এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

রবিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৪

আটপৌরে জীবনের গল্প !

বুঝলিরে দাদুভাই

একদিন আমিও ছিলাম তাগড়া জোয়ান

করেছি লড়াই

উন্মত্ত মোষের বিপরীতে !





কূলভাঙ্গা বানে

সাঁতরে পেরিয়ে গেছি যত বাঁক  

যত স্রোত – উজানের ঢেউ । তারপর

কখন যে জড়ায়ে গিয়েছি -

জীবন-পাঁকে , কে জানে !





বুঝলিরে দাদুভাই

একদিন তোর দিদুমণিও ছিলেন রাজকন্যা

ছিলেন সম্রাজ্ঞী !  ক্লিওপেট্রা অথবা হেলেন

সুলতানা কিংবা নূরজাহান ! তাই বুঝি

এই এক মানবীর প্রেমে কেটে গেল অর্ধেক জীবন !





একদিন আমিও ছিলাম বেপরোয়া পথিক

হেঁটেছি অবিরাম জীবনের পথে

আষাঢ়ে ফাগুনে ভাদ্রে চৈত্র বৈশাখে

দুপায়ে মাড়িয়ে গেছি সাইক্লোন । হাতের তুড়িতে উড়িয়েছি

ভয়াল সুনামি !



পথের শেষ সীমানায় হলো তোর দেখা । ভাবলাম –

একটু জিরিয়ে নিই এইখানে । এই ফাঁকে খানিকটা বলে যাই

মোহময় এক আটপৌরে জীবনের গল্প !





২.

আজ তবে এটুকুই থাক । সময় হলো পা বাড়াবার 

অনন্ত যাত্রায় ।







[জীবনের গল্প/ ৩১-০৩-২০১৪]

শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৪

বিনিময়

‘কী চাই ?’

বাজখাঁই কন্ঠ শুনে দমে যাই আমি । কাঁচুমাচু হয়ে বলি-

‘মাফ করবেন । তেমন কিছু না, এই সামান্য এক টুকরো জমিন...

মানব জমিন’ ।

‘কতটুকু ?’

‘এই ধরুন সাড়ে তিন হাত !’

‘কেন ?’ সংশয়ভরা কর্কশ কন্ঠ শুধায় ।

‘কেন আবার ! করবো আবাদ । চাষ করে ফলাবো ‘মানুষ’ !’

‘কী আছে তোমার ? কী দেবে বদলে ?’

‘গরীব এ অধম , ‘আমি’ ছাড়া আমার আর নেইতো কিছুই

তাই দেবো , সবটুকু

এতেকি হবেনা যথেষ্ট বিনিময় ?’  







[ বিনিময়/ ২৯-০৩-২০১৪ ]

শুক্রবার, ২৮ মার্চ, ২০১৪

জৈবসার

একদিন জৈবসার হবে আমার শরীর

পিতামহ-প্রপিতামহ, কিংবা নাম না জানা পূর্বপুরুষের মত  ।





উর্বর মৃত্তিকায় বেড়ে ওঠা পুষ্ট ডালিমের ডালে

সুবহে সাদিকে গাইবে বসন্তের পাখিরা

আমায় ভুলে তুমিও শুনবে কোকিলের কুহুতান

বিমোহিত হৃদয়ে !





একদিন বৈশাখী হাওয়ায় বেয়াড়া ধুলিকণা এসে

জাপটে ধরলে তোমার মায়াবী চোখের পাতা

হয়তো বিরক্ত হবে তুমি । জানতেও পারবেনা সেযে

আমারই অবশেষ ! একদা তোমার ভালবাসায় সিক্ত

মাদকতাময় শরীর !





একদিন জৈবসার হবে আমার শরীর

বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত  

কিংবা সরিষার হলুদাভ ফুলের মাঠে

ধীর পায়ে হেঁটে যাবে তুমি দিগন্তের পানে

জানতেও পারবেনা মিশে আছি আমিই 

প্রতিটি স্বর্ণাভ ধানের শীষে ! 





এইসব জৈবনিক ভালোবাসা – প্রেম সংসার

সব শেষে একদিন আমি হয়ে যাবো

অচেনা জৈবসার !



শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০১৪

মনরে... বলি তোমায়...

তোমায় নিয়ে থাকি আমি
বড়ই দ্বিধা দ্বন্দে ,
পারিনা যে বাঁধতে তোমায়
কোনরকম ছন্দে !

তেজ কটালের জোয়ার কখন
কখন মরা কটাল
কখন তুমি শান্ত থাকো
কখন যে হও মাতাল !

কখন তোমার পূর্ণিমা হয়
কখন অমাবশ্যা
কখন তোমার গ্রহণ লাগে
কখন আকাশ ফস-সা !

কখন তুমি ক্ষিপ্ত যে হও
কখন পরাণ জুড়ায়
কখন থাকো আমার ভেতর
কখন যে মনপুরায় !

[মনরে...বলি তোমায়/ ২১-০৩-২০১৪]


বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০১৪

আমরা কি দিয়েছি নারীকে প্রাপ্য অধিকার ?

এদেশের ইসলামপন্থিরা অনেকেই সহশিক্ষার বিরোধিতা করেন । নারীদের স্বনির্ভর – কর্মমুখী করার ব্যাপারে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংকের যে প্রচেষ্টা তার বিরোধিতা করেন । মুসলিম হিসেবে , আদর্শিক অবস্থান থেকে আমিও করি । কিন্তু তার আগে একবার চিন্তা করা উচিৎ , বিরোধিতা তো করলেন , আপনি এবং আপনারা কি দায়িত্ব পালন করেছেন ?
বেগম রোকেয়াকে কেন নারী জাগরণের কথা বলতে হয়েছিল ? কেন বলতে হয়েছিল – ‘জাগো গো ভগিনী’ ?
ইসলাম নারীর অধিকার দিয়েছে । নারীর মর্যাদা পশুর পর্যায় থেকে মানুষের পর্যায়ে এনেছে , দিয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষের চেয়ে বেশি সম্মান । কিন্তু মুসলিম নাম নিয়ে আমরা কী করেছি ? আমরা কি নারীকে তার প্রাপ্যটা দিয়েছি ? বলার আগেই অধিকার দিয়েছি ? নাকি ধর্মের দোহাই দিয়ে – যেটুকু আমার পক্ষে যায় সেটুকু বলে নারীকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছি ?

আসলে কী হয়েছে ?
রাসুল (সাঃ) বলেননি – অথচ আমরা দিব্যি হাদিস বানিয়েছি – ‘স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেশত’ !
জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে দেখা যায় – পুরুষদের কথায় কথায় তালাক দেয়ার প্রবণতা । খুবই বাস্তব । গ্রামে দেখেছি- পুরুষ মাত্রই ‘তালাক’ নামক পারমানবিক অস্ত্রের অধিকারী ! পান থেকে চুন খসুক আর চুন থেকে পান খসুক – তারা যখন তখন ‘তালাক’ নামক স্টেনগান তাক করে স্ত্রীকে ব্রাশফায়ারের হুমকী দেন ! (নারী নির্যাতন বিরোধী আইন হবার পর এই প্রবণতা কমেছে । এখন উল্টা মহাবীর ‘পুরুষ’ মহোদয় নির্যাতিত হন ।)
এখন কিছুটা কমেছে , কিন্তু একসময় প্রতিটি গ্রামে অন্তত কয়েকজন করে ‘তালাকপ্রাপ্তা’ নারী থাকাটাই ছিল যেন স্বাভাবিক ব্যাপার । এদের কোন আশ্রয় নেই । এরা থাকে বাপের বাড়ির গলগ্রহ হয়ে । ননদ-ভাবীর গালমন্দ খেয়ে বেঁচে থাকাটাই যেন তাঁদের ভাগ্য । অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে- খুব বেশি দোষ ছিলনা সংসার ভাঙ্গার মত ।
পুরুষেরা এমন আচরণ করেন,করতেন , কথায় কথায় এমনভাবে তালাকের হুমকী দেন যেন তারা ‘প্রভু’ । স্বামীর ‘খেদমত’ করা স্ত্রীর দায়িত্ব ! ‘স্বামী’র মাথা টিপে দেয়াও স্ত্রীর কাজ, পা টিপে দেয়াও স্ত্রীর কাজ ! ‘স্বামী’ – সে যেন এক মানব প্রভুর নাম !
পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা নয় , এ যেন মালিক-ভৃত্যের সম্পর্ক । স্বামীর নাম মুখে নেয়া যাবেনা , ভাসুরের নাম মুখে নেয়া যাবেনা । মেয়েমানুষ- লেখাপড়া করে কী হবে ? জজ-ব্যারিস্টার হবে ? কোনমতে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারলেই হবে । সুরা ফাতেহা , সুরা এখলাস পড়তে পারলেই হবে ।
মেয়ের বিয়ে হবে – ছেলের পছন্দই সব । মেয়ের পছন্দ-অপছন্দের কোন দাম নেই । বালাই নেই । জিজ্ঞেসও করা হয়না- বরকে তার পছন্দ হয়েছে কিনা ? সে যে একজন ‘মানুষ’, তা যেন আমরা ভুলেই যাই । কোনমতে একজন ‘পুরুষের’ কাছে গছিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতেহ ।
একটা যৌথ পরিবারে যদি কোন বউ চাকরি করে , নিজে উপার্জন করে , তাঁকে কিছুটা হলেও ভিন্ন চোখে দেখা হয় । সম্মানের চোখে দেখা হয় । কারণ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা । আজ আর পুরুষ ‘প্রভু’ নেই । বুক ফুলিয়ে বলতে পারেনা – ‘আমিই খাওয়াই-পরাই’ ।
বেগম রোকেয়ার প্রতি শ্রদ্ধা আসে । তিনি সাহস করে নারীশিক্ষার কথা বলেছেন । তিনি পুরুষকে ‘স্বামী’ নয়, অর্ধাংগ নাম দিয়েছেন ।
অসহায় নারীদের সাহায্য করার জন্য ইসলামপন্থী দের ভূমিকা কী ? তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কি আমরা করতে পেরেছি ? তাঁদের দুর্বিষহ জীবনে এতটুকু স্বস্তি এনে দেবার জন্য আমরা কি কোন সহযোগিতা করতে পেরেছি ? ব্র্যাক যদি সেখানে এগিয়ে যায় , আশা যদি সেখানে এগিয়ে যায়- কেন এইসব নারীরা ছুটে যাবেনা ?

