এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ৩১ মে, ২০১৪

ত্রিভুজের তৃতীয় বাহু

বিপ্লব কবিতা ও নারী । এই হলো পৃথিবীর মানুষের
ভালোবাসার ত্রিভুজ প্রেরণা ।
কেউ নারীকে ভালোবেসে জীবন কাটিয়ে দেয় । কেউ কবিতা ।
কেউ বিপ্লব ।

কবিতা ও নারীকে তবু একতারে বাঁধা যায় । কিন্তু বিপ্লব ? 
এও কি সম্ভব , বিপ্লব কবিতা ও নারীকে
একই সুতোয় গাঁথা ?


নারী চায় গৃহকোণ , ঘর সংসার । সুদৃঢ় বন্ধন । অথচ
বিপ্লব মানেই বন্ধন ছেঁড়ার আহ্বান । ঘোড়া আর তলোয়ার সঙ্গী করে 
অচেনা পথে বেরিয়ে পড়ার শপথ । বিপ্লব মানেই 
হৃদপিন্ড হাতে নিয়ে বন্ধুর পথে ছুটেচলা ।


চিৎকার ধুলো আর রক্তের ভেতর , কবিতা হয়তো তবু বেঁচে থাকে 
স্বপ্নের মত । কিন্তু নারী ? সংগীত মূর্ছনার বদলে  
কোন নারী কি কখনো রণভেরি ভালোবাসে ?
সেও কি সম্ভব ?




বিপ্লবের পথে আপাতত তাই
ঘোড়া আর কবিতাই সঙ্গী থাকুক । কোনদিন যদি 
বিজয় নিশান হাতে ফিরে আসি গোধূলী বেলায় , পুরনো মেঠোপথে
সেদিন নাহয় খুঁজে নেবো ত্রিভুজের তৃতীয় বাহু  । ফুলের বদলে 
বিজয় পতাকা তুলে দেবো
তাঁর হাতে । গৃহী হবার পথে ,
সেই হবে একজন ফিরতি বিপ্লবীর 
প্রথম প্রয়াস ।


▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
ত্রিভুজের তৃতীয় বাহু / ৩১-০৫-২০১৪

রবিবার, ২৫ মে, ২০১৪

একটি অমানবিক গল্প

কানাকানি হতে হতে খবরটা জোবায়দার কানে এসে যখন পৌঁছলো , তখন জোবায়দা বাস করছিল কল্পনার জগতে । বান্ধবীরা গাইছিল বিয়ের গীত । কথায় কথায় নানান রসিকতা আর ফোড়ন কাটা চলছিল সমানতালে । কিন্তু সেদিকে কান ছিলনা জোবায়দার । সে ভাবছিলো কেমন হবে মারুফের আজকের সাজ । বর হিসেবে মারুফকে কেমন লাগবে । কেমন হবে প্রথম চোখাচোখি , প্রথম হাত ধরার অনুভূতি । কী কথা হবে আজ ? ভাবনার সাথে সাথে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছিল জোবায়দার মুখের মানচিত্র । খুব বেশি সাজেনি জোবায়দা । আজকাল যেভাবে পার্লারে কণে সাজানো হয় , তার কিছুই হয়নি । বান্ধবীরা তবু কম সাজায়নি । একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল জোবায়দা , জেরিনটাই জোর করে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল । 'দ্যাখ্‌  রাজকন্যা , নিজের রুপ দ্যাখ্‌ । আমি ছেলে হলে তোরে কিছুতেই হাতছাড়া করতাম না কিন্তু !'
জোবায়দা নিজেও কম অবাক হয়নি । বান্ধবীগুলো যেন এক একটা জিনিয়াস বিউটিশিয়ান ।


অতীত ভবিষ্যত্‍ সবকিছু যেন তার মনে একসাথে খেলা করছিলো । এই ঘর , বাবা মা , বুবুর নেওটা ছোট ভাইটা , সবাইকে আজ ছেড়ে যেতে হবে । জানে , সব মেয়েদেরই এমন করতে হয় । দাদী , নানী , মা সবাইকে একদিন শৈশব কৈশোরের চিরআপন পরিবেশ ছেড়ে আসতে হয়েছিল । তবুও ভেতরে একটা কান্নার দলা পাকিয়ে উঠতে চাচ্ছে যেন । জোবায়দা সেটাকে জোর করে ঠেলে ভেতরে পাঠাচ্ছে বারবার । মারুফের মুখটা চোখের সামনে ধরে রাখার চেষ্টা করছে । যেন চিনে নিতে চাচ্ছে  মারুফের মুখ ও কপালের প্রতিটি রেখা ।


দেখাদেখির দিন লজ্জা সংকোচ না করে মারুফের মুখটা ভালো করেই দেখে নিয়েছে সে । গোলগাল হাসিহাসি মুখ । হালকা দাড়ি আছে পুরোটা জুড়ে । কথার মধ্যে একটা দৃঢ়তা আছে , বেশ ধীর স্থির । কোনকিছুতে তাড়াহুড়ো নেই । তবে একটু জড়তা ছিল । যেসব ছেলের মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যেস নেই তাদের এমন একটা জড়তা থাকে । আর তাছাড়া বিয়ের দেখাদেখি । এ তো এক বড় ডিসিশানের ব্যাপার । জড়তা থাকতেই পারে । জোবায়দার ভালই লেগেছে । সবচেয়ে বড় কথা , চেহারায় একটা সরলতা ছিল মারুফের । এটা সবার থাকেনা ।

আরো খোঁজখবর আগেই জেনেছিল । ছেলে নামাজী , ভার্সিটি ছাত্র হলেও কুরআন হাদীসের ভালো জ্ঞান রাখে । দেখাদেখির দিনেও জোবায়দার কয়েকটি প্রশ্নের এমন ব্যাখ্যা দিয়েছে - সত্যি বলতে কি , জোবায়দা জীবন নিয়ে ওভাবে আগে ভাবেনি ।


একটা সাহসী ছেলেকে নিজের স্বামী হিসেবে সবসময় কামনা করেছে জোবায়দা । অবশ্য সব মেয়েই মনে হয় তা-ই চায় । পুরুষ যদি হয় ভীতুর ডিম , তাহলে কেমন করে হবে ? কেউ কেউ অবশ্য ভ্যাবলা ছেলেই পছন্দ করে , যেমন জেরিন । ওর কথা হলো স্বামীকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে । এমন স্বামী সে চায়- বাবুরাম সাপুড়ের সাপের মত । করে নাকো ফোঁসফাস , মারে নাকো ঢুসঢাস । উল্টাপাল্টা দেখলেই জেরিন ওর স্বামীকে  ‘তেড়ে মেরে ডান্ডা , করে দেবে ঠান্ডা’ । একথা বলতে বলতে জেরিন প্রায়ই হেসে গড়িয়ে পড়ে ।
জোবায়দা সেরকম না ।

মারুফ যে সাহসী সেটা বোঝা যায় । সে ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি সচেতন । রাজনীতি করেছে । সরকারী দলের লুতুপুতু সুবিধাবাদী রাজনীতি না , বিরোধী রাজনীতি । ইসলাম পন্থি দল , এদের আচার ব্যবহারের মাধুর্য আর সততা সবাই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয় । কিন্তু বিরোধী দলের রাজনীতি মানে সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা । সে কি যা তা ব্যাপার ? পুলিশ বাহিনী , আদালত সবকিছুকে সরকার ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করার জন্য । মারুফের নামেও নাকি মামলা আছে । পলিটিকাল মামলা । মিথ্যা মামলা । জোবায়দা এ নিয়ে ভাবেনা । সত্য কথা বলে নবী রসুলরা যেখানে মিথ্যা অভিযোগ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন , সেখানে এই সময়ে তো এমনটা হবেই । না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক ।


দেখাদেখির দিন কথাবার্তায় যা মনে হয়েছে , মানসিকতার মিল রয়েছে বেশ । মানসিকতার মিল , ভালোবাসার সাথে সহযোগিতা সহমর্মিতার মনোভাব খুব বেশি দরকার যৌথ জীবনের পথচলায় । জোবায়দা এদিক থেকে পুরোপুরি একমত । সে জানে , দুজন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন পরিবারে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা । দুজনের সবকিছু কীকরে দুজনেরই পছন্দ হবে ? কিছুনা কিছু তো অপছন্দ থাকবেই । সব ব্যাপারেই দুজনের মতামত এক হবে কীকরে ? এটাতো সম্ভব নয় । একই মায়ের দু সন্তানও একরকম হয়না । সেজন্য মেনে নিতে হবে । ছাড় দিতে হবে । মারুফ কতটুকু ছাড় দেয়ার মানসিকতা রাখে ? অবশ্য সেদিনের কথায় মনে হয়েছে , মারুফও এমন চিন্তা করে । তবু বলা যায় না , কেমন হবে আগামীর দিনগুলো । সারাজীবন একসাথে থেকেও হয়তো একজন মানুষকে পুরোপুরি চেনা যায়না । বাবা অথবা মা তাঁদের সন্তানকে অনেক ভালো বোঝেন ।  কিন্তু  পুরোপুরি বুঝতে কি পারেন ?  পারেন না । দেখা যাক । সময়ই সবকিছু বলে দেবে ।



বিক্ষিপ্ত চিন্তায় মাঝে মাঝেই ছেদ পড়ছিলো । বদমাশ বান্ধবীগুলোর চিমটি কাটার বদভ্যাস । চিমটি কেটেই ক্ষান্ত হয়না । নানান কথা ওদের । আহারে , রাজপুত্তুরের কথা ভেবে ভেবে দোস্তটার বুক ফেটে যাচ্ছেরে । এত দেরি করছে কেন হ্যা ? সখীর যে আর তর সইছে না রে !

তারপর অট্টহাসি । কেউ একজন বলে , চল্‌  রাজকন্যাকে বন্দী করে রাখি । রাজপুত্তুরের হাতে এত সহজে তুলে দেবো ? হাউ মাউ খাউ ।
আরেকজন বলে , সোনার কাঠি রুপোর কাঠি ঠিকমত লুকিয়ে রাখিস । সহজে যেন খুঁজে না পায় ! হাউ মাউ খাউ ।


ওদের এত দুষ্টুমি ভালো যেমন লাগছিল , মন খারাপও লাগছিল । আহা , এরা কত আত্মার আত্মীয় । এদের সাথে আর যখন তখন দেখা হবেনা । ছেলেরা বিয়ের পরও বন্ধু হারায় না । কিন্তু মেয়েদের হারাতে হয় । বিয়ের পর কে কোথায় যায় , কতদিন পর কারো সাথে দেখা হয় , কারো সাথে হয়তো আর কোনদিনই দেখা হয়না । এরা যে এখন এত হাসি তামাশা করছে , এরা কি বোঝেনা ? বোঝে । জোবায়দা চলে গেলে এই ঠাট্টা তামাশা করা বান্ধবীরাই একা একা কেঁদে বালিশ ভেজাবে । প্রাণের বান্ধবীকে নতুন জীবনে সাহস দিতে হবে , এই ভেবে ওরা সব কষ্টকে বুকের ভেতর ছাইচাপা দিয়ে অভিনয় করে যাচ্ছে । যতক্ষণ ওরা পাশে আছে , সত্যিই সাহস লাগছে জোবায়দার । মারুফ কি পারবে এদের মত বন্ধু হতে ?


