এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

সীমানাহীন পৃথিবীর স্বপ্ন

একটা সময় ছিল পুরো পৃথিবীটা ছিল ‘মানুষের’ । 

পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে মানুষ যেতে পারতো অন্য কোন প্রান্তে । বিনা বাধায় । এভাবেই সারা পৃথিবীর মানুষ ছড়িয়ে পড়ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে । আরব থেকে ভারত, চীন , আফ্রিকার দেশে ।

আজ আর সেটা সম্ভব নয় । এখন অনেক বাধা বিপত্তি পার হতে হয় কোথাও যেতে হলে । পৃথিবীটা ভাগ হয়ে গেছে অনেকগুলো ‘কারাগারে’ । 
এই কারাগারগুলোকে বলা হচ্ছে ‘দেশ’ ।

একটা কারাগারে কী থাকে ? অনেক কিছুই থাকে , আবার অনেক কিছুর অভাব থাকে । কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয়টা যা মানুষকে কষ্ট দেয়- যেখানে ইচ্ছা যেতে না পারার কষ্ট । বিপদে পড়া প্রিয়জনের সাহায্যে আসতে না পারার কষ্ট । খোলা আকাশের নিচে হাঁটতে না পারার কষ্ট । বাইরে অনেক খাবার আছে , কিন্তু সীমানা প্রাচীরের কারণে কেউ খাবার দিতে পারবেনা ।

‘দেশ’ এর সীমানা আমাদের আজ একেকটা বড় বড় কারাগারে আবদ্ধ করে রেখেছে । সীমান্তে পাহারা , কাটাতারের বেড়া । এক ভূখন্ড থেকে আরেক ভূখন্ডে যেতে লাগবে ‘পাসপোর্ট’, ‘ভিসা’ । এই সিস্টেমটা ১০০ বছর আগেও এরকম ছিল না । আধুনিক পাসপোর্টের যাত্রা শুরু হয় সম্ভবত ব্রিটেনে ১৯১৪ সালের দিকে ।
১৯৪৭ সালের আগে রংপুরের একজন মানুষ যেতে পারতো দিল্লী, যেতে পারতো ইসলামাবাদ । আফগানিস্তান । একটা সময় বাংলাদেশের মানুষ হেঁটে হেঁটে চলে যেত বোম্বে । সেখান থেকে জাহাজে চড়ে আরব ।

অথচ এখন আমরা ‘বাংলাদেশ’ নামক একটা কাঁটাতার ঘেরা ভূখন্ডে বন্দী । মিয়ানয়ারের মানুষ আরেকটা ভুখন্ডে বন্দী । সেখানে মানুষকে খুন করা হচ্ছে, আমরা যেতে পারছি না তাদের সাহায্যে । 
তারা আসতে পারছে না আমাদের কাছে । কারাগার নয়তো কী ?
মিশরে সিরিয়ায় কাশ্মীরে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে , আমরা বসে আছি কাছেই, যেতে পারছি না তাদের সাহায্যে । এ যেন একেকটা বৃহৎ কারাগার ।

সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ আমাদের হৃদয়কে সংকীর্ণ করে দিয়েছে । ‘দেশপ্রেম’ নামে এক অবাস্তব চেতনা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে আমাদের মন মগজে । ‘মানব প্রেম’ এর চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ভূমিপ্রেম’ ।  মানুষের জীবনের চেয়ে মাটির দাম বেশি ? সাগরে ভাসে মানুষ দিনের পর দিন অনাহারে । কিসের সীমানা তাদের আশ্রয় দিতে বাধা দেয় ?
সীমান্তে বাংলাদেশি দেখলেই গুলি করে মেরে ফেলে ভারতের বিএসএফ । আমরা কি তাহলে কারাগারে নেই ?

জাতীয়তাবাদ । 
ভাষা, ভূমি, সীমানা । প্রতিটি দেশকে একেকটা কারাগারে পরিণত করেছে জাতীয়তাবাদ । এই পৃথিবী মানুষের , গোটা পৃথিবী । যে যেখানে ইচ্ছা যাবে । পৃথিবীর বিশাল বিশাল ভূখন্ড পড়ে আছে জনমানবহীন । অথচ সীমানার কারাগারে আটকে আছে কোটি কোটি মানুষ ভূমিহীন, আশ্রয়হীন । পৃথিবীর বিশাল বিশাল জমিন পড়ে আছে অনাবাদী । অথচ দুর্ভিক্ষ হয়ে বাংলাদেশে, সোমালিয়ায় । তুলে দাও সীমানা, দেখো পৃথিবীতে কেউ না খেয়ে মরবে না । পৃথিবীতে কারো আশ্রয়ের অভাব হবে না । কারো খাদ্যের অভাব হবে না । আফ্রিকায়ও থাকবে সাদা মানুষ , আমেরিকায়ও থাকবে কালো মানুষ । গায়ের চামড়া ভালোবাসায় –ভ্রাতৃত্বে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না ।

স্বপ্ন দেখি সীমানাহীন পৃথিবীর । যে পৃথিবীতে থাকবে না ‘বাংলাদেশি’, ‘পাকিস্তানি’, ‘ভারতীয়’, ‘চীনা’ ভেদ । পৃথিবীটা হবে ‘মানুষের’ ।

মানুষ মুক্তি পাবে জাতীয়তাবাদের কারাগার থেকে ।

সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৩

খ্যাতি ও জীবন

১।
মানুষের একটা ন্যাচারাল ইন্সটিংক্ট হলো – মানুষ সম্মান চায়, খ্যাতি চায় । ছোটবেলায় ক্লাসের বইয়ে পড়েছিলাম – ভালো কাজ করার একটা উদ্দেশ্য হলো, মৃত্যুর পরেও মানুষ আমার কথা মনে রাখবে । আমি মরে যাবো, কিন্তু আমার নাম বেঁচে থাকবে আমার কাজের মাধ্যমে ।

খ্যাতির জন্য মানুষ কতকিছুই না করে ! ‘গিনেস বুক অব রেকর্ডস’ এ নাম ওঠানোর জন্য আজগুবি কত কিছুযে হয় ! কেউ খেয়ে খেয়ে ওজন বাড়ায়, কেউ বছরের পর বছর নখ কাটে না, দাড়িগোঁফ-চুল কাটে না, কেউ লোহা খায় । আরও কতকি ! ফেসবুকেও দেখি সামান্য খ্যাতির জন্য কতজনে মিথ্যা তথ্য ছড়ায় ।

আচ্ছা এই খ্যাতি দিয়ে কী হবে ? পৃথিবীর আদি থেকে আজ পর্যন্ত কত কবি জন্মেছিলেন তাদের কতজনের কথা আমরা জানি ? কত ঔপন্যাসিক, কত দার্শনিক, শিক্ষক , গায়ক জন্মেছিলেন তার ক’জনের কথা আমরা জানি ?যে সাহিত্য সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখে, তার কাছেও অনেক সাহিত্যিকের নাম শেষ পর্যন্ত অজানাই থেকে যায় । বিজ্ঞান নিয়ে যে পড়াশোনা করে, চিন্তা –গবেষণা করে , তার কাছেও অনেক বিজ্ঞানীর নাম এবং কাজ অজানাই থেকে যায় ।

ধরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা । তিনি আসলেই একজন জিনিয়াস কবি ছিলেন । সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন । কিন্তু তবুও পৃথিবীর কতজন মানুষ তার নাম জানে ? অন্যান্য দেশের কথা বাদই দিলাম, বাংলাদেশ এবং ভারতেরই কমপক্ষে অর্ধেক মানুষ তার নাম জানে না । কতজন তার সাহিত্য পড়েছে ? অধিকাংশ মানুষই পড়েনি । আরও একশত বছর পরে হয়তো এই সংখ্যা আরও কমে যাবে । একসময় রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ্যপুস্তক থেকেও হারিয়ে যাবে ।

ধরে নিলাম , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর অনেক বছর পরেও তার নাম মানুষ স্মরণ করে । আচ্ছা তাতে রবিঠাকুরের লাভটা কী হচ্ছে ? তার মৃত্যুর পরেও তো লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম রাখা হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ’ ! শুধু এই নামটা থাকাতে কী পার্থক্য হয়েছে ? তিনি জীবিত থাকাতে যতটুকু সম্মান পেয়েছেন , আসলে ততটুকুই তার লাভ । এরপর সবকিছু শুন্য ।