‘পতিতা’ নাম নিয়ে আর একদল নারী চরম অমানুষিক জীবন যাপন করছে । ওদের ঘৃণা করতে সবাই পারে । পতিতাদের উদ্ধার না করে তথাকথিত ‘যৌনকর্মী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবি করে অনৈসলামিক সেক্যুলার নারীবাদি সংগঠনগুলো । ওরা নারীদের ব্যবহার করতে চায়- বিনিময়ে ‘পারিশ্রমিক’ দিতে চায় ! অথচ মানবতার চরম অপমান দেখেও , এই নারীদের – তথাকথিত পতিতাদের পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ কি নিয়েছে মুসলিমদের কেউ ? আলেম-ওলামাগনের কেউ ? ইসলামপন্থি কেউ ?
কোন মেয়ে কি কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিতে পারে ? মানবতার চরম অপমান দেখেও কী করে আমরা চুপ করে বসে থাকি ?
তসলিমা নাসরিনের মত সীমালংঘনকারী মহিলা- যে জরায়ুর স্বাধীনতা চায় , গাঁয়ের জামা খুলে একজন পুরুষের মত প্রকাশ্যে হাটে বাজারে ঘুরে বেড়াতে চায় –( ইমদাদুল হক মিলন আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে কিছুটা বোধোদয় হয়েছে হয়তো) সে পর্যন্ত এই পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে কথা বলছে ।
কুরআন নারীকে অধিকার দিয়েছে । ইসলাম নারীকে অধিকার দিয়েছে । আমরা কি দিয়েছি ? সেটাই ভাবতে হবে । থিওরি বলে , এর-ওর বিরোধিতা করে কোন লাভ নেই । নারীদের প্রকৃত অধিকার দিতে ও নিতে , অসহায় নারীদের কল্যানে কাজ করতে হবে ।
ইসলামের সঠিক বাস্তবায়নই পারে নারীকে তার সঠিক মর্যাদা দিতে । কিন্তু , ইসলাম কী দিয়েছে , কী দিতে চায় সেটা বাস্তবে দেখাতে হবে । তবেই আসবে প্রকৃত নারী স্বাধীনতা । নারীর প্রকৃত কল্যান ।

মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০১৪

অনন্ত রহস্য !



এই এক চাঁদ
কত জনম ধরে মুগ্ধ করে রেখেছে পৃথিবীর মানুষকে
স্বপ্নভূক কবিকে
নিশ্চুপ কথাশিল্পীকে  
দূর গাঁয়ের বোকাটে কৃষক নিরাশা মামুদকে ।  

নিশাচর খেকশিয়ালটাও কি চন্দ্রাহত  জন্ম-জন্মান্তরে ?
হুতুমপেঁচাও কি রাত জাগে চাঁদেরই মায়ায় ?

ঝিঁঝিঁ পোকার দলও চাঁদেরই বিরহে
কিংবা চাঁদের মোহেই রাতভর ডাকে কিনা
ডোবার ব্যাঙটাও গলা ফুলিয়ে চিৎকার করে কিনা
চাঁদের আলোয় বসে পাড়ের শিশিরভেজা ঘাসের ওপর 
এ এক অনন্ত রহস্য !

কেউ কেউ চাঁদের পানে চোখ রাখে, খোলা আঙ্গিনায়
কেউ অবাক চোখ তাকায় বহুতল ভবনের খোলা জানালায়  
কেউ মায়ের কোলে
কেউ ইজি চেয়ারে
কেউ নতুন এসেছে পৃথিবীর বুকে  
কেউবা প্রস্তুতি নিচ্ছে চিরবিদায়ের  
দুজনের চোখে তবু একই মুগ্ধতা , একই বিস্ময় !

কোটি বছর ধরে 
একই চাঁদের আলোয় এত মায়া কেন
এত ভালোলাগা কেন
এত ভালোবাসা কেন
এ যেন এক অনন্ত রহস্য !

সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০১৪

সচেতন নাগরিকের দিনপঞ্জি



পত্রিকার পাতা খুলে দেখলাম – ভেতরের পাতায় একটি কলাম
‘মেঘনায় ভাসছে গলিত লাশ’ । পাতা উল্টিয়ে যাই অবলীলায়
এ আর এমন কী ? এসব তো এখন রোজকার আটপৌরে খবর
আজকাল তাই ছাপাও হয়না কাগজের প্রথম পাতায় । সেখানে থাকে
কোন এক ভিনদেশি নায়িকার গর্ভস্থ সন্তানের নড়াচড়ার 
‘রোমাঞ্চকর’ খবর !

চায়ের কাপ ফুরোয় । আমি প্যান্টের বেল্ট লাগাই । জীবন যুদ্ধে
কোমর শক্ত করে বেঁধে নামতে হবে না ? গলায় ঝুলে থাকে
স্ত্রীর সযত্ন হাতে লাগানো ‘টাই’
আমার একটা হাত কাজ করে অফিসের টেবিলের ওপরে । আরেকটা 
ব্যস্ত থাকে অন্য কোথাও, টেবিলের নিচে । অনেকেই ‘খুশি হয়ে’
এগিয়ে দেয় মোটাতাজা খাম । সযত্নে সেইসব ঢুকিয়ে রাখি 
ব্রীফকেসে । 

দেশের ‘সেবা করে’ ক্লান্ত আমি । ঘুমানোর আগে তবু 
টিভিতে একবার চোখ রাখি । সচেতন নাগরিক তো –
দেশের খবর না রাখলে চলে ?
দেশনেতারা দাঁত কেলিয়ে হাসেন ।
‘আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো’  
যেকোন সময়ের তুলনায় ! 

নিশ্চিন্ত হই । যাক বাবা , বাঁচা গেলো ! এইবার নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায় ।

[সচেতন নাগরিকের দিনপঞ্জি/ ১৭-০৩-২০১৪]

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪

স্রোতের বিপরীতে



. 
হাঁটতে শেখার পর থেকেই দেখছি-

একটা সর্বনাশা স্রোত আমায় ঠেলে দিতে চায়  
আমার পথ হতে । টেনে নিতে চায়, ভাসিয়ে নিতে চায় –
পেছনের দিকে । অসুন্দর , পংকিলতা আর ক্রুরতার ভয়ংকর স্রোত ।

সেই স্রোতে চলছে হাজারো মানুষ 
লাখো মানুষ ।
কোটি মানুষ ।
খড়কুটোর সাথে মিলেমিশে একাকার !
আমার ভেতর থেকেও এক বিশ্বাসঘাতক প্রেরণা জাগায়-  
সেই স্রোতে ভাসাতে শরীর । নিষ্ঠুর জল্লাদের মত সে ক্রমাগত ছুরি চালায় 
আমার বিশ্বাসের শ্বাসমূলে ।  

.
সবাইকে ঠেলে সামনে এগোনো বড্ড কঠিন, বড় কষ্ট  
অনেক শক্তি আর সাহসের কাজও বটে !
দুর্বল আমি তাই- আমার পথের ওপর থমকে দাঁড়াই । ভাবি  
নাইবা পারলাম হাঁটতে স্রোতের বিপরীতে
দাঁড়িয়ে তো থাকি –
সেটাই বা কম কিসে ? 

পায়ের পাতা ফুঁড়ে শিকড় গজাক  
বটগাছের ঝুরির মত হাতগুলোও নেমে আসুক মাটির পরে  
চুলগুলো হোক মায়ের ভালোবাসার মত অচ্ছেদ্য শেকল   
প্রোথিত হোক সময়ের আঙ্গিনায় ; আঁকড়ে রাখুক অনন্তকাল   
আমার বিশ্বাসের এঁটেল মৃত্তিকায় ।

স্রোতের বিপরীতে নাইবা পারলাম হাঁটতে 
দাঁড়িয়ে তো থাকি –  
সেটাই বা কম কিসে ?

