এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৩

কষ্টের ডিপ ফ্রিজ !

প্রতিদিন নিজেকে প্রতিজ্ঞা করাই
আমার কারণে যেন কাউকেও করতে না হয়
একবিন্দু কষ্ট ! আমার ভান্ডারে যা আছে জমা, থাক রক্ষিত
সবটুকু সযতনে । অন্তরের ডিপ ফ্রিজে –
হিমাংকের নিচে !   

দিনশেষে তবু হিসেব মেলেনা । দেখি
নিজের অজান্তে কাউকে দিয়েছি কিছু কষ্ট
হয়তো ফ্রিজের ডিপ সেকশনে একটা সুক্ষ্ণ ছিদ্র
রয়ে গেছে দৃষ্টির আড়ালে । অথবা চুইয়ে পড়েছে কষ্টের নির্যাস
অথবা হাওয়ায় ছড়িয়ে গেছে উদ্বায়ী কষ্টগুলোর 
একটা ছোট টুকরো !

দোহাই তোমাদের
আমার দেয়া কষ্টগুলো ফিরিয়ে দিয়ে যাও
আপাতত রেখে দেবো অন্তরের অন্য কোন প্রকোষ্ঠে
ছাপোষা মানুষ আমি ; মাস শেষে আর কিছু টাকা পেলে -  
মেরামত করিয়ে নেব পুরনো ফ্রিজটা ।   

আমি কিংবদন্তীর কৃপণ হবো , হবো কষ্টের কুবের  । তবু 
কাউকে যেন না দিতে হয় এতটুকু ‘কষ্ট’ ; সবটুকু
আমারই থাকুক ।   

[কষ্টের ডিপ ফ্রিজ / ৩০-১১-২০১৩]
 https://www.facebook.com/muhsin.abdullahmu/posts/10200532045297525

শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

জীবনের জ্যামিতি !

মানুষ  
জীবনের হিসেব মেলাতে চায় , পাটিগণিতের সরল অংকের মত
দিনশেষে ব্যর্থ হয়ে ভাবে –
নাহ , মনে হয় বীজগণিতেই সমাধান !

তারপর
এ প্লাস বি হোল স্কয়ার করে দ্যাখে  , জীবন এইসব সূত্র মেনে চলে না !
হতাশা তখন ঘিরে ধরে ; বৃত্তের মত  !

বৃত্ত ।
জীবনের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে ফুরিয়ে গেলে জীবন
শেষ মুহূর্তগুলিতে হঠাৎ বুঝে আসে সব
জীবন পাটিগণিত নয়, বীজগণিত নয় ত্রিকোনমিতি নয়
এযে জলজ্যান্ত জ্যামিতি !
চতুর্ভুজ নয়, রম্বস নয় , আয়তক্ষেত্র কিংবা সামন্তরিক নয়
বৃত্ত ! জীবনটা কেটে গেছে একটা বৃত্তের ভেতর !

‘পাই’ এর সাথে ব্যাসার্ধের বর্গের গুনফল তার ক্ষেত্র
আর ব্যাসের সাথে ‘পাই’ এর মান গুণ করলে তার পরিধি
ঠিক ঠিক মিলে যায় জীবনের সাথে !
 
[জীবনের জ্যামিতি/ ২৯-১১-২০১৩]
https://www.facebook.com/muhsin.abdullahmu/posts/10200528008796615

বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৩

দীর্ঘশ্বাসের মিছিল !

একটা দীর্ঘশ্বাস হয়তো সংগোপনে হারিয়ে যায়
হয়তো কানের টিম্প্যানিক পর্দায় কম্পন জাগায়না তার শব্দেতর তরঙ্গ 
মাত্র কয়েকটি ধূলিকণার কম্পন - হয়না দৃশ্যমান  
তোমাদের চোখের রেটিনায় । 

দাঁড়াও । কান পেতে শোনো   
অগণিত দীর্ঘশ্বাস আজ হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ  
তোমাদের পাশবিক চোখে ওরা লাগিয়ে দেবে ধূলির আস্তরণ 
ঘূর্ণিবায়ু উড়িয়ে নিয়ে যাবে তোমাদের মুখ ও মুখোশ  
মিলিয়ে দেবে জুলুমের প্রাসাদ আর তার ভেতরের রক্তাভ মসনদ । 

একটা দীর্ঘশ্বাস হয়তো তোমাকে বিচলিত করে না  
তাই বেড়ে চলে দীর্ঘশ্বাসের বিদ্রোহী মিছিল  
ওরা হারিকেন নয় , সুনামি নয় – ওরা দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণিবায়ু 
আবহাওয়া দপ্তর তাই জানাতে পারবেনা কোনও পূর্বাভাস !  