সত্যিকারার্থে মৃত্যুর পরের জীবনে তিনি এখান থেকে আর কিছুই পাচ্ছেন না ।

২।
তাহলে কি কিছু করার দরকার নেই ? খেয়েদেয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারাটাই সফলতা ?
আসলে তাও নয় । আমাদের কাজ করতে হবে , অনেক কাজ । তবে সেসবের শুরুতে প্রয়োজন ঈমান । ঈমানবিহীন সব কাজের মুল্য শুন্য । দ্বিতীয়ত, করতে হবে এমন কাজ যাতে মানুষ সত্যের পথ খুঁজে পায়, সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে পারে । মানুষের উপকার হয় এমন কাজ । ঈমানদার ব্যক্তি বিশ্বাস করেন, ভালো কাজের পুরস্কার মৃত্যুর পরের জীবনে পাওয়া যাবে । শুধু ‘নাম’ থাকার মত বায়বীয় কোন অবাস্তব পুরস্কার নয়, সত্যিকার পুরস্কার । অনন্ত কালের জন্য সুখ সাচ্ছন্দ্য । একটু সুখের জন্য পৃথিবীতে মানুষ কী না করে !

সাহিত্য রচনা করতে হবে , যে সাহিত্য মানুষকে শেখায় ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে । অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে দাড়াতে । শেখায় মানুষকে ভালোবাসতে, পশুপাখি, গাছপালাকে ভালোবাসতে । শেখায় স্রস্টাকে ভালোবাসতে, তার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে ।

বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে হবে , যাতে মানুষের জীবন হতে পারে আরো সহজ । মানুষ থাকতে পারে আরো শান্তিতে । মানুষকে কষ্ট দেয়া স্রস্টার উদ্দেশ্য নয় । আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যাকিছু দিয়েছেন- মানুষের সুখের জন্যই । প্রয়োজনীয় উপকরণ সেখান থেকে মানুষকে খুঁজে নিতে হবে , আর মানতে হবে নির্ধারিত সীমা । কাজ করতে হবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য । কাজ করতে দারিদ্র্য থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য । দুনিয়ায় ‘নাম’ থাকুক আর না থাকুক, মৃত্যুর পর অনন্ত কালের জীবনে সত্যিকার পুরস্কার পাওয়া যাবে – থাকতে হবে সেই বিশ্বাস ।

৩।
তাই বলে কি আমরা কৃতি ব্যক্তিদের নাম সংরক্ষণ করবো না ? অবশ্যই করতে হবে । কারণ- প্রত্যেককে দিতে হবে তাঁর প্রাপ্য সম্মান । প্রাপ্য মজুরী । শ্রমিককে যেমন মজুরী দিতে হয়, তেমনি কৃতি ব্যক্তিকে দিতে হবে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা । একজন মানুষের কাজ তাঁর নিজস্ব সম্পদ । তিনি যদি সেটা মানুষের জন্য করেন , তবু তা তারই । অস্বীকার করার উপায় নেই । কাউকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান না দেওয়াটা অবিচার, অন্যায় । আল্লাহর প্রেরিত নবীও সেটাই বলে গেছেন ।
আর তাছাড়া, সম্মান চাওয়াটা মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য । ভালো কাজে আমরা যত বেশি উৎসাহ দেব, সম্মান দেব – মানুষ ভালো কাজে তত বেশি উদ্বুদ্ধ হবে । ক্রমে পৃথিবীটা হয়ে উঠবে আরো শান্তিময় ।

..............................
খ্যাতি ও জীবন/ ২৫-০৮-২০১৩

বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৩

আলমে আরওয়ায় দেয়া সাক্ষ্য স্মরণে নেই কেন ?

আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষকে রুহের জগতে একত্রিত করেছিলেন । তাদের কাছে সবার সামনে সবার কাছ থেকে স্বীকৃতি নিয়েছিলেন যে তিনিই আমাদের প্রভু । কিয়ামতের দিন এই ঘটনাকে মানুষের বিচারের জন্য সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা হবে ।
মনে প্রশ্ন জাগে, এই ঘটনাতো আমাদের কারো মনে নাই । তবুও এটাকে আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করাটা কি যৌক্তিক হবে ?

এ সম্পর্কে কুরআন বলে -
‘আর হে নবী! লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা যখন তোমাদের রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করিয়েছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আমি কি তোমাদের রব নই ? তারা বলেছিলঃ নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব , আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি ৷ এটা আমি এ জন্য করেছিলাম যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো একথা জানতাম না ৷ (সুরা আরাফ-১৭২ )

আমরা সাধারণভাবে চিন্তা করলে কী দেখি ? আমরা কেউ কি বলতে পারবো , ছোটবেলায় ঠিক কখন থেকে আমি বুঝতে শিখেছি ? আমরা কেউ জানিনা । ছোটবেলায়- জ্ঞান হবার আগে কে কী বলেছে, আমরা কে কী করেছি কিছুই আমাদের মনে নেই । কিছুই স্মরণে না থাকলেও এটা চিরসত্য যে, শিশুকালে অনেক কিছুই শুনেছি, বলেছি, দেখেছি । বাবা – মা , ভাইবোন কাউকেই তো চিনতাম না । বাবা মা কাকে বলে এটাও তো জানতাম না । সেজন্যেই মাকে জিজ্ঞেস করি- ‘এলেম আমি কোথা হতে ?’

সুতরাং , পৃথিবীতে আসার আগেই যে কথা বলেছি- সেটা স্মরণে থাকবে এটা আশা করা অবান্তর । কিন্তু আল্লাহ যখন আমাদের স্মৃতিতে সেটা আবার দিয়ে দেবেন , তখন সব মনে পড়বে ।
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরও মেমোরি লস হবার ঘটনা আছে । মেমোরি রিগেইনের ঘটনাও আছে । এখান থেকেও আমরা সহজেই বুঝতে পারি – রুহের জগতের ঐ ঘটনা খুব খুব সম্ভব । মোটেই অযৌক্তিক নয় ।

তাফহীমুল কুরআন এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছে এভাবে-
‘এর জবাবে বলা যায়, সেই অংগীকারের কথা যদি মানুষের চেতনা ও স্মৃতিপটে জাগরুক রাখা হতো তাহলে, মানুষকে দুনিয়ার বর্তমান পরীক্ষাগারে পাঠানো ব্যাপারটা একেবারে অর্থহীন হয়ে যেতো । কারণ এরপর পরীক্ষার আর কোন অর্থই থাকতো না । তাই এ অংগীকারের কথা চেতনা ও স্মৃতিপটে জাগরুক রাখা হয়নি ঠিকই কিন্তু অবচেতন মনে ও সুপ্ত অনুভূতিতে তাকে অবশ্যি সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। তার অবস্থা আমাদের অবচেতন ও অনুভূতি সঞ্জাত অন্যান্য জ্ঞানের মতই। সভ্যতা, সংস্কৃতি, নৈতিক ও ব্যবহারিক জীবনের সকল বিভাগে মানুষ আজ পর্যন্ত যা কিছুর উদ্ভব ঘটিয়েছিল তা সবই আসলে মানুষের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজিত ছিল। বাইরের কার্যকারণ ও ভিতরের উদ্যোগ আয়োজন ও চেষ্টা সাধনা মিলেমিশে কেবলমাত্র অব্যক্তকে ব্যক্ত করার কাজটুকুই সম্পাদন করেছে। এমন কোন জিনিস যা মানুষের মধ্যে অব্যক্তভাবে বিরাজিত ছিল না, তাকে কোন শিক্ষা , অনুশীলন ,পরিবেশের প্রভাব ও আভ্যন্তরীন চেষ্টা-সাধনার বলে কোনক্রমেই তার মধ্যে সৃষ্টি করা সম্ভব নয় এটি একটি জাজ্বল্যমান সত্য। আর এ প্রভাব -প্রচেষ্টাসমূহ নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও মানুষের মধ্যে যেসব জিনিস অব্যক্তভাবে বিরাজিত রয়েছে তাদের কোনটিকেও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেবার ক্ষমতা রাখে না। বড় জোর তারা তাকে তার মূল স্বাভাব প্রকৃতি থেকে বিকৃত করতে পারে মাত্র। তবুও সব রকমের বিকৃতি ও বিপথগামীতা সত্ত্বেও সেই জিনিসটি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, আত্মপ্রকাশের প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে এবং বাইরের আবেদন সাড়া দেয়ার জন্যে সর্বক্ষণ উন্মুখ থাকবে । (তাফহীমুল কুরআন, সুরা আরাফের টীকা)

[[আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়ুন তাফহিমুল কুরআন সুরা আরাফের ব্যাখ্যা । তাফসীর ইবনে কাসীর এবং মারেফুল কুরআনে এই বিষয়টি খুব বেশি বিস্তারিত আলোচনা করেনি ।]]


১৪-০৮-২০১৩ 

রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৩

ডঃ আব্দুল্লাহর যুগান্তকারী আবিস্কার

ডঃ আব্দুল্লাহ এরকম একটি যুগান্তকারী আবিস্কার করে ফেলবেন- নিজেও জানতেন না । খামখেয়ালিপনার ভেতর দিয়ে মানবজাতির জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই আবিস্কার হয়ে যাবে কেউ কি কল্পনাও করেছিল ?