[স্রোতের বিপরীতে / ১৪-০৩-২০১৪]

বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০১৪

শাবিপ্রবিতে ছাত্রদের বহিষ্কারের প্রতিবাদ করা জরুরী

শাবিপ্রবিতে ১৪ জন ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে ‘চেতনা ৭১’ স্তম্ভ এবং এক শিক্ষকের গাড়িতে হামলার অভিযোগে । ‘অভিযোগ’ , প্রমাণিত নয় । তো এইটার প্রতিবাদ করার জরুরত আছে । ঐ ছাত্ররা শিবির সমর্থক , কিন্তু এর প্রতিবাদ করার জন্য কারো শিবির সমর্থক হবার দরকার নাই , এটা মানবিক ও নৈতিক সচেতনতার ব্যাপার । প্রথম কথা ওরা ছাত্র , এখনো পড়াশোনা শেষ করতে পারে নাই । দ্বিতীয় কথা , ওদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত নয় । ওরা শিবিরের বলে আজ যদি আপনি এর প্রতিবাদ না করেন , তাহলে কাল আপনার বা আপনার কারো ওপরও যদি এই খড়গ নেমে আসে , কোন অন্যায় হয় , কেউ প্রতিবাদ করবে না আপনি ছাত্রদল বলে , কিংবা আপনি ছাত্রলীগ বলে, কিংবা আপনি কোন দলের নন বলে ।
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্তম্ভ এবং শিক্ষকের গাড়িতে হামলা দুটোই নিন্দনীয় কাজ , সন্ত্রাসী কাজ । যেই করুক না কেন – তার শাস্তি হওয়া দরকার । সেজন্য মামলা হোক, তদন্ত হোক, বিচার হোক , ফৌজদারি অপরাধের আইন অনুযায়ী শাস্তি হোক । কিন্তু আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে , নিজেরাই অভিযোগ করে, অভিযুক্তদের কোন বক্তব্য না শুনে আজীবন বহিষ্কার , ছাত্রদের আশা-আকাংখা ও ভবিষ্যতের স্বপ্নকে ধূলিস্যাত করা সমর্থন করা যায় না ।
প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে । ছাত্রের হাতে ছাত্র খুন হয়েছে , শিক্ষক লাঞ্চিত হয়েছেন । কিন্তু কোথাও কারো ছাত্রত্ব বাতিল করা হয় নাই । আর এখানে অভিযোগ করেই সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ।
দরকার হয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন- দেশ উপকৃত হবে । কিন্তু এইসব ছাত্র একেকটা পরিবারের আশা আকাংখার প্রতীক । শিক্ষক হয়ে কারো শিক্ষাজীবনকে এভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারেন না ।

মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০১৪

দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না...



১।
২০০৯ সালের ৯ বা ১০ জানুয়ারী । আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েকদিন মাত্র হয়েছে । আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ে সবাই হতভম্ব অবস্থায় । কী হবে, কী করতে হবে এ নিয়ে সারাদেশের সংগঠন কিংকর্তব্যবিমূঢ় । নভেম্বর ২০০৮ এ মারামারি হয়ে ক্যাম্পাস আগে থেকেই বন্ধ, হোস্টেল খালি । নির্বাচনের পর ছাত্রলীগ মেইন হোস্টেল এবং ইন্টার্ণী হোস্টেলে অবৈধভাবে অবস্থান করছিল । আমরা তখন চকবাজারে থাকি । সবাই তখনো বাড়ি থেকে আসে নি । ৩০-৩৫ জন সম্ভবত এসেছেন চট্টগ্রামে ।

ঐদিন বিকাল বেলা আমরা তৎকালীন সেক্রেটারি Sajjad ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ৬ জন-  গেলাম কলেজ সেন্ট্রাল মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে । বলা যায়-  আওয়ামী লীগের এই আমলে ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রথম প্রবেশ । কথা ছিল, নামাজ শেষ করে আমরা চলে আসবো । ওমা, নামাজ শেষ করে বারান্দায় বের হয়েই দেখি ছাত্রলীগের ২০-৩০ জন মসজিদের বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে !

সভাপতি Iqbal ভাইকে খবর দিলাম । তিনি আমাদের আরো ভাইদের সাথে নিয়ে আমাদের সাহায্যে রওয়ানা দিলেন । এদিকে সাজ্জাদ ভাই এবং মুকুল ভাই এর সাথে ছাত্রলীগের ৪৬ এবং ৪৭ এর নেতাদের কথা হলো । বেশ কিছুক্ষণ বাগবিতন্ডা হলো । আমরা ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে আসবো, ওরা আসতে দিবে না । পরে আমরা পশ্চিম গেট দিয়ে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে চকবাজারের দিকে গেলাম(যেহেতু মাত্র ৬ জন ) । পুর্ব গেটের একটু দূরেই ইকবাল ভাইয়ের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা আমাদের ভাইদের সাথে দেখা হয়ে গেল ।

২।

সেসময় একই সাথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছিল আমাদের । প্রথমত- আওয়ামী লীগ সরকার মারাত্মক রকম নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে । সামনে তাদের পুরো পাঁচটি বছর । আমাদের সাথে সরকারের আচরণ কেমন হবে , পাঁচ বছর সংগঠনকে কীভাবে পরিচালনা করা হবে সবকিছু নিয়ে সংশয় । কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছিল না । স্পষ্ট করে কোন পরামর্শও কেউ দিতে পারছিল না ।
আমরা হোস্টেলের বাইরে । ছাত্রদল অস্তিত্ববিহীন – পলাতক । ছাত্রলীগ হোস্টেলে অবস্থান করছে । হোস্টেলে ওঠাটা একটা চ্যালেঞ্জ ।
৪৭ তম ব্যাচের দায়িত্বশীল ভাইদের সেকেন্ড প্রফ পরীক্ষা জানুয়ারি মাসেই হবার কথা । তাঁদের পড়াশুনাও করা দরকার । আবার তাঁদের ছাড়া কোন কিছু করাও সম্ভব না । 46 এর পর তখন ক্যাম্পাসে ওনারাই সিনিয়র ব্যাচ, শক্তিশালী ব্যাচ ।
৫১ তম ব্যাচের ফিশিং । এই ব্যাচের ফিশিং শুরু হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক আমলে , এখন আওয়ামী লীগের সরকার । ছাত্রলীগ ক্রমাগত হুমকী ধমকি দিচ্ছে । এই পরিস্থিতিতে নতুন ছাত্রদের পাওয়া এবং ধরে রাখা দুটোই ছিল খুব কঠিন ।
এদিকে ৫০ তম ব্যাচ থেকে ছাত্রলীগ আমাদের সমর্থকদের ক্রমাগত ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের দলে টানছিল । 
এরকম অবস্থায়ও ইকবাল ভাইয়ের নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ চলতে লাগলো । আমরা কয়েকটা রুমে গাদাগাদি করে ফ্লোরিং করে ঘুমাই । প্রতি রুমে গড়ে ১২ থেকে ১৫ জন । শান্তিপুর্ণ উপায়ে ক্যাম্পাস ও হোস্টেলে সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করছি আমরা ।
এসময় ইকবাল ভাই সভাপতি থাকাটা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত । তিনি অসুস্থ ছিলেন, আগের মারামারিতে কোমরে ব্যথা পেয়েছিলেন এই অবস্থায়ও  তিনি শক্তভাবে ক্যাম্পাসে ও হোস্টেলে ওঠার জন্য আমাদের নিয়ে কাজ চালাতে লাগলেন । আমি তখন সদস্য প্রার্থী , আর 47 ব্যাচের ভাইদের পরীক্ষা, 46 ব্যাচের ভাইদের না পাওয়া ইত্যাদি কারণে আমার সুযোগ হয়েছিল এই সময়ে ইকবাল ভাইর সাথে থাকার । সেই সময়ে বড় ভাইরা সবাই সর্বোচ্চ সামর্থ্যটুকু দিয়ে কাজ করেছেন- সাজ্জাদ ভাই, ইমরান ভাই, রুশো ভাই ...... আমি পেছনে থাকতাম লেজের মত । কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সেসময়ের ইকবাল ভাইয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের দৃশ্যগুলি আমি কোনদিন ভুলতে পারি না , পারবো না ।  সেসময় আমাদের কোন রুটিন ছিল না । যতদুর মনে পড়ে- এই দিনগুলোতে ইকবাল ভাইর সাথে আমরা সারাদিন দৌড়িয়েছি , কাজ করেছি । গড়ে ৩-৪ ঘন্টা করে ঘুমাতে পারতাম আমরা । কলেজ প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ, আলাপ আলোচনা হিসাব নিকাশ চলতে লাগলো ।
৪৭ এর ভাইয়েরা ঠিকমত পড়াশোনা করতে পারছিলেন না । মূল দায়িত্ব তো তাঁদের কাঁধে । হাতে একটা বই নিয়ে উনারা কাজ করতেন ।
নভেম্বর-২০০৮ এর মারামারিতেই আমাদের অনেকের রুম ভাংচুর-লুটপাট ও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল । এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ বাকি জিনিসপত্রগুলিও লুট করে নিয়েছে । আমাদেরকে একপ্রকার ‘ফতুর’ অবস্থায় কাটাতে হচ্ছিল দিনগুলি ।
মহানগরীর বায়তুলমাল সম্পাদক আজাদ ভাই আমাদের খোজখবর রাখতেন । বলা চলে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়েছিলেন আমাদের সাথে কাজ করায় ।