ওরা তেড়ে আসবে অকস্মাৎ অফুরন্ত ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ বুকে নিয়ে 
তোমাদের বিচলিত না করেই  !
[দীর্ঘশ্বাসের মিছিল/ ২৮-১১-২০১৩]

https://www.facebook.com/muhsin.abdullahmu/posts/10200523333559737

বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৩

ফেরারী ভিক্ষুক !

ভুগছি সময়ের দুর্ভিক্ষে
ক্ষুধায় কাতর জীবন ; চোঁ চোঁ করছে পেট, মন ও মনন
কোথা পাই একমুঠো ‘সময়’ ?  

এত চিন্তা এত প্ল্যান এত এত কাজ
অথচ ‘সময়’ এত কম !
সূর্যটা প্রতিদিন হেঁটে যায় অবিরাম চেনা পথে
উপেক্ষা করে আমার আকুল মিনতি
ক্ষণেক দাঁড়াবার ! 
কতটা সূর্যোদয় কতটা পূর্ণিমা কতটা অমাবশ্যা আছে
ভান্ডারে জমা ; তাও জানা নেই ।   

এই দুর্ভিক্ষে এই মঙ্গায় আমি এক ফেরারী ভিক্ষুক
যা আছে সম্বল সব ঢেলে দেবো । তবু
বিনিময়ে কেউ কি দিতে পারো -
একমুঠো ‘সময়’ ?

[ফেরারী ভিক্ষুক/ ২৭-১১-২০১৩]

https://www.facebook.com/muhsin.abdullahmu/posts/10200518567760595

অপরাধী লাশ!



আমার হাতে লাল রক্তের ছোপ
ঠোঁটের দু’পাশ হতে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত 
ভ্যাম্পায়ারের মত!

স্বীকার করছি কিংবা করতে বাধ্য হচ্ছি –আমি অপরাধী
ভাবছেন- আমি খুনী? নারে ভাই
আসলে আমিই খুন হয়ে গেছি 
খুন হয়ে যাওয়াই যে এখানে অপরাধ!   

এই দেশে খুনিদের হাত থাকে ঝকঝকে 
পুলিশের খাতায় তারা হয়না আসামী, 
কেন মরে গেল- সে হিসেব দিতে হয় মৃতকেই! 

[লাশ/ ২৭-১১-২০১৩]

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

সুখের সহজ সংজ্ঞা !



কোকিল ডাকা সুবহে সাদিকে    
এক দমকা হিমেল হাওয়া  
এক বিকেলে ধুলোময় মেঠোপথে 
কিছুদূর হেঁটে যাওয়া 

শীত শীত ভোরে একচিলতে মিঠে রোদ্দুর, 
নীল আকাশে এক টুকরো কালো মেঘ  
এক ফোঁটা মন ভেজানো বৃষ্টি  ! 

স্নেহময় হাতের একটা শীতল পরশ, 
কোন একজনের ভালোলাগা চোখে- 
এক মুহূর্তের মায়াভরা দৃষ্টি !  

এর বেশি আশা করো না  
পৃথিবীর ক্ষণিক এই জীবনে ;
ভেবে নিও - এইতো সুখ  
এইতো পরম প্রাপ্তি ! 

[সুখের সহজ সংজ্ঞা/ ২৬-১১-২০১৩]

সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৩

ভালোবাসার এট্রফি হয়না !

মনে করো আধা শতাব্দী পরে
জীর্ণ শরীর-শীর্ণ পায়ে আনমনে হাঁটবার কালে
হয়ে গেল দেখা তোমার সাথে, হঠাৎ একদিন গোধূলী বেলায়
তিস্তার কোন এক শুকনো বাঁকে ; কাশফুলে ছাওয়া শুভ্র বালুচরে !

ভুলে যাবো সময়ের হিসেব , আমি নিশ্চিত
ধমনী-শিরায় রক্তকণিকাগুলি দাপিয়ে উঠবে - আগ্নেয়গিরির লাভা কিংবা
একদা মাতাল তিস্তার অবাধ্য ঢেউয়ের মত !

