বিভিন্ন সময়ে বৃহত্তর কোন স্বার্থে , অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে
নিহতদের এবং কৃতিমান পুর্বপুরুষদের স্মরণে তাদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে
কিংবা তাদের স্মরনে নির্মিত কোন সৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর একটি প্রথা
আমাদের সমাজে চালু আছে । বছরের বিভিন্ন দিনে কখনো কখনো ঘটা করেও এই পন্থায়
শ্রদ্ধার্ঘ দিতে দেখা যায় । এছাড়াও এক মিনিট নীরবতা পালন , প্রদীপ প্রজ্বলন
করতেও দেখা যায় । এ বিষয়ে ইসলামে কী বিধান রয়েছে ?
মু’মিন
ব্যক্তিদের জীবন পরিচালনার পথে সকল বিষয়েই আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর দেয়া
বিধান খুঁজতে হবে । এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা
চালাতে হবে । এতে যদি সেই বিষয় নিজের আবেগের বিরুদ্ধে যায় , আজীবনের লালিত
রীতিনীতির ব্যতিক্রম ঘটে , সামাজিক প্রথার পরিবর্তন হয় , তবুও ।
‘ তা নয়, বরং এরা বলে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে একটি পন্থার ওপর পেয়েছি, আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরন করে করছি ৷
এভাবে
তোমার পূর্বে আমি যে জনপদেই কোন সতর্ককারীকে পাঠিয়েছি, তাদের স্বচ্ছল
লোকেরা একথাই বলেছে, আমরা আমাদের বাপ দাদাদেরকে একটি পন্থার অনুসরন করতে
দেখেছি৷ আমরাও তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরন করছি ৷
প্রত্যেক নবীই
তাদের বলেছেন, তোমরা তোমাদের বাপ দাদাদের যে পথে চলতে দেখেছো আমি যদি
তোমাদের তার চেয়ে অধিক সঠিক রাস্তা বলে দেই তাহলেও কি তোমরা সেই পথেই চলতে
থাকবে ? তারা সব রসূলকে এই জবাবই দিয়েছে, যে দীনের দিকে আহবান জানানোর জণ্য
তুমি প্রেরিত হয়েছো, আমরা তা অস্বীকার করি ৷
শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে মার দিয়েছি এবং দেখে নাও, অস্বীকারকারীদের পরিণাম কি হয়েছে ৷’ ( আয যুখরুফ , ২২-২৫ )
মৃত
ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রতিকৃতিতে এবং সৌধে ফুল দেয়ার প্রথা
মুসলিম সংস্কৃতির সাথে বলা যায় সাংঘর্ষিক । কোন মৃতব্যক্তির প্রতি সম্মান
দেখানোর জন্য কোথাও ফুল দিতে রাসুল (সাঃ) আমাদের শেখান নি তা যতবড়
ব্যক্তিত্বই হয়ে থাকুন না কেন । বদর, ওহুদ, হুনাইনের যুদ্ধে শাহাদাত বরনকৃত
বীরসেনানীদের জন্য ফুলের ব্যবস্থা করেন নি সালফে সালিহীনগন । ইসলামে এই
প্রথার অনুমতি থাকলে সবার আগে আমাদের উচিৎ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবাদের
স্মরণে সৌধ নির্মাণ করে ফুল দেয়া ! ( নাউযুবিল্লাহ )
বরং আমাদের
নিজেদের হাতে নির্মিত কিছু প্রতীকি মুর্তির সামনে ফুল দেয়ার ব্যাপারটা
কিছুটা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অনুসৃত প্রথা এবং কিছুটা মুর্তিপুজার সাথে
সাজুয্যপুর্ণ । এতে শিরক হওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে । কুরআনের কয়েকটি আয়াতের
দিকে দৃষ্টি দেই-
►‘ সে সময়ের কথা স্মরণ করো
যখন সে তার নিজের বাপকে ও জাতিকে বলেছিল, “এ মূর্তিগুলো কেমন, যেগুলোর
প্রতি তোমরা ভক্তিতে গদগদ হচ্ছো?” (-আম্বিয়া:৫২ )
► হে ঈমানদারগণ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ
সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকলাপ। এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায়