পাঁচটা পেরিয়ে গেছে আধাঘন্টা আগে । পাঁচটার মধ্যেই বরযাত্রী আসার কথা ।

কিরে , বর এখনো আসেনা ক্যান ? পদব্রজে আসছে নাকি ?
নাহ , বোধহয় গাধার পিঠে চড়ে আসছে !

এলোমেলো আলাপের মাঝে জেরিন উঠে যায় । দেখি খবর নিয়া আসি , রাজকন্যাকে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে !

একটু পরে শুকনো মুখে জেরিন এসে মুন্নুকে ডেকে নিয়ে যায় । বাইরে বসে ওরা জোবায়দার বাবার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করে । কীভাবে খবরটা জোবায়দাকে বলবে ? জোবায়দা এমনিতে শক্ত মেয়ে , কিন্তু এটা সইতে পারবে তো ? একটা মেয়ের জীবনে এমন সময় কি বারবার আসে ?


জোবায়দার বাবা , জেরিন , মুন্নু তিনজনে ঘরে এসে ঢোকেন । সবাই চুপ হয়ে যায় । আংকেলের মুখ গম্ভীর । জেরিন এবং মুন্নুর চোখ ছলছল করছে । সবাই বুঝলো , কিছু একটা সমস্যা হয়েছে । জোবায়দার বুকটাও ধ্বক করে উঠলো । কী হলো ?

জোবায়দার বাবা ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন , মা , বিয়েতে আসার পথে গাড়ি থামিয়ে পুলিশ  মারুফকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে । সবই আল্লাহর ইচ্ছা মা । ধৈর্য রাখ্‌ । আল্লাহর ওপর ভরসা হারিও না ।



জোবায়দা স্তব্ধ হয়ে শুনলো । জেরিন এবং মুন্নু আর সামলাতে পারলো না । অনেকক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ছিল । হু হু করে কেঁদে উঠলো দুজনেই ।

জোবায়দা ধীর পায়ে উঠে গেল । মারুফের মুখটা একবার কল্পনা করলো , বরের পোষাকে কেমন আছে মানুষটা পুলিশ কাস্টডিতে ?
মারুফের জন্য ওর ভালোবাসা বেড়ে গেছে অনেক । যতদিন লাগে ,  মারুফের জন্য অপেক্ষা করবে জোবায়দা । বান্ধবীরা কাঁদছে , কাঁদুক । এই অবস্থায় জোবায়দার অনুভূতি ওরা ছাড়া আর কে ভালো বুঝবে ?
 ওয়াক্ত হয়েছে । ওযু করে আসরের নামায পড়বে । বুক ফেঁটে কান্না আসছে ওরও ।  সেও কাঁদবে , কিন্তু এখানে না । নামাযে দাঁড়িয়ে কাঁদবে সে । এই জুলুমের , এই অমানবিকতার বিচার চাইবে আল্লাহর কাছে ।




টীকাঃ
গতকাল ফেসবুকে হঠাৎ  চোখ পড়ে এক বোনের স্ট্যাটাসে । তাঁর বিয়ে হবার কথা ছিল শুক্রবারে । আসার পথে বরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ।
তখন থেকে মনটা খচখচ করছিল । পড়াশোনায় কোনভাবেই মন বসাতে পারছিলাম না । কিছুতো করার নেই , নিজেকে তার জায়গায় রেখে,  চিন্তা করে শুধু সমব্যথী হলাম । এই লেখা হয়তো তাঁর নজরে যাবে না কারণ তিনি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই । পড়লেও হয়তো তাঁর কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না ।

তবু লিখলাম । এইসব ঘটনা হয়তো লেখা থাকবেনা ইতিহাসে । অন্তত লেখা থাকুক ক্ষুদ্র একজন সাধারণ মানুষের ফেসবুক নোটে । খুব সাধারণ একটি গল্প হয়ে । এই নষ্ট সময়ে , এক ভ্রষ্ট রাষ্ট্রের অমানবিক গল্প ।

শনিবার, ২৪ মে, ২০১৪

মোহগ্রস্ত আহাম্মক !

এইটুকু যথেষ্ট নয় , পেতে হবে আরও বেশি ।
আরও আরও বেশি । পাহাড় সমান সম্পদের সামনে দাঁড়িয়েও ,
এই ভেবে অস্থির হয় মানুষের মন । আহাম্মকের মত
কবরে যাবার আগ মুহূর্তেও গলায় জড়িয়ে রাখে পরম আগ্রহে
প্রাচুর্যের লোভ, লালসার চাঁদর !


বেশি বেশি পাওয়ার নেশায় ছুটতে ছুটতে
হঠাৎ একদিন সে পৌঁছে যায় অনন্ত ময়দানে । প্রখর সূর্যতাপে
হাবুডুবু খেতে থাকে ঘামের সমূদ্রে । ‘এ কোথায় এলাম ?’ এটুকু ভাবারও
ফুরসত জোটেনা তাঁর । ঐযে পূর্বপুরুষেরা সব – সারি বেঁধে চলেছে কোথায়
কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই- যেন সব ভিনদেশি অচেনা মানুষ । দূরে ঐ দেখা যায়
ঘোর কালো সাতটি অগ্নিকুন্ড ! প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটছে সবাই । এরই মাঝে
কে যেন ধমকে ওঠে ভয়ানক স্বরে, ‘বল্‌ কী করেছিস পৃথিবীতে তা দিয়ে-
যা কিছু তোকে দিয়েছিলাম ?’


(সুরা আত তাকাসুর এর শিক্ষা অবলম্বনে)

শুক্রবার, ২৩ মে, ২০১৪

নেকড়ের ক্ষুধা

গরম খবর , গরম খবর ! দৈনিক ‘নেকড়ের আলো’র
আজকের গরম খবর ! ফুলগাজী উপজেলার ‘চেয়ারনেকড়ে’-কে
পুড়িয়ে মারলো  আরেক নেকড়ে । গরম খবর !


হকারের চিৎকার চেচামেচিতে বিরক্ত হই । কৌতূহলও জাগে কিছুটা ।
আমি এক নিরীহ হরিণ । এই জঙ্গলে নেকড়ের রাজত্বে প্রতিদিন
নেকড়েদের হাতে  মারা পড়ে আমার স্বজাতি,
কতশত নিরীহ হরিণ !  দৈনিক ‘নেকড়ের আলো’য়  
ছাপা হয় প্রতিনিয়ত পৈশাচিক উল্লাসের পদাবলী । সেসব খবরে তাই  
আগ্রহ পাইনা আজকাল ।  নীরবে সয়ে যাই সব । বরং
নিজেকে প্রস্তুত করি যেকোন মুহূর্তে নিজেই ‘শিকার’ হয়ে     
নেকড়ের আহার যোগানোর !


সে তুলনায় আজকের খবরটা
সত্যিই ভিন্ন স্বাদের বটে ! এক নেকড়েকে খুন করেছে আরেক নেকড়ে ! 
‘দাওহে একটা পত্রিকা’ ! হাক ছাড়ি আমি হকারের উদ্দেশ্যে । খুঁজে খুঁজে পড়ি   
‘নেকড়েনীতি’র খবর !  মনুষ্য সমাজে নাকি একদা  
‘রাজনীতি’ বলে একটা কথা ছিল । আমাদের পশু সমাজে
আজকাল সেটাকেই বলা হয়-  ‘নেকড়েনীতি’ ।


জাতীয় নেকড়ে সংসদের মাননীয় সদস্য, পুড়িয়ে মেরেছেন তাঁর
সহযোগী ‘চেয়ারনেকড়ে’কে । পুড়ে অঙ্গার হওয়া ছবিটার দিকে
আমি একবার নির্লিপ্ত চোখে তাকাই । মনে প্রশ্ন জাগে -
নিয়মিত হরিণ মেরেও নেকড়েদের ক্ষুধা মিটছে না ?
এত ক্ষুধা কেন এদের ? 

বৃহস্পতিবার, ২২ মে, ২০১৪

হলুদ হিমু , কালো...

মাথার যন্ত্রণায় দুর্বিষহ হয়ে উঠছে জীবনটা । ইনভ্যাসিভ ব্যাক্টেরিয়ার মত
বিদঘুটে চিন্তাগুলি ঘরবাড়ি বানাচ্ছে নিউরনে নিউরনে । সাম্রাজ্যবাদী
আমেরিকার মত একে একে দখল করছে
সেরেব্রাল কর্টেক্সের প্রতিটি লোবকে !


হাত কিংবা পায়ের মত – মাথাটা ছাড়াই যদি
বেঁচে থাকা যেত । নেয়া যেত নিশ্বাস । তবে হয়তো
কেটেই ফেলতাম ওটা নাকের ওপর থেকে ! এই নষ্ট সমাজে
নাপিতের অভাব আছে । কিন্তু
মাথা কাটবার লোকের তো কোন অভাব নেই ! বিশ্বাস নাহয় তো
জিজ্ঞেস করে দেখো সাতক্ষীরা কিংবা লক্ষ্মীপুরের কোন একজন জেলে
কিংবা সাধারণ কৃষাণকে ! বিশ্বাস নাহয় তো একবার মুখ তুলে
উচ্চারণ করে দেখো অপ্রিয় সত্য !


সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাবে কালো পোষাকের কেউ
তোমার গলাকাটা দেহটা পড়ে থাকবে পরদিন – এই ঢাকারই
কোন এক ম্যানহোলে !


এই দেখো , কী বোকা আমি ! কালো সানগ্লাস , কালো মুখোশ
কালো পোষাকের কথা , আজকাল বলে নাকি কেউ ? কার আছে
অতটা বুকের পাটা ? এইসব অলক্ষুণে কথা আমি কিনা
নির্দ্বিধায় বলে চলেছি তোমাদের কাছে !
তবে কি শীঘ্রই আমি মুক্তি পেতে যাচ্ছি
বদমাশ মাথাটার যন্ত্রণা থেকে !


