এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫

যুগান্তরের অপসাংবাদিকতা

যুগান্তরের গোষ্ঠি সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে । তারা তাদের 'মালিকের' নিজ দোষে পাওয়া অপমানের জ্বালা কোনভাবেই ভুলতে পারছে না । সাংবাদিকতার মুখে চুনকালি মেখে সবরকম নিয়মনীতি ভঙ্গ করে তারা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে ডাক্তারের নামে কুৎসা- কাহিনী লিখতে ।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, একজন এমপি কী করে দলবল নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের মত ব্যস্ত হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে ডাক্তার- রোগী সবার চেয়ার দখল করে বসে থাকতে পারেন? তিনি কীরকম জনপ্রতিনিধি? সব আলোচনা শুরুর আগে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে ।
তাঁকে বলা হয়েছে- 'আপনি ডিরেক্টরের রুমে অপেক্ষা করুন, এখানে এত লোক থাকায় জরুরী রোগীদের চিকিৎসায় ব্যাঘাত হচ্ছে।' এর বিপরীতে তিনি কী করেছেন? তিনি তাঁর 'পরিচয়' তুলে ধরেছেন । তিনি এই সেই । তার মানে তিনি 'এই-সেই' বলে তার জন্য জরুরী রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ রেখে ডাক্তারকে ঘোড়ার ঘাস কাটতে যেতে হবে? একজন 'জনপ্রতিনিধির'(!) এই কাণ্ডজ্ঞান ? ইমার্জেন্সি রুম ছেড়ে ডিরেক্টরের রুমে বসতে বলাটা তাঁর 'অপমান' হয়ে গেছে?
যুগান্তর সম্পাদক মহিলা এমপির সামনেই তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা নারী ডাক্তারকে তুলে নিয়ে যাওয়ার, দেখে নেওয়ার, বদলি করার হুমকি দিয়েছে । শুধুমাত্র ডাক্তার একজন 'নারী' ছিলেন বলেই হয়তো গায়ে হাত তোলে নাই । তিনি কীরকম এমপি, যার সামনে একজন নারী ডাক্তারকে অপহরণের হুমকী দেয়া হয়?
এবার আসি তাদের হলুদ সংবাদ প্রসঙ্গে । তারা লিখেছে- ''ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের এক অভদ্র চিকিৎসকের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে বিস্মিত হয়েছেন রোগী ও রোগীর স্বজনরা। জরুরি বিভাগে কর্মরত একজন নারী চিকিৎসকের এ ধরেনের অসৌজন্যমূলক, রূঢ় আচরণে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপস্থিত লোকজন। ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা ওই নারী চিকিৎসক চরম দুর্ব্যবহারে তার সনদ বাতিলসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।''
আসলে কোন রোগী কিংবা রোগীর স্বজনই বিস্মিত কিংবা বিক্ষুব্ধ হয়নি । কারণ, যুগান্তর সম্পাদকের একপাল সাঙ্গপাঙ্গের ভীড়ে সেখানে রোগী অথবা রোগীর স্বজনরা ভিড়তেই পারেননি । আর ডাক্তার কথা বলেছেন রোগীদের স্বার্থে, সুতরাং রোগীদের বরং ঐ কাণ্ডজ্ঞানহীন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই বিক্ষুব্ধ হবার কথা । আসলে রোগী কিংবা রোগীর স্বজন নয়, বিক্ষুব্ধ হয়েছেন যুগান্তরের সাংবাদিকরা । এমপির সাঙ্গপাঙ্গরা । কিন্তু সেটা বলার সাহস তাদের নাই । মুহূর্তেই তারা নিজেরাই হয়ে গেছে - 'রোগী ও রোগীর স্বজন !!' এরপর তারা নিজেদেরকে রোগীর স্বজন হিসেবে ভেবে নিয়ে তাদের মনের ক্ষোভ ঝেড়ে ডাক্তারদের সম্পর্কে তারা এতদিন ধরে যেসব কথা বাজারে ছড়িয়ে এসেছে সেগুলোর সবই ঐ নারী চিকিৎসকের ওপর চাপিয়েছে ।
এ ছিল গতকালের কথা । এরপরের দিন অর্থাৎ আজকে তারা আবার বানিয়ে বানিয়ে ইচ্ছেমত ডাক্তারের ফ্যামিলিয়াল ম্যাটার নিয়ে 'সংবাদ' (!!) লিখেছে !! কতটা নিচুমনের হলে একজন সম্পাদক অথবা এমপি এই কাজ করতে পারেন ভেবে অবাক হই । আর হ্যা, এই ঘটনার মাধ্যমে আরো একবার যুগান্তর পত্রিকার অপসাংবাদিকতা জনগনের চোখে স্পষ্টভাবে ধরা দিল । আর বোঝা গেল, যতদিন আমাদের দেশে এরকম নিচুমনের জনপ্রতিনিধি কিংবা সম্পাদক থাকবে, ততদিন মেধাবীরা এই দেশে কাজ করার পরিবেশ পাবে না ।