বেশ কিছুদিন চলে গেল । কোন সমাধান আসছিল না । দিনদিন আমাদের ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছিল । অবশেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- মার্চ টু হোস্টেল করতে হবে যা আছে কপালে ।

৩।

যত দিন যাচ্ছিল আমাদের ক্ষতি বাড়ছিল । হোস্টেলে অবৈধভাবে অবস্থান করে ছাত্রলীগ আমাদের রুমগুলো অবাধে লুটপাট করছিল । একে একে আমাদের বেশ কিছু রুমও তারা দখল করে নিচ্ছিল । আমাদের জুনিয়র সমর্থকরা ছাত্রলীগের হুমকী-ধমকির কাছে বেশিদিন টিকতে পারছিল না । বিশেষ করে 50 ব্যাচ থেকে আমরা জনশক্তি হারাচ্ছিলাম বেশি ।

আমরা কলেজ প্রশাসনের কাছে বারবার দাবি করছিলাম – দ্রুত কলেজ ও হোস্টেল খুলে দেয়ার জন্য । কিন্তু কলেজ খোলা হচ্ছিল না ।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব ছিলনা । সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো- যেকোন মূল্যে হোস্টেলে উঠবো আমরা । ২০ অথবা ২১ তারিখ বিকালে আমরা আল্লাহ ভরসা করে রাস্তায় নেমে এলাম ।

‘প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি’ নিয়ে কিছু ভাইকে ব্যাকআপ রেখে আমরা ১৫-২০ জন চট্টেশ্বরি রোড ধরে হোস্টেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এগোতে লাগলাম । আমাদের অনেকের কাঁধে ব্যাগ । আমার কাঁধে তো আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ঐতিহাসিক সেই কালো ব্যাকপ্যাকটা ছিল – কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাগটি ছিল Sajjadur সাজ্জাদ ভাইয়ের কাঁধে । ঐতিহাসিক সেই ব্যাগ । ব্যাগটি সাজ্জাদ ভাইয়ের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিল ! ছয় ফুট লম্বা ভাইয়ের কাঁধে প্রায় আড়াই ফুট দীর্ঘ ব্যাগ । ভেতরে যাই থাকুক- বাইরে থেকে দেখলেই আত্মারাম খাচাছাড়া হয়ে যেত যে কারো !

আমরা দুই ভাগ হয়ে লতিফিয়া ও মাহমুদিয়ায় নাস্তা করতে বসলাম । হোস্টেল থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো । কিছুক্ষণ পর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে জুম্মা এবং 48 এর দুয়েকজন এসে রাস্তা থেকে ঘুরে গেল । আমাদের নিরীহ নির্বিকার হাসিখুশি মুখ দেখে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল , সম্ভবত হোস্টেলে পোলাপান রেডি রেখে এসেছিল তারা । আমরা ওদের সাথে হ্যান্ডশেক করলাম, জিজ্ঞেস করলাম- কিরে কেমন আছিস ? হোস্টেলের কী অবস্থা ?

ঘন্টাখানেক হাটাহাটি  হাসি তামাশা গল্পগুজব ও নাস্তাপানি করে বায়তুস সালামে নামাজ পড়ে সেদিনের মত ফিরে গেলাম আমরাযা হবার তা হয়ে গেছে- রাতেই খবর পাওয়া গেল, আগামীকাল আমাদের সাথে মিটিং করে সমাধানে আসতে চায় ছাত্রলীগ ও কলেজ প্রশাসন । 

৪।
ছাত্রলীগ চেয়েছিল ছাত্রদলের মত আমাদেরকেও বাদ দিয়ে অর্থাৎ ক্যাম্পাস থেকে উৎখাত করে এককভাবে ক্যাম্পাস দখলে নিতে । কিন্তু তারা এতে ব্যর্থ হচ্ছিল । অনেক চেষ্টা করেও তারা আমাদের কিছু জুনিয়র সমর্থক ছাড়া তেমন কাউকে ভাগিয়ে নিতে পারেনি । পারিপার্শ্বিক এলাকায় শিবিরের আধিপত্য এবং সবশেষে আমাদের যেকোন মূল্যে হোস্টেলে ওঠার ব্যাপারে দৃঢ় ও মারমুখী অবস্থান ছাত্রলীগের আশায় গুড়ে বালি হয়ে দাঁড়ায় । অগোছালো অবস্থায় তারাও আর ঝুঁকি নিতে চাইলো না । এককথায় আমাদের এই অবস্থানে ছাত্রলীগেরও আর উপায় ছিল না আমাদেরকে বেশিদিন বাইরে রেখে হোস্টেলে ঘুমানো । পরবর্তীতে জানা গিয়েছিল যে , ঐ রাতে তারা আসলেই ঘুমাতে পারেনি ।

যাহোক, পরদিন সকালবেলা ক্যাম্পাসের পাশে এক রেস্টুরেন্টে বৈঠক হলো । @iqbal   ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের শিবিরের টিম বৈঠকে অংশ নেয় । বৈঠক সম্পর্কে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই , কারণ  এ ধরণের বৈঠকের আলোচনা কখনো বাইরে প্রকাশ করা হয়না । রাজনৈতিক ঐতিহ্যই এরকম ।

মোদ্দাকথা, বৈঠকের ফলাফল হলো- আমরা হোস্টেলে উঠবো । পরদিন থেকে কলেজ খুলে দেয়া হবে । ছাত্রলীগ ধীরে ধীরে তাঁদের দখলে থাকা আমাদের রুমগুলো ছেড়ে দিবে ।

আমরা প্রস্তুতি নিলাম । যাকিছু আছে তাই নিয়ে বিকাল বেলা ৩০-৩৫ জন মিলেই হোস্টেলে উঠে গেলাম । তোষক বালিশ, ব্যাগে কিছু কাপড়-চোপড় ।  কোন রুমে থাকার মত অবস্থা নেই । সব ধ্বংসস্তুপ । ক্যামেরায় ছবি তোলা হলো । সবগুলো রুমে একবার ঘুরে আসলাম আমরা । কোন রুমের কী অবস্থা লিস্ট করলাম ।

এশার আগেই খেয়েদেয়ে সবাই হোস্টেলে উপস্থিত । কোনমতে ঝাড়ু দিয়ে ছাই-ময়লার ওপরেই তোষক বিছিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করলাম আমরা । সারারাত সতর্ক থাকলাম , শারিরীক ও মানসিক ভাবে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম । যতদূর মনে পড়ে – ইকবাল ভাই ও আমি সারারাত ঘুমাই নি । অনেক কথা বললাম, চিন্তাভাবনা করলাম আমরা । কীভাবে কী করা যায় । নভেম্বর-২০০৮ এর মারামারির আগে  ১৯/সি তে আমি, ইকবাল ভাই, ইয়াসির ভাই এবং তোফা ভাই থাকতাম । সেরাতেও সেখানেই থাকলাম । আমাদের ভাইয়েরা বিভিন্ন রুমে ভাগ হয়ে থাকলেন ।

কলেজ খুললে সকাল বেলা আমরা কলেজে গেলাম । ক্লাস করলাম । ক্লাস শেষে ১১ টায় ব্রেক টাইমে সবাই যথারীতি এসে বসলাম আমাদের প্রিয় জায়গা ‘লং আইল্যান্ডে’ ।

একটু পরেই দেখা গেল ছাত্রলীগ সভাপতি তানভীর ভাই কয়েকজনকে সাথে নিয়ে এসে ইকবাল ভাইয়ের সাথে কথা বলছেন । ভাবভঙ্গিতে বোঝা গেল- কোন বিষয়ে তারা তাদের আপত্তি জানাচ্ছে ইকবাল ভাইকে ।

৫।

লং আইল্যান্ড অর্থাৎ আব্দুল্লাহ সরণীর ওপর বসা ছাত্রশিবিরের ঐতিহ্য । এই বিষয়েই কথা বলতে এসেছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি তানভীর ভাই । ওদের বক্তব্য হচ্ছে- আমাদের এভাবে লং আইল্যান্ডে বসে মহড়া দেয়াটা ছাত্রলীগের জন্য ইরিটেটিং । আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, ক্যাম্পাস কেবল খুলেছে , এভাবে শিবিরের ছেলেপেলে দের চোখের সামনে বসে মহড়া দেয়াটা সবার চোখে লাগছে । আমরা ওখানে বসলে  ছাত্রলীগের ছেলেরাও আমাদের সামনে জটলা পাকাবে, মহড়া দেবে । ঝামেলা হবে ।