[হলুদ হিমু , কালো... /২২-০৫-২০১৪]

মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০১৪

বিপদ !

বড্ড বিপদে আছি চোখ দুটো নিয়ে। বন্ধ করে আর কতকাল থাকা যায় ?
অদ্ভুত এক দেশে জন্মেছিলাম । তাই
চোখ থাকলেও আশেপাশে তাকাতে ভয় হয় । কোথায় তাকাবো ?
মেঘনায় - শীতলক্ষ্যায় ? খালে বিলে ? মাঠের সবুজ ঘাসে ?
লাশ ছাড়া আর কিছু কি চোখে পড়ে ?
পিচঢালা  রাস্তায় - পোড়াগাড়ি পোড়ালাশ  ।
পত্রিকার পাতায় - মিথ্যার বেসাতি । জিঘাংসু বুদ্ধিজীবিদের
পরিপাটি ছবির আড়ালে ড্রাকুলার বিষদাঁত । 
টিভি স্ক্রিনে কতকাল রাখিনা চোখ । আর কত দেখবো মিথ্যার বাস্তব চিত্রায়ন ?


চোখ দুটো নিয়ে বড্ড বিপদে আছি ।
অদ্ভুত এক দেশে জন্মেছিলাম । এখানে নিরীহ মানুষ যেন
নদীর মাছের মত । ইচ্ছে হলেই বড়শি ফেলে
তুলে এনে খেয়ে ফেলা যায় ! হাটে বিক্রি করাও যায় ।
বেশ ভালো দাম ওঠে ! মুক্তিপণ দিলে
পাওয়া যায় তরতাজা লাশ । আহ ! সত্যিকারের মুক্তি !


মানবতা মানবাধিকার ন্যায়বিচার আইনের শাসন - 
জড়াজড়ি হয়ে ঘুমায় কুম্ভকর্নের সাথে প্রতিযোগিতা করে ! 
খুনি- সন্ত্রাসী মরলেই শুধু
হরি হরি বলে ধরফর করে জেগে ওঠে  -
'আমার এত বড় অপমান !'


চোখ দুটো নিয়ে বড্ড বিপদে আছি । বন্ধ করে আর কতকাল থাকা যায় ?

[বিপদ / ২১-০৫-২০১৪]

সোমবার, ১৯ মে, ২০১৪

খাঁচার দাস !

বয়সটা অদ্ভুত বটে !

বেশ আছি মুক্ত স্বাধীন মানুষ । ইচ্ছে হলে  
নীলরঙা জিন্সের ওপর মেরুন ফতুয়া জড়িয়ে   
চলে যেতে পারি যেকোন দিগন্তে, যখন তখন । বগলে চেপে  
জীবনানন্দের 'রুপসী বাংলা' । নসীম হেজাজীর ‘হেজাজের কাফেলা’ ।
মেঠো পথে হাঁটতে হাটতে 
গাইতে পারি গান - গাধার কন্ঠের মত সুমধুর সুরে !   


শৈশব কৈশোর হতে
এমন অবাধ স্বাধীনতাই তো ছিল পরম চাওয়া ! অথচ
কী অদ্ভুত ! এখন কিনা হঠাৎ হঠাৎ
খাঁচায় বন্দী- ‘পোষা পাখি’ হতে ইচ্ছে করে !


ঘরের দাওয়ায় ঝুলিয়ে রাখা ছোট্ট খাঁচায় 
সকাল বিকাল ভাঙ্গা বাটিতে খুদ খাবো । পালকের আড়ালে ঠোঁট গুজে ঘুমাবো 
দিনরাত শেখানো বুলি আওড়াবো । আর   
গৃহকর্ত্রীকে দেখলে - আল মাহমুদের কলেজ পড়ুয়া অবুঝ মেয়ের পোষমানানো   
'কবিতা'  নামের সেই ‘খাঁচার দাসী’ পাখিটির মত বলে উঠবো 
‘ভালোবাসি' 'ভালোবাসি’ !   


কোনোদিন যদি খোলা পাই খাঁচার দরোজা
তবু উড়ে যাবোনা কোথাও , যাবোনা  ফিরে সীমাহীন মুক্ত আকাশে
খাঁচার দাস হয়েই কাটিয়ে দেবো
বাকিটা জীবন !

[খাঁচার দাস !/ ২০-০৫-২০১৪]

দুশমন !

আমি ওর নাম দিয়েছি 'দুশমন' । শত্রুদের তালিকায় তাকে
কত নম্বরে রাখা যায়- এখনো ঠিক করিনি । তবে
সামনের সারিতেই রাখবো নিশ্চয় ! আমার
মূল্যবান কত সময় সে নষ্ট করেছে , আরও কতযে ভোগাবে এ জীবনে
কে জানে !

বয়সে ছোটই হবে । তবু
তুই তোকারি করার স্বভাব হয়েছে তার । বলে
'তোর কিছু একটা লেখা দরকার !' আমি বলি-
'কেন লিখবো ? কার জন্যে লিখবো ?' এর চেয়ে বরং
চেষ্টা করি- আরো কিছু টাকা উপার্জনের ! টাকাই তো সব
এই জগতে । ইট পাথরের এই শহরে , নাকি ?

দু'দিনের ছেলে তুই , পরগাছার মত আমার ভেতরে বসে
ঠিকমত তিনবেলা পেটপুরে খেতে পাস বলে -
বাস্তবতা বুঝিসনি আজো । বড় হলে বুঝবি !
তোর কথা শুনলে আমার চলবে !

সে কাঁদে । মায়ের আঁচল ধরে নেওটা ছেলের
অনুপেক্ষণীয় কান্নার মত । আমার মস্তিষ্কের শিরায় ধমনীতে
নিউরনে-সিনাপসে সারাক্ষণ গুঞ্জরিত হয়
তার অবিরাম কান্নার একঘেয়ে নাকি সুর ।

তারপর
সব ছেড়ে ছুড়ে কলমটা হাতে নিয়ে লিখেই ফেলি
অবান্তর কথামালা । কিংবা কীবোর্ডে চালাই আঙ্গুল ।
আমার ভেতরের অচেনা ছেলেটা তখন -
মায়ের কোলে চাঁদমামার গল্পশোনা শিশুর মত
ঘুমিয়ে পড়ে পরম নিশ্চিন্তে  ।

সাময়িক মুক্তি পেয়ে আমি
আবার নেমে পড়ি 'জীবন যুদ্ধে' ।

[দুশমন / ১৯-০৫-২০১৪]



বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০১৪

সেন্টমার্টিনে গলাচিপা !



সেন্টমার্টিন আসার সবকিছু ঠিকঠাক, এর মধ্যে বেঁকে বসলো মামুন । অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম , কিন্তু না । কোন এক অজানা – রহস্যজনক কারণে সে আসবেই না । অবশেষে ওকে ছাড়াই আসতে বাধ্য হলাম আমরা ।

এবারের ট্যুরটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন । ব্যাচমেটদের সাথে হতে পারে এটাই শেষ ট্যুর । সেন্টমার্টিন হয়তো আবার আসা হবে – কিন্তু ব্যাচের বন্ধুরা সবাই একসাথে , এইভাবে কি আর আসা হবে ? এইতো আর একটা বছর । সবাই পাশ করে কোথায় চলে যাবো ! কতদিন পর কার সাথে দেখা হবে , কারো সাথে আর এ জীবনে আদৌ দেখা হবে কিনা, কে জানে ! আমার কাছে এটা হলো – অন্স ইন আ লাইফটাইম ইভেন্ট । কিন্তু কোনভাবেই মামুনকে রাজী করানো গেলনা । সেন্টমার্টিনে এসেছি- অন্যরকম ভালো লাগছে । কিন্তু তারপরেও কোথাও যেন একটু অপূর্ণতা রয়ে গেলো ।

হাঁটছি সেন্টমার্টিনের বালুকাময় পশ্চিম তীর ধরে । সাথে আছেন – সিনিয়র ভাই , ডাক্তার , ‘আব্দুল্লাহ’ ভাই । ছোটখাটো চেহারার, হাস্যোজ্জ্বল , নিরীহ লোক । কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ডেঞ্জারাস । সবাই বলে- বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল, তাঁর ভেতরে কী চলছে ! 

চরম ভ্রমণপাগল মানুষ । হাতে যদি তাঁর কিছুটা সময় থাকে – তাহলে তিনি আপনার কোন ভ্রমণবিষয়ক অফার ফিরিয়ে দেবেন না । আমি গ্যারান্টি দিতে পারি । বিয়ের পর কী হবে কে জানে – উনার  অনেক বন্ধুই নাকি বিয়ে করে হয়ে গেছে ‘সম্পূর্ণ পরাধীন’ । সেজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন – বিয়ের আগেই যত পারেন ঘুরে বেড়াবেনবাংলাদেশের চৌষট্টিটি জেলায় পা রাখার ইচ্ছা তাঁর । ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক কাভার করেছেন । পাগল একটা ।

কয়েকদিন আগে একটা কাজে ঢাকায় গিয়েছিলাম । আব্দুল্লাহ ভাইকে বলেছিলাম- ভাই, সেন্টমার্টিন যাচ্ছি আমরা সামনের তিন তারিখ । চলেন না আমাদের সাথে ! ভদ্রতার খাতিরেই বলেছিলাম অনেকটা । কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে আব্দুল্লাহ ভাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে হাজির ! হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজ করে চলে এসেছেন । ফোন করে জানালেন – ‘আসিফ, চলে এলাম । টেকনাফের বাস কয়টায় ?’