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৫

হাহাকার !

আমারও তো ইচ্ছে হয়
অন্তত একটা পায়রা পোষবার ।
মুক্ত স্বাধীন পায়রা উড়বে উড়ুক অনন্ত আকাশে-
আমি শুধু এইটুকু চাই
লালচে পাখায় ভেসে গোধুলী বেলায়
যেন সে ঠিক ঠিক ফিরে আসে-
পুরনো কামরায় ।
.

তোমাদের অভিধানে পায়রা নাকি শান্তির প্রতীক ? অথচ
পোষা পায়রা বিনে কতটা বুভুক্ষু হাহাকার জমছে প্রতিদিন আমার হৃদয়ে-
সে খবর কি তোমরা কেউ
নিয়েছো কোনদিন?

শুক্রবার, ২৪ জুলাই, ২০১৫

দিবাস্বপ্ন

বাইরে বৃষ্টি তুমুল তবু
রিকশার হুড বেয়ে কাঁধের ওপর নেমে আসা ক'ফোঁটা বৃষ্টিজল
অচেনা কারো অশ্রু বলে ভ্রম হয় ।
এইসব দিবাস্বপ্ন কেন আসে কে জানে ! অথচ
আমার তো বেশ জানা আছে রূঢ় বাস্তবতাঃ মা ছাড়া
একফোঁটা অশ্রু ঝরাবার মত-
এ বিশ্ব চরাচরে আমার আর কেউ নেই ।
কেউ নেই ।

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৫

হতচ্ছাড়া ইঁদুর !

সব দোষ হচ্ছে গিয়ে ঐ হতচ্ছাড়া ইঁদুরের। ঐ ব্যাটাই যতসব নষ্টের মূল !
হৃদয় বেহালার লাল নীল সুতোগুলো কেটে দিয়ে চলে গেছে
কাল রাতে,
অগোচরে ঘুমের ভেতর ।
কেউ দ্যাখেনি তাকে তবু আমি বেশ জানি
হতচ্ছাড়া ইঁদুরটাই যতসব নষ্টের মূল !
ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গেছে- কতগুলো অচেনা হৃদয়তন্ত্রী-
বেহালায় আজ তাই- আমি- তুলতে পারিনি কোন সুর;
না ভালোবাসা, না বিরহের ।

মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০১৫

দত্তক

জাতীয় পর্যায়ের একটি এবং স্থানীয় দুইটি পত্রিকার সাংবাদিক এসেছে শামীমের সাক্ষাত্‍কার নিতে ।
-আপনি বাচ্চাটাকে কোথায় পেলেন?
-আমি নিয়মিত মর্নিং ওয়াকে বের হই । আজও তেমনি বের হয়েছিলাম ।
শামীম গুছিয়ে বলার চেষ্টা করে । পত্রিকায় শামিমের ছবিসহ ছাপা হবে । শিরোনাম হয়তো থাকবে 'একজন শামীমের মহানুভবতা' বা এরকম কিছু । সুতরাং যতটা সম্ভব গুছিয়ে সুন্দর করে বলতে হবে ঘটনাটা । যেন মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে যায় ।
গলা খাকারি দিয়ে শামীম বলে যায়,
-আমি যখন বের হয়েছিলাম তখন ভোর ছয়টা । দুএকজন মর্নিং ওয়াক করা লোক ছাড়া রাস্তায় কেউই ছিলনা । মেডিকেল কলেজ মাঠের পাশে যে পায়ে চলার পথটা গিয়েছে , ওটা দিয়ে হাঁটছিলাম । হঠাত্‍ কানে এলো শিশুর কান্নার মত একটা অস্ফূট শব্দ । আমি থমকে দাঁড়ালাম । একবার মনে হলো , হ্যালুসিনেশন হবে হয়তো । কিন্তু তবু কৌতুহল দমন করতে পারলাম না । ভালো করে কান পেতে আবার শোনার চেষ্টা করলাম । আবার শোনা গেল শব্দটা । বোঝার চেষ্টা করলাম কোনদিক থেকে শব্দটা আসছে । আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম , কিছুই নেই । তারপর খেয়াল করে দেখলাম, কয়েক গজ দূরে একটা ছোট ঢিবির মত মাটির স্তুপ । আবার কান্নার শব্দ এলে মোটামুটি নিশ্চিত হলাম শব্দটা ঐ ঢিবির কাছে থেকেই আসছে ।
সতর্ক পায়ে ঢিবির দিকে এগিয়ে গেলাম । তখনই চোখে পড়লো চটের বস্তাটা । বাচ্চাটার পুরো শরীর চটের বস্তার ভেতরে ছিল , শুধু মাথাটা ছিল বাইরে । আমি ওভাবেই তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে এসেছি ।
-এই মুহুর্তে আপনার অনুভূতি কী?
-আমি খুবই খুশি যে আমি একটা জীবন রক্ষার জন্য কাজ করতে পেরেছি । সেই সাথে আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি , মানুষ কীভাবে এতটা নিষ্ঠুর হয়? এমন একটা ফুটফুটে শিশুকে কীকরে এভাবে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে ফেলে যায়? এরা কি মানুষ?
-এখন কী অবস্থা শিশুটির ?
-আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি , বাচ্চার অবস্থা এখন অনেক ভালো । ডাক্তাররা অনেক হেল্প করছেন । ইন্টার্ণ ডাক্তাররা নিজেদের টাকায় সম্পূর্ণ বিনাখরচে শিশুটির চিকিত্‍সার ব্যবস্থা করেছেন । আর তাছাড়া আমি সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি । কোনকিছুর প্রয়োজন হলে আমি তত্‍ক্ষনাত্‍ সেটার ব্যবস্থা করছি । শিশুর জন্য যা লাগে আমি সবকিছু করবো ।
-হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করলে বাচ্চাকে নিয়ে কী করবেন?
-সেটা এখনো ভাবিনি । তবে ভালো কোন দম্পতির কাছে দত্তক দেব ।
-আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
-আপনাকেও ধন্যবাদ ।

********
হোস্টেলে ফিরে অগোছালো বিছানাতে শরীর এলিয়ে দিল শামীম । সারাদিন বেশ ধকল গেল বলা চলে । তবে বাইরের চেয়ে ভেতরের ধকলটাই ছিল বেশি । বানানো কাহিনীটা ভালোই বিশ্বাসযোগ্য করে বলতে পেরেছে সে । বিকেলের দিকে এক নিঃসন্তান দম্পতি যোগাযোগ করেছিল শামীমের সাথে । দুজনেই শিক্ষক । তাঁরা বাচ্চাটিকে দত্তক নিতে চান ।
শামীম রাজি হয়েছে । এমন দম্পতির কাছে হয়তো ভালো থাকবে বাচ্চাটি । হয়তো একদিন সে মানুষের মত মানুষ হবে ।
দত্তকের কথা পাকা হবার পর থেকে বুকটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে শামীমের ।
সবাইকে মিথ্যা কাহিনী শুনিয়েছে বটে, কিন্তু এ যে তার নিজের সন্তান ! যে ভুল সে করে ফেলেছে তার জন্য হয়তো দুনিয়া আখেরাতে শাস্তি পেতে হবে । অথবা তওবা করে ক্ষমা চাইতে থাকলে আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন মাফ করেও দিতে পারেন । কিন্তু 'ভুলের' ফসল কিংবা 'অবৈধ' যাই হোক, নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার মত অতটা পাষাণ এখনো হতে পারেনি শামীম । ফেলে দেয়ার পরেও তাই আবার কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে ।
দত্তকের ধারণাটা হঠাৎ করেই মাথায় আসে শামীমের । অন্তত এটুকু সান্ত্বনা থাকলো- নিজের কাছে না থাকুক, অন্য কোথাও হলেও তার সন্তান বেঁচে থাকবে পৃথিবীর বুকে ।