আমার পঁচাশি বছর বয়স্ক ক্যাটারাক্ট আক্রান্ত ঝাপসা চোখে
জ্বলে উঠবে হয়তো একটা সূর্যই ! কিংবা অন্তত কয়েক কোটি শুকতারা
আর্থ্রাইটিসে জর্জরিত কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে দেবো অজান্তে
তোমার দিকে । এট্রোফি হয়ে যাওয়া কিছু নিউরণ চরম উচ্ছ্বাসে গেয়ে উঠবে –
চলো বন্ধু আর একবার মেতে উঠি পুরনো খেলায় !

মানুষের বয়স বাড়ে – মস্তিষ্কে এট্রফি হয় । কিন্তু
ভালোবাসার এতটুকু এট্রফি হয় না !

স্যাক্রিফাইস



.
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে । হলুদ ভাব কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে লাল আভা ফিরে আসছে সূর্যটায় । দীঘির বাঁধানো ঘাটে একা একা বসে আছে অপু । ওর চোখ ছলছল করছে । ইটের টুকরো গুলো কিছুক্ষণ পরপর ছুড়ে দিচ্ছে দীঘির নীল পানিতে । দুলে উঠছে কচুরিপানাগুলো । ছোট ছোট ঢেউ গিয়ে শেষ হচ্ছে পাড়ে ধাক্কা খেয়ে । একটা ঢেউ শেষ হলে আরেকটা ঢিল ছুড়ছে অপু ।

এক ঘণ্টারও বেশি হলো অপু এখানে চুপচাপ বসে আছে । চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু দাগ রেখে গেছে । কিছুক্ষণ পরপর ফুলে ফুলে উঠছে ঠোঁট, ওঠানামা করছে বুক ।

অপু ক্লাস ফাইভে পড়ে । আজ ওর বুবুর বিয়ে ওর একমাত্র বড়বোন । মিনাবুবু ।  বাড়িতে বিয়েবাড়ির সব আয়োজন চলছে । এতক্ষণে হয়তো বরযাত্রীরা চলে এসেছে । আসরের নামাজের পরই তাদের আসার কথা ।
সকালবেলা থেকে বাড়ির আশপাশের পুরোটা রংবেরঙের কাগজ, রঙ্গিন গেট, ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে । কাজিনরা অনেকে পটকা-বাজি কিনে এনেছে । তারা সকাল থেকে মাঝে মাঝেই সেগুলো ফুটাচ্ছিল । প্রথম প্রথম অপুরও মনে হয়েছিল – এটা বুঝি একটা আনন্দানুষ্ঠান । কিন্তু দুপুরের পর যখন বড়দের ভেতর আলাপ আলোচনা চলতে লাগলো- বরযাত্রী কখন আসবে, মেয়েকে কখন নিয়ে যাবে , মেয়েকে সাজানোর কতদূর হলো ইত্যাদি তখন থেকে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটা বুঝে আসতে লাগলো অপুরমনটা খুব খারাপ হতে লাগলো ওর । ও বুঝতে পারছিল- আজ থেকে বুবু এই বাড়িতে থাকবে না । অন্য কোথাও যাবে । এখন থেকে অন্য কোন বাড়িতে থাকবে বুবু । অপুর সাথে তাঁর আর সকাল বিকেল দেখা হবেনা ।

বিকেল হলে অপু চলে এসেছে ওর প্রিয় জায়গা এই দীঘির পাড়ে । ওদের বাড়ি থেকে দীঘির দুরত্ব আধা কিলোমিটারের মত বিকেল বেলা বুবুর সাথে প্রায়ই আসত এখানে । বুবুই নিয়ে আসত । কত কথা বলতো ওরা এই ঘাটে বসে । পানিতে পা ডুবিয়ে বসে বসে মাঝে মাঝে গান গাইতো ওরা । এই ঘাটে বুবু আর বসবে না ? অপু এখন থেকে একা হয়ে যাবে ? ভাবতেই ঠোঁট ফুলে কান্না আসছে অপুর ।
কত কথা মনে পড়ছে । ছোটবেলা থেকে বুবুর আদরে বড় হচ্ছে অপু । কখনো কল্পনাও করেনি বুবুকে ছেড়ে থাকতে হবে । এখানে বসেই বুবু ওকে ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে শোনাতো দুর্গা যেদিন মারা গেল, ওরা দুজনে খুব কেঁদেছিলসেদিন বুবু বলেছিল , একদিন সেও চলে যাবে । অপু জড়িয়ে ধরে বলেছিল , আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবনা ।
অথচ আজ ঠিকই বুবু  চলে যাবে । ও কীভাবে আটকাবে ? বড়রা সবাই মিলে বিয়ে দিচ্ছে বুবুকে । বড়দের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কিছু করতে পারবে অপু ? ওর কথা কে শুনবে ? তাই অপু চলে এসেছে । ও আর বাড়ি ফিরে যাবেনা । যেখানে বুবু থাকবেনা, সেখানে অপুও থাকবেনা ।