যাহোক- আমরা অনেকটা মেনে নিলাম । কথা তো ঠিক । সমঝোতার পর ক্যাম্পাসে ঢুকে শুরুতেই যদি আবার মারামারি হয় তাহলে সেই অবস্থায় ওদের চেয়ে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হতাম বেশি । আমার যতদূর মনে পড়ে, ওদেরকে বলা হয়েছিল- অনেকদিনের অভ্যাস, ছেলেপেলেরা তো এখানে বসবেই । তবে নেতারা কম বসবে যাতে বেশি সমাগম না হয় । ধীরে ধীরে কমে যাবে ।

আরো একটা সমস্যা ছিল ঐসময় লং আইল্যান্ডে বসার । লোকাল ও সাধারণ সমর্থক ছেলেরা অনেকেই আমাদের সাথে লং আইল্যান্ডে প্রকাশ্যে বসতে বিব্রত বোধ করছিল । সব মিলে সভাপতির নির্দেশনায়- লং আইল্যান্ডে বসা আমরা ধীরে ধীরে কমিয়ে দিলাম ।

সংগঠনকে গুছিয়ে নেয়া, হোস্টেলে রুম সংস্কার, সবার পুনর্বাসন , পরিবেশ উন্নয়ন , পলিসি নির্ধারন, নতুন ব্যাচ ৫১ তম ব্যাচের দেখাশোনা সব মিলিয়ে তখনো খুব  ব্যস্ত সময় কাটতো আমাদের । সংঘাত – সংঘর্ষ এড়িয়ে স্থিতিশীল হওয়া দরকার । সবসময় সতর্ক থাকতে হয় । ১৯/সি তে ইকবাল ভাইয়ের সাথে থাকি । রাতে তেমন একটা ঘুমাই না । মোবাইল সাইলেন্ট করি না । কোন কল এলেই সাথে সাথে রিসিভ করেন ইকবাল ভাই । ভুলে কেউ মিসকল দিলেই কলব্যাক । বাইরে কোথাও শব্দ হলে বারান্দায় বের হয়ে ঘুরে আসি । রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে একটু ঘুমাই । এরমধ্যে ফজর হয় । সালাত সালাত করে রুমে রুমে ডাকি । Nurul রনি ভাই এবং নেসার ভাইও এই কাজে তৎপর ছিলেন । সকাল ৮ টার মধ্যে উঠে কলেজে যাই । দায়িত্বশীলকে কলেজে থাকতে হবেই । ক্লাস না থাকলেও ক্যাম্পাসে থাকি । সকাল বেলা প্যান্ট শার্ট পড়ে ব্যাগ কাঁধে বের হই- বেশিরভাগ দিনেই রুমে ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা পার হয়ে যায় ।

৫১ ব্যাচ তখন আমাদের চোখের মণি । ক্যাম্পাস থেকে ফিরেই ওদের কাছে যাই । বিকালে –সন্ধ্যায় যতক্ষণ সম্ভব ওদের কাছে থাকি । আমি ছোট-খাটো মানুষ, আমাকে ওরা ছোট ভাই(!) এর মতই দেখত ! Talibul রুশো ভাই ব্যাচের পরিচালক, আমি সহকারী । রুশো ভাই খুব ভালো পরিকল্পনা মাফিক কাজ কাজ এগিয়ে নিতে লাগলেন । মহানগরীর আজাদ চৌধুরী ভাই এবং  মিজান ভাই খোঁজখবর রাখেন । ৫১ তম ব্যাচ আমাদের আশা আকাংখার কেন্দ্রবিন্দু । কঠিন পরিবেশ মোকাবেলা করে টিকে থাকার জন্য ওদেরকে খুব ভালো করে গড়ে তুলতে হবে । ওরা যথেষ্ট খাদক ব্যাচ, আমরাও অকৃপণ । মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে ঘুরতে যাই । সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয়েছে দই-চিড়া, ভ্যানিলা আর রসমালাই । ৫১ এর যে কারো মুখ চিপলে হয়তো এখনো দই-চিড়া-আইসক্রিম বের হবে !!

এমনি করে কাটছিল দিনগুলি । কিছুদিন পরেই আমাদের আশংকাকে সত্য প্রমাণিত করে একদিন ছাত্রলীগ হামলে পড়লো ৫১ তম ব্যাচের shoab সবুজের ওপর ।

৬।

সাধারণত আড়াইটার আগে হোস্টেলে ফিরতাম না- অর্থাৎ ক্যাম্পাস থেকে 51 এর শেষজনও চলে না যাওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাসেই থাকতাম । কিন্তু সেদিন একটু আগে – ২.১৫ এর দিকে ফিরেছি । দিনটি ছিল ৮ই মার্চ ২০০৯ । ব্যাগটা রেখে লতিফের দোকানে গিয়েছি ভাত খেতে । কয়েক লোকমা মুখে দিতে পেরেছি- এমন সময় anoarur আনোয়ার ফোন করলো । ভাই, সবুজকে ছাত্রলীগের ছেলেরা মারছে । জিজ্ঞেস করলাম, এখন কোথায় ? বললো- হোস্টেলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে


রুশো ভাই , সাজ্জাদ ভাই, ইকবাল ভাই সবাইকে জানানো হলো । ভাত খাওয়া বাদ দিয়ে তৎক্ষণাৎ হোস্টেলে এলাম । সবাইকে ফোন করে একত্রিত হতে বললাম । ক্যাম্পাসে গিয়ে সবুজকে উদ্ধার করতে হবে । এজন্য যা করা দরকার হয় তাই করা হবে ।

আমরা একত্রিত হচ্ছি এরই মধ্যে কিছুক্ষণের ভেতর দেখা গেল সবুজকে নিয়ে আসছে হোস্টেলে । রুশো ভাইরা গেলেন- কথাবার্তা বলে সবুজকে নিয়ে আসলেন তাঁরা ।
এদিকে আমরা প্রস্তুত – যেকোন নির্দেশ পাওয়ার জন্য । কিন্তু শেষমেষ ভালোয় ভালোয় উদ্ধার করা গেল সবুজকে । ওকে মোটামুটি ঘুষি লাথি মেরেছে ।

সবুজের জবানিতে ঘটনাটা ছিল এরকম-
  সেদিন আমরা নিয়মিত দিনের মতো ক্লাস এ গেলাম। ক্লাস শেষে ছাত্রলীগের শান্ত রজত হিমেল চাকমা সানি দেবু আমি সহ সোহান রাজী মুন্না মিজানকে লং আইল্যান্ডে নিয়ে এক এক করে আমাদের সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করে কে কোথায় থাকি। যখন আমি বললাম যে রেটিনায় থাকি তখন শান্ত চিৎকার করে বলে কালকের মধ্যে সবাইকে নিয়ে নাসিরাবাদ হোস্টেলে উঠবি । আমি বললাম যে ভাই উঠতে পারবো না যা খুশি করেন। এ কথা বলতেই হিমেল চাকমা এলোপাথারি কিলঘুষি শুরু করে। বাকিদের ছেড়ে দিয়ে আমাকে টেনে হেচড়ে হোস্টেলে নিয়ে যেতে শুরু করে । পথিমধ্যে জানতে চায় আমরা কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছি কোন কোন বড়ো ভাইকে চিনি । মনসুর দোকান পর্যন্ত আসার পর দেখি রুশো ভাই মুকুল ভাই সাজ্জাদ দাড়িয়ে আছে। তারা ছাত্রলীগের সভাপতির সাথে কথা বলে আমাকে সেখানে থেকে উদ্ধার করে ১৯ সি তে নিয়ে যায় ।তখন আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি নি ।চোখ থেকে নেমে আসে অঝোর অশ্রুধারা ........’
                           