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০১৫

আবদার

-এই রিকশা যাইবা?
-যামু ।
-কত?
-রোযা রমজানের মাস, ঈদের বাজার, ন্যায্য ভাড়া দিয়েন ।
-পরে আবার ক্যাচাল করবানাতো?
-না ভাই, আপনেরা আমারে ঠকাইবেন না, হেই বিশ্বাস আমার আছে ।
ঈদে কিছু বাড়তি ইনকামের আশায় ঢাকায় এসেছে আব্বাস । পথঘাট সব যে ভালো চেনে তা নয় । যদিও গতবছরও এসেছিল সে । দিন পনেরো রিক্সা চালিয়ে কিছু টাকা নিয়ে ঈদের আগের দিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিল । নিউমার্কেট থেকে দেখে শুনে বড় ছেলেটা আর কোলের মেয়েটার জন্য জামাকাপড় নিয়ে গিয়েছিল ।
এবারও সেই আশাতেই ঢাকায় আসা আব্বাসের । কয়েকটা দিন একটু বেশি কষ্ট হলেও বাচ্চাগুলো আর বউটার মুখে ঈদের দিন যদি একটু হাসি ফোটাতে পারে, সেটাই আব্বাসের জন্য চরম আনন্দ ।
আব্বাস গ্রামেও রিক্সা চালায় । কিন্তু গ্রামে রিক্সা চালিয়ে যা ইনকাম তা দিয়ে কোনরকম দিন গুজরান করা যায়, ঈদে-বরাতে বাড়তি খরচ করা যায় না । সেজন্যেই ঈদের আগে শহরে চলে আসে সে । ভাড়া নিয়ে সে কারো সাথে কোন ক্যাচালে যায় না । আব্বাস দেখেছে, যারা যাত্রীদের সাথে ক্যাচাল বাঁধায় তারা যে ভাড়া বেশি পায় তা নয় । বরং যাত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করলেই ভাড়া বেশি পাওয়া যায় । খুশি হয়ে অনেকে ভাংতি টাকা ফেরত নেয় না । কোন যাত্রী যদি অযথা মেজাজ গরম করে, আব্বাস নরম গলায় বিনয়ের সাথে বলে- স্যার আপনারা দুই চার টাকা বেশি না দিলে আমরা কই যামু?
আব্বাসের বিশ্বাস, ভদ্রলোকেরা তাঁকে ঠকাবেন না । আর কেউ যদি ঠকায় তাহলে আল্লাহ তায়ালাই তার শাস্তি দিবেন । আল্লাহ চাইলে অন্য কোন ভাবে আব্বাসকে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন । বাস্তবেও আব্বাস অনেকবার এর প্রমাণ পেয়েছে ।
রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে আব্বাস । রিকশায় বসে আছে এক ভদ্রলোক আর তার পাঁচ ছয় বছর বয়সের ছেলে । টুকটুক করে কথা বলছে তারা । খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব কথা শুনছে আব্বাস । বাড়ির কথা মনে পড়ে যায় আব্বাসের । বাড়িতে তার ছেলেটা এখন কী করছে? নিশ্চয়ই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে । আব্বাসের ছেলের বয়স দশ বছর । আবির । গ্রামের স্কুলে ক্লাস ফাইভে উঠেছে এবার । খুবই ভালো ছেলে । সবসময় আব্বাসের কথা শোনে । কোন কথার অবাধ্য হয় না । এমন লক্ষ্মী ছেলে পেয়ে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হয় আব্বাসের। প্রতিদিন সে ছেলেকে রিক্সায় করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসে । ছেলে রিক্সায় বসে এদিক ওদিক তাকায়, আব্বাসের সাথে টুকটুক করে কথা বলে, কী যে ভালো লাগে তখন ! ছেলেটা এবার একটা ঘড়ি কিনে চেয়েছে আব্বাসের কাছে । অনেক দিন ধরেই