রাতে বাসে উঠে সকালে টেকনাফ । কেয়ারী ক্রুজ এন্ড ডাইন শিপে করে সেন্টমার্টিন ।  পশ্চিম সৈকতে হোটেল আগে থেকেই ঠিক করা ছিল- এসে উঠেছি সেখানে । দুপুরবেলা সাগরে নেমে অনেকক্ষণ ঢেউয়ের সাথে খেললাম । এখানকার ঢেউগুলো কক্সবাজারের মত অত জোরালো না । বেশ মিষ্টি ঢেউ । তবে প্রবালের জ্বালায় ঠিকমত হাঁটা যায়না পানিতে । পা কেটে গেছে আমার । তীরের কাছাকাছি বেশ কিছু মাছ ধরার জেলে নৌকা নোঙ্গর করা আছে । নৌকায় উঠে দুললাম কিছুক্ষণ । তারপর খেয়েদেয়ে বের হয়েছি হাঁটতে । বাকিরা প্রায় সবাই রুমের ভেতরে – রেস্ট নিচ্ছে । আঁতেল পোলাপান ।

আগামীকাল ভোরে বিচ ফুটবল , সকালে নাস্তা সেরে ট্রলারে ছেঁড়া দ্বীপ । বিকেলে কেয়ারী সিন্দাবাদে ফিরবো ।
ভাবলাম – আজ বিকেলেই হেঁটে হেঁটে পুরো সেন্টমার্টিন দ্বীপ এক চক্কর দেবো । আব্দুল্লাহ ভাই এবং অসীম ভাইকে বলা মাত্রই উনারাও রাজি হলেন । আব্দুল্লাহ ভাইকে বলামাত্রই তিনি বললেন – ‘চলো যাওয়া যাক’ ! কে জানে- হয়তো তিনিও এমন সময় হন্টনোপযোগী সঙ্গী খুঁজছিলেন !
বিকেল বেলা সেন্টমার্টিনের পশ্চিম তীরে ঢেউয়ের শো শো শব্দ , হু হু বাতাস আর জনমানবহীন নিস্তব্ধ প্রকৃতি – সত্যিই অসাধারণ লাগছে ।

অসীম ভাই তাঁর হ্যাট মাথায় দুলকি চালে এগিয়ে চলেছেন । অসীম পিয়াস । গল্পকার । কথাশিল্পী । আমাদের সিনিয়র ভাই । উনিও আছেন আমাদের সাথে ।  অসাধারণ সব গল্প লেখেন তিনি । বেশিরভাগ গল্পই রহস্যে ভরা । ফরেনসিক মেডিসিনের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি রহস্য উদঘাটন করেন । রাইগর মর্টিস, এবরশন এইসব নিয়ে তাঁর গল্প । তাঁর পাঠকপ্রিয়তাও তুঙ্গে । তাঁর সাথে কোথাও বের হওয়াই দায় । কখন কোত্থেকে কে ছুটে আসে – ‘আপনি অসীম ভাই না ?’


বছর দুই আগে অসীম ভাই তাঁর রুমমেট আকবর ভাইকে পঁচিয়ে একটা গল্প লেখেন – ‘গাধা আকবর’ । গল্পটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় । সেইযে শুরু । তারপর থেকে লিখছেন তো লিখছেনই । উনি লেখেন , আর আমি পড়েই শেষ করতে পারিনা । একজন মানুষ এতকিছু কেমনে লেখে ?

‘গাধা আকবর’ লেখার পর থেকে তাঁকে বন্ধুরা আর সহজে কেউ ঘাটাতে চায় না । কখন আবার কার নামে গল্প লিখে মান সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দেয় ! ইজ্জত বলে একটা কথা আছেনা , শেষে ঐটা নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে । কী দরকার সাপের লেজে পা দেয়ার !

অসীম ভাইয়ের এক বন্ধু , কবি । উজবুক কবি নদ্দিউ ফরিশ । উল্টা করে পড়লে নামটা একটা সুন্দর নাম হয় । কিন্তু কবি হতে গেলে নাকি বিদঘুটে নামধারণ করতে হয় ! সেজন্যেই তাঁর নামের এই অবস্থা । নদ্দিউ ফরিশ ।  অবশ্য লেখার চেয়ে পড়েন বেশি । তাঁকেও সাথে নেবার ইচ্ছা ছিলো । কিন্তু অসীম ভাই আসছেন জেনে তিনি আর এপথে পা মাড়ালেন না । উজবুক কবিকে সাথে পেলে অবশ্য মন্দ হতো না ! কবি সাহিত্যিকদের আমার এইজন্যে ভালো লাগে- এঁরা জীবনকে অনেক গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে পারেন , উপলব্ধি করতে পারেন ।


অনেক দূর চলে এসেছি । একটার পর একটা বাঁক পেরিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছিই । মনে হয় এইতো সামনের বাঁকটাই শেষ । কিন্তু ঐ বাঁক পেরিয়ে দেখি সামনে আরো একটা বাঁক । সেন্টমার্টিন দ্বীপটা উত্তর দক্ষিণেই লম্বা । দক্ষিণের শেষ প্রান্তে আছে ছেঁড়া দ্বীপ । 

আব্দুল্লাহ ভাইকে পেলে আমি নানান প্রশ্ন করিশুনি জীবনের নানা দর্শনগত ব্যাখ্যা । অভিজ্ঞতা । আব্দুল্লাহ ভাই প্রায়ই বলেন – ‘আসিফ, ক্ষুদ্র এ জীবনে অভিজ্ঞতা তো কম হলনা রে !’ নানান ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে ব্যাখ্যা শুনি তাঁর কাছে । সবকিছুর ব্যাপারে নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে আব্দুল্লাহ ভাইয়ের । সিনিয়র হলেও যথেষ্ট খোলামেলা কথা বলা যায় তাঁর সাথে । জিজ্ঞেস করলাম- ভাই, এইযে আজকালকার তরুণীরা রাস্তাঘাটে বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করে – নজর না দিয়ে – চোখ অক্ষত রেখে পথচলা কী করে সম্ভব ? আব্দুল্লাহ ভাইয়ের ব্যাখ্যা হলো – দিস ইজ নাথিং বাট এ  ম্যাটার অব ডিসিশান । প্রথমে তোমাকে দেখতে হবে – তোমার অবস্থান কী ? তুমি জীবনে কী চাও, এই মুহূর্তে তোমার পক্ষে কতটুকু কী করা সম্ভব ? তুমি যদি জানো  যে – তোমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না । তাহলে তুমি কারো দিকে নজর দিয়ে কী করবে ? যেহেতু তোমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না , সুতরাং কেউ যত সুন্দরীই হোক তাতে তোমার কিছু যায় আসেনা । তুমি হয়তো মনে করতে পারো- কাউকে পছন্দ করে রাখবা । সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো- যে মেয়ে তাঁর রুপ-সৌন্দর্য ‘সবার জন্যে উন্মুক্ত’ বা ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ বানিয়ে রেখেছে , যাকে চাইলেই রাস্তার ফকির থেকে মেথর সবাই আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে পারে – তাঁকে তুমি পছন্দ করবে কীভাবে ? সুতরাং ঐ দিকটা বাদ গেলো । আর যারা পর্দা করে বের হয় – তাঁদের দিকে তো তুমি সারাদিন তাকিয়ে থেকেও লাভ নেই । সুতরাং বুঝতেই পারছো , ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেই ব্যস । দেখবা রাস্তাঘাটে যতই ক্লিওপেট্রা থাকুক তোমার চোখ কোথাও আটকাবে না !  আর চোখ পড়ে গেলে সরিয়ে নিবা , ব্যস !

আমাদের হোটেলটা একেবারে সৈকতের ওপরেই বলা যায় ।  আজ রাতে ওখানে বসে রাতের সেন্টমার্টিন দেখবো । ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসের শীতল আমেজ – অন্ধকারে বসে বসে নিজের জীবন নিয়ে আরো অনেক কিছু ভাববো আজ । আব্দুল্লাহ ভাই নিশ্চয়ই থাকবেন  । তখন আরো কথা বলা যাবে । মনে মনে প্রশ্নগুলো গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম । 
আমরা যোহরের নামাজের সাথেই আসরের নামাজ পড়ে নিয়েছি । মুসাফিরের জন্য এটার সুযোগ আল্লাহ্‌ দিয়েছেন ।  সুতরাং আমাদের আসরের নামাজের তাড়া নেই ।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর অসীম ভাই এবার কুইজ শুরু করলেন । বিদঘুটে নামের বিভিন্ন এলাকার নাম তিনি বলবেন , আমাদের বলতে হবে- কোন জেলায় অবস্থিত ।  ভেড়ামারা, শিয়ালদহ , আড়াইহাজার , ঠেঙ্গামারা, গলাচিপা, ছাগলনাইয়া ...


আব্দুল্লাহ ভাই ভালই উত্তর দিলেন । তারপর আরো অনেকক্ষণ আমরা চুপচাপ হাটলাম । পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা  চলে এসেছি দ্বীপের প্রায় দক্ষিণ অংশে । দ্বীপের এদিকটা ধীরে ধীরে সরু হয়ে ছুরির ফলার মত রূপ নিয়েছে ।  কথা বলতে বলতে এতক্ষণ খেয়ালই করিনি কতদূর চলে এসেছি । এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে আসছে প্রায় । হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেলো একটা সাইনবোর্ডে ।  ‘ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জনাব নজরুল ইসলাম , গাজীপুর । জমির পরিমাণ  ৩ কাঠা । গলাচিপা, সেন্টমার্টিন’ ।

‘আরে এইখানে দেখি গলাচিপা আছে । আগে তো জানতাম শুধু পটুয়াখালিতেই গলাচিপা আছে !’ উত্তেজিত কন্ঠে আমি প্রায় চিৎকার করেই বললাম

অসীম ভাই , আব্দুল্লাহ ভাই কারো কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ডানপাশে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম – কেউই নেই । কোথায় গেলেন তাঁরা ? উনারা কি পেছনে পড়ে গেছেন ? আমার হাঁটার গতি একটু বেশি । আর ওদিকে অসীম ভাই মোটাসোটা মানুষ – একটু ধীরেই হাঁটেন । আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করলেই চলে আসবেন তাঁরা ।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও তাঁদের দুজনের কারো চিহ্ন দেখতে না পেয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম । পেছনের দিকে কি একটু এগিয়ে যাবো নাকি জোরে জোরে চিৎকার করে ডাক দেবো ?