অবশ্য পৃথিবীর অনেক বড় বড় আবিস্কার হয়েছে আকস্মিকভাবেই । নিউটন আপেল গাছের নিচে বসে ছিলেন , তাঁর মাথায় আপেল পড়লো । তিনি আবিস্কার করলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি । বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস ন্যাংটা হয়ে চৌবাচ্চায় গোসল করতে করতে আবিস্কার করলেন তাঁর বিখ্যাত সুত্র । বিজ্ঞানী অগাস্ট কেকুল স্বপ্নে লেজ কামড়ানো সাপ দেখে আবিস্কার করে ফেলেছিলেন বেনজিনের গঠন ।

আজ বন্ধু ডালিম কোথায় ? মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর প্রথম দিকে হোস্টেলে ডঃ আব্দুল্লাহর রুমমেট ছিলেন বন্ধু ডালিম । ডালিম বিরক্তও হত, অবাকও হত যে আব্দুল্লাহ কোনদিন মশারি টাঙ্গায় না । অবশ্য তখন অলসতাই ছিল মূল কারণ । কিন্তু সে কথা আব্দুল্লাহ স্বীকার করবেন কেন ? তিনি বলতেন- আমরা মানুষ, আশরাফুল মাখলুকাত । আমরা বাঘ, ভাল্লুক, হাতি-ঘোড়া , অজগর সাপ , সব জন্তু জানোয়ারকে বশ করেছি । তাদেরকে খাঁচায় বন্দী করেছি । আর আমরা সেই মানুষ- সামান্য মশার ভয়ে নিজেই খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকবো ? মশারি খাঁচা নয়তো কী ? মানব জাতির এত বড় অপমান আমি সইবো না । কামড়াক, যত পারে মশা আমাকে কামড়াক । আমি থাপ্পড় মেরে যে কয়টাকে পারি খতম করবো ।

আসলেই তাই হত । রাতের বেলা ঠাস ঠাস শব্দ শোনা যেত ডঃ আব্দুল্লাহর বেড থেকে । সকাল বেলা দেখা যেত বেডশিটে লাল রঙের আলপনা । আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো মশার রক্ত মনে হলেও, আসলে তো ডঃ আব্দুল্লারই রক্ত ! তবু তাঁকে দমানো যায়নি ।

বন্ধু ডালিম ডঃ আব্দুল্লার নাম দিয়েছিল ‘মশা মারা পালোয়ান’ । মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে সে ডঃ আব্দুল্লাহর গা চাপড়ে দিত- ‘ইস , এই খানে একটা মশা বসেছিল’ !

হোস্টেলের নিচতলার রুম । পাশেই পাহাড় – জঙ্গল । চট্টগ্রাম এমনিতেই ম্যালেরিয়ার জন্য এন্ডেমিক রিজিওন । সবার ধারণা ছিল আজ নাহয় কাল আব্দুল্লাহ ম্যালেরিয়ার শিকার হবেই । কিন্তু না , ম্যালেরিয়া-ফাইলেরিয়া-ডেঙ্গু কোনটাই কাবু করতে পারেনি তাঁকে ।
হতে পারে ভাগ্যক্রমে কোন এডিশ বা এনোফিলিস মশা তাঁকে কামড়ায় নি । কিন্তু সেটাই বা কীভাবে বিশ্বাস করা যায় ?

বিয়ের পর ডঃ আব্দুল্লাহর স্ত্রী মিমুও প্রথম প্রথম অবাক হতেন । সবসময় তিনি নিজেই এরোসল স্প্রে করে রাখতেন । একবার স্প্রে ফুরিয়ে যায় । সেসময় তিনি বাবার বাড়িতে । কয়েকদিন পর ফিরে এসে দেখেন , আব্দুল্লাহ স্প্রে কেনেননি , মশারিও যেখানে ছিল সেখানেই বহাল তবিয়তে আছে । ঘটনা কি ?

ডঃ আব্দুল্লাহ স্ত্রীকেও সেই যুক্তি দেখান ।
আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে মশার ভয়ে খাচার ভেতর বন্দী থাকা ? অসম্ভব । আর তাছাড়া মশারও তো রিজিক আছে । আল্লাহ যদি মশার রিজিক আমার শরীরেই রেখে থাকেন, তাহলে আমি বাধা দেয়ার কে ?

তবে মিমুর পাল্টা যুক্তিতে ধরা খেয়ে যান বেচারা ডঃ আব্দুল্লাহ ।

‘ও তাই নাকি ?’ ‘তাহলে এক কাজ করো তুমি- সুন্দরবনে চলে যাও । বাঘের সামনে গিয়ে দাঁড়াও । আল্লাহ যদি বাঘের রিজিক রাখেন তোমাকে দিয়ে, তাহলে তুমি বাধা দেয়ার কে ? তোমার উচিৎ নিজেই গিয়ে বাঘের রিজিক হওয়া ! আচ্ছা ধরো আমরা কোন বিপদে পড়লাম, বাসায় ডাকাত আসলো- তুমি কি বাধা দেবে না ? নাকি বলবে যে- যাক সব নিয়ে যাক । ডাকাতেরও তো রিজিক আছে নাকি !’

এবার সত্যিই লা-জবাব হয়ে যান ডঃ আব্দুল্লাহ । আসলেই তো ! এতদিন তিনি সরলমনে চিন্তা করতেন । উল্টোদিকটাতো ভাবেননি !

মাঝে মাঝে জ্ঞানী গুনী লোকেরা অনেক সহজ ব্যাপার বুঝতে পারেন না । যেমন পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী । তাঁকে নাকি একদিন কেউ একজন এসে বলেছিল – ‘স্যার, মহা দুঃখের সংবাদ আছে আপনার জন্য । আপনার স্ত্রী তো বিধবা হয়ে গেছেন !’ পন্ডিত মশাই নাকি তখনই কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেন । আহারে আমার বউটা ! বেচারি অল্পবয়সে বিধবা হয়ে গেল !

মখা স্কেল আবিস্কারের পর যে ধকলটা গিয়েছিল , সেটা কাটানোর জন্য ডঃ আব্দুল্লাহ প্ল্যান করেন – কিছুদিন পাহাড়ি পরিবেশে একটু নিরিবিলি কাটিয়ে আসার । সেই সাথে মশার ব্যাপারে একটা ফায়সালা করা দরকার । জীবনে এত মশার কামড় খেলেন- একবারও ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু হলো না , এটা তো ঠিক না ! অভিজ্ঞতা বলে একটা কথা আছে না ? তাঁর মত মহান বিজ্ঞানী ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গুর অভিজ্ঞতা ছাড়াই দুনিয়া ত্যাগ করবেন – এটা হতে পারেনা ।

মাইক্রোবায়োলজির সহকারী অধ্যাপক, গবেষক বন্ধু রাগিবও ইচ্ছা পোষণ করলেন । তাঁরও খুব জানার ইচ্ছা- ব্যাপার কী ? এত মশার কামড়েও আব্দুল্লাহ বহাল তবিয়তে থাকে কীভাবে ?