বায়না করছিল, কিন্তু আব্বাসের উপায় ছিলনা । অভাবের সংসার, ঠিকমত ভাত কাপড়ই জোটেনা । সেখানে ঘড়ি কেনার টাকা কোথায় পাবে? নানা কথায় বুঝ দিয়ে রেখেছিল ছেলেকে । ঈদে কিনে দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে রেখেছিল । ঈদ এসেই গেল প্রায়, আর তাছাড়া সামনে আবিরের বৃত্তি পরীক্ষা । ঘড়ি না হলে পরীক্ষার সময়ের হিসাব ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যায় । যত কষ্টই হোক, এবার ঘড়ি কিনে দিতেই হবে ।
ঢাকায় এসে আব্বাস একদিন গিয়েছিল ঘড়ির দোকানে । দাম দস্তুর কেমন জানতে । ঘড়ির দোকানদার কেমন যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল । আব্বাস অবশ্য তেমন কিছু মনে করেনি । লুঙ্গি গেঞ্জি পরা, গলায় গামছা বাঁধা একজন লোক যদি ঘড়ির দোকানে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করে, তারা অবাক হতেই পারে । কিন্তু কারও অবজ্ঞাকে পাত্তা দেয়না আব্বাস । একদিন পরেই ঈদ । চাঁদ রাতে বাড়ির পথ ধরবে সে। ছেলেটার জন্য একটা ঘড়ি কিনে নিয়ে যেতে হবে, এটাই শেষ কথা ।
*********
ঈদের ভোর । ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে চলেছে আব্বাস । মনটা ভীষণ খারাপ । কাঁধের ব্যাগটা যেন পাহাড়সমান । যতই বাড়ির নিকটবর্তী হচ্ছে ততই হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে আব্বাসের ।
সারারাত বাসে কাটিয়েছে । ক্লান্ত দেহে বাসের সিটে বসে ঘুমিয়েই পড়েছিল । আবিরের জন্য কেনা ঘড়িটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিল আব্বাস । সকালে যখন বাসের কন্ডাকটর ডেকে বললো যে তারা পৌঁছে গেছে, পকেটে হাত দিয়েই ছ্যাত করে উঠেছিল আব্বাসের বুক ।
ঘড়ি নেই পকেটে !
সিটের নিচে খোঁজাখুঁজি করেছিলো কিছুক্ষণ । কিন্তু পাওয়া যায়নি আবিরের জন্য কেনা ঘড়ি ।
আব্বাসের পাশের যাত্রী আগেই নেমে গিয়েছিল । যে দুএকজন তখনো নামেনি, তাদেরকে জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হলোনা । কেউ কিছুই বলতে পারলো না । আব্বাসের বুক খা খা করছে । ছেলেটা একটা আবদার করেছিল, সেটা পুরণ করতে পারলো না সে ! কী জবাব দেবে সে আবিরকে? ঐটুকু ছেলে, ঘড়ি হারিয়ে গেছে বললে বিশ্বাস করবে তো? বাবাকে মিথ্যাবাদী ভেবে বসবে নাতো?
ব্যাগের ভেতর নিজের একটা নতুন লুঙ্গি, বউয়ের জন্য একটা শাড়ি আছে । কিন্তু ছেলের জন্য কেনা ঘড়ি হারিয়ে ঐ দুটোকে এখন অনেক বড় বোঝা মনে হচ্ছে তার । ছোট ব্যাগটার ওজন যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক হাজার টন ।
পা দুটোও খুব ভারী মনে হচ্ছে আব্বাসের । হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার । কষ্টের একটা দলা পাকানো স্তুপ যেন আটকে আছে গলার কাছে । এ এক অন্যরকম কষ্ট, কাউকে বোঝানো যাবে না ।
একজন 'পিতা'ই শুধু বোঝে, সন্তানের সামান্য আবদার মেটাতে না পারার কষ্ট ।