বিকেলে আমরা বৈঠকে বসলাম । আমাদের কথা একটাই- বিনা প্রতিবাদে এই ঘটনা মেনে নেয়া যাবে না । অনেকেরই মত ছিল- যারা সবুজকে মেরেছে- ওদেরকেও মারতে হবে । কিন্তু সেটা আসলে ছিল অবাস্তব প্রস্তাব । ঐ অবস্থায় সেটা সম্ভব না । শেষমেষ অনেক আলোচনা-পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল মিছিল করা হবে ক্যাম্পাসে । এরপর যা হবার হবে । সৌভাগ্যক্রমে একদিন পর ছিল ঈদে মিলাদুন্নবী । ঈদে মিলাদুন্নবীকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার বানানো হলো । রাতে সবাই মিলে অনেক ফেস্টুন বানালাম আমরা । কর্মী সমর্থক সবাইকে দাওয়াত দেয়া হলো । অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হল । ক্ষোভ ছাপিয়ে সবার ভেতর উৎসাহ উদ্দীপনা কাজ করতে লাগলো । সকাল ৯ টায় মিছিল হবে । আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্যাম্পাসে প্রথম মিছিল ।

৭।
ফযরের পর সভাপতির মেসেজ পেলাম- মহানগরী সভাপতি কলিমউল্লাহ ভাই জরুরী বৈঠক ডেকেছেন ।
রাতের বৈঠকে তো তিনি ছিলেন, আবার কিজন্য এখন ডাকলেন ? ভাবলাম- হয়তো প্রস্তুতিমূলক কোন বিষয় হবে । বৈঠকে উপস্থিত হয়ে দেখি মহানগরী সভাপতি কলিম ভাই, সেক্রেটারি মিজান ভাই, বায়তুলমাল সম্পাদক আজাদ ভাই সবাই উপস্থিত । কুরআন তেলাওয়াতের পর কলিম ভাই সরাসরি তাঁর বক্তব্য রাখলেন । মূলকথা হচ্ছে- গতকাল রাতে কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল করিম ভাই চট্টগ্রাম এসেছেন । রাতে মহানগর অফিসে বান্না, বাপ্পারা ফেস্টুন বানাচ্ছিল । তিনি দেখে খোঁজখবর নিয়েছেন । তিনি পরামর্শ দিয়েছেন – মিছিল না করার । কেন্দ্রীয় সভাপতির এরকম পরামর্শ একধরণের নির্দেশ ।

আমাদের মাথায় বাজ পড়লো । এ অসম্ভব । এই ঘটনাকে যদি বিনা প্রতিক্রিয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে ছাত্রলীগ আমাদের গায়ে হাত তোলাকে কিছুই মনে করবে না । তারা এটাকে রুটিন বানিয়ে ফেলবে । আমরা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের ধরে  রাখতে পারবো না । মানোন্নয়ন করাতে পারবো না । এটা আমাদের অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিবে ।

সবাই এই পরামর্শের প্রতিবাদ করলেন । কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়তো প্রকৃত পরিস্থিতি জানেন না । আমি কী বলেছিলাম মনে নেই- কিন্তু এই মিছিল না করা হলে সংগঠনের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা যেন স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম । আমার 51 আমার চোখের সামনে হারিয়ে যাবে ।

অজান্তেই চোখ ভিজে গেল । দাতে ঠোট চেপেও নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না । হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ফেললাম । রুমে আমার কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগলো । কয়েকজন ভাই বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম হলেন । আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার মত অবস্থাও কারো ছিল না ।

অবশেষে আগের সিদ্ধান্তই বহাল রাখা হলো ।
আমরা ক্যাম্পাসে মিছিল করলাম । সবটুকু শক্তি দিয়ে শ্লোগান দিলাম- ‘আল্লাহু আকবার’ । ছাত্রলীগের যারা ক্যাম্পাসে ছিল তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো । বাধা দেয়ার মত অবস্থা তাদের ছিল না । ছাত্রলীগের কাছে স্পষ্ট মেসেজ গেল- ফার্স্ট ইয়ারকে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে ছাড় দেয়া হবে না । অধ্যক্ষ গোফরান স্যার রাজনীতি বোঝা মানুষ । তিনি আমাদের সভাপতিকে বললেন- শিবির ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করে, তাতো জানতাম না !

৮।
বহুদিন ধরে বন্ধুরা মিলে কোথাও যাওয়া হয়না । ফার্স্ট প্রফ পরীক্ষার আগে মারামারি হলো (১০ জুলাই ২০০৮, সে কথা পরে বলবো) , মেডিকেল লাইফের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ফার্স্ট প্রফ দিলাম , এরপর ইয়ার এন্ডিং প্রোগ্রাম নিয়ে ঝামেলা হলো, ফিশিং হলো, আবার মারামারি হলো, সরকার চেঞ্জ হলো – কত কিছু হয়ে গেলো । কোথাও একটু ঘুরে আসতে পারলে ভালো লাগতো । একপ্রকার জোরাজুরি করেই অনুমতি নিলাম আমরা 49 . ঘুরতে যাবো কোথাও, দূরে যাওয়ার পারমিশন নাই- পুরো একটা ব্যাচ, বলা চলে শক্তিশালী ব্যাচ- ক্যাম্পাসের বাইরে দূরে কোথাও গেছে জানলে ছাত্রলীগ সুযোগ নিতে পারে । অনুমতি পাওয়া গেল- পারকি বীচে যাওয়ার ব্যাপারে ।
                 
যথারীতি উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে প্রস্তুতি নিলাম আমরা । শুক্রবার । ১৩ই মার্চ ২০০৯ । মিনিবাস নিয়ে গান গাইতে গাইতে গেলাম পতেঙ্গা বীচ । সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে নৌকা ভাড়া করে পার হলাম ওপারে । চলে গেলাম পার্কি বীচের কাছাকাছি । তখনো জুমার নামাজের সময় হয়নি ।
খবর এলো- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাথে শিবিরের মারামারি হচ্ছে । গুজব শোনা যাচ্ছে যে ছাত্রলীগের সভাপতি মারা গেছে । তাড়াতাড়ি ব্যাক করো, সেরকম কিছু হলে আমাদের ক্যাম্পাসেও ইফেক্ট আসতে পারে ।

আমরা সাথে করে দুপুরের খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম । কোনমতে খাবার খেয়ে নিলাম , গলা দিয়ে নামছিল না কিছুই । টেনশন হচ্ছিল- আমরা ঘুরতে আসার কারণে যদি সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয় !

দেরি না করে আমরা ঐ অবস্থাতেই ফিরতি পথে যাত্রা করলাম । ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরে এলাম হোস্টেলে । ততক্ষণে খবর পেয়ে গেলাম- ছাত্রলীগের কেউ না, শহীদ হয়ে গেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানী ভাই । সবাই আমরা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে 19/C তে খবর দেখছিলাম ।

আঁখি জলে ভাসি আঁখি জলে ভাসি
আঁখি জলে ভাসে বুক
আঁখিতে যখন ভেসে ওঠে হায়
নোমানীর চাঁদ মুখ......

৯ ।
তখন ডাব্লিউ ব্লকের নিচতলায় থাকি । আমি 4W তে,  মাসুম থাকে 1w তে । বাকি রুম ও সিটগুলো বরাদ্দ ছিল কিছু লোকাল ভাইদের জন্য যারা তেমন একটা থাকতেন না ।  চকি-তোষক ছিল, কিছু বই-পুস্তক ছিল, মাঝে মাঝে আসতেন । বাস্তবিক অর্থে পুরো ডাব্লিউ ব্লকের নিচতলায় আমি আর মাসুম থাকি ।  দুই তলায় 11w তে থাকতো কিবরিয়া, ইয়াসিন, রাগিব । দিনেরবেলা আমি তেমন একটা হোস্টেলে থাকতে পারতাম না- নানান কাজে বাইরে থাকতে হত । ১১w তে ইয়াসিনরা দিনে-রাতে শর্ট পিচ ক্রিকেট খেলতো । ঐ রুমটা হয়ে উঠেছিল মোটামুটি আমাদের 49 ব্যাচের কমনরুম ।

এই সময় ফেসবুকে Voice Ban নামক এক ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী আইডি দেখা যায় । সেই আইডির একটা স্ট্যাটাসে কমেন্ট করে ভারতের সমর্থকদের নেড়ি কুত্তা আখ্যা দেয় ইয়াসিন । ইয়াসিনের আগের একটা কমেন্ট করেছিল ছাত্রলীগের চামচা, 49 ব্যাচের ওয়েস্ট ইন্ডিজ নাজমুল ।
ইয়াসিনের কমেন্টটাকে সে নিজের ওপর নিয়ে নেয়,  অর্থাৎ সে নিজেকে ‘নেড়ি কুত্তা’ ভেবে নিয়েছিল ।

যাহোক, ৫ই এপ্রিল ২০০৯ । রাত সাড়ে দশটা কি এগারোটা হবে । আমি নিচতলায় আমার রুম থেকে আড্ডা দেয়ার উদ্দেশ্যে 11w তে গেলাম । ওমা , গিয়ে দেখি লঙ্কা কান্ড ! ওয়েস্ট ইন্ডিজ নাজমুল, সুমন, জুম্মা, রাজীব, রাসেল ওরা ঐ রুমে গেছে । ফেসবুকের সেই কমেন্টের জন্য ওরা ইয়াসিনকে ধমকাধমকি করছে । ইয়াসিনও যথাসাধ্য প্রত্যুত্তর করছে । জুম্মার উদ্ধত ভঙ্গি । সে হাত উচিয়ে ‘কল্লা ফালাই দিমু’, ‘কাইট্টা নদীতে ভাসাই দিমু’ , ‘শহীদ কইরা দিমু’ এইসব বলছে । কিবরিয়া , রাগিব, রিয়াদ, তুহিন ওদের বোঝানোর চেষ্টা করছে ।

আমাদের রুমে এসে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে ! আমার মাথা গরম হয়ে গেল । গলা চড়িয়ে জুম্মাকে বললাম- ‘ঐ হাত নামায়া কথা ক’ । তুই বেশি বাড়াবাড়ি করতেছিস । ফেসবুকের জিনিস নিয়া রুমে কী ? বিরাট বাহাদুর হয়ে গেছিস !

