সেন্টমার্টিন আসার সবকিছু ঠিকঠাক, এর মধ্যে
বেঁকে বসলো মামুন । অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম , কিন্তু না । কোন এক অজানা –
রহস্যজনক কারণে সে আসবেই না । অবশেষে ওকে ছাড়াই আসতে বাধ্য হলাম আমরা ।
এবারের ট্যুরটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন ।
ব্যাচমেটদের সাথে হতে পারে এটাই শেষ ট্যুর । সেন্টমার্টিন হয়তো আবার আসা হবে –
কিন্তু ব্যাচের বন্ধুরা সবাই একসাথে , এইভাবে কি আর আসা হবে ? এইতো আর একটা বছর ।
সবাই পাশ করে কোথায় চলে যাবো ! কতদিন পর কার সাথে দেখা হবে , কারো সাথে আর এ জীবনে
আদৌ দেখা হবে কিনা, কে জানে ! আমার কাছে এটা হলো – অন্স ইন আ লাইফটাইম ইভেন্ট ।
কিন্তু কোনভাবেই মামুনকে রাজী করানো গেলনা । সেন্টমার্টিনে এসেছি- অন্যরকম ভালো
লাগছে । কিন্তু তারপরেও কোথাও যেন একটু অপূর্ণতা রয়ে গেলো ।
হাঁটছি সেন্টমার্টিনের বালুকাময় পশ্চিম তীর
ধরে । সাথে আছেন – সিনিয়র ভাই , ডাক্তার , ‘আব্দুল্লাহ’ ভাই । ছোটখাটো চেহারার,
হাস্যোজ্জ্বল , নিরীহ লোক । কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ডেঞ্জারাস । সবাই বলে-
বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল, তাঁর ভেতরে কী চলছে !
চরম ভ্রমণপাগল মানুষ । হাতে যদি তাঁর কিছুটা
সময় থাকে – তাহলে তিনি আপনার কোন ভ্রমণবিষয়ক অফার ফিরিয়ে দেবেন না । আমি
গ্যারান্টি দিতে পারি । বিয়ের পর কী হবে কে জানে – উনার অনেক বন্ধুই নাকি বিয়ে করে হয়ে গেছে ‘সম্পূর্ণ
পরাধীন’ । সেজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন – বিয়ের আগেই যত পারেন ঘুরে বেড়াবেন । বাংলাদেশের চৌষট্টিটি
জেলায় পা রাখার ইচ্ছা তাঁর । ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক
কাভার করেছেন । পাগল একটা ।
কয়েকদিন আগে একটা কাজে ঢাকায় গিয়েছিলাম ।
আব্দুল্লাহ ভাইকে বলেছিলাম- ভাই, সেন্টমার্টিন যাচ্ছি আমরা সামনের তিন তারিখ ।
চলেন না আমাদের সাথে ! ভদ্রতার খাতিরেই বলেছিলাম অনেকটা । কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে
আব্দুল্লাহ ভাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে হাজির ! হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজ করে চলে
এসেছেন । ফোন করে জানালেন – ‘আসিফ, চলে এলাম । টেকনাফের বাস কয়টায় ?’
রাতে বাসে উঠে সকালে টেকনাফ । কেয়ারী ক্রুজ
এন্ড ডাইন শিপে করে সেন্টমার্টিন । পশ্চিম সৈকতে হোটেল আগে থেকেই ঠিক
করা ছিল- এসে উঠেছি সেখানে । দুপুরবেলা সাগরে নেমে অনেকক্ষণ ঢেউয়ের সাথে খেললাম ।
এখানকার ঢেউগুলো কক্সবাজারের মত অত জোরালো না । বেশ মিষ্টি ঢেউ । তবে প্রবালের
জ্বালায় ঠিকমত হাঁটা যায়না পানিতে । পা কেটে গেছে আমার । তীরের কাছাকাছি বেশ কিছু
মাছ ধরার জেলে নৌকা নোঙ্গর করা আছে । নৌকায় উঠে দুললাম কিছুক্ষণ । তারপর খেয়েদেয়ে
বের হয়েছি হাঁটতে । বাকিরা প্রায় সবাই রুমের ভেতরে – রেস্ট নিচ্ছে । আঁতেল পোলাপান
।
আগামীকাল ভোরে বিচ ফুটবল , সকালে নাস্তা
সেরে ট্রলারে ছেঁড়া দ্বীপ । বিকেলে কেয়ারী সিন্দাবাদে ফিরবো ।
ভাবলাম – আজ বিকেলেই হেঁটে হেঁটে পুরো
সেন্টমার্টিন দ্বীপ এক চক্কর দেবো । আব্দুল্লাহ ভাই এবং অসীম ভাইকে বলা মাত্রই
উনারাও রাজি হলেন । আব্দুল্লাহ ভাইকে বলামাত্রই তিনি বললেন – ‘চলো যাওয়া যাক’ ! কে
জানে- হয়তো তিনিও এমন সময় হন্টনোপযোগী সঙ্গী খুঁজছিলেন !