***
বেশিক্ষণ ভাবতে পারলো না আসিফ । আব্দুল্লাহ ভাইকে চিৎকার করে ডাক দিতে যাবে এমন সময় সে অনুভব করলো- সাঁড়াশি হাতে কে যেন তার গলা চেপে ধরেছে । 

বুধবার, ১৪ মে, ২০১৪

নারী নেতৃত্ব হারাম ?-১৬

আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী তাঁর ‘ফতোয়া’ বইয়ে নারী নেতৃত্ব সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তর দেন । সেখানে তিনি ‘নারী নেতৃত্ব’কে 'ডাইরেক্ট হারাম' বলে ফতোয়া দেননি । আগেই বলেছি- শীর্ষ আলেমগন এই ব্যাপারে সতর্কতার সাথে কথা বলছেন । তবে নারী নেতৃত্ব যে অপছন্দনীয় এবং একটি জাতির চূড়ান্ত কল্যানের ক্ষেত্রে 'সহায়ক নয়' সেটি তো অনস্বীকার্য । আল্লামা কারযাভীও সে বিষয়ে জোরালো ইঙ্গিত করেছেন ।
প্রশ্নঃ
সেই হাদীস কি সহীহ , যে হাদীসে রাসুল(সাঃ) বলেছেন – সেই জাতি কখনো কল্যান লাভ করতে পারেনা , যে জাতি একজন মহিলাকে নিজেদের নেতা নির্বাচন করে ।
যারা নারী নেতৃত্ব সমর্থন করেন তারা এই হাদীস মানেন না । তারা বলেন – এই হাদীস অন্য একটি হাদীসের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় – যে হাদিসে রাসুল(সাঃ) বলেছেন- ‘হে লোকসকল, তোমরা দ্বীনের অর্ধেক বিষয় ‘হামিয়া’ অর্থাৎ আয়েশার কাছ থেকে গ্রহণ করো ।
উত্তরঃ
মূর্খতা এক বড় বিপদ । যদি এর সামনে প্রবৃত্তির সামান্য আকাঙ্ক্ষাও যুক্ত হয় তবে করলার সাথে নিমযুক্ত হওয়ার মত ক্ষতিকর অবস্থা দেখা দেয় । আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন- ‘তার চাইতে বেশি গোমরাহ ব্যক্তি আর কে আছে যে আল্লাহ্‌ তায়ালার পক্ষ থেকে কোন হেদায়াত (পাওয়া) ছাড়াই কেবল নিজের খেয়াল খুশির অনুসরন করে । (সুরা আল কাছাছ- আয়াত ৫০)
যাদের মধ্যে মূর্খতা এবং প্রবৃত্তির দাসত্ব দুটোই একত্রিত হয় তাঁদের জন্য এটা অসম্ভব নয় যে , তারা সহীহ হাদীসকে যঈফ আর জঈফ হাদীসকে সহীহ বলে অভিহিত করবে ।
১।
মহানবী (সাঃ) এ কথা কীভাবে বলতে পারেন যে , আমরা অর্ধেক দ্বীন একজন মহিলা সাহাবীর কাছ থেকে গ্রহন করবো । অবশিষ্ট অর্ধেক দ্বীন অন্য সকল সাহাবীর কাছ থেকে গ্রহণ করবো , সাহাবীদের সংখ্যা যেখানে হাজার হাজার ।
সেই সকল সাহাবীর অনেকে মর্যাদার ক্ষেত্রে হযরত আয়েশার চেয়ে শ্রেষ্ঠ । তাছাড়া এটা কেমন যুক্তিবিরুদ্ধ কথা যে আমরা অর্ধেক দ্বীন হযরত আয়েশা(রাঃ) থেকে গ্রহণ করবো , অবশিষ্ট অর্ধেক দ্বীন অন্য সাহাবাদের কাছ থেকে গ্রহণ করবো ?
২। হযরত আয়েশা (রাঃ) সংক্রান্ত হাদীসে ‘হামিয়া’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে । এ শব্দের অর্থ হচ্ছে ছোট লাল মেয়ে । এই শব্দ ব্যবহারে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা এবং আদর সোহাগ ফুটে উঠেছে । মহানবী সাঃ কি এমন প্রসঙ্গে এই শব্দ ব্যবহার করতে পারেন , যেখানে লোকদেরকে দ্বীন শিক্ষার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন । বিবেক তো এরকম কথায় সায় দেয় না । বাস্তবতা হচ্ছে যে , ইসলামে বিশেষজ্ঞ আলেমরা হযরত আয়েশার(রাঃ) কাছ থেকে দ্বীনের অর্ধেক তো দূরে থাক এক চতুর্থাংশও গ্রহণ করেননি । কারণ, ইসলামের ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে যে , ইসলামী শিক্ষার প্রচার প্রসারে হাজার হাজার সাহাবা অংশগ্রহণ করেছেন । হযরত আয়েশা(রাঃ) সেই হাজার সাহাবার মধ্যে মাত্র একজন ।
ইতিহাসের বাস্তবতা হতে দূরে সরে এসে যদি বিবেকের কষ্টিপাথরে উক্ত হাদীস যাচাই করা হয় , তবে বিবেকের বিরুদ্ধে রায় দেয় । যদি দ্বীনের অর্ধেক হযরত আয়েশা(রাঃ) এর ওপর নির্ভর করে , তাহলে হযরত আবু বকর(রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ) , হযরত ওসমান (রাঃ) , হযরত আলী(রাঃ) , ইবনে মাসউদ (রাঃ) , হযরত মুআজ ইবনে জাবাল (রাঃ) এর মত বিশিষ্ট সাহাবীদের কাছ থেকে দ্বীন শিক্ষার কতটুকু অংশ অবশিষ্ট থাকে ? হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা তো হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যার চেয়ে অনেক কম ।
ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের এবং ব্যক্তি মর্যাদার যেসব হাদীস আমাদের কাছে এসেছে সেসব হাদীস গ্রহণে আমাদের যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার । কারণ, যারা জাল হাদীস তৈরি করেছে তারা ব্যক্তির মর্যাদার ক্ষেত্রেই সর্বাধিক হাদিস তৈরি করেছে । ব্যক্তি বিশেষের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা পোষণকারী ব্যক্তিরা ব্যক্তির মর্যাদা প্রমাণের জন্য বহু সংখ্যক জাল হাদীস তৈরি করেছে । হযরত আয়েশা(রা) এর মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র প্রমাণের জন্য সেসব কথাই যথেষ্ঠ , যা সুরা নূর-এ এবং অন্যান্য সহীহ হাদীসে বিদ্যমান রয়েছে । তাঁর মর্যাদা প্রমাণের জন্য জাল হাদীস তৈরি করার কোন প্রয়োজন নেই ।

সোমবার, ১২ মে, ২০১৪

আরেক সংগ্রাম

বাবা মা নাম রেখেছিলেন এরশাদ, কিন্তু মেডিকেল কলেজে এসে কীভাবে কীভাবে যেন তাঁর নাম হয়ে গেল ‘আরশাদ’ । এতে অবশ্য ভালই হয়েছে, নইলে ‘এরশাদ’ নামের যন্ত্রণায় তাঁকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হত । এরশাদ শব্দের অর্থ আজকাল যা দাঁড়িয়েছে – অনেকে অনেক কথা বলে হাসাহাসি করে । এক কথায় প্রকাশ করুন – ‘সকালে এক কথা , বিকালে আরেক কথা’ । উত্তরঃ এরশাদ । ‘সরকারের গৃহে পালিত হয় যে পশু’ । উত্তরঃ এরশাদ ! আরো কত কী ! সেদিক থেকে আরশাদের রক্ষে হয়েছে বৈকি ! বাবা-মা’রই বা দোষ কী ? যখন ওর জন্ম হলো- সেই ১৯৮৬ সালে , তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদের জয়জয়কার , বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিপতি ! বিপুল জনপ্রিয়তা ! কে জানতো, সেই এরশাদের এই অবস্থা হবে ? মীরজাফরের বাবা-মা কি জানতেন, তাঁদের ছেলের নাম যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হবে ?

আরশাদ এখন আর শুধু ‘আরশাদ’ নেই । হয়ে গেছে ডাঃ আরশাদ । কিন্তু তাঁর অবস্থা ছুটি গল্পের ফটিকের মত । রবীঠাকুর বলেছিলেন , তের-চৌদ্দ বছরের ছেলের মত এমন বালাই আর নাই । কিন্তু আরশাদের মনে হয়- কবিগুরু যদি এই ২৫-২৬ বছরের সদ্য পাশ করে বেরুনো কোন ডাক্তারের কথা জানতেন তাহলে তিনি লিখতেন, ২৫-২৬ বছর বয়সের নবীন ডাক্তারের মত এমন বালাই আর নাই । না পারে কিছু কইতে, না পারে সইতে ।

একজন ডাক্তারের জীবনে সবচেয়ে কঠিন যে সময়গুলো পার হতে হয়- আরশাদ এখন সেরকম একটি পিরিয়ড অতিক্রম করছে । কুয়োর ব্যাঙকে হঠাৎ গভীর সমুদ্রে ছেড়ে দিলে যে অবস্থা হবে , সেই অবস্থা । চোখের সামনে শুধু অন্ধকার । আশা আকংখার সাথে বাস্তবতার আর প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে হিমশিম । কোথায় অর্থ, কোথায় সম্মান – কোথায় কী ? এই বয়সে হঠাৎ করে ‘ডাক্তার’ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি থেকে আর টাকা চাওয়াও যায় না – লজ্জার ব্যাপার । মধ্যবিত্ত সংসারে সে বিলাসিতার সুযোগও নেই । এখন নিজের পেটের দায় নিজেকেই মেটাতে হবে । ছেলে ‘ডাক্তার’ হয়েছে, মা-বাবা ভাইবোনেরও কি একটু আশা আকাঙ্ক্ষা থাকেনা – টানাটানির সংসারে এবার সুদিন আসবে । সংসারের হাল ধরবে ‘ডাক্তার’ ছেলে ! হাল যদি নাও ধরে, অন্তত কিছুনা কিছু কন্ট্রিবিউট করবে । সে প্রত্যাশার দায় কিছুটা হলেও তো মেটানো দরকার । বাবা-মার বয়েসও হয়েছে । এমন সময় যদি কিছু খেদমত করা না যায়- তাহলে আর এত পড়াশোনা, এত ডিগ্রী দিয়ে হবেটা কি ?
এই বয়সে আরশাদের ভার্সিটি পড়ুয়া বন্ধুরা তো অনেকেই ‘জবে’ ঢুকে গেছে । মাসে মাসে বেতন পাচ্ছে । কেউ কেউ বিয়েও করেছে । হুম, বিয়ে- সেতো আরেক দীর্ঘশ্বাসের নাম । বিয়ে যে করবে, কাকে করবে ? কীভাবে করবে ? খাওয়াবে কী ? নিজের তো  এখনো চালও হলোনা, চুলোও হলোনা । ‘ডাক্তারে’র সাথে বিয়ে হবে, মেয়েটার মনে নিশ্চয়ই অনেক আশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা , অনেক প্রত্যাশা থাকবে । কিন্তু বাস্তবে কী পাবে ? ‘এক বুক ভালোবাসা’ ছাড়া আর কিছুই তো নেই তাঁর এখন ! হয়তো একসময় সবই হবে- অনেক কিছুই হবে, অর্থ, খ্যাতি, সম্মান । কিন্তু সেতো অনেক অনেক দেরি । এখন বাদাম চিবানোর জন্য ইচ্ছা আছে, দাঁত আছে কিন্তু  টাকা নাই । টাকা হবে যখন , তখন আর বাদাম চিবানোর জন্য দাঁতই থাকবে না । অতদিনের সংগ্রামে নবযৌবনা একটি মেয়ে কেন সঙ্গ দেবে ? কার অতটা সাহস আছে ?