সবাই রেডি হলেন । ডঃ আব্দুল্লাহ, তাঁর স্ত্রী মিমু , মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডাঃ রাগিব ও তাঁর পরিবার । ডঃ আব্দুল্লাহ ছাড়া সবাই কুইনাইনের প্রোফাইলেক্টিক (প্রতিরোধমূলক) ডোজ নিলেন । অধ্যাপক রাগিব নিলেন তাঁর গবেষণার যন্ত্রপাতি ।
প্রয়োজনীয় জরুরী ওষুধপত্রও নেয়া হলো । এক বিকালে দুটি গাড়িতে করে তাঁরা বান্দরবানের ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় পৌছলেন । সেখানে আগেই বাসা ভাড়া করা ছিল ।

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বান্দরবানের মানুষকে বিশেষ ধরণের মশারি সাপ্লাই দিয়েছে জাতিসংঘ ও বিশ্বের অন্যান্য দাতা এনজিওগুলো । সেজন্য এখন ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অনেকটাই কমে গেছে । তবে কেউ যদি মশারি ছাড়া ঘুমায়- তাহলে খবর আছে ।

যেই ভাবা সেই কাজ । ১০-১২ দিন ধরে বারান্দায় ঘুমিয়ে মশাদেরকে নির্বিঘ্নে কামড়ানোর সুযোগ দিলেন ডঃ আব্দুল্লাহ । সারাদিন ঘোরাফেরা করেন, সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরেন । ১৫ দিনের মাথায় একদিন তাঁর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেল । এইবার মনে হয় আর রক্ষা নাই । কুইনাইন (ম্যালেরিয়ার ওষুধ) শুরু করার আগে ব্লাড স্যাম্পল নিলেন মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডাঃ রাগিব । শুরু হলো কাজ । ডঃ আব্দুল্লাহও সবসময় বন্ধুর সাথে থেকে কাজ করলেন । দুদিনের মাথায় আবিস্কৃত হল – ডঃ আব্দুল্লাহর রক্তে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু – সবধরণের মশাবাহিত রোগের এন্টিবডি রয়েছে । তাঁরা এন্টিসেরাম তৈরি করে ফেললেন । একমাস ধরে দুজনে মিলে লিখে ফেললেন এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্র ।

গবেষণাপত্র প্রকাশের পর বিশ্বের বড় বড় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছে । এ এক যুগান্তকারী আবিস্কার । বাণিজ্যিকভাবে এই এন্টিসেরাম উৎপাদন করার কাজ শুরু হয়েছে । শীঘ্রই সারাবিশ্বের মানুষ এর সুফল পাবে । মশাবাহিত রোগের কবল থেকে বাঁচবে মানবকুল ।

গবেষণাপত্রে তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে- বান্দরবানের বানরের দেহ থেকে এই এন্টিসেরাম পাওয়া গেছে । এজন্য অবশ্য তাঁরা এন্টিসেরাম কিছু বানরের শরীরে ইঞ্জেক্ট করে ছেড়ে দিয়েছেন । আসলে যে ডঃ আব্দুল্লাহর রক্ত থেকে পাওয়া গেছে এই কথা কি আর বলা যায় ? দেখা যাবে – এক রাতে ডঃ আব্দুল্লাহকে অপহরণ করে শরীরের সকল রক্ত বের করে নেবে কেউ ! কে জানে- হয়তো ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গু-ফাইলেরিয়ার ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোই তাদের ব্যবসার স্বার্থে করতে পারে এই কাজ !

ডঃ আব্দুল্লাহ আজ খুবই আনন্দিত । মশার ভয়ে খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকে মানুষ ! আশরাফুল মাখলুকাত মানবজাতিকে এই অপমান থেকে উদ্ধার করতে চলেছেন তিনি !

.............................................
ডঃ আব্দুল্লাহর যুগান্তকারী আবিস্কার / ১১-০৮-২০১৩

শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৩

ছিনিমিনি খেলার ইশতেহার

১।
জীবনটা ছেলেখেলা নয় । তবু আজ
জীবন নিয়ে খেলতে ইচ্ছে করে
ডাংগুলি খেলা নয়- মল্লযুদ্ধ নয় । রীতিমত
‘ছিনিমিনি’ খেলা !

যে খেলায় জীবনই হাতিয়ার , জীবনই বাজি
কেউ কি আছো আমার সাথে , খেলতে রাজি ?

২।
আমি এমন এক সময়ের কথা বলছি
যখন জীবন স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
সময় চলে যায় দিন মাস বছর । তবু
জীবন গতিহীন , দিঘীর শান্ত জলের মতন ।

স্থবির জীবনে আজ
কানে আসে শুধু দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ ।

কোটি কোটি মানুষের অব্যক্ত ব্যথা, হা-হুতাশ
দীর্ঘশ্বাসের সাথে নিয়ে আসে যেন উত্তপ্ত বাতাস

নিঃশব্দে গর্জন করে ওঠে মানুষের ক্ষোভ
আমার স্থবির জীবনে জাগে – জীবন নিয়ে
ছিনিমিনি খেলার এক ভয়ংকর নেশা ।

চলো তবে , শুরু করা যাক !

.......................................
ছিনিমিনি খেলার ইশতেহার / ১০-০৮-২০১৩

শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

ডাঃ বকুলের ঈদের দিন

বিষন্ন মনে ডক্টরস রুমে বসে আছেন ডাঃ বকুল । আগে থেকেই একটু মন খারাপ ছিল । ঈদের চাঁদ ওঠার পর থেকে মন খারাপের মাত্রাটা বেড়েছে । সারারাত ঘুমাতে পারেননি । রোগীর চাপ তেমন নেই । তবুও ঘুম আসেনি । সারারাত এ পাশ ও পাশ করে কাটিয়েছেন । রাতে নামাজ পড়ে কিছু সময় কাটিয়েছেন । সকাল বেলা শারমিন ফোন করেছিল । বাচ্চাটা ‘বাপু কোথায়’ ‘বাপু কোথায়’ বলে কাঁদছে । তখন থেকে মনটা খুব খুব বিষন্ন ।

বাচ্চার বয়স তিন বছর । নাম রেখেছেন খালিদ । গত বছরও বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে ঈদ করতে পারেননি । বিয়ের আগে মনে মনে কল্পনা করতেন , একটা ফুটফুটে বাচ্চা হবে, বাচ্চাটাকে নতুন ছোট্ট পাঞ্জাবি-পাজামা-টুপি পড়িয়ে , আতর দিয়ে সাথে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঈদগাহে যাবেন । ছোট্ট শিশু , আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে – নিজের একটা শিশু ডান হাতের আঙুল ধরে হাটবে । পাশে বসে ঈদের নামাজ পড়বে । ভাবতে খুব ভালো লাগতো । স্বপ্নের মত যেন । শারমিন বলতো – আমি নিজ হাতে ওর গায়ে পোষাক পরিয়ে দেব, তুমি কিন্তু ভাগ বসাতে আসবে না ।

খালিদের জন্মের প্রথম বছরে বাড়িতে ঈদ করতে পেরেছেন ডাঃ বকুল । তখনো তাঁর পোস্টিং হয়নি কোথাও । কিন্তু এর পরের বছর থেকে –গত দুবছর ঈদ করতে হচ্ছে বাড়ির বাইরে । পোস্টিং যেখানে- বাড়ি থেকে প্রায় সাতশ কিলোমিটার দূরের এক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স । বাচ্চাটাকে নিয়ে ঈদ করা হয়নি গত বছরও । কিন্তু গতবছর সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি । এবার সে বুঝতে পারছে যে ‘বাপু’ নেই । সকাল থেকে তাই কাঁদছে । অনেক কষ্টে ডাঃ বকুলের বাবা, খালিদের দাদা তাকে থামিয়েছেন ।

ডাঃ বকুলের আব্বা তাঁকে বাপু বলে ডাকতেন ছোটবেলা থেকে । এখনো বলেন । সেখান থেকেই খালিদ শিখেছে ‘বাপু’ । 

তাকে যতই শেখানো হয়- ‘বাবা’ বলতে , সে ঘুরেফিরে বলে ‘বাপু’ । 
এখন আবার যুক্তি দেওয়া শিখেছে- দাদু যে তোমাকে বাপু বলে ডাকে ? আমিও ডাকবো ।