এইবার তো আমার সাথে লেগে গেলসেও গরম, আমিও গরম । দুজনেই চিল্লাচ্ছি যার যার মত । কেউ জুম্মাকে আটকায় কেউ আমাকে আটকায় । রিয়াদ আমাকে বারবার বলছিল- এই মুহসিন এই মুহসিন , আপনি কি অবুঝ হয়ে গেলেন নাকি ? 

জুম্মা তো কথা জানে না – ঘুরে ফিরে কথা ছিল ঐকয়টাই । সে বলে তুই হাত নামা, আমি বলি তুই হাত নামা । ও বলে তোর হাত ভাইঙ্গা দিমু, আমি বলি – তোর হাত মচকায়া দিমু । সে বলে কল্লা ফালাই দিমু, আমি বলি- আসিস দেখা যাবে কারটা থাকে !

এরি মধ্যে দেখি জনিও চলে এসেছে ।
পরিবেশ খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে সুমন ও রাসেল বের হয়ে গেল । ধীরে ধীরে জুম্মাও বের হয়ে গেল । 
এই ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে – এ নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে আমরা আবার খেলা শুরু করলাম । সিদ্ধান্ত হলো – আগামী কয়েকদিন বন্ধুরা আমাকে চোখে চোখে রাখবে ।

১০।
এপ্রিল মাসের কোন একদিন বৈঠক ডাকা হলো । উত্তপ্ত ক্যাম্পাস, কত বৈঠকই তো হয় ! গেলাম ঠিকঠাকমত । বৈঠক শুরুর কিছুক্ষণ পরেই ইকবাল ভাই ঘোষণা করলেন, বৈঠকের পরবর্তী অংশ পরিচালনা করবেন মহানগরী সভাপতি কলিমউল্লাহ ভাই ।
মাথায় বাজ পড়লো । এই কথার অর্থ জানা আছে । দায়িত্বশীল পরিবর্তন !  কিছুদিন ধরেই এরকম কানাঘুষা শুনছিলাম ।
যথারীতি কুরআন তেলাওয়াতের পরে কলিম ভাই ঘোষণা করলেন – এখন থেকে ইকবাল মাহমুদ ভাই মহানগরীর জনশক্তি হিসেবে কাজ করবেন । মেডিকেল কলেজের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সাজ্জাদুর রহমান ভাই ।
সবাই আলহামদুলিল্লাহ্‌ পড়লাম । শপথ শেষ হলো । সেক্রেটারী মনোনীত হলেন ইমরানুল হুদা ভাই । বৈঠক শেষ হলো ।
সবাই রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল । হঠাৎ করে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না । দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম ।
মেডিকেল কলেজে পা দেয়ার আগে থেকে ইকবাল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ।  কত জায়গায় ঘোরাঘুরি, কত রাতের গল্প, সংগঠন নিয়ে একসাথে কত প্ল্যান, কত কাজ, সবসময়ের জন্য মাথার ওপর একজন ছায়া , একজন গাইড ছিলেন ইকবাল ভাই – সব যেন মনে পড়ে গেল । এটাই বাস্তবতা , মেনে নিতেই হবে । তবু হারানোর বেদনা সইতে পারেনা মন ।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল সংগঠন, এই সময়ে ইকবাল ভাইয়ের নেতৃত্ব ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত । দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সবাইকে সাথে নিয়ে দিনরাত কাজ করেছেন তিনি । শরীর তখনো অসুস্থ , রাত হলে কোমরের ব্যথা বাড়ে । তবুও কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত অবধি- নিরলস কাজ কাজ আর কাজ ।
হোস্টেলে ওঠার পরেও সেই পেরেশানি কমে না । আমি তখনো রুমমেট । ১৯/সি তে থাকি । সবসময় কান খাড়া রাখতে হয় । কোথাও একটু শব্দ হলে ইকবাল ভাই উঠে পড়েন, ‘মুহসিন, চলতো দেখে আসি কোন সমস্যা হলো কিনা’ । মোবাইল একেবারে কানের কাছে , কাউকে যেন দ্বিতীয়বার কল দিতে না হয় । একবার রিং হলেই রিসিভ , কোন সমস্যা হলো নাতো ?
ফযরের নামাজের পর কোন কোনদিন শরীরচর্চার প্রোগ্রাম, আটটার পরেই কলেজের উদ্দেশ্যে । ফাইনাল ইয়ারের শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা । এইতো কাটছিল সময়গুলো । উনাকে দায়িত্বে রাখাটা জুলুম হয়ে যাচ্ছিল , কিন্তু আমার কথা ছিল- ভাই, থেকে যান আর কিছুদিন । সভাপতির দায়িত্বে থেকেই ফাইনাল প্রফ দেন । সব কাজ আমরাই করবো । রাজনৈতিক ভাবে আমাদের আরো স্থিতিশীল হবার জন্যে এটা দরকার । আর ছাত্রলীগের সভাপতি তো ঠিকই ৪৬ এর তানভীর ভাইই আছে ।
                                          
যদিও সত্য না, তবু মনে হচ্ছিল যেন ইকবাল ভাইকে চিরতরে হারালাম । আমি কাঁদছিলাম । আমার কান্না নীরব থেকে মাঝে মাঝে কিছুটা সরবও হয়তো হয়েছিল । মাসুদ ভাই, নেসার ভাই এসে আমার পাশে বসে শান্ত করার চেষ্টা করলেন । ইকবাল ভাই এলেন । খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল, চোখমুখ ধুয়ে একটু পর খাওয়া শুরু করলাম ।
শুরু হলো নতুন দায়িত্বশীলের নেতৃত্বে সংগ্রামের অনিশ্চিত পথে নতুন করে যাত্রা ।

১১।
২০০৮ এর ১০ জুলাইতে যে মারামারি হয়েছিল তাতে আমাদের কয়েকটি রুম পুড়িয়ে দেয় ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ । 7W, 9C, 15B   9C ছিল সেসময় আমার রুম । আমার রুমমেট ছিল রাগিব, 50 ব্যাচের সৈকত, আশরাফ, সোহাগ ।
রুমগুলো এতদিন পরিত্যক্ত ছিল । কলেজের পক্ষ থেকে সিলগালা করা ছিল । মেরামত হচ্ছিল ধীরে ধীরে । মোটামুটি মেরামত হয়েছে । দরজা , জানালা লাগানো হয়েছে ।  ইলেক্ট্রিসিটি লাইন লাগানো হয়েছে । মেঝেটা এখনো প্লাস্টার করা হয় নাই । আর কিছুদিনের মধ্যে হয়তো মেরামত শেষ হবে । আমাদের ধারণা, সি ব্লকের ২ তলায় এখন যেহেতু সব রুম ছাত্রলীগের দখলে , তারাই হয়তো দখল করে ফেলবে ৯সি । কিন্তু এভাবে তো রুম বিনা কথায় ছেড়ে দেয়া যায় না ।
                                                                                    
মে মাসের মাঝামাঝি একদিন । সিদ্ধান্ত হলো আমরা ৯সি দখলে নেব । আমাদের রুম , অধিকার আমাদেরই । সে অনুযায়ী সকাল দশটার দিকে কলেজ থেকে হোস্টেলে ফিরলাম । কিছুক্ষণ পরেই আমি, রাগিব, মাসুম, রিয়াদ , ইয়াসিন আমরা আমাদের রুম থেকে চকি তোষক বালিশ নিয়ে 9C তে নিয়ে গেলাম । দুইপাশে বিছানা পাতলাম । সাজ্জাদ ভাইসহ সিনিয়র ভাইরা উপরে থাকলেন । সার্বক্ষণিক আপডেট দেয়া হচ্ছিল ।
9C তে গোছগাছ করছি এমন সময় খবর পেয়ে ক্যাম্পাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছাত্রলীগের ছেলেরা চলে এলো । জুম্মা, সুমন, রাজীব, রাসেল, প্রভাস...আরো  কয়েকজন । সাথে জুনিয়র কয়েকজন । এসেই চিলাচিল্লি । আমাদের সাথে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল ।