ইন্টার্ণশিপ শেষ মানে মেডিকেল প্রফেশনে শুরু মাত্র । নট ইভেন দা ভেরি বেগিনিং অব দা এন্ড । ক্যারিয়ার লাগবে । এফিসিপিএস, এমডি , এমআরসিপি লাগবে । নইলে যে ডাক্তার সমাজেই তৃতীয় শ্রেণী হয়ে থাকতে হবে । বাইরের কথা আর নাইবা ভাবা গেলো ! সেও কি যা-তা কথা ? সারাদেশের সকল ডাক্তারদের সাথে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে অল্প কিছু সিটের একটি বাগিয়ে নাও । বেগার খেঁটে ট্রেনিং নাও পাঁচ বছর । পরীক্ষা দিয়ে, থিসিস দিয়ে পাস করতে আরো ১-২ বছর । তার মানে আরো ৭-৮ বছরের ধাক্কা ।
বিসিএস ? হা হা । আনমনে হেসে ওঠে আরশাদ । সে তো আরেক দিল্লীকা লাড্ডু । মধ্যবিত্তের সন্তান , বিসিএস ক্যাডার হলে খারাপ হয়না । অন্তত মাসে মাসে কিছু টাকার তো নিশ্চয়তা আছে ! বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে বিসিএস এর মর্যাদাও বেশ আছে বৈকি ! কিন্তু এর অপর পৃষ্ঠে যে আরেক বেদনার হাহাকার । কোন গ্রামে পোস্টিং হবে কে জানে ? হয়তো বসারই ব্যবস্থা নাই । থাকার ব্যবস্থা, পিওন আর্দালি ফ্যান এসি সেসব তো আকাশের চাঁদ । গ্রামে ফেলে রাখবে তিন বছর । আরো বেশিও হতে পারে । কবে ট্রেনিং পোস্ট পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই । পোস্ট গ্রাজুয়েশন দিনে দিনে আরো কঠিন হয়ে উঠবে । বয়স বাড়বে । পড়ালেখার ঝোক-অভ্যাস কমে যাবে ।

অন্যান্য ক্যাডারে বয়স বাড়ে, অভিজ্ঞতা বারে , প্রমোশন হয় । হেলথ ক্যাডারে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ছাড়া প্রমোশন নাই । চাকরির বয়স যত বছরই হোক , থাকতে হবে একই পদে- উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে ।

পতেঙ্গা  সমূদ্র সৈকতে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে আরশাদ । কী করবে, কী করবেনা – সিদ্ধান্তহীনতার এক অকূল পাথারে ভাসছে সে । শুধু ভবিষ্যৎ চিন্তাই নয়, ক্যাম্পাস জীবনের অনেক স্মৃতিও তাঁকে তাড়া করে ফিরছে আজ । কত স্মৃতি ! বন্ধুরা আজ সবাই বিচ্ছিন্ন । যে যার পথে নেমে গেছে । ক্যারিয়ারের প্রয়োজনে , জীবনের প্রয়োজনে । কারো কারো সাথে হয়তো এই জীবনে আর দেখাই হবে না । নীরবে নিভৃতে অনেকেই চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে । হয়তো কারো কারো খবর পাওয়া যাবে , কারো কারো সেটাও পাওয়া যাবেনা ।

ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের যেকোন আন্দোলন-সংগ্রামে আরশাদ ছিল সদা তৎপর । তারুণ্যে টগবগ তাজা রক্ত  । আন্দোলন সংগ্রাম অধিকার আদায় এইসবের ভেতর যেমন আছে বিবেকের দায়শোধের তাড়না , তেমনি আছে এডভেঞ্চারও । যারা এগুলোর ভেতরে ছিলনা, তারা কখনো সেটা বুঝবেনা ।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময় ।

কিংবা

মানবজন্মের নামে কলংক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই, 
উত্তরপুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো  
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই ।

এইগুলো টগবগে বিদ্রোহী তরুণদের প্রিয় কবিতা । আরশাদেরও তাই ছিল । কখনো কখনো ভরাট কন্ঠে বক্তৃতা দিতে হত আরশাদকে । ছাত্রছাত্রীদের সামনে । শ্লোগান উঠতো । হাততালি পড়তো । এডভেঞ্চারের শিহরণ বয়ে যেত শরীরে !

আকাশে মেঘ করেছে । গ্রীষ্মের শেষাশেষি । এই সময়ে আকাশ যখন তখন কালো মেঘে ঢেকে যায় । বৃষ্টি নামে । আজও পশ্চিম দিকে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে । মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম শব্দও হচ্ছে । সেদিকে অবশ্য আরশাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ।
পেছন থেকে হঠাৎ একটা হাতের স্পর্শে অনেকটা চমকে ওঠে আরশাদ । একটা রিনরিনে কন্ঠ- পরিচিত লাগে, ‘কিরে আরশাদ, কেমন আছিস ?’
হতচকিত আরশাদ মুখ ফিরিয়ে তাকায় । একটা মেয়ে- পরিচিত , হ্যা খুব পরিচিত আরশাদের । ক্লাসমেট । অবশ্য শুধু ক্লাসমেট বললে ভুলই হবে হয়তো । একদিন... থাক সেসব কথা । কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে ?

‘এখানে কী করছিস ? এখুনি বৃষ্টি নামবে, চল আমাদের গাড়িতে’ । আবার কন্ঠটা রিনরিন করে ওঠে ।
আরশাদ বিব্রত ভাবে উঠে দাঁড়ায় । ‘না মানে এমনি বসে আছি । কী খবর তোর ? কোত্থেকে হঠাৎ ?’
‘নে হ্যান্ডশেক কর । তোর দুলাভাই’ । সাথের ছেলেটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নীলা ।
আরশাদ হ্যান্ডশেক করে । ধন্যবাদ দিয়ে বলে , ‘না, তোরা যা । আমি আরো কিছুক্ষণ বসবো’ ।
আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথা হয় । ‘এই কি করছিস এখন, কোথায় আছিস’ টাইপের । বৃষ্টির ফোঁটা পরতে শুরু করেছে । নীলা তাঁর স্বামীসহ গাড়িতে ওঠে । গাড়িটা চলতে শুরু করে । ‘ভালই আছে মেয়েটা’ । ভাবে এরশাদ ।
সুজাতাই আজ শুধু সব চেয়ে সুখে আছে , শুনেছি তো লাখপতি স্বামী তাঁর । হীরে আর জহরতে আগাগোড়া মোড়া সে, বাড়ি গাড়ি সবকিছু দামী তাঁর ।
মান্নাদে-র গান আপনা আপনি বেজে ওঠে আরশাদের বুকের গভীরে কোথাও ।

সেই নীলা । হাহ । আরশাদের একটু চোখের ইশারা পাবার জন্য কতইনা ব্যাকুল ছিল । কিন্তু আরশাদ একজন মুসলিম হিসেবে কখনো তাঁর অন্যায় চাওয়াকে প্রশ্রয় দেয়নি । আরশাদের এই দৃঢ়তা নীলাকে আরো বেশি আকর্ষিত করেছিল কিনা তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না । কিন্তু আরশাদের পুরুষালী ভরাট কন্ঠ যে নীলাকে খুব ভালোভাবেই টেনেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনি নীলা নিজেই । আরশাদ যেন আজ এত বছর পরেও স্পষ্ট শুনতে পায়- ‘আরশাদ , জানিস- আমি তোর কন্ঠের প্রেমে পড়ে গেছিরে’ ।
আরশাদের উপায় ছিলনা । বিয়ে করতে পারতো ? না, সে সুযোগ ছিলনা তাঁর ।

বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে । মোবাইলটা আজ আরশাদ সাথে করে আনেনি । ভালোই হয়েছে । আরশাদ বাঁধের ওপর বসলো আবার । ভাবনায় ফিরে গেলো সে । এই এতকিছুর মাঝেও সবই করতে হবে । ক্যারিয়ার, অর্থোপার্জন , সংসারের দায়িত্বগ্রহন, বিয়ের প্রস্তুতি- সব । বন্ধুরা তো অনেকেই বিয়েথা করে ফেলেছে । নীলা তো চোখের সামনেই চলে গেলো , দেখিয়ে গেলো । আর তাছাড়া বিয়ের ব্যাপারে আরশাদের চিন্তা হলো- দিল্লীকা লাড্ডু হোক আর করাচীকা লাড্ডু হোক, যদি পস্তাতেই হয় তবে খেয়ে পস্তানোই ভালো !

নাহ । এতসব চিন্তা করে লাভ নেই । যেসব ভয়ংকর দিন আরশাদ পার করে এসেছে তার তুলনায় সামনের এই অনিশ্চয়তা কিছুই নয় ।

জনশূন্য সমূদ্র সৈকতে ঝড়ো বাতাসের মাঝে, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে, নীলার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আরশাদ চিৎকার করে আবৃত্তি করতে লাগলো –

এখন যৌবন যার , মিছিলে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার , যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময় ।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে আরশাদের বৃষ্টিভেজা মুখ একবার ঝলক দিয়ে উঠলো । কেউ দেখলে হয়তো মনে করবে – সে চিৎকার করে কাঁদছে । কিন্তু না – আরশাদ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।
এ জীবন যুদ্ধে তাঁকে যে জিততেই হবে ।

{আরেক সংগ্রাম / ১২-০৫-২০১৪}
[ পিঠবাঁচানোঃ সব চরিত্র কাল্পনিক । ইহার কোন অংশ কারো সহিত মিলিয়া গেলে তা  কাক ও তালগাছের দোষ । লেখককে অহেতুক দায়ী করিয়া প্রতারিত হইবেন না !] 

শুক্রবার, ৯ মে, ২০১৪

ডাক্তারদের প্রতি আদালতের রুল

ইন্টার্ন ডাক্তারদের প্রতি আদালতের রুলঃ মাস্তানি করতে হলে রাস্তায় যান । (হলুদ পত্রিকার খবর অনুসারে)

এই রুল সমস্যার কানাকড়িও সমাধান তো করবেই না, বরং ডাক্তারদের আরো বেশি ক্ষুব্ধ করবে ।( রাস্তায় গিয়ে মাস্তানি করা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ কিনা সে প্রশ্ন নাইবা তুললাম । ) ডাক্তারের ওপর হামলা তো অনেক জায়গাতে , অনেক বারই হয়েছে । ডিউটিরত অবস্থায় ডাক্তার খুনও হয়েছে । কোথাও কি একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে ? একজনকেও কি শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে ? কোন আদালত কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের কাছে কোনোদিন জানতে চেয়েছেন- কেন বারবার এমন ঘটনা ঘটছে ? কেন হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবেনা ? হাসপাতালের নিরাপত্তাব্যবস্থা কেন বাড়ানো হবেনা ? যদি আগেই একটু সতর্ক হতেন, 'আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না' বলার জন্য সিনেমার শেষে না আসতেন, তাহলে ইন্টার্নি ডাক্তারদের দিনে ১৬ ঘন্টা ডিউটির পর মাঝে মাঝে এক্সট্রা দুই ঘন্টা মারপিট করতে হতো না ।
( বলা বাহুল্য, সাংবাদিকরা সবসময় হামলাকারীদের পক্ষ নিয়েছে , উস্কে দিয়েছে ।)

এই রুলের আগে কিংবা এর সাথেও যদি সেই কথাটা একবার জানতে চাইতেন , হামলাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশনা দিতেন তাহলেও হতো । কিন্তু না, তা হয়নি । এক্ষেত্রে মাঠ চলে গিয়েছিল বলের বাইরে ! ছিল মেঘমুক্ত মাঠ, কর্দমাক্ত আকাশ !