বিকেল বেলা সেন্টমার্টিনের পশ্চিম তীরে
ঢেউয়ের শো শো শব্দ , হু হু বাতাস আর জনমানবহীন নিস্তব্ধ প্রকৃতি – সত্যিই অসাধারণ
লাগছে ।
অসীম ভাই তাঁর হ্যাট মাথায় দুলকি চালে এগিয়ে
চলেছেন । অসীম পিয়াস । গল্পকার । কথাশিল্পী । আমাদের সিনিয়র ভাই । উনিও আছেন
আমাদের সাথে । অসাধারণ সব গল্প লেখেন তিনি
। বেশিরভাগ গল্পই রহস্যে ভরা । ফরেনসিক মেডিসিনের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি রহস্য
উদঘাটন করেন । রাইগর মর্টিস, এবরশন এইসব নিয়ে তাঁর গল্প । তাঁর পাঠকপ্রিয়তাও
তুঙ্গে । তাঁর সাথে কোথাও বের হওয়াই দায় । কখন কোত্থেকে কে ছুটে আসে – ‘আপনি অসীম
ভাই না ?’
বছর দুই আগে অসীম ভাই তাঁর রুমমেট আকবর
ভাইকে পঁচিয়ে একটা গল্প লেখেন – ‘গাধা আকবর’ । গল্পটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় ।
সেইযে শুরু । তারপর থেকে লিখছেন তো লিখছেনই । উনি লেখেন , আর আমি পড়েই শেষ করতে
পারিনা । একজন মানুষ এতকিছু কেমনে লেখে ?
‘গাধা আকবর’ লেখার পর থেকে তাঁকে বন্ধুরা আর
সহজে কেউ ঘাটাতে চায় না । কখন আবার কার নামে গল্প লিখে মান সম্মান ধুলায় মিশিয়ে
দেয় ! ইজ্জত বলে একটা কথা আছেনা , শেষে ঐটা নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে । কী দরকার
সাপের লেজে পা দেয়ার !
অসীম ভাইয়ের এক বন্ধু , কবি । উজবুক কবি
নদ্দিউ ফরিশ । উল্টা করে পড়লে নামটা একটা সুন্দর নাম হয় । কিন্তু কবি হতে গেলে
নাকি বিদঘুটে নামধারণ করতে হয় ! সেজন্যেই তাঁর নামের এই অবস্থা । নদ্দিউ ফরিশ
। অবশ্য লেখার চেয়ে পড়েন বেশি । তাঁকেও
সাথে নেবার ইচ্ছা ছিলো । কিন্তু অসীম ভাই আসছেন জেনে তিনি আর এপথে পা মাড়ালেন না ।
উজবুক কবিকে সাথে পেলে অবশ্য মন্দ হতো না ! কবি সাহিত্যিকদের আমার এইজন্যে ভালো
লাগে- এঁরা জীবনকে অনেক গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে পারেন , উপলব্ধি করতে পারেন ।
অনেক দূর চলে এসেছি । একটার পর একটা বাঁক
পেরিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছিই । মনে হয় এইতো সামনের বাঁকটাই শেষ । কিন্তু ঐ বাঁক
পেরিয়ে দেখি সামনে আরো একটা বাঁক । সেন্টমার্টিন দ্বীপটা উত্তর দক্ষিণেই লম্বা ।
দক্ষিণের শেষ প্রান্তে আছে ছেঁড়া দ্বীপ ।
আব্দুল্লাহ ভাইকে পেলে আমি নানান প্রশ্ন করি । শুনি জীবনের নানা দর্শনগত
ব্যাখ্যা । অভিজ্ঞতা । আব্দুল্লাহ ভাই প্রায়ই বলেন – ‘আসিফ, ক্ষুদ্র এ জীবনে অভিজ্ঞতা তো কম হলনা রে !’ নানান ব্যাপারে
জিজ্ঞেস করে ব্যাখ্যা শুনি তাঁর কাছে । সবকিছুর ব্যাপারে নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে
আব্দুল্লাহ ভাইয়ের । সিনিয়র হলেও যথেষ্ট খোলামেলা কথা বলা যায় তাঁর সাথে । জিজ্ঞেস
করলাম- ভাই, এইযে আজকালকার তরুণীরা রাস্তাঘাটে বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করে – নজর না
দিয়ে – চোখ অক্ষত রেখে পথচলা কী করে সম্ভব ? আব্দুল্লাহ ভাইয়ের ব্যাখ্যা হলো – দিস
ইজ নাথিং বাট এ ম্যাটার অব ডিসিশান ।
প্রথমে তোমাকে দেখতে হবে – তোমার অবস্থান কী ? তুমি জীবনে কী চাও, এই মুহূর্তে
তোমার পক্ষে কতটুকু কী করা সম্ভব ? তুমি যদি জানো যে – তোমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না । তাহলে
তুমি কারো দিকে নজর দিয়ে কী করবে ? যেহেতু তোমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না ,