ওদের কথা হলো রুম এখনো মেরামত কমপ্লিট হয়নাই , এখন কেন উঠসি আমরা । রুমে ওঠা যাবে না । ঝামেলা হবে ।  আমাদের কথাও স্পষ্ট, আমার রুম আমি থাকবো । মেরামত লাগবে না । ঝামেলা হলে হবে ।
কোন লাভ হলো না তর্কে । আমরা নির্বিকার বসে থাকলাম রুমের ভেতরআমি, রাগিব, মাসুম, রিয়াদ, ইয়াসিন । বাইরে ওরা লাঠি-রড- হকিস্টিক-রামদা নিয়া ঘোরাঘুরি করা শুরু করলো । উদ্দেশ্য আমাদের ভয় দেখানো । টুংটাং শব্দ করছে । গালাগালি করছে ।
ইয়াসিন এরই মাঝে ঘুমিয়ে পড়লো কাঁথা গায়ে দিয়ে । রাগিব ভাই সাহাবীদের গল্প বলা শুরু করলেন । আর আমি আমার প্রিয় ‘কাদেসিয়ার যুদ্ধের ঘটনা’ বলা শুরু করলাম । নো টেনশন ।

এরই মাঝে আরো দুএকবার ওরা এসে কথা বলে গেল । আমরা ভাইয়াদের জানালাম পরিস্থিতি । উনারাও খেয়াল রাখছিলেন । ওদিকে ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে এবং স্যারদের সাথে ভাইয়াদের যোগাযোগ হচ্ছিল 
পরিস্থিতির চূড়ান্ত মুহূর্তে সাজ্জাদ ভাইয়ের নির্দেশনা এলো , জিনিসপত্র রেখে তোমরা চলে আসো । এনাফ ফর নাউ ।
আমরা ইয়াসিনকে ঘুম থেকে তুলে তিনতলায় চলে গেলাম ।

হোস্টেলে ওঠার পর এটা ছিল সংগঠনের জন্য একটা সাহসী পদক্ষেপ । 

১২। 
৩১ শে মে ২০০৯ । বর্ষাকাল । বরাবরের মত ক্যাম্পাসে আধূনিকের ধূমপানবিরোধী র‍্যালী অনুষ্ঠিত হলো । সিনিয়র ভাইয়েরা কিছুটা টেনশনে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল সব । সবাই যার যার মত ক্লাসে, রুমে ফিরে গেল ।
ফুটবল খেলা তখন আমাদের নিত্যদিনের রুটিন । সকালে অথবা বিকালে , খেলা হবেই । হয় আমাদের চমেক মাঠে অথবা প্যারেড গ্রাউন্ডে । বৃষ্টি নামলে আর সকাল বিকালের হিসাব থাকেনা , বৃষ্টি নামলেই খেলা হবে ।
সেদিনও বৃষ্টি নেমেছিল । ফলাফল যা হবার তাই । ফুটবল নিয়ে আমরা আমাদের চমেক মাঠে নেমে গেলাম । খেলা হল যথারীতি ।
খেলাশেষে ফিরছি । ভেজা শরীর, কাদায় লেপ্টানো । আমরা যারা সিনিয়র – হোস্টেলে থাকি । ফার্স্ট ইয়ার ৫১ ব্যাচ থাকে বাইরে ।  ওরাও আমাদের সাথেই আসছিল, হোস্টেলের ভেতর দিয়ে বের হয়ে চট্টেশ্বরী রোড হয়ে চকবাজার যাবে । কয়েকজনের ব্যাগও সম্ভবত হোস্টেলে ছিল । র‍্যালীর পর চলে এসেছে ।
মনসুরের দোকানের সামনে এসেছি , এমন সময় ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি মুইদ ভাই, রিপন সরকার ভাই , সাথে আরো কয়েকজন আমাদের পথ আটকে দাড়ালো । ফার্স্ট ইয়ারের যারা ছিল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । নাম কী ? কোথায় থাকো ? শিবিরের সাথে কেন থাকো ? ইত্যাদি । সোহানের গায়ে একটা টি শার্ট ছিল বাংলাদেশের পতাকার ছবিওয়ালা । মুইদ ভাই বলে- গায়ে দিছ বাংলাদেশের পতাকা , থাকো রাজাকারদের সাথে । তারপর রাজাকার সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া শুরু করলো ।
তোফা ভাই ছিলেন সাথে ।(জুয়েল এবং অপু ভাইও সম্ভবত ছিলেন)  উনি এতক্ষণ মনসুরের দোকানে কলা বিস্কিট খাচ্ছিলেন । আমিও । আমি ইতোমধ্যেই ফোন করে দিয়েছি সভাপতি সাজ্জাদ ভাইকে-  এখানে আমাদের আটকিয়েছে । (পরিবেশ-পরিস্থিতি যা ছিল- আমি কখনো মোবাইল ছাড়া থাকতাম না । টয়লেটে গেলেও মোবাইল নিয়ে যেতাম । ) আমাদের ধারণা ছিল – টুকটাক কিছু কথা বলে হয়তো পথ ছেড়ে দিবে । কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল, ওদের কথা ফুরায় না ।
তোফা ভাই এগিয়ে এলেন । বললেন, ঠিক আছে কথাবার্তা শেষ কর । ওদের ছেড়ে দে , ওরা যাক ।
এইবার তোফা ভাইয়ের সাথে কথা শুরু হলো । তর্কাতর্কি চললো কিছুক্ষণ । আমি এরই মধ্যে ফোনে আরো কয়েকজনকে জানালাম । আমার ফোন করা দেখে মুইদ ভাই বলে- ‘এই ছেলেটা, এই ছেলেটাকে দেখলেই আমার কেমন লাগে’ !
এরই মধ্যে সাজ্জাদ ভাই চলে এলেন । তারপর আরো কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডা শেষে সাজ্জাদ ভাই আমাদের পাঠিয়ে দিলে আমরা সবাই আমাদের রুমে চলে গেলাম ।

আমার রুম নিচতলায় । ডব্লিউ ব্লকে । নিচে একা একা বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবেনা । তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নিলাম । এরই মাঝে লবিতে চিৎকার চেচামেচি । কেউ একজন ফোন করলো উপরে যাবার জন্য । গেলাম । আমাদের রেখে সাজ্জাদ ভাইরা নিচে গেলেন কথাবার্তা বলার জন্য । ওদের দাবি- তোফা আমাদের সহ-সভাপতির সাথে বেয়াদবি (!) করেছে , তোফাকে ক্ষমা চাইতে হবে । আমরা কোনভাবেই তোফা ভাইকে নিচে পাঠাবো না । বেয়াদবি আবার কি ? তোফা ভাই , মুইদ ভাই ইয়ারমেট । ইয়ারমেটের সাথে আবার বেয়াদবি কী ? যা হবার হইছে , দ্যাটস অল ।

এরই মধ্যে ইমরান ভাই বাইরে থেকে হোস্টেলে ঢুকার সময় উনাকে ছাত্রলীগের ছেলেরা ধাওয়া দেয় । টেনে উনার শার্ট ছিড়ে ফেলে । পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছিল । হোস্টেলে উঠার মাত্র তিন মাস হয়েছে, এরই মাঝে আবার মারামারি করে হোস্টেল বন্ধ হলে আমাদেরই ক্ষতি । সাজ্জাদ ভাই কথা বলে এলেন ওদের সাথে যে , তোফা এসে কোলাকুলি করে যাবে মুইদের সাথে , জুনিয়ররা দূরে থাক ।
সেমতেই তোফাভাই নিচে গেলেন সিনিয়র দায়িত্বশীলদের সাথে । সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই হলো । কোলাকুলি হলো , মিটমাট হলো । এরপর যখন সবাই আবার উপরে উঠছেন তখন সুমন-জুম্মা-শান্ত-হিমেল এরা ধর ধর করে তেড়ে আসে পেছন থেকে । সবাই উপরে উঠে আসে , সাজ্জাদ ভাই একটু পরে আসেন ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পেলাম আমরা যে ৪৮ রনি ভাইকে ছাত্রলীগের ছেলেরা লবিতে মেরেছে । রনি ভাই ঐসময় কীভাবে লবিতে গেলেন আর কীভাবে  সাজ্জাদ ভাইসহ সবাই চলে আসার পরেও পেছনে থেকে গেলেন – সেটা আমার কাছে এখনো রহস্য । রনি ভাইকে কখনো জিজ্ঞেস করাও হয়নি ।

সংঘাত এড়ানোর প্রয়োজনে আমরা বড় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না । সারাদিন সতর্ক থাকলাম সবাই ।

টীকা-
১ ।  র‍্যালীর পরপরেই দায়িত্বশীল ভাইদের অনুমতি না নিয়ে খেলতে যাওয়া ঐদিন আমাদের ভুল ছিল । তাছাড়া খেলার পর ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের হোস্টেলের দিকে আসতে দেয়াও ভুল ছিল ।
২।  সবকিছু মনসুরের দোকানের সামনে প্রথম দফা আলাপেই মিটমাট হয়েই গিয়েছিল । দ্বিতীয় দফা ঝামেলার মূলে ছিল সুমন ও জুম্মার কারসাজি । ওরাই জুনিয়রদের জড়ো করে ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিল ।
৩।  শেষপর্যন্ত তোফা ভাইসহ দায়িত্বশীলগন নিচে নেমে মিটমাট করাটা সঠিক পদক্ষেপ ছিল । 
৪। সবকিছুর শেষে ৪৮রনি ভাইয়ের নির্যাতিত হওয়াটাই ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার ।
চলবে...