পাদটীকাঃ ডাক্তারদের 'রুল'টা আদালতের রুলের চেয়েও খুবই সাধারণ- 'মাস্তানি করতে হলে রাস্তায় যান , হাসপাতালে নয় । রোগী হলে চিকিৎসা নিন, মাস্তান হলে আপনাকে রোগী ও পত্রিকার হেডলাইন বানানোর দায়িত্ব নবীন ডাক্তারদের হাতে ছেড়ে দিন' !

বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০১৪

ফিরে আসুন মাহমুদুর রহমান

ছোটবেলায় কারো সাথে মারামারি করে ফিরলে হারি বা জিতি দোষ আমার থাকুক বা না থাকুক আম্মা আরেকবার মাইর দিয়ে গোসল করাতে নিয়ে যেতেন । 'কেন মারামারি করতে গেলাম'- সেটাই দোষ । সেইরকমই অনেকটা- মাহমুদুর রহমানের ওপরই রাগ হচ্ছে । তাঁকেই দোষ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে । অক্ষমের ইচ্ছা ।

কার জন্যে আপনি এইরকম তিলে তিলে মরবেন ? এই জনগনের জন্যে ? আমাদের জন্যে ? আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি । আমরা কোনোদিন কাউকে প্রাপ্য সম্মান দিতে জানি নাই । আমাদের সকল আদর্শ 'মাদ্রাসায় অনুদান দিলে'ই গলে যায় । আপনার মুক্তির কথা আমাদের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়না । আমাদের ওপর যে স্বৈরশাসক চেপে বসেছে- সেটা আমাদেরই কর্মফল , আমাদের যথার্থ প্রাপ্য ।

সাহসের বাতিঘর মাহমুদুর রহমান , আপনি বের হয়ে আসুন । এই অকর্মণ্য অকৃতজ্ঞ জাতির দিকে তাকিয়ে নিজেকে ধ্বংস করবেন না । আমরা এতটা পাবার যোগ্য নই ।
অনুভূতি দোষী

মতিলালের চিকিৎসা আন্দোলন !

দৈনিক মতিকন্ঠের সম্পাদক মতিলাল চক্রবর্তীর জ্বর হয়েছে । কিন্তু এইবার উনি ডাক্তারের কাছে যাবেন না । তিনি একটা পণ করেছেন । এইবার তিনি ডাক্তারদের শায়েস্তা করার জন্য নতুন ধরণের আন্দোলনে নামবেন । তিনি জনগনকে বোঝাবেন – আমরা ডাক্তারদের কাছে যাই বলেই ওরা ‘রোগী’ পায় । আমরা নিজেরাই গিয়ে টাকা দিয়ে আসি , আর এতে করে ডাক্তারদের ভাব বেড়ে গেছে !
সুতরাং ডাক্তারের কাছে যাওয়া বন্ধ করতে হবে । ওঝা, কবিরাজ, হোমিওপ্যাথিতে জনগনের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে । জনগন যদি অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে না যায় – তাহলেই ডাক্তাররা না খেয়ে মরবে !

যেই ভাবা সেই কাজ । ছেলেমেয়েদের নিষেধ না শুনে মতিলাল চক্রবর্তী তাঁর পণে স্থির থাকলেন । তিনি তাঁর জ্বর সারাবার জন্যে একজন ভালো ওঝা ডাকতে বললেন ।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হলো । ‘ওঝা আবশ্যক’ । জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের জ্বর সারাইবার নিমিত্তে একজন দক্ষ ওঝা আবশ্যক । বিজ্ঞাপন দেখে ওঝারাতো মহাখুশি । এইবার মনে হয় আমাদের কপাল ফিরছে ! শ’য়ে শ’য়ে ওঝা এলো মতিলাল বাবুর চিকিৎসা করতে । মতিলালও মহা খুশি । এত ওঝা এসেছে তাঁর জন্য ! এইবার ডাক্তারদের উচিৎ শিক্ষা দেয়া হবে । ব্যাটারা টের পাবে কত ধানে কত চাল আর কত গমে কত আটা ! সাংবাদিকের সাথে তেড়িবেড়ি !


অনেক ওঝার ভেতর থেকে একজনকে সিলেক্ট করা হলো । কালু ওঝা । কুচকুচে কালো চেহারা । লম্বা চুল কাঁধ পেরিয়ে পিঠে নেমেছে । জটাধারী ফকির- মানে চুলে জট পাকানো । দাড়ি গোঁফের বিশাল বহর । ঠোঁট তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা – মানে দেখাই যায় না ! পরণে ময়লা ফতুয়া-ধূতি । এইতো চাই । এমন ওঝাই মনে মনে খুঁজছিলেন মতিলাল বাবু । যাক, এইবার জ্বর পালাবেই । এই সফলতার সংবাদ তিনি পত্রিকায় লাল কালিতে আট কলাম হেডিং করবেন । লিড নিউজ । দেশের মানুষ বুঝবে , ডাক্তারের কাছে যাবার কোন দরকার নেই !


ডাক্তারদের দুরবস্থার কথা কল্পনা করে এই জ্বরতপ্ত শরীরেও  মতিলাল বাবু  সাংবাদিকসুলভ  পৈশাচিক আনন্দ  পাচ্ছেন । কল্পনায় তিনি দেখছেন- ঢাকার ফুটপাতে দেশের বাঘাবাঘা ডাক্তাররা সারিবেঁধে ভিক্ষা করছেন । আমার আল্লা নবিজীর নাম , এই শাওয়াল মাসের চান, দুইটা টাকা করেন দান, আমার আল্লা নবিজীর নাম ।
ইন্টার্নি না ফিন্টার্নি , যারা আজকাল হলুদ সাংবাদিক দেখলেই পিটায় তারা ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ, ডাঃ কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, ডাঃ প্রাণ গোপালদের পেছনে পেছনে ভিক্ষার জন্য নিজের হাত-পা কেটে পঙ্গু অবস্থায় গড়াগড়ি খাচ্ছে । স্লামডগ মিলিওনিয়ার ইন বাংলাদেশ !


এইসব ভাবতে ভাবতে মতিলাল বাবু আবিস্কার করলেন তাঁকে একটা কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে । দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । রুমে তিনি আর ওঝা ছাড়া কেউ নেই ।
ওঝাকে জিজ্ঞেস করলেন – ‘ওঝা বাবু, জ্বর পালাবে তো ?’
ওঝা চোখ পাকিয়ে তাকালেন । ঝোলা থেকে বের করলেন একটা চাবুক । গম্ভীর কন্ঠে গোঁফের জঙ্গলের ভেতর মুখ নাড়িয়ে বললেন- ‘পালাবে না মানে ? এমন পিটুনি দেবো, ব্যাটা জ্বরের চৌদ্দগুষ্ঠি পালাবে !’
ওঝার মুখের নাড়াচাড়া বাইরে থেকে দেখা না যাওয়ায় ওঝার কথাটাকে অনেকটা গায়েবী আওয়াজের মত লাগলো ।

এরপরের দশ-পনেরো মিনিট রুমের বাইরে থেকে ‘ও বাবাগো, মাগো, বাঁচাও, বাঁচাও’ শব্দ শোনা গেলো । শব্দ থেমে গেলে ওঝা ঘর্মাক্ত শরীরে বীরের বেশে বের হয়ে আসলেন । তিনি পিটিয়ে জ্বরকে তাড়িয়েছেন !

দৌড়ে রুমে ঢুকলেন মতিলাল বাবুর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে । দেখলেন , মতিলাল বাবু নির্জীব হয়ে পড়ে আছেন । তাঁর সারা শরীরে চাবুকের দাগ । কয়েক জায়গায় ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে !
‘বাবা বাবা, কথা বলো’ ! আর্তনাদ করে উঠলো ছেলে মেয়েরা । মতিলাল বাবু ধীরে ধীরে চোখ খুললেন । অনেক কষ্টে কোনমতে মুখ খুলে বললেন – বাবারে, মা ,  ডাক্তারকে খবর দে । আমারে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়া চল !

[ মতিলালের চিকিৎসা আন্দোলন ! / ০৮-০৫-২০১৪ ]

বুধবার, ৭ মে, ২০১৪

বাংলাদেশি ডাক্তারের ওপর অসন্তুষ্ট আংকেলের দুঃখ !

গতকালের ঘটনা । এক আংকেল এসেছেন পেশেন্টের খবর নিতে । প্রথমে তিনি বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলার মাধ্যমে আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বোঝালেন যে উনি একজন 'শিক্ষিত' মানুষ । এরপর বিদেশের ডাক্তারদের সম্পর্কে বেশ গুনগান গেয়ে বোঝালেন যে তিনি দেশ বিদেশ ঘোরা লোক ।
অতঃপর তিনি বলিলেন - 'এই দেশের ডাক্তারদের প্রতি আমি সন্তুষ্ট না' । তারপর শুরু করিলেন যথাবিহীত ক্যাচাল ।
একজন মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে আমি সকল কথা মনোযোগ দিয়া শুনিলাম । অবশেষে ধৈর্যশীল শ্রোতা পাইয়া আংকেল তাঁহার বয়ান তৃপ্তির সহিত সমাপ্ত করিলে এক মোক্ষম সময়ে আংকেলের সহিত আসা 'আন্টি' মুখ খুলিলেন । বলিলেন, বাবা- আমার ছেলেটারে ডাক্তার বানাইতে চাইছিলাম । বড় আশা ছিল মনে । কিন্তু হইলো না । এখন ফার্মেসিতে দিছি । ফার্মেসিও খুব কঠিন সাবজেক্ট ।

আমি আর কী বলিব ! আংকেলের অসন্তুষ্টির সমূহ কারণ তো সরলমনা আন্টি ফাঁস করিয়া দিলেন । মনে মনে কহিলাম - আহা ! আংকেলের মনে যে বড়ই দুঃখ , কী করিয়া তিনি এইদেশের ডাক্তারদিগের প্রতি সন্তুষ্ট হইবেন ?
— অনুভূতি বিশেষ

মঙ্গলবার, ৬ মে, ২০১৪

হতভাগীর প্রশ্ন !

