১.
সূর্য
পশ্চিমে হেলে পড়েছে । হলুদ ভাব কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে লাল আভা ফিরে আসছে সূর্যটায় ।
দীঘির বাঁধানো ঘাটে একা একা বসে আছে অপু । ওর চোখ ছলছল করছে । ইটের টুকরো গুলো কিছুক্ষণ
পরপর ছুড়ে দিচ্ছে দীঘির নীল পানিতে । দুলে উঠছে কচুরিপানাগুলো । ছোট ছোট ঢেউ গিয়ে
শেষ হচ্ছে পাড়ে ধাক্কা খেয়ে । একটা ঢেউ শেষ হলে আরেকটা ঢিল ছুড়ছে অপু ।
এক
ঘণ্টারও বেশি হলো অপু এখানে চুপচাপ বসে আছে । চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু দাগ
রেখে গেছে । কিছুক্ষণ পরপর ফুলে ফুলে উঠছে ঠোঁট, ওঠানামা করছে বুক ।
অপু
ক্লাস ফাইভে পড়ে । আজ ওর বুবুর বিয়ে । ওর একমাত্র বড়বোন । মিনাবুবু । বাড়িতে বিয়েবাড়ির সব আয়োজন চলছে । এতক্ষণে হয়তো
বরযাত্রীরা চলে এসেছে । আসরের নামাজের পরই তাদের আসার কথা ।
সকালবেলা
থেকে বাড়ির আশপাশের পুরোটা রংবেরঙের কাগজ, রঙ্গিন গেট, ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে
। কাজিনরা অনেকে পটকা-বাজি কিনে এনেছে । তারা সকাল থেকে মাঝে মাঝেই সেগুলো
ফুটাচ্ছিল । প্রথম প্রথম অপুরও মনে হয়েছিল – এটা বুঝি একটা আনন্দানুষ্ঠান । কিন্তু
দুপুরের পর যখন বড়দের ভেতর আলাপ আলোচনা চলতে লাগলো- বরযাত্রী কখন আসবে, মেয়েকে কখন
নিয়ে যাবে , মেয়েকে সাজানোর কতদূর হলো ইত্যাদি তখন থেকে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটা
বুঝে আসতে লাগলো অপুর । মনটা খুব খারাপ হতে লাগলো ওর । ও বুঝতে পারছিল- আজ থেকে বুবু এই বাড়িতে থাকবে না । অন্য
কোথাও যাবে । এখন থেকে অন্য কোন বাড়িতে থাকবে বুবু । অপুর সাথে তাঁর আর সকাল বিকেল
দেখা হবেনা ।
বিকেল
হলে অপু চলে এসেছে ওর প্রিয় জায়গা এই দীঘির পাড়ে । ওদের বাড়ি থেকে দীঘির দুরত্ব
আধা কিলোমিটারের মত । বিকেল বেলা বুবুর সাথে প্রায়ই আসত এখানে । বুবুই নিয়ে আসত । কত কথা বলতো ওরা
এই ঘাটে বসে । পানিতে পা ডুবিয়ে বসে বসে মাঝে মাঝে গান গাইতো ওরা । এই ঘাটে বুবু আর বসবে
না ? অপু এখন থেকে একা হয়ে যাবে ? ভাবতেই ঠোঁট ফুলে কান্না আসছে অপুর ।
কত কথা
মনে পড়ছে । ছোটবেলা থেকে বুবুর আদরে বড় হচ্ছে অপু । কখনো কল্পনাও করেনি বুবুকে
ছেড়ে থাকতে হবে । এখানে বসেই বুবু ওকে ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে শোনাতো । দুর্গা যেদিন মারা গেল, ওরা দুজনে খুব কেঁদেছিল । সেদিন বুবু বলেছিল , একদিন সেও চলে যাবে । অপু জড়িয়ে ধরে
বলেছিল , আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবনা ।
অথচ আজ
ঠিকই বুবু চলে যাবে । ও কীভাবে আটকাবে ?