শুধু বাচ্চাটা কেন ? শারমিনেরও কি মন খারাপ নেই আজকে ? তারও তো অধিকার আছে , আশা আছে ঈদের দিনটা একসাথে কাটানোর । ঈদের পরদিন কোথাও ঘুরতে যাবার । বাবার বাড়ি- বোনদের বাড়িতে যাবার । বিয়ের মাত্র চার বছর হলো । শ্বশুর বাড়ি বলে হয়তো বাইরে হাসিখুশি ভাবটা ধরে রাখবে । কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে তারও ।

একটাই রক্ষা যে শারমিন নিজেও ডাক্তার । তাই সে ডাক্তারের জীবনটা বোঝে । আর তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুবই ভালো । সকাল বেলা শারমিন যখন ফোন করলো, বকুল ভেবেছিল ওকে সান্তনা দেবে । কিন্তু শারমিন নিজেই আগ বাড়িয়ে বকুলকে সান্তনা দিল । চিন্তা করো না । বাড়িতে আমরা সবাই মিলে ঈদ করছি – আমাদের নিয়ে ভেবো না । আর তাড়াতাড়ি চলে আসার চেষ্টা করো । আগেই টিকেট কেটে রাখবে ।

শারমিন এই ব্যাপারগুলো খুব ভালো বোঝে । বকুল মোটামুটিভাবে ইমোশনাল । শারমিন বুঝেছিল- যদি তাঁর কথায় একটু কষ্ট প্রকাশ পায় – বকুল হয়তো কেঁদেই ফেলবে । আর তাঁর কষ্ট তো বকুলের চেয়ে কম । বকুল কত দূরে একা , কিন্তু বাড়িতে তো বকুল ছাড়া আর সবার সাথে ঈদ করতে পারছে তারা । খালিদকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সান্তনা দিয়ে রাখতে পারলেই হলো ।

ঈদের তিনদিন পরে বকুলের ছুটি । এবার দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে তারা । বিয়ের প্রথম বছর যা একটু ঘোরাঘুরি করেছে । গত দুই বছর ছোট বাচ্চা , তাই দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি । হাসপাতালে ডাঃ করিম ভাইকে ম্যানেজ করে ছুটি একটু বেশি নিতে হবে । করিম ভাই এখন বকুলের কিছু ডিউটি করে দেবেন , পরে বকুল করিম ভাইয়ের ডিউটি করে দেবে ।

বিয়েটা হঠাৎ করেই হয়ে গিয়েছিল । বকুল ইন্টার্ণশিপ শেষ করে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়াশোনা করছে । বেকার । মাঝে মাঝে ক্লিনিকে ডিউটি করে পেট চালানোর মত কিছু রোজগার করে । একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে শারমিনের সাথে পরিচয় । শারমিন তখন ফিফথ ইয়ারে । বকুল শারমিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল । তাঁর পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । বিষয়টা খেয়াল করে বন্ধু মাসুদ মাথায় চাট্টি মেরে বলে – কিরে দোস্ত , তুই তো কারো দিকে তাকাস না । আজ কী হলো ? লাগবে নাকি ?

শারমিন মাসুদের আত্মীয় । ওদিকে শারমিনও নাকি লুকিয়ে বকুলকে দেখে নিয়েছিল । মাসুদ যেদিন বকুলের পক্ষ হয়ে শারমিনদের বাসায় হাওয়া বুঝতে গেল- শারমিন নিজেই আগ বাড়িয়ে বকুল সম্পর্কে খোজখবর নেয়া শুরু করলো । ভাইজান- আপনার বন্ধুর খবর কি ?

ওমা ! এ যে দেখি চুম্বকের দুই প্রান্ত । বাহ বাহ । শেষে যা হবার তাই হলো । ছ’মাসের মাথায় বিয়েটা হয়ে গেল ওদের ।

‘আসতে পারি ?’ একটা নারীকন্ঠ দরজাটা একটু ঠেলে জিজ্ঞেস করলো ।
‘হ্যা হ্যা আসুন’ । ‘এখন কী অবস্থা খুকুমনির ?’

স্বামী স্ত্রী দুজনে রুমে প্রবেশ করলেন । শিক্ষক দম্পতি । দুজনেই কলেজের প্রভাষক । বাচ্চার বয়স আড়াই বছর । ঈদের নামাজের পর হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় বাচ্চার । এজমা এক্সাজারবেশন । তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁরা । শংকায় ছিলেন , হাসপাতালে আদৌ ডাক্তার আছেন কিনা । কিন্তু হাসপাতালে এসে তাঁরা দুজনেই খুব সন্তুষ্ট । শুধু সন্তুষ্ট বলাটা যথেষ্ট না- বলা উচিৎ ‘বিমোহিত’ । ডাঃ বকুল খুবই আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা দিলেন । ডাক্তারের রুমে আসার আগে ওরা নিজেরা বলাবলি করছিলেন- ডাঃ বকুলের মনটা ঠিক বকুল ফুলের মত স্নিগ্ধ । তবে একটু মলিন লাগছে মুখটা । নামটা তাঁরা জেনে নিয়েছেন নার্সের কাছে ।

মেয়েটা এখন ভালো । মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে যেতে চান তাঁরা । ডাক্তারের সাথে পরামর্শ এবং ডাক্তারকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য দেখা করতে এসেছেন ।

‘ভাই, আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই । আপনার মুখটা মলিন দেখাচ্ছে । আপনার বোধহয় মন খারাপ । সকালে সেমাইও বোধহয় খাননি’ । 

বাচ্চাটির বাবা বললেন ।

ডাঃ বকুল কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না । সকাল থেকে আসলেই তিনি কিছু খাননি । ভালো লাগছে না । মনের এই অবস্থায় কি মুখে কিছু রোচে ?

এই দম্পতিকে দেখে খুব ভালো মানুষ মনে হচ্ছে । অনেকেই তো চিকিৎসা নিয়ে চলে যায় । কৃতজ্ঞতাবোধ খুব কম লোকেরই থাকে । এরা তাদেরই একজন । অনেক আন্তরিকতা নিয়েই জিজ্ঞাসা করেছে কথাটা । চোখেমুখে বিনয় ও কৃতজ্ঞভাব স্পষ্ট ।

ডাঃ বকুল কাঁপা গলায় শুধু বললেন , বাড়িতে আমারও একটা বাচ্চা আছে । তিন বছর বয়স ।

বাচ্চাটির মায়ের চোখ কেন যেন ছলছল করে উঠল । এক ফোটা অশ্রু চোখের কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এল । মেয়েরা এমনিতেই বেশি ইমোশনাল হয় । বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারে কথা উঠলে তারা আর সহ্য করতে পারে না ।

‘ভাই, ভাবীর মোবাইল নাম্বারটা কি একটু দেবেন । আমি উনার সাথে কথা বলবো’ ।

মোবাইলে শারমিনের সাথে কথা বলছিল বাচ্চাটির মা । এমনভাবে কথা বলতে লাগলো যেন তারা কতদিনের পরিচিত বান্ধবী । বেশ গুছিয়ে কথা বলে মেয়েটা । কলেজে পড়ায় তো । একটা কথা ডাঃ বকুলের কানে আটকে গেল । বাচ্চাটির প্রভাষিকা মা শারমিনকে বলছিলেন- ‘ভাবী, এই ঈদের দিনে যদি কাউকে নিয়ে মানবতার জয়গান গাওয়া যায় – সে আপনার স্বামী । একজন ডাক্তার’ ।

বিষন্ন মনে এই কথাটা খুব ভালো লাগলো ডাঃ বকুলের । কষ্টটা যেন কমে আসতে লাগলো । আসলেই, ঈদের দিনে যাদেরকে নিয়ে মানবতার জয়গান গাওয়া যায়- তাদের একটা লিস্ট যদি করা হয় – সবার উপরে লিখতে হবে ‘ডাক্তার’ ।

নিশ্চয়ই শারমিনেরও খুব ভালো লেগেছে কথাটা ! খালিদ যখন বুঝতে শিখবে, তারও ভালো লাগবে হয়তো ।