মে দিবস উপলক্ষে ফাইভ স্টার হোটেল রেডিসনে   
বিজিএমইএ আয়োজিত একটা সেমিনারে সেদিন   
‘শ্রমিকের অধিকার’ বিষয়ক প্রবন্ধের গুরুগম্ভীর তত্ত্ব শুনতে শুনতে
খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিলাম । কিংবা
বোধকরি তন্দ্রাই পেয়ে বসেছিল ! ঘুমের ভেতর এলো সে
মেয়েটি । কতইবা হবে বয়স , আঠারো কি উনিশ !
শ্যামবর্ণ মুখ । কাজল টানা চোখ । কোলে তার একবছরের ছেলে শিশু
চুষে যাচ্ছে দু’টাকার লাল আইসক্রিম । মুচকি হেসে মেয়েটি বললে –
‘ইকবাল সাহেব , চিনেছেন আমায় ?’ নাক কুঁচকে শুধালাম
–‘উঁহু ! কে তুমি ?’ বললে
-‘সেকি ! আমায় চিনলেন না ? অথচ
সিঙ্গাপুর থেকে কেনা আপনার গলার ঐ লাল টাইয়ে
মিশে আছে আমারই রক্ত ! এখনো চিনলেন না ?’


-‘আমি রহিমা । রানা প্লাজার ইটের স্তুপে থেতলে যাওয়া রহিমা খাতুন ।
এই ক’দিনেই বেমালুম ভুলে গেলেন ? যাকগে, দয়া করে একটু বলবেন কি –
কেমন আছে ছেলেটা আমার ?’


বন্ধ চোখের সামনেই রহিমা দাঁত কেলিয়ে হাসে । অথবা কাঁদে ।
আমার অস্বস্তি হয় । ‘ডিস্টার্বড ফিল করি !’  যত্তসব ।
‘ছোটলোকগুলো মরেও শান্তি নেই । হতচ্ছাড়া হতভাগীটা  এখন কিনা, এই গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে এসে 
আমার গুরুত্বপূর্ন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে !’



[হতভাগীর প্রশ্ন / ০৬-০৫-২০১৪]

ডাক্তাররা কি লাটসাহেব হইয়া গিয়াছে ?

ডাক্তারদের জন্য আলাদা লিফট ? এই গরীব দেশে এতবড় বিলাসিতা ? উহারা কি লাটসাহেব হইয়া গিয়াছে ? উহাদের সিঁড়ি বাহিয়া উঠিতে হইবে । শুনিয়াছি- হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ডাক্তারদের জন্যে আলাদা 'ডক্টরস রুম' আছে । ইহা কী ধরনের বিলাসিতা ? ঐসব ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হইবে । ডাক্তাররা রোগীদের বিছানাতে অথবা বিছানার নিচে মেঝেতে বসিবে। আর বসিবেই বা কেন ? বসিলে জনগনের সেবা হইবে কীরুপে ? শুনিয়াছি- রাত্রিকালীন ডিউটিরত ডাক্তারদিগের জন্যে দু-একখানা বিছানাও রহিয়াছে । সেইগুলোতে নাকি ডাক্তাররা পালা করিয়া বিশ্রাম নেয় । সেইগুলা সবার জন্যে উন্মুক্ত করিয়া দিতে হইবে । অনেকেই দূর দূরান্ত হইতে রোগী দর্শন করিতে আসে , তাহাদের বিশ্রামের জন্যে ডাক্তারের রুম ছাড়িয়া দিতে হইবে । প্রয়োজন হইলে ডাক্তাররা হাসপাতালের করিডোরে মাদুর পাতিয়া বসিয়া বিশ্রাম নিবে ( উহাদের বিশ্রামেরই বা কী দরকার ? ) ।

সোমবার, ৫ মে, ২০১৪

ফ্লাশআউট মতিঝিল

নেত্রী মহান নেত্রী মহান না বলে ওরা এসেছিল
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার বলতে বলতে । ধর্মনিরপেক্ষ দেশে
মৌলবাদী শ্লোগান দেয়- এত বড় সাহস ! আবার কিনা
দফায় দফায় দাবিও করে !


মনে মনে ক্ষুব্ধ ছিলাম । নেত্রীও তাই ।
গদিতে আরাম করে বসতেও সমস্যা হচ্ছিল কিছুটা তাঁর । নির্দেশ পেয়ে
মেরেছিলাম টিয়ারশেল- হ্যান্ডগ্রেনেড বায়তুল মোকাররমে । পল্টনে । মতিঝিলে ।
ভেজা বেড়ালের মত
চুপচাপ সটকে না গিয়ে ওরা কিনা ভেঙ্গেছিল গাছের ডাল । কী নির্মম ! কী নিষ্ঠুর !
গাছের আছে প্রাণ – বলে গেছেন জগদীশ বসু সেই কবে ! এরা কি জানেনা এটাও ?
যত্তসব ব্যাকডেটেড মওলানার দল !


এই নিষ্ঠুরতায় নেত্রী কেঁদেই ফেললেন । আমারও বুকটা হাহাকার করে উঠলো । পত্রিকা সম্পাদক
মতিমিয়ার চোখের জলে বান ডাকলো কাওরান বাজারে ।উঠলো শোকের মাতম চ্যানেলে চ্যানেলে । অতঃপর
নেত্রীর নির্দেশে মুহুর্মুহু ব্রাশফায়ারে; রাতের অন্ধকারে     
করে দিলাম ফ্লাশআউট । ফ্লাশআউট মানে জানো ? গুলি করে আবর্জনা সাফ করে ফেলা ।
এইগুলো হলো সেইসব হাড় – ঢাকার ডাস্টবিনে , ময়লার ভাগাড়ে ভাগাড়ে ।
এই ছিল ওদের উচিৎ শাস্তি । বুঝেছ বাপু ?

-'আচ্ছা বাবা, মওলানা হুজুররাও কি মানুষ ? ওদের কি প্রাণ আছে ?'
-'নাহ । মনে হয় নেই । জগদীশবাবু কি বলেছেন কোথাও ?'


রবিবার, ৪ মে, ২০১৪

খুনির কৈফিয়ত !

করুণ চোখে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই
হে পিতা । এখন আমিও ‘খুন’ করে ফেলতে পারি তোমাকেই
অবলীলায় ।


খুনি হয়ে গেছে তোমার সন্তান । কারণ
জন্মাবার পর হতে যতই নিয়েছি শ্বাস ; নাসারন্ধ্র হয়ে
হুসহুস করে ঢুকে গেছে ফুসফুসে
তোমাদের ছড়িয়ে রাখা ঘৃণার বিষবাষ্প । ভকভক করে
ঢুকে গেছে গ্যালন গ্যালন জিঘাংসা । আমার হৃৎপিন্ডের বাম প্রকোষ্ঠের ভেতর
মিশে গেছে রক্তের প্রতিটি লোহিত কণিকায় ।


এই দেশে আজ তোমাদের বুদ্ধিজীবিরা যে নিশ্বাস ছাড়েন
মন্ত্রী এমপি আমলাদের এয়ারকুলার হতে বের হয় যে বাতাস
মেপে দেখো তাতে, ঘৃণা ও জিঘাংসার শতকরা পরিমান
অনেক অনেক বেশি কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ।


আমার জন্মভূমিতে আজ
শিক্ষকের লেকচার মানে পিশাচ হবার শিক্ষা
সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় মানে রক্তপিপাসুর নিঃশব্দ আহ্বান -
নেতার বক্তৃতা মানে ক্ষুধার্ত অসুরের পৈশাচিক চিৎকার
রাষ্ট্র কাউকে ‘বীর’ খেতাব দিলে বুঝে নিতে হয়- নিশ্চিত সে একজন
নৃশংস সিরিয়াল কিলার ।


আবাদী জমিতে তোমরা করো জিঘাংসার চাষাবাদ । ধানের বদলে
বাম্পার ফলন হয় নতুন নতুন জাতের হাইব্রিড ‘বর্বরতা’র
বাতাসে এখানে তাই জিঘাংসা অনেক বেশি-
জলীয় বাষ্পের তুলনায় ।


করুণ চোখে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই
হে পিতা । খুনি হয়ে গেছে তোমার সন্তান । এখন
অবলীলায় আমি করতে পারি খুন তোমাকেই ।


শুক্রবার, ২ মে, ২০১৪

লাশে ভাতে বাঙালি !

নদীতে জাল ফেলে জেলেপাড়ার কুবের মাঝি
এখন মাছের সাথে প্রায়শই তুলে আনে পঁচা-গলা লাশ
পদ্মা মেঘনা যমুনায় শীতলক্ষায় । কখনো কখনো মাছের তুলনায়
লাশের সংখ্যাটাই বেশি হয় বটে !

এ বড় বিড়ম্বনা কুবেরের -
লাশ কি বিকোনো যায় মাছের বাজারে ?

সরকারের ‘হেফাজতে’ই আজকাল অনেকেই গুম হয়ে যায়
কেউ কেউ তবু ধরা দেয় কুবেরের মাছ ধরা জালে
সম্পাদক মহাশয়গনের অশেষ কৃপায়(!)
কেউ কেউ সৌভাগ্যবশত (!) হয়ে থাকে ‘সংবাদ’ , পত্রিকার পাতায়
স্বজনেরা কেউ কেউ তবু পায় ‘লাশ’ নামক নির্মম সান্ত্বনা
কেউ কেউ পায়না সেটাও । যারা বিয়োগ হয় –
পুর্বের ‘সংখ্যা’র সাথে তাঁদের ‘সংখ্যাটা’ই শুধু
‘যোগ’ হয়ে যায় ।


একদা আমাদের পুর্বপুরুষেরা হয়তো ছিলেন
‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ । সে কতকাল আগের কথা কে জানে !
আমরা এখন পুরোদস্তুর- ‘লাশে ভাতে বাঙালি’ !

২।
তাই বলে আমাদের বেরসিক ভাববেন না । এই পৃথিবীতে
মানুষের লাশ খেতে খেতে নিজেকে ‘মানুষ’ দাবি করার ‘রসিকতা’টুকু
আমাদের চেয়ে আর কেই-বা অত ভালো জানে ?