এ বাড়িতে থাকলে সমস্যা কী ? কেন বিয়ে দিতে হবে ? আর বিয়ে হলেই বা কেন অচেনা অজানা এক বাড়িতে চলে যেতে হবে ? অপুর বুঝে আসেনা । দরকার হলে ও না খেয়ে থাকবে, এক প্লেট ভাত ভাগ করে খাবে তবু বুবুকে ছাড়া থাকতে পারবেনা ।

আঙ্গিনায় খেজুর পাতার মাদুর বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো ওরা । মিনাবুবু, পাশের বাড়ির নাজমা বু, আর অপু । অপুকে মাঝখানে শুইয়ে কত কথা বলতো ওরা দুই বান্ধবী । মাঝে মাঝে উল্কা ছুটে আসতো আকাশ থেকে । সাত ভাই চম্পা, কালপুরুষ , তিন সৈনিক , মা মরা তারা – কত তারার কত নাম । হাত ধরে দেখিয়ে দেখিয়ে চিনিয়ে দিত অপুকে । একটা তারা দুইটা তারা, ঐ তারাটার মা মরা । সাত ভাই চম্পার গল্প শুনতে শুনতে কতদিন ঘুমিয়ে গেছে সে । সব তারাদের নিয়েই গল্প আছে । বুবুর মুখে তন্ময় হয়ে সেগুলো শুনতো অপু । ওকে নিয়ে চাঁদের জোছনায় বিনা কারণে বসে থাকতো বুবু । কী ভাবতো কে জানে ! বুবুর মুখে চাঁদের বুড়ির গল্প , চরকায় সুতা কাটার গল্প শুনতে কী যে ভালো লাগে অপুর ! বুবু আজ চলে যাবে ? বারান্দায় শুয়ে খোলা আকাশের তারাদের গল্প আর শোনা হবেনা অপুর !   
নাজমা বু-টারও নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে । পরের মাসেই তারও বিয়ে । কোথায় চলে যাবে ওরা , হয়তো দু-বান্ধবীতেও আর খুব একটা দেখা হবেনা । বিয়ের পর  সারাজীবনে আর ক’বারই বা দেখা হয় বান্ধবীদের ?

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে একটু পরেই । না, আজ অপু এখানেই বসে থাকবে । যদিও খুব ইচ্ছে হচ্ছে বুবুর কাছে গিয়ে বসে থাকতে । কিন্তু পরক্ষণেই মন বিদ্রোহ করে উঠছে- কেন যাবে সে বুবুর কাছে ? বুবু কেন বিয়েতে সায় দিল ? বলে দিলেই পারতো, আমি বিয়ে করবোনা ! অপুর কথা কি তার একবারও মনে আসেনি ?
চোখ মুছে সামনের দিকে তাকালো অপু । দুএকটা জোনাকী জ্বলে উঠছে আশেপাশেজ্বলুক জোনাকীরা । আজ ওদের প্রতি কোন আগ্রহ নেই অপুর ।

আচ্ছা বুবু কি আগে থেকেই জানতো যে একদিন অপুকে একা রেখে চলে যেতে হবে ? সন্ধ্যা হলে বুবু মাঝে মাঝেই অপুকে নিয়ে বের হতো । বাড়ির সামনের দিকটায় বুবুর হাতে গড়া ছোট্ট বাগান । পেয়ারা, ডালিম, লেবু, আর মেহেদি গাছ । গোলাপ, পাতাবাহার, জবা, গাঁদা ফুলের গাছ । বাগানে জোনাকীদের মেলা বসে সন্ধ্যা হলেই । ওখানে জোনাক পোকা ধরতো ওরা । জোনাক পোকা ধরা সহজ, কিন্তু খুব সহজ না । হাতের ফাঁক গলে ওরা বেরিয়ে যায় । অপুর ছোট্ট হাতে সহজে আটকানো যেত না জোনাকী । বুবু ধরে দিলে, সেটাকে দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে অবাক চোখে জোনাকীর জ্বলা-নেভা দেখতো সে ।  হাতের মুঠোর ভেতর জোনাক পোকার ঝিলমিল আলো দেখতে খুব ভালো লাগে অপুর ।
বুবু জোনাকী পোকা নিয়ে খেলার সময় আবৃত্তি করতো-

‘পুকুর ধারে লেবুর তলে, 
থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে, 
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই, 
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই ?   
বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, 
মাগো আমার শোলক্-বলা কাজলা দিদি কই ?’    