..........................................
ডাঃ বকুলের ঈদের দিন / ০৯-০৮-২০১৩

বৃহস্পতিবার, ৮ আগস্ট, ২০১৩

আব্দুল্লাহ সাহেবের ঈদ উদযাপন

এশার নামাজ পড়ে বাসা থেকে বের হলেন আব্দুল্লাহ সাহেব । কয়েকদিন পরেই ঈদ । টুকিটাকি কিছু কাজ সারতে হবে । এছাড়া তিনি একটু মার্কেটেও যাবেন । মার্কেটে যাওয়াটা এখন এক ঝক্কির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু তবু তিনি যাবেন । এবার তিনি 'ঈদ উদযাপনে মানসিকতার বিবর্তন' শীর্ষক একটা প্রবন্ধ লিখছেন । একটা বিখ্যাত সাইকিয়াট্রি ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার কথা রয়েছে ।

মার্কেটগুলো খুব জমজমাট মানুষের ভিড়ে । সাজুগুজু করা ললনারা ঘুরে বেড়াচ্ছে । মার্কেটের সামনে কিছু বখাটে ছেলে আড্ডা দিচ্ছে । একটা দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি খুবই বিরক্ত হলেন । হাই ভলিউমে গান বাজানো হচ্ছে । কোন ভাষা কে জানে ! কথার কোন ঠিক নেই- শুধু ড্রাম আর গিটারের শব্দই বোঝা যায় । এটা কী ধরণের আধুনিকতা তাঁর বুঝে আসে না ।

তিনি মার্কেটে ঢুকে এক জোড়া মোজা কিনলেন । আসলে মার্কেটের পরিস্থিতি দেখাটাই উদ্দেশ্য । বের হয়ে একটা রিক্সায় উঠলেন । নামলেন গিয়ে একটা সেলুনের সামনে । রিক্সাওয়ালা ৩০ টাকা দাবি করলো । আসলে ভাড়া বিশ টাকা । আব্দুল্লাহ সাহেব বিশ টাকা দিলেন রিক্সাওয়ালাকে । বললেন- তুমি ভাড়া বেশি দাবি করাতে তোমাকে নির্দিষ্ট ভাড়াটাই দিলাম , নাহলে হয়তো কিছু বেশিই দিতাম । যাও । তিনি মনে করেন যারা অতিরিক্ত ভাড়া চায় এদেরকে বেশি দেয়াটা ঠিক নয়- কারণ এতে করে এরা শহরে নতুন কিংবা গরীব লোকদের কাছেও ভাড়া বেশি দাবি করতে পারে । রিক্সাওয়ালার অবস্থান থেকে এটাই জুলুম । জুলুম শব্দটা শুধু ধনী এবং ক্ষমতাবানদের জন্য নির্দিষ্ট নয় , সবাই যার যার অবস্থান থেকে জুলুম করতে পারে ।

রিকশাওয়ালা দের প্রায়ই ভাড়া বেশি দেন তিনি । অনেক রিক্সাওয়ালাকে দেখে মায়া হয় । তাদেরকে বেশি দেন । তবে ব্যাপারটা স্পষ্ট করেই দেন- দেখো, তোমার আসল ভাড়া এত টাকা, আর এইটা দিলাম বখশিস । কেউ কেউ নিজেরাই চেয়ে নেয় । ভাইজান- আপনেরা জ্ঞানী গুণী মুরুব্বি মানুষ , আপনাদের কাছ থেইকা যদি দুই টাকা বেশি না নেই তাইলে আমরার জেবন চলবে কেমনে ? আব্দুল্লাহ সাহেব ওদেরকেও বেশি দেন । যাও, তবে মানুষের কাছে কখনো অতিরিক্ত ভাড়া দাবি কইরা নিবা না । ঠিক আছে ?

তিনি সেলুনে ঢুকলেন ।  মাথাভর্তি  বড় চুল রাখা তাঁর ছোটবেলার অভ্যাস । তবে ঈদের আগে একটু সাইজ করে নিতে হয় । এটাও ঈদের প্রস্তুতির মধ্যে পড়ে । নাপিতদের ব্যাপারে তিনি মহা খ্যাপা । মনমত করে চুল কাটাতে পেরেছে এমন নাপিত জীবনে কদাচিৎ জুটেছে । একটা না একটা ঝামেলা করবেই । হয় একটু বড় রাখবে, অথবা বেশি ছোট করে দেবে । তবে বড় রাখলে তাও কিছুটা রক্ষা , আবার কেটে ছোট করা যায় । কিন্তু ছোট করে ফেললে তো আর তৎক্ষণাৎ বড় করার সুযোগ নাই । খুবই খারাপ লাগে  । মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেই চুল কাটার একটা দোকান দেন । কিন্তু সমস্যা হলো- নিজের চুল তো আর নিজে কাটা সম্ভব না ।

সেলুনে ঢুকে তিনি দেখলেন  নাপিত বেশ বয়স্ক । বয়স ৪৫ থেকে ৫০ হবে হয়তো ।  একটা ছেলে সেলুনে ঢুকে আবার বের হয়ে গেল । বয়স্ক নাপিত, হালের ফ্যাশানে চুল কাটাতে পারবে বলে তার বিশ্বাস হয়নি !

আব্দুল্লাহ সাহেব অবশ্য একেই পছন্দ করলেন । যে নাপিতের বয়স চল্লিশের বেশি সে নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবে !

সেলুনে চলছিল রাজনৈতিক আলোচনা । সামনে কী হবে, কোন দল মার খাবে , কে জেলে যাবে , কে দেশ থেকে পালিয়ে যাবে ইত্যাদি । দেশের রাজনীতির সুতিকাগার মনে হয় নাপিতের দোকান আর চায়ের দোকান । আব্দুল্লাহ সাহেব খেয়াল করলেন - বেটা নাপিত রাজনীতির বিশ্লেষণ খারাপ করছে না । টকশোতে বসিয়ে দিলে জনগনকে  মাত করে দিবে । বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি হিসেবে টকশোতে গলাবাজি করে বাকি জীবনটা ভালোই কাটিয়ে দিতে পারবে ।

চুল কাটতে কাটতে নাপিত বললো- ভাইসাহেব , আপনি মনে হয় চুলে তৈল দেন না । আপনি চুলে তৈল দিবেন গৈ বুঝলেন ! চুলের খাইদ্য হইলো গিয়া তৈল বুঝলেন । আমাদের নবিজীও চুলে তৈল দিতেন ।

চুলের খাদ্য তৈল ! কথাটা আব্দুল্লাহ সাহেবের বেশ মনে ধরলো । এইটা নিয়া গবেষণা করা যায় । একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলা যাবে । তিনি এই বিষয়টা মনে রাখলেন । লেখার আগে আরেকবার এসে এই নাপিতের সাথে কথা বলে যেতে হবে ।

এখনি বাসায় ফেরার দরকার নেই । ইচ্ছাও নেই । কারণ একটা গুরুত্বপুর্ণ কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে । তিনি কিছুক্ষণ এদিন সেদিক তাকিয়ে একটা সিটি বাসে উঠে পড়লেন । বাসের ড্রাইভার যুবক । কিন্তু কন্ডাকটর এবং হেল্পার দুজনেই অল্পবয়স্ক ।

বাসের পেছনের একটা সিটে গিয়ে বসলেন তিনি । চলছে বাস চলুক । সিটি বাস, শহরের বাইরে তো আর যাবে না ।

বাসের ড্রাইভার , কন্ডাকটর -হেল্পারদের জীবনটা অন্যদের কাছে যেন তুচ্ছ । বাসে উঠলেই সবাই নবাবের পুত হয়ে যায় । একটু বাস থামালেই ড্রাইভারকে গালিগালাজ শুরু । ঐ বেটা বারবার দাড়াস ক্যান ? বাস ছাড়বি না ? আর কত লোক তুলবি ? তোগো পেট ভরে না ? শুয়োরের বাচ্চা কোনহানকার ।

আবার এই লোকই হয়তো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বাস না পেলে  কিংবা বাস না থামালে গালি শুরু করেন- কুত্তার বাচ্চারা বাস নিয়া কই যায় ? হেগোরে বাস দিছে কি জইন্যে ?
একই ব্যক্তি হয়তো অন্য কোন বাসে ঠিকই বাদুরঝুলা হয়ে উঠে পড়েন । আবার বলেন- এত লোক যে কইত্থাইকা আসে । দ্যাশটা মাইনষে ভর্তি হইয়া গেছে । বাসে একটা সিট পাওয়া পর্যন্ত যায় না !

