এসে থেমে গেছে । ট্রেনটা কেন কীভাবে থামলো আল্লাহই জানেন । পুরো ঘটনাটা যেন ম্যাজিকের মত ঘটে গেল । মহান প্রভূও হয়তো তাঁর ক্ষুদ্র সৃষ্টি মানুষকে নিয়ে ম্যাজিক করেন ! তারা ওখানে আর দাঁড়ালো না । আল্লাহর শুকরিয়া জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো । রিনার গালে বিকেলের কোমল আলোয় চকচক করছিল একফোঁটা অশ্রুবিন্দু ।
ইকবাল গভীর আবেগে আবৃত্তি করতে লাগলো –

‘‘সেদিন ছিলো পাহাড়টার জন্মদিন ।
পাহাড় মেঘকে বললে
আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে ।
মেঘ পাহাড়কে বললে
আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে’’ ।

..................................
আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে / ০৬-০৭-২০১৩