বুবুর মুখে শুনে শুনেই অপুর মুখস্ত হয়ে গেছে ছড়াটা । চোখের সামনে জোনাক পোকা ধরে বুবু একদিন বলেছিল, ‘অপু- ভাই আমার , আমি চলে গেলে তুই কাঁদবি নাতো ?’
কী বলবে অপু ? সবসময় যা বলে, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে ? আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবোনা ।’

অথচ আজ ! অপুর চোখ আবার ভিজে যায় ।

.....................
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ । কিছুক্ষণ পরেই মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে বরপক্ষ । অপু কোথায় ? অপুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।
মিনা’র ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে । এই বাড়ির প্রতিটি ধুলিকণার সাথে তার পরিচয় , সখ্যতা । বাবা-মা, অপু,  এই গ্রাম , এই পুকুরঘাট , এই নদী , এই গ্রামের মানুষ সবকিছু রেখে চলে যেতে হচ্ছে । বেঁচে থাকতেই পর হয়ে যাচ্ছে সব । তিলতিল করে গড়ে ওঠা ভালোবাসা, মায়ার পর্বত ভেঙ্গে দিতে হচ্ছে নিজ হাতে !

সারাজীবনের জন্য দূরে চলে যাচ্ছে সে । হয়তো মাঝে মাঝে আসা হবে । হয়তো কিছুক্ষণ, কিছু দিনের জন্য দেখা হবে কখনো সখনো
এখন থেকে তাকে নতুন একটি পরিবেশ, নতুন একটি পরিবার, নতুন একটা জায়গাকে আবার আপন করে নিতে হবে সম্পুর্ণ নতুন করে । কতটুকু ভালো লাগবে নাকি আদৌ লাগবে না , তার জানা নেই । ভালো না লাগলেও ভালবাসতে হবে । শরীরের প্রতিটি লোমকূপের সাথে পরিচয় যে মাটির, যে গাছপালাগুলির, যে পোষা কুকুর-বিড়াল-কবুতরের, তাকে ছেড়ে যেতে হবে । এটা কি নতুন ধাঁচের এক নির্বাসন ? কেন শুধু মেয়েকেই চলে যেতে হয় ?

অনেকক্ষণ হলো অপুকে দেখেনি মিনা । কেউ দেখেনি অপুকে । বিয়ের কবুল বলা শেষ । খাওয়া দাওয়া শেষ । আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যেতে হবে । বরপক্ষের মুরুব্বীরা তাগাদা দিচ্ছেন । বেশি রাত করা যাবেনা , তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে ।

সাহস করে বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না মিনা । বিয়ে বাড়িতে বাজানো যেসব গান সে আগে শুনেছিল , আজ যেন তারই বুকের ভেতর সেগুলো বাজছে – ‘আমি যাচ্ছি বাবা... যাচ্ছি...বাবা খেয়াল রেখো তুমি তোমার প্রতি...’ । বাবা মানসিকভাবে শক্ত , কিন্তু উদাসীন আত্মভোলা মানুষ । ওষুধ খেতে ভুলে যান, চশমা খুঁজে পান না । বাবার সাথে কত স্মৃতি । বাবার বুকে কিসের ঝড় বইছে কে জানে ! বাবাকে রেখে যেতে হবে আজ । কেন ? কিসের প্রয়োজনে ? নিজের , নাকি সমাজের ?  

মা মা’র কথা ভাবতেই পারছে না মিনা । এ এক অতলান্ত কষ্ট । নারীর নাড়ী ছেড়ার কষ্ট । বিয়ের কথা শুরু হবার পর মিনার মন খারাপ দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলেছিল- ‘মারে, আমাদের কথা ভাবিস না । সব মেয়েকেই একদিন মায়ের আঁচল ছাড়তে হয় একদিন তুইও মা হবি, তখন বুঝবি’ ।

যাকেই পাচ্ছে তাকেই মিনা জিজ্ঞেস করছে অপুর কথা । ওকে খুঁজে আনো । আমার ভাই কোথায় গেল ? ওকে না দেখে আমি যাবো কীভাবে ?
বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও অপুকে বাড়ির আশেপাশে পাওয়া গেলনা । অনেকক্ষণ ধরে কেউ তাকে দেখেনি । একা একা কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে ? মিনা’র হঠাৎ মনে হলো, অপু দীঘির ঘাটে যায়নি তো !