কন্ডাকটরের সাথে  এক টাকা নিয়ে ঝগড়া শুরু করে  কেউ কেউ । এই ব্যাটা এক টাকা বেশি নিলি ক্যান  ? দে টাকা দে । দুই মাস আগেই তো ভাড়া আছিল ৩ টাকা, তুই চার টাকা নিলি ক্যান ?

কখনো কখনো কন্ডাকটর হেল্পারকে চড় থাপড়ও মারে কোন কোন 'ভদ্রলোক' । কেউ প্রতিবাদ করে না । সবাই থাকে ঐ 'ভদ্দরলোকের' পক্ষে । শালা ছোটলোকের বাচ্চার উচিৎ শিক্ষা হইছে । অগোরে আরো পিটান দরকার !

বাসে চড়ে এইসব অভিজ্ঞতা আগেই হয়েছে আব্দুল্লাহ সাহেবের । আজও তিনি পেছনে বসে পরিস্থিতি দেখছিলেন । একটা কিশোর ছেলের ঘাড়ে একটা বড় ব্যাগ । সে ব্যাগটা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে । ভিড়ের ভেতর ব্যাগটা কাধে নিয়ে বাসে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে । হয়তো ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাচ্ছে । এরই মধ্যে একজনের গায়ে একটু হয়তো ধাক্কা লেগেছে- সে ক্ষেপে গিয়ে ছেলেটাকে ধমকাচ্ছে । আরে মিয়া কি শুরু করছ তুমি ? ব্যাগ নিয়া উঠছে গাড়িতে ।

আব্দুল্লাহ সাহেব ওই লোকটাকে ডাকলেন ।

এই যে ভাই , শোনেন । আপনার কী অসুবিধা হয়েছে ?
দেখছেন না ব্যাগটা আমার গায়ে লাগলো ।
আপনার শুধু একটু গায়ে লেগেছে , আর ছেলেটা যে ব্যাগটা কাধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কষ্ট হচ্ছে না ?
তাতে আমার কী ? ব্যাগ নিয়া তারে উঠতে কইছে কে ? সে নাইম্যা যাইতে পারে না ?
আপনার কি ঠ্যাং নাই , আপনিও তো নেমে যেতে পারেন ।
আমি নামুম ক্যান, গাড়ি কি অর বাপের ?
আপনাকে দেখেও তো এই বাসের মালিকের ছেলে মনে হচ্ছে না । বাসের মালিকের ছেলে ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে যাতায়াত করে এইরকম তো আমি কল্পনাও করতে পারিনা । খোলাফায়ে রাশেদার যুগ এসে পড়লো নাকি ?

আশেপাশের লোকজন কেন যেন বেশ মজা পেয়ে গেল । হো হো করে হেসে উঠলো কয়েকজন ।
এতটুকুতে আনন্দ পেয়ে গেছে । এইজন্যেই বাংলাদেশের মানুষ- এত অন্যায় অবিচার শোষণ নির্যাতনের ভেতরেও সুখী । তারা অল্পতেই সুখ খুজে পায় ।

বাস থেকে একে একে লোকজন নেমে যেতে লাগলো । ফাকা হয়ে যেতে লাগলো বাস । কন্ডাকটর ছেলেটা ভাড়া চাইতে এসেছিল । আব্দুল্লাহ সাহেব তাকে একশ টাকার একটা নোট দিয়েছেন ।

কই নামবেন ?
যেখানে তোমাদের গন্তব্য শেষ সেখানে নামবো ।

ছেলেটা তখন অবাক হয়ে ফিরে গিয়েছিল  । কত টাকা ভাড়া রাখবে বুঝতে না পেরে বলেছিল- নামার সময় বাকি টাকা নিয়েন খেয়াল কইরা ।
বাস থেমে গেলে তিনি কন্ডাক্টর ও হেল্পারকে ডাকলেন ।

তোমাদের বাড়ি কোথায় ?
আমার বাড়ি ভোলা ।
আমার লক্ষীপুর ।
তোমাদের বাড়িতে কেউ নাই ? বাবা মা ভাই বোন ?

একজন বললো তার বাবা মারা গেছে ছোটবেলায় । গ্রামে মা আছে , অন্যের বাড়িতে কামলা খাটে । হেল্পার ছেলেটার কেউ নাই । চাচারা আছে । তারা ওর খোজ রাখে না ।

আব্দুল্লাহ সাহেব তাদের দুজনকে নিয়ে একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন । বললেন- তোমাদের যা ইচ্ছা খাও । তারা গরুর গোশত দিয়ে পেটপুরে ভাত খেল । তারপর তিনি তাদের সাথে কথা বলতে বলতে একটু দূরে একটা কাপড়ের দোকানে নিয়ে গেলেন । ওদের শার্ট প্যান্ট ছেড়া ময়লা । দুজনকে পছন্দ মত শার্ট প্যান্ট কিনে দিলেন । ছেলে দুটো হতভম্ব হয়ে গেল । তারা হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছিল না । হেল্পার ছেলেটার মুখ হাসিখুশি, কিন্তু কন্ডাক্টর ছেলেটার চোখে পানি । মার কথা মনে পড়েছে । ছোটবেলায় বাবা বেচে থাকতে একবার এরকম শার্ট প্যান্ট কিনে দিয়েছিলেন । সেকথাও মনে পড়েছে তার ।

আব্দুল্লাহ সাহেব  ওদের আদর করে বিদায় করলেন । একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি । কদিন পরেই ঈদ । কার ঈদ ?

আজ ২৫ রমজানের রাত । শবে কদর হবার সম্ভাবনাও আছে । রমজানের শেষ দশদিনের বিজোড় রাতগুলোতে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এক রাত্রির সন্ধান করতে বলা হয়েছে । সেই রাত্রিতে আল্লাহর বানী মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল হয়েছিল । শুধু নফল নামাজ পড়ে সেই রাত্রি পাওয়া যায় কিনা, আল্লাহকে পাওয়া যায় কিনা তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে । তাঁর ধারণা, যায় না । কুরআনের মূল উদ্দেশ্য- মানুষের প্রতি ইনসাফ- ভালোবাসা না করে শুধু নফল নামাজে আল্লাহকে পাওয়া যাবে না । তিনি এই রাত্রিগুলোয় সত্যিকার দুঃখী মানুষের সন্ধানে বের হন ।  ঈদের আনন্দটা তিনি পেয়ে যান ঈদের আগেই । ঈদের দিন তাঁর মনটা প্রশান্তিতে ভরে থাকে । প্রতিবছর তিনি এভাবেই অনাথ শিশুদের মুখে হাসি ফুটিয়ে ঈদ করতে চান  তিনি ।

আকাশে মেঘ জমেছিল । দুএক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো । ঠান্ডা বাতাসে বুকটা ভরে গেল আব্দুল্লাহ সাহেবের । তিনি ধীরে ধীরে হাটা ধরলেন । বাসায় পৌঁছে নামাজ পড়তে হবে ।

................................................
আব্দুল্লাহ সাহেবের ঈদ / ০৮-০৮-২০১৩

সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০১৩

বন্ধু দিবস কি খারাপ ?

