একক পরিবার নাকি যৌথ পরিবার? এই নিয়ে বিতর্ক ইদানিং বেশ জমে উঠেছে সামাজিক পরিমন্ডলে। কেউ কট্টরভাবে যৌথ পরিবারের পক্ষে, কেউ একক পরিবারের। নব্য নারীবাদিরা নতুন করে এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। তারা বেশিরভাগই যৌথ পরিবারের বিরুদ্ধে প্রান্তিক অবস্থান নিয়েছেন। আবার পুরুষরা অনেকেই কট্টরভাবে যৌথ পরিবারের পক্ষ নিয়েছেন।
আমার অবস্থান মোটাদাগে পৃথক পরিবারের পক্ষে।
যৌথ পরিবারের বউ মানে যদি হয় পরিবারের 'সবার সেবক', তাহলে আমি এর বিরোধী। আবার একক পরিবার মানেই যদি হয় বাবা-মা, ভাই-বোনদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকা, সেটাকেও আমি সমর্থন করতে পারি না।
মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো, মানুষ দিতে চায় কম, নিতে চায় বেশি। যৌথ পরিবারে এই সমস্যাটা বেশি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। কে ঠিকঠাক কাজ করে না, কে কতটুকু দেয়, কে বেশি নেয়- একটা যৌথ পরিবারে দিনশেষে সম্ভবত প্রত্যেকের ঘরে এগুলোই হয়ে ওঠে কমন আলোচনার বিষয়। গীবত আর চোগলখুরির চর্চাটা শুরু হয় সম্ভবত এখান থেকেই।
একটা পরিবারে টুকটাক অনেক কাজ থাকে। একটা বড় যৌথ পরিবারে সেই কাজের পরিমাণ হয় অনেক অনেক বেশি। কিন্তু সেখানে সত্যিকারার্থে কোন কর্মবন্টণ থাকে না। ফলে, অনেকে মিলে করলেও কাজের 'শেষ' হয় না। দিনশেষে তাই সবার মনে থাকে অতৃপ্তি, অন্যের প্রতি অভিযোগ, আক্ষেপ।
সবচেয়ে বেশি চাপ সহ্য করতে হয় বাড়ির 'বড় বউ'কে। তার নিজের জীবন বলতে কিছু থাকেনা।
সকাল বিকাল চা-নাস্তা বানানো, তিন বেলা ভাত-তরকারি রান্না, কাপড়-চোপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, ঘরদোর সামলে রাখা- সহজ কাজ নয়। একজন গৃহিনী বউকে সারাদিনে যতবার এঘর ওঘর করতে হয়, হিসাব করলে তাতে তার প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার হাঁটা হয়ে যায়। কাউকে কাউকে সারাদিনে যে পরিমাণ রান্নাবান্না করতে হয়, সেই পরিমাণ রান্না করে হয়তো একটা বড়সড় রেস্টুরেন্ট চালানো যাবে। যে পরিমান কাপড় ধুতে হয় বা ইস্ত্রি করতে হয়, সেই পরিমাণ কাজ করে বোধহয় বাণিজ্যিকভাবে একটা লন্ড্রি দোকানই চালানো সম্ভব।
সকাল বিকাল চা-নাস্তা বানানো, তিন বেলা ভাত-তরকারি রান্না, কাপড়-চোপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, ঘরদোর সামলে রাখা- সহজ কাজ নয়। একজন গৃহিনী বউকে সারাদিনে যতবার এঘর ওঘর করতে হয়, হিসাব করলে তাতে তার প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার হাঁটা হয়ে যায়। কাউকে কাউকে সারাদিনে যে পরিমাণ রান্নাবান্না করতে হয়, সেই পরিমাণ রান্না করে হয়তো একটা বড়সড় রেস্টুরেন্ট চালানো যাবে। যে পরিমান কাপড় ধুতে হয় বা ইস্ত্রি করতে হয়, সেই পরিমাণ কাজ করে বোধহয় বাণিজ্যিকভাবে একটা লন্ড্রি দোকানই চালানো সম্ভব।
যৌথ পরিবারে কারো নিজস্ব সময় বলে কিছু থাকেনা। একটু বিশ্রাম, নিজের বাচ্চাটাকে একটু বেশি সময় দেয়া, স্বামীর সাথে একটু অতিরিক্ত গল্পগুজব- কোনোটাই নিশ্চিন্তে করা যায় না। মাথায় অনেক কাজের চাপ, আবার যেকোন সময় যেকেউ ডাক দিতে পারে।
'মা এক কাপ চা দাও না'। 'আমার ঘড়িটা কোথায়?' 'ভাবী এক গ্লাস পানি দাও।' 'বউমা একটু রান্নাঘরে যাও।' যেকোন সময় কানে আসতে পারে যেকোন আদেশ, কিংবা অনুরোধ।
'মা এক কাপ চা দাও না'। 'আমার ঘড়িটা কোথায়?' 'ভাবী এক গ্লাস পানি দাও।' 'বউমা একটু রান্নাঘরে যাও।' যেকোন সময় কানে আসতে পারে যেকোন আদেশ, কিংবা অনুরোধ।
ক্লাস নাইনে থাকতে প্রথম যেদিন আমি নিজে নিজে আমার সব কাপড় ধুয়েছিলাম, আমার কোমর ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল। আমার মা এবং বোনেরা কত কষ্ট করে সেটা বুঝতে আর বাকি ছিলনা। এরপর থেকে নিজেই কাপড় ধুই।
গোসল করতে গেলেই আমি দুএকটা কাপড় ভিজিয়ে রাখি। তবুও সপ্তাহ শেষে একগাদা ময়লা কাপড় জমে থাকে। একজনের কাপড় নিয়েই যদি এই হয় অবস্থা, একটা পুরো পরিবারের কাপড় সামলানো কতটা কঠিন, ভাবা যায়?
প্রাপ্তবয়স্ক এবং বিবাহিত ছেলে মেয়েরা তাই পৃথক পরিবার চালানোই ভালো। তবে পৃথক পরিবার মানে বাবা-মা বিহীন পরিবার নয়। বাবা-মা'র দায়িত্ব থেকে মুক্তি নয়। শ্বশুর শ্বাশুড়ির দায়িত্ব থেকে মুক্তি নয়। ভাইবোনদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি নয়। ভাই বোনদের মধ্যে যে বেশি স্বচ্ছল, তারই উচিত বাবা-মার দায়িত্ব নেয়া। তারই উচিত বেশি বেশি বাকি সবার খবর নেয়া। সবার বোঝা উচিত, বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেয়াটা বিরাট সুযোগ, এটা কোন বার্ডেন নয়। বাপ-মা কিংবা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সেবা করার জন্য ছেলেমেয়ে বউ-জামাইদের রীতিমত প্রতিযোগিতা করা উচিত।
অনেক ক্ষেত্রে যৌথ পরিবারগুলো শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায় ঝগড়াঝাটির মাধ্যমে। এতে করে জীবনের বাকি সময়টাও আর স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে না। এমন তিক্ততা সৃষ্টি হবার আগেই পরিবার পৃথক হওয়া ভালো। এতে করে বাকি জীবনেও সম্পর্কগুলো ভালো থাকে। তিক্ততা নিয়ে, অসন্তুষ্টি নিয়ে যৌথ পরিবারে থাকার চেয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে পৃথক পরিবারে থাকাই ভালো। খারাপ সম্পর্ক নিয়ে কাছে থাকার চাইতে ভালো সম্পর্ক নিয়ে দূরে থাকা ভালো।