বড়রা সবাই মিলে বিয়ে দিচ্ছে বুবুকে । বড়দের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কিছু করতে পারবে অপু
? ওর কথা কে শুনবে ? তাই অপু চলে এসেছে । ও আর বাড়ি ফিরে যাবেনা । যেখানে বুবু
থাকবেনা, সেখানে অপুও থাকবেনা ।
এ
বাড়িতে থাকলে সমস্যা কী ? কেন বিয়ে দিতে হবে ? আর বিয়ে হলেই বা কেন অচেনা অজানা এক
বাড়িতে চলে যেতে হবে ? অপুর বুঝে আসেনা । দরকার হলে ও না খেয়ে থাকবে, এক প্লেট ভাত
ভাগ করে খাবে । তবু বুবুকে ছাড়া থাকতে পারবেনা ।
আঙ্গিনায়
খেজুর পাতার মাদুর বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো ওরা । মিনাবুবু,
পাশের বাড়ির নাজমা বু, আর অপু । অপুকে মাঝখানে শুইয়ে কত কথা বলতো ওরা দুই বান্ধবী
। মাঝে মাঝে উল্কা ছুটে আসতো আকাশ থেকে । সাত ভাই চম্পা, কালপুরুষ , তিন সৈনিক ,
মা মরা তারা – কত তারার কত নাম । হাত ধরে দেখিয়ে দেখিয়ে চিনিয়ে দিত অপুকে । একটা
তারা দুইটা তারা, ঐ তারাটার মা মরা । সাত ভাই চম্পার গল্প শুনতে শুনতে কতদিন
ঘুমিয়ে গেছে সে । সব তারাদের নিয়েই গল্প আছে । বুবুর মুখে তন্ময় হয়ে সেগুলো শুনতো
অপু । ওকে নিয়ে চাঁদের জোছনায় বিনা কারণে বসে থাকতো বুবু । কী ভাবতো কে জানে
! বুবুর মুখে চাঁদের বুড়ির গল্প , চরকায় সুতা কাটার গল্প শুনতে কী যে ভালো লাগে
অপুর ! বুবু আজ চলে যাবে ? বারান্দায় শুয়ে খোলা আকাশের তারাদের গল্প আর শোনা হবেনা
অপুর !
নাজমা
বু-টারও নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে । পরের মাসেই তারও বিয়ে । কোথায় চলে যাবে ওরা , হয়তো
দু-বান্ধবীতেও আর খুব একটা দেখা হবেনা । বিয়ের পর
সারাজীবনে আর ক’বারই বা দেখা হয় বান্ধবীদের ?
সন্ধ্যা
হয়ে এসেছে । অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে একটু পরেই । না, আজ অপু এখানেই বসে থাকবে । যদিও
খুব ইচ্ছে হচ্ছে বুবুর কাছে গিয়ে বসে থাকতে । কিন্তু পরক্ষণেই মন বিদ্রোহ করে
উঠছে- কেন যাবে সে বুবুর কাছে ? বুবু কেন বিয়েতে সায় দিল ? বলে দিলেই পারতো, আমি
বিয়ে করবোনা ! অপুর কথা কি তার একবারও মনে আসেনি ?
চোখ
মুছে সামনের দিকে তাকালো অপু । দুএকটা জোনাকী জ্বলে উঠছে আশেপাশে । জ্বলুক জোনাকীরা । আজ
ওদের প্রতি কোন আগ্রহ নেই অপুর ।
আচ্ছা
বুবু কি আগে থেকেই জানতো যে একদিন অপুকে একা রেখে চলে যেতে হবে ? সন্ধ্যা হলে বুবু
মাঝে মাঝেই অপুকে নিয়ে বের হতো । বাড়ির সামনের দিকটায় বুবুর হাতে গড়া ছোট্ট বাগান
। পেয়ারা, ডালিম, লেবু, আর মেহেদি গাছ । গোলাপ, পাতাবাহার, জবা, গাঁদা ফুলের গাছ ।
বাগানে জোনাকীদের মেলা বসে সন্ধ্যা হলেই । ওখানে জোনাক পোকা ধরতো ওরা । জোনাক পোকা
ধরা সহজ, কিন্তু খুব সহজ না । হাতের ফাঁক গলে ওরা বেরিয়ে যায় । অপুর ছোট্ট হাতে
সহজে আটকানো যেত না জোনাকী । বুবু ধরে দিলে, সেটাকে দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে আঙ্গুলের
ফাঁক দিয়ে অবাক চোখে জোনাকীর জ্বলা-নেভা দেখতো সে । হাতের মুঠোর ভেতর জোনাক পোকার ঝিলমিল আলো দেখতে
খুব ভালো লাগে অপুর ।
বুবু
জোনাকী পোকা নিয়ে খেলার সময় আবৃত্তি করতো-
‘পুকুর
ধারে লেবুর তলে,
থোকায়
থোকায় জোনাক জ্বলে,
ফুলের
গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই,
মাগো
আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই ?
বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো
আমার শোলক্-বলা কাজলা দিদি কই ?’
বুবুর
মুখে শুনে শুনেই অপুর মুখস্ত হয়ে গেছে ছড়াটা । চোখের সামনে জোনাক পোকা ধরে বুবু
একদিন বলেছিল, ‘অপু- ভাই আমার , আমি চলে গেলে তুই কাঁদবি নাতো ?’
কী বলবে
অপু ? সবসময় যা বলে, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে ? আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবোনা
।’
অথচ আজ
! অপুর চোখ আবার ভিজে যায় ।
.....................
বিয়ের
আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ । কিছুক্ষণ পরেই মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে বরপক্ষ । অপু কোথায়
? অপুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।
মিনা’র
ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে । এই বাড়ির প্রতিটি ধুলিকণার সাথে তার পরিচয় , সখ্যতা ।
বাবা-মা, অপু, এই গ্রাম , এই পুকুরঘাট ,
এই নদী , এই গ্রামের মানুষ সবকিছু রেখে চলে যেতে হচ্ছে । বেঁচে থাকতেই পর হয়ে
যাচ্ছে সব । তিলতিল করে গড়ে ওঠা ভালোবাসা, মায়ার পর্বত ভেঙ্গে দিতে হচ্ছে নিজ হাতে
!
সারাজীবনের
জন্য দূরে চলে যাচ্ছে সে । হয়তো মাঝে মাঝে আসা হবে । হয়তো কিছুক্ষণ, কিছু দিনের
জন্য দেখা হবে কখনো সখনো ।
এখন
থেকে তাকে নতুন একটি পরিবেশ, নতুন একটি পরিবার, নতুন একটা জায়গাকে আবার আপন করে
নিতে হবে । সম্পুর্ণ নতুন করে । কতটুকু ভালো লাগবে নাকি আদৌ
লাগবে না , তার জানা নেই । ভালো না লাগলেও ভালবাসতে হবে । শরীরের প্রতিটি লোমকূপের
সাথে পরিচয় যে মাটির, যে গাছপালাগুলির, যে পোষা কুকুর-বিড়াল-কবুতরের, তাকে ছেড়ে
যেতে হবে । এটা কি নতুন ধাঁচের এক নির্বাসন ? কেন শুধু মেয়েকেই চলে যেতে হয় ?
অনেকক্ষণ
হলো অপুকে দেখেনি মিনা । কেউ দেখেনি অপুকে । বিয়ের কবুল বলা শেষ । খাওয়া দাওয়া শেষ
। আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যেতে হবে । বরপক্ষের মুরুব্বীরা তাগাদা দিচ্ছেন । বেশি
রাত করা যাবেনা , তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে ।
সাহস
করে বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না মিনা । বিয়ে বাড়িতে বাজানো যেসব গান সে আগে
শুনেছিল , আজ যেন তারই বুকের ভেতর সেগুলো বাজছে – ‘আমি যাচ্ছি বাবা... যাচ্ছি...বাবা
খেয়াল রেখো তুমি তোমার প্রতি...’ । বাবা মানসিকভাবে শক্ত , কিন্তু উদাসীন আত্মভোলা
মানুষ । ওষুধ খেতে ভুলে যান, চশমা খুঁজে পান না । বাবার সাথে কত স্মৃতি । বাবার
বুকে কিসের ঝড় বইছে কে জানে ! বাবাকে রেখে যেতে হবে আজ । কেন ? কিসের প্রয়োজনে ?
নিজের , নাকি সমাজের ?
মা । মা’র কথা ভাবতেই পারছে না মিনা । এ এক
অতলান্ত কষ্ট । নারীর নাড়ী ছেড়ার কষ্ট । বিয়ের কথা শুরু হবার পর মিনার মন খারাপ
দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলেছিল- ‘মারে, আমাদের কথা ভাবিস না । সব মেয়েকেই একদিন
মায়ের আঁচল ছাড়তে হয় । একদিন তুইও মা
হবি, তখন বুঝবি’ ।
যাকেই
পাচ্ছে তাকেই মিনা জিজ্ঞেস করছে অপুর কথা । ওকে খুঁজে আনো । আমার ভাই কোথায় গেল ? ওকে
না দেখে আমি যাবো কীভাবে ?