সুতরাং কেউ যত সুন্দরীই হোক তাতে তোমার কিছু যায় আসেনা । তুমি হয়তো মনে করতে পারো-
কাউকে পছন্দ করে রাখবা । সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো- যে মেয়ে তাঁর রুপ-সৌন্দর্য ‘সবার
জন্যে উন্মুক্ত’ বা ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ বানিয়ে রেখেছে , যাকে চাইলেই রাস্তার
ফকির থেকে মেথর সবাই আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে পারে – তাঁকে তুমি পছন্দ করবে কীভাবে
? সুতরাং ঐ দিকটা বাদ গেলো । আর যারা পর্দা করে বের হয় – তাঁদের দিকে তো তুমি সারাদিন
তাকিয়ে থেকেও লাভ নেই । সুতরাং বুঝতেই পারছো , ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেই ব্যস ।
দেখবা রাস্তাঘাটে যতই ক্লিওপেট্রা থাকুক তোমার চোখ কোথাও আটকাবে না ! আর চোখ পড়ে গেলে সরিয়ে নিবা , ব্যস !
আমাদের হোটেলটা একেবারে সৈকতের ওপরেই বলা
যায় । আজ রাতে ওখানে বসে রাতের
সেন্টমার্টিন দেখবো । ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসের শীতল আমেজ – অন্ধকারে বসে বসে নিজের
জীবন নিয়ে আরো অনেক কিছু ভাববো আজ । আব্দুল্লাহ ভাই নিশ্চয়ই থাকবেন । তখন আরো কথা বলা যাবে । মনে মনে প্রশ্নগুলো
গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম ।
আমরা যোহরের নামাজের সাথেই আসরের নামাজ পড়ে
নিয়েছি । মুসাফিরের জন্য এটার সুযোগ আল্লাহ্ দিয়েছেন । সুতরাং আমাদের আসরের নামাজের তাড়া নেই ।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর অসীম ভাই এবার কুইজ
শুরু করলেন । বিদঘুটে নামের বিভিন্ন এলাকার নাম তিনি বলবেন , আমাদের বলতে হবে- কোন
জেলায় অবস্থিত । ভেড়ামারা, শিয়ালদহ ,
আড়াইহাজার , ঠেঙ্গামারা, গলাচিপা, ছাগলনাইয়া ...
আব্দুল্লাহ ভাই ভালই উত্তর দিলেন । তারপর
আরো অনেকক্ষণ আমরা চুপচাপ হাটলাম । পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে হাঁটতে
আমরা চলে এসেছি দ্বীপের প্রায় দক্ষিণ অংশে
। দ্বীপের এদিকটা ধীরে ধীরে সরু হয়ে ছুরির ফলার মত রূপ নিয়েছে । কথা বলতে বলতে এতক্ষণ খেয়ালই করিনি কতদূর চলে
এসেছি । এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে আসছে প্রায় । হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেলো একটা সাইনবোর্ডে
। ‘ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জনাব নজরুল
ইসলাম , গাজীপুর । জমির পরিমাণ ৩ কাঠা ।
গলাচিপা, সেন্টমার্টিন’ ।
‘আরে এইখানে দেখি গলাচিপা আছে । আগে তো
জানতাম শুধু পটুয়াখালিতেই গলাচিপা আছে !’ উত্তেজিত কন্ঠে আমি প্রায় চিৎকার করেই
বললাম ।
অসীম ভাই , আব্দুল্লাহ ভাই কারো কোন
সাড়াশব্দ না পেয়ে ডানপাশে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম – কেউই নেই । কোথায় গেলেন তাঁরা ?
উনারা কি পেছনে পড়ে গেছেন ? আমার হাঁটার গতি একটু বেশি । আর ওদিকে অসীম ভাই
মোটাসোটা মানুষ – একটু ধীরেই হাঁটেন । আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করলেই চলে আসবেন তাঁরা
।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও তাঁদের দুজনের
কারো চিহ্ন দেখতে না পেয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম । পেছনের দিকে কি একটু এগিয়ে
যাবো নাকি জোরে জোরে চিৎকার করে ডাক দেবো ?
***
বেশিক্ষণ ভাবতে পারলো না আসিফ । আব্দুল্লাহ
ভাইকে চিৎকার করে ডাক দিতে যাবে এমন সময় সে অনুভব করলো- সাঁড়াশি হাতে কে যেন তার
গলা চেপে ধরেছে ।