কয়েকজন মিলে দীঘিঘাটে গিয়ে পেল অপুকে । এখন আর কাঁদছেনা সে । ফোলা ফোলা মুখ, গাল ভিজে আছে নোনতা জলে । সিঁড়িতে বসে আছে চুপচাপ , কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ।
পাজাকোলা করে তুলে আনা হলো অপুকে বুবুকে দেখেই আবার কেঁদে উঠলো সে । ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ ? তুমি নিষ্ঠুর !’ মিনার চোখও বাধ মানলো না । হঠাৎ যেন কান্নার বাধভাঙ্গা ঢেউ আছড়ে পড়লো । সমুদ্র যেন অপেক্ষা করছিল শুধু একটা ঝড়ো বাতাসের । পুরো ঘরে গমকে উঠলো কান্নার ঢেউ । অপু কাঁদছে, মিনা কাঁদছে, বাবা কাঁদছেন , মা কাঁদছেন । মিনা’র বান্ধবীরা, যারা সারাদিন ওকে সাহস দিয়েছে , হাসি ঠাট্টা করেছে- তারাও শেষ মুহুর্তে আবেগকে লুকিয়ে রাখতে পারলো না ।
কোনভাবেই বোঝাতে না পেরে ছোট্ট অপুকেও মিনার সাথে তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হল ।
....................................

.
বিয়েতে বরের চোখে অশ্রুবিন্দু সাধারণত দেখা যায় না । বলতে গেলে একেবারেই দেখা যায় না । তাই আজ বিয়েবাড়ির সবাই অবাক হয়ে গেল । কিন্তু আজ অপুর বিয়ে । ডাঃ অপু । দু’বছর আগে এমবিবিএস পাস করেছে সে । একটু পরেই জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে ফিরে যাবে বাড়িতে । বিয়ের আসরে নাকে রুমাল চেপে সব ছেলেরা হয়তো ভাবে, ‘পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম’ । কিন্তু অপু বসে বসে ভাবছিল তার ছোটবেলার কথা । বুবুর চলে যাওয়ায় কত কষ্ট পেয়েছিল সে । বুবুও কি কম কষ্ট পেয়েছিল ?
আজ যাকে সে সারাজীবনের জন্য নিয়ে যেতে এসেছে তার কষ্টটা কি কেউ অনুভব করতে পারছে ?

বুবু অবশ্য আজ তার বিয়েতে এসেছে । পাশেই বসেছে । জানে, ভাইটি তাঁর খুব আবেগপ্রবণ । অপুর বাম হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে তার নবপরিণীতা বউ । হয়তো ভাবছে- এ বাড়ির প্রিয় সবকিছু ছাড়ার জন্য অন্তত একটি হাত তাকে শক্তি যোগাক । প্রাণপন চেষ্টা করেও অশ্রু রুখতে পারছেনা সে । অপুও ডান হাতে রুমাল দিয়ে বারবার চোখ মুছছে । যদিও বুবু বারবার বলছে ‘ধুর বোকা, নিজের বিয়েতে কোন ছেলে কাঁদে !’  তবু, একমাত্র বুবুই বুঝবে কেন এই কান্না ।

একটা সংসার শুরুর প্রয়োজনে জীবনের শুরুতেই একজন মেয়েকে যতটা স্যাক্রিফাইস করতে হয় , একজন ছেলেকে সারাজীবনেও কি তা করতে হয় ?
অপু বোঝে । বেড়ে ওঠার সব অবলম্বনকে একদিনে পর করে দেয়া সহজ কথা নয় । কালবৈশাখী ঝড়ে নীড়হারা, স্বজনহারা পাখিই শুধু জানে তার কষ্ট কতটা গভীর । 

[স্যাক্রিফাইস/Muhsin Abdullah Mu/২২-১১-২০১৩] 
ফেসবুক স্ট্যাটাস লিংক https://www.facebook.com/muhsin.abdullahmu/posts/10200487872393230