বেশ
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও অপুকে বাড়ির আশেপাশে পাওয়া গেলনা । অনেকক্ষণ ধরে কেউ
তাকে দেখেনি । একা একা কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে ? মিনা’র হঠাৎ মনে হলো, অপু
দীঘির ঘাটে যায়নি তো !
কয়েকজন
মিলে দীঘিঘাটে গিয়ে পেল অপুকে । এখন আর কাঁদছেনা সে । ফোলা ফোলা মুখ, গাল ভিজে আছে
নোনতা জলে । সিঁড়িতে বসে আছে চুপচাপ , কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ।
পাজাকোলা
করে তুলে আনা হলো অপুকে । বুবুকে দেখেই আবার কেঁদে উঠলো সে । ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ ? তুমি নিষ্ঠুর !’ মিনার চোখও
বাধ মানলো না । হঠাৎ যেন কান্নার বাধভাঙ্গা ঢেউ আছড়ে পড়লো । সমুদ্র যেন অপেক্ষা
করছিল শুধু একটা ঝড়ো বাতাসের । পুরো ঘরে গমকে উঠলো কান্নার ঢেউ । অপু কাঁদছে, মিনা
কাঁদছে, বাবা কাঁদছেন , মা কাঁদছেন । মিনা’র বান্ধবীরা, যারা সারাদিন ওকে সাহস
দিয়েছে , হাসি ঠাট্টা করেছে- তারাও শেষ মুহুর্তে আবেগকে লুকিয়ে রাখতে পারলো না ।
কোনভাবেই
বোঝাতে না পেরে ছোট্ট অপুকেও মিনার সাথে তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হল ।
....................................
২.
বিয়েতে
বরের চোখে অশ্রুবিন্দু সাধারণত দেখা যায় না । বলতে গেলে একেবারেই দেখা যায় না ।
তাই আজ বিয়েবাড়ির সবাই অবাক হয়ে গেল । কিন্তু আজ অপুর বিয়ে । ডাঃ অপু । দু’বছর আগে
এমবিবিএস পাস করেছে সে । একটু পরেই জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে ফিরে যাবে বাড়িতে । বিয়ের
আসরে নাকে রুমাল চেপে সব ছেলেরা হয়তো ভাবে, ‘পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম’ । কিন্তু
অপু বসে বসে ভাবছিল তার ছোটবেলার কথা । বুবুর চলে যাওয়ায় কত কষ্ট পেয়েছিল সে ।
বুবুও কি কম কষ্ট পেয়েছিল ?
আজ যাকে
সে সারাজীবনের জন্য নিয়ে যেতে এসেছে তার কষ্টটা কি কেউ অনুভব করতে পারছে ?
বুবু অবশ্য
আজ তার বিয়েতে এসেছে । পাশেই বসেছে । জানে, ভাইটি তাঁর খুব আবেগপ্রবণ । অপুর বাম
হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে তার নবপরিণীতা বউ । হয়তো ভাবছে- এ বাড়ির প্রিয় সবকিছু
ছাড়ার জন্য অন্তত একটি হাত তাকে শক্তি যোগাক । প্রাণপন চেষ্টা করেও অশ্রু রুখতে পারছেনা
সে । অপুও ডান হাতে রুমাল দিয়ে বারবার চোখ মুছছে । যদিও বুবু বারবার বলছে ‘ধুর
বোকা, নিজের বিয়েতে কোন ছেলে কাঁদে !’ তবু,
একমাত্র বুবুই বুঝবে কেন এই কান্না ।
একটা
সংসার শুরুর প্রয়োজনে জীবনের শুরুতেই একজন মেয়েকে যতটা স্যাক্রিফাইস করতে হয় ,
একজন ছেলেকে সারাজীবনেও কি তা করতে হয় ?
অপু
বোঝে । বেড়ে ওঠার সব অবলম্বনকে একদিনে পর করে দেয়া সহজ কথা নয় । কালবৈশাখী ঝড়ে
নীড়হারা, স্বজনহারা পাখিই শুধু জানে তার কষ্ট কতটা গভীর ।
[স্যাক্রিফাইস/Muhsin
Abdullah Mu/২২-১১-২০১৩]