তোমরা সফলতা লাভ করবে। - (মায়েদা:৯০ )
► “তোমরা দুনিয়ার জীবনের তো আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তিগুলোকে নিজেদের
মধ্যে প্রীতি- ভালোবাসার মাধ্যমে পরিণত করে নিয়েছো। কিন্তু কিয়ামতের দিন
তোমরা পরস্পরকে অস্বীকার এবং পরস্পরের প্রতি অভিসম্পাত করবে আর আগুন
তোমাদের আবাস হবে এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী হবে না।” – (আনকাবূত:২৫ )
► হে আমার রব! এ মূর্তিগুলো অনেককে ভ্রষ্টতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, (হয়তো
আমার সন্তানদেরকেও এরা পথভ্রষ্ট করতে পারে, তাই তাদের মধ্য থেকে) যে আমার
পথে চলবে সে আমার অন্তর্গত আর যে আমার বিপরীত পথ অবলম্বন করবে, সে ক্ষেত্রে
অবশ্যি তুমি ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। - (ইবরাহীম:৩৬ )
এ বিষয়ে সতর্ক হওয়াটা এজন্যই জরুরী যে এতে শিরকের উপাদান আছে । আর শিরক এমন ধরনের অপরাধ যা আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেন না ।
‘
স্মরণ করো যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল , সে বললো, “ হে পুত্র !
আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না ৷ যথার্থই শিরক অনেক বড় জুলুম ৷’ – (
সুরা লুকমান, ১৩ )
‘ আল্লাহ অবশ্যি শিরককে মাফ করেন না ৷ এ
ছাড়া অন্যান্য যত গোনাহর হোক না কেন তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন ৷ যে
ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করেছে সেতো এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে
এবং কঠিন গোনাহের কাজ করেছে ৷’ - (সুরা নিসা: ৪৮)
‘যে
ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেছে তার ওপর আল্লাহ জান্নাত হারাম করে
দিয়েছেন এবং তার আবাস জাহান্নাম ৷ আর এ ধরনের জালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই
৷’ - (সূরা মায়িদাহ: ৭২)
‘কিন্তু যদি তারা কোন শির্ক করে থাকতো তাহলে তাদের সমস্ত কৃতকর্ম ধ্বংস হয়ে যেতো ৷’ - (সুরা আন্ আমঃ ৮৮)
‘(হে নবী) বলুনঃ আমি তো আমার রবের ইবাদত করি আর তাঁর সাথে কোন শিরক করি না ।’ -(সুরা জ্বীনঃ ২০)
এই রীতিটি খ্রিষ্টানদের হতে গৃহীত হয়েছে । এ প্রসঙ্গে কুরআনের বক্তব্য –
“হে
মুমিনগণ ! তোমরা ইহুদী ও নাসারাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না । তারা
পরস্পরে বন্ধু । তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই
অন্তর্ভূক্ত হবে। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।” (সূরা মায়িদাহঃ
৫১)
“ইহুদী ও খৃষ্টানরা কখনই আপনার উপর সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্তু আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ না করবেন।” (সূরা বাকারাঃ ১২০)
আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কোন ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের অনুসরণ করে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত”। (আবু দাউদ)
একটি নজির ঃ
খলীফা
ওমর (রাঃ)-এর সময় তাকে সংবাদ দেয়া হল যে, কিছু মানুষ ঐ বৃক্ষের উদ্দেশ্যে
যাতায়াত করে যে বৃক্ষের নীচে ছাহাবীগণ নবী করীম (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত
করেছিলেন। অতঃপর তিনি [ওমর (রাঃ)] ঐ বৃক্ষকে কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন
(ফাৎহুল বারী ৭/৪৪৮)।
এই প্রথাগুলো পৃথিবীর অন্যান্য
অঞ্চলের তুলনায় আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বেশি প্রচলিত ।
এর একটি কারন হতে পারে , এই অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ও ইসলামী শাসনের ইতিহাস
খুব বেশি দীর্ঘ নয় । রাসুলুল্লাহ মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজ হাতে তৎকালীন
মূর্তিপূজারী আরবদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংষ্কার, শিরক, কুফর ও
ভ্রান্ত ধারনা দূর করে দিয়ে যান। ইসলামের সৌন্দর্য আর সত্যতা উপলবদ্ধি করে
ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য জাতি ইসলাম গ্রহন করে এর সুশীতল
ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহন করেছে । তবে অনেক ক্ষেত্রে ইসলাম গ্রহনের পূর্বে
ধারনকৃত বিশ্বাস, ধ্যান-ধারনার কিছু অংশ রয়ে যায় অনেকের মধ্যেই । যেহেতু
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠির পুর্বপুরুষ এককালে মূর্তিপূজারী
মুশরিক ছিল সেকারনে পূর্বপুরুষদের পালনকৃত অনেক শিরক, কুফর ও বিদআত আমাদের
মধ্যে থেকে গেছে । কিন্তু এখন আমাদের সামনে সত্য পরিষ্কার । সুতরাং আমাদের
অবশ্যই এই ঈমান বিধ্বংসী রীতিনীতি থেকে সরে আসতে হবে ।
একটি ফতোয়া ঃ
‘গবেষনা ও ইফতা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি কর্তৃক ফতোয়া
চেয়ারম্যানঃ আব্দুল আযীয ইবন আবদুল্লাহ ইবন বায
ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ আবদুল রাজ্জাক আল আফিফী
কমিটি সদস্যঃ আবদুল্লাহ ইবন গদাইয়্যান আল তামীমী এবং আবদুল্লাহ ইবন ক'উদ
প্রশ্নঃ মিনার এবং অজ্ঞাত সৈনিকদের স্মৃতিসৌধ নির্মানের বিধান কি?
উত্তরঃ
কোন
দেশের বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা
পালনকারী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের ভাষ্কর্য এবং যা অজ্ঞাত সৈনিকের
স্মৃতিসৌধ নামে পরিচিত এগুলো নির্মান একটি জাহেলী (ইসলামপূর্ব অজ্ঞতা)
কর্মকান্ড। এটি এক ধরনের অমিতব্যায়িতা কেননা আমরা বিভিন্ন সভা করতে দেখি এই
সকল সৌধের পাশে এবং তাদেরকে সম্মান জানানোর জন্য ফুল দিতে দেখি। এটা
মুর্তিপুজার যুগের সমতুল্য এবং শিরক উল আকবার (আল্লাহতালার সাথে বড় ধরনের
শরীক সাব্যস্ত করা) এর দিকে ধাবিত করে, আমরা এগুলোর থেকে আল্লাহতালার নিকট
আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তাওহীদ (আল্লাহতালার একত্ববাদ) এর বিশ্বাসকে
সংরক্ষনের জন্য, অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত খরচ এড়ানো এবং কাফিরদের (অবিশ্বাসী)
ঐতিহ্য ও রীতির অনুসরণ যা আমাদের মন্দের দিকে ধাবিত করে সেগুলো এড়ানোর
জন্য এ ধরনের রীতিগুলোকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’
আমাদের পুর্বপুরুষ এবং প্রিয় মানুষদের জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দু’আ করতে পারি । সেটাই হবে তাঁদের ও আমাদের জন্য মঙ্গলজনক ।
সত্য
উপস্থিত হওয়ার পরে - ব্যাক ডেটেড, মৌলবাদী , প্রতিক্রিয়াশীল ,
প্রগতিবিরোধী বলা হবে এই ভয়ে আল্লাহর বিধান অনুসরণ থেকে যদি কেউ দূরে থাকেন
তবে তা হবে চরম বোকামী ।
আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ অনুসরনের তাওফীক দান করুন । আমীন ।
রবিবার, ফেব্রুয়ারি 26, 2012