কাল নাকি #বন্ধু দিবস ছিল । অনেক #দিবস প্রচলিত হয়েছে । মা দিবস, বাবা দিবস, বন্ধু দিবস , ভালবাসা দিবস এইসব । যেকোন দিবস পালনের ক্ষেত্রে দুটো গ্রুপ দেখা যায় । এক গ্রুপ অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে প্রচলিত গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিবস উদযাপনে মেতে ওঠে । আরেক গ্রুপ এসব দিবসের বিরোধিতায় নেমে পড়ে ।

যেমন বন্ধু দিবসে একদল তরুণ –তরুণী ‘বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল’ ভেবে ছেলে মেয়ে একে অপরের ওপর লাফিয়ে পড়া, দিনভর বেহুদা কথাবার্তার আড্ডা দেয়া , এইসবে এতে উঠেছিল । আবার অপরপক্ষ , বিশেষত ইসলামী ধ্যানধারণা লালনকারী গোষ্ঠি ‘বন্ধু তো সবসময়ের- দিবসের কী দরকার ?’, ‘দিবসের মাধ্যমে বেহায়াপনা-অশ্লীলতার প্রচার হচ্ছে’ এসব কথা বলে এর বিরোধিতা করেন ।

উভয়পক্ষই ভুল কনসেপশনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলেই আমার মনে হয় ।

বন্ধুত্ব আসলেই সবসময়ের , কেউ বললেও সবসময়ের- না বললেও সবসময়ের । সেজন্য বিশেষ দিবসের প্রয়োজন হয়না । কিন্তু একটা দিবস যদি পালন করা হয়- সেটা কি ক্ষতিকর কিছু ? আমার মনে হয়না । যেমন ধরুন- গাছ রোপন করা সবার দায়িত্ব, সবসময়ের জন্যই । কিন্তু তবুও ‘বৃক্ষরোপন সপ্তাহ’ পালন করা হয় । শিশুদের অধিকার রক্ষা করা সবসময়ের কাজ , কিন্তু তবুও তো ‘শিশু সপ্তাহ’, ‘শিশু অধিকার দিবস’ পালন করা হয় । মানবাধিকার দিবস , পরিবেশ দিবস এরকম শত শত দিবস পালন করা হয় । আপনি কি এগুলোর বিরোধিতা করেন ? সম্ভবত না ।

আরো আছে । আনন্দ –বেদনা মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী । কিন্তু তবু আমাদের আছে দুটি ঈদের দিন । আনন্দের দিন । তার মানে কি অন্যান্য দিনে মুসলমানেরা আনন্দ করেনা ? তা তো নয় ।

সুতরাং টুলসের বিরোধিতা করার সস্তা প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার । টুলসের বিরোধিতা করার প্রয়োজন নেই- প্রয়োজন টুলস ব্যবহারের মানসিকতার পরিবর্তন, উদ্দেশ্যের পরিবর্তন । উদ্দেশ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা । ঈদ উপলক্ষ্যেও সিনেমা হলে অশ্লীল সিনেমার প্রদর্শনী হয় । গানের এ্যালবাম বের হয় । উদ্দাম কনসার্টের আয়োজন হয় । স্টার জলসা, স্টার মুভিজ, এ এক্স এন, আল জাজিরা , ন্যাট জিও, পিস টিভি সবই টিভি চ্যানেল । পার্থক্যটা আপনি নিজেই বোঝেন- উদ্দেশ্য ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির ভিন্নতা । সুতরাং গোড়ায় হাত দিতে হবে । সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কারে হাত দিতে হবে ।

বন্ধুত্ব দিবস উপলক্ষ্যে যদি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বন্ধুদের খোঁজ নেয়া হয় , যদি কোন বন্ধুর কোন সাহায্যে এগিয়ে আসা যায় সেটা তো ভালোই ।

তবে এটা বুঝতে হবে-
#বন্ধুত্ব মানে শুধু ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয়া নয়, বন্ধুত্ব মানে ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা নয় , একে অপরের ওপর ঝাপিয়ে পড়া নয় । বন্ধুত্ব মানে একসাথে মিলে দুষ্টুমি করা নয় । খারাপ কাজেও সহযোগিতা করা নয় ।

বন্ধুত্ব মানে বন্ধুর প্রতি দায়িত্ববোধ, বন্ধুর বিপদে আপদে সবার আগে এগিয়ে আসা, সবাই মিলে ভালো উদ্যোগ নেয়া, ভালো কাজ করা । বন্ধু বিপথে গেলে টেনে ফিরিয়ে আনা ।

একজন বন্ধু যখন অসুস্থ হয়- তখন বন্ধুরা রাত জেগে তাঁকে সঙ্গ দেয় । বন্ধুর জন্য রাস্তায় ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাঁড়াতেও কখনো লজ্জা হয় না । এমন বন্ধুত্বই প্রয়োজন ।

তবু সবার আগে মা-বাবা, ভাই বোন । তারপর বন্ধু । সেকথাও মনে রাখা দরকার ।

বন্ধুত্ব থাকুক । বন্ধু দিবসও থাকুক । সবকিছু হোক কল্যাণের জন্য । সত্যের পথে । ন্যায়ের পথে ।
বন্ধু হোক জান্নাতের পাথেয় । বন্ধু হোক চিরকালের- দুনিয়া এবং আখেরাতে ।


০৫-০৮-২০১৩ 

শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য

আল্লাহ তায়ালা নবী রাসুলদের কেন পাঠালেন ? এই প্রশ্নের উত্তরে ছোটবেলায় ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়েছি- ‘যুগে যুগে পথভোলা মানুষকে পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা নবী রাসুল পাঠিয়েছেন’ । কথাটা ঠিকই আছে । কিন্তু এতে নবী রাসুলদেরকে ধর্মপ্রচারকের বেশি মর্যাদা দেয়া হয় না । বিশেষ করে শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ব্যাপারে এই কথাটা যথেষ্ট নয় ।

কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

﴿هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ﴾
৩৩) আল্লাহই তার রসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দীন সহকারে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি একে সকল প্রকার দীনের ওপর বিজয়ী করেন, মুশরিকরা একে যতই অপছন্দ করুক না কেন ৷
-সুরা তাওবা ।

এখান থেকে আমরা কী দেখতে পাই ? রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে – আল্লাহ্‌র দ্বীনকে পৃথিবীর অন্য সকল প্রকার দ্বীন বা মতবাদের ওপর বিজয়ী করা । নিছক কোন ধর্ম-প্রচার নয় ।

রাসুল (সাঃ) কে এবং তাঁর মাধ্যমে মানবজাতিকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে – সেসবের উদ্দেশ্য হচ্ছে আসল লক্ষ্য বাস্তবায়ন । এরকম কোন আয়াত আমার জানা নেই যেখানে বলা হয়েছে যে –আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবীকে পাঠিয়েছেন নামাজ পড়ার জন্য , হজ্ব করার জন্য । কিন্তু এখানে স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে রাসুল (সাঃ) কে প্রেরণ করা হয়েছে যেন তিনি আল্লাহ্‌র দ্বীনকে অন্য সকল মত-পথের ওপর বিজয়ী, সুপিরিয়র রাখতে পারেন ।

প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কেন নামাজ-রোযা এসব ফরয করা হয়েছে ?
ধরা যাক একজন বাবা তাঁর ছেলেকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করালেন । উদ্দেশ্য কী ? উদ্দেশ্য অবশ্যই ছেলেকে ডাক্তার বানানো –যেন ছেলে ডাক্তার হয়ে মানুষের চিকিৎসা করতে পারে । মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে পারে । বাবা ছেলেকে উপদেশ দেয়ার সময় বলেন- তোকে পাঠাচ্ছি ডাক্তার হবার জন্য । ভালো করে লেখাপড়া করবি ।

ডাক্তার হবার জন্য ছেলেকে সময়-রুটিন মত কলেজে যেতে হয় , ক্লাস করতে হয় , প্র্যাক্টিকাল করতে হয় । একজন ছাত্র কী করে ভালো ডাক্তার হবে ? যদি সে তাঁর আসল উদ্দেশ্য- মানুষের চিকিৎসা করতে হবে এই কথা মনে রাখে ।
আমাদের উদ্দেশ্য আর পাথেয় এই দুয়ের পার্থক্য বুঝতে হবে । ডাক্তার হওয়া উদ্দেশ্য- ক্লাস, পড়া এসব হচ্ছে ট্রেনিং, পাথেয় ।

সুতরাং- নামাজ রোযা এবং অন্যান্য আমল সবকিছু হচ্ছে আল্লাহ্‌র দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য পাথেয় । এই ট্রেনিং ছাড়া যেমন আল্লাহ্‌র দ্বীনকে বিজয়ী করা এবং বিজয়ী রাখা সম্ভব নয়, তেমনি উদ্দেশ্য না বুঝে – লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ না করলে সবকিছু অর্থহীন ।

আল্লাহ আমাদের হেদায়াত দান করুন । আল্লাহ্‌র দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করার তাওফিক দান করুন । আমীন ।


০২-০৮-২০১৩