রাত প্রায় দু'টা বেজে গেছে। ডিউটি আওয়ার শেষ হতে আরো ছয় ঘন্টা বাকি। মুনীর এখন আছে সরকারী হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে।
আজকে এই ওয়ার্ডে এডমিশন নেই, মানে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে অন্য ওয়ার্ডে। সেজন্য কিছুটা রিলাক্স হয়ে বসার সুযোগ পাওয়া গেল এতক্ষণ পর হলেও। এডমিশন নাইট হলেতো এক মুহূর্ত বসার সুযোগ হত না।
ফেসবুকে লগ ইন করতেই মুনীরের চোখে এলো অনেক রোমান্টিক স্ট্যাটাস -আজকে পূর্ণিমা রাত। বাহিরের আকাশে নাকি অসাধারণ আলো ছড়াচ্ছে পূর্ণ চাঁদ।
মুনীর কোথায় যেন পড়েছে, কবিরা নাকি খুব সৌন্দর্যপিপাসু হয়। চা-খোর যেমন মজা করে চা খায়, কবিরা নাকি সেরকম একটু একটু করে সবকিছুর সৌন্দর্য চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করে। মুনীর কবি নয়, কিন্তু সেও সৌন্দর্য পিয়াসীদের একজন। এই মুহূর্তে মুনীরের মনে পড়ে, হোস্টেলের ছাঁদে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কত রাত কাটিয়ে দিয়েছে সে। কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাতার ফাঁকে দেখেছে চাঁদের লুকোচুরি। পশ্চিমের চাঁদ একসময় ঢলে গেছে পূবের আকাশে, পূবের চাঁদ পশ্চিমে। একেকটা মুহূর্তের একেকরকম সৌন্দর্য। অমাবশ্যার রাতে যখন পেঁচারা উড়ে যায়, তারও একটা অন্যরকম সৌন্দর্য আছে।
"স্যার একটু আইবেন?"
চিন্তায় ছেদ পড়ে মুনীরের। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে এক পিচ্চি মেয়ে। বয়স সাত কি আট হবে হয়তো।
"কী হয়েছে বাবু?" নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে মুনীর।
"স্যার আমার মায়ের শ্বাসকষ্ট। মায় আপনারে ডাকতে কইছে।"
স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে দ্রুত উঠে পড়ে মুনীর। চলো চলো চলো, পিচ্চিটাকে তাগাদা দিয়ে নিয়ে চলে নির্দিষ্ট বেডের দিকে। যাওয়ার সময় নার্সকেও একটা হাঁক দিয়ে যায়। সিস্টার তেইশ নাম্বারে আসেন।
রোগীর ডায়াগনোসিস একিউট সিভিয়ার এজমা। গতকাল ভর্তি হয়েছে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে। পাক্কা দুই ঘন্টা চেষ্টার পর তার অবস্থা স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়েছিল।
শ্বাসের কষ্ট খুব খারাপ। জীবন সংশয়ের কথা বাদ দিলেও, একজন মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা, এটা কি যা-তা কথা? মুনীর ভাবে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের কত আরামে রেখেছেন। তবু মানুষ কত অকৃতজ্ঞ। মুনীরের মনে হয়, একজন মানুষের যদি কিছুই না থাকে, সে যদি শুধু নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারে- তাতেই তার মস্তক অবনত করে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। দুনিয়ায় কিছু কিছু মানুষকে শ্বাসকষ্টের রোগ দিয়ে আল্লাহ হয়তো সকল মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন তাঁর অশেষ নেয়ামতের কথা।
মুনীর রোগীর পাশে বসে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলো। শুধু ওষুধ দিয়ে ক্ষান্ত নয়, মুনীর সবসময় চেষ্টা করে রোগীকে পাশে দাঁড়িয়ে মানসিক শক্তি যোগানোর। যদিও সবসময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। মুনীরের অবজার্ভেশান হলো, ওষুধের পাশাপাশি মানসিক শক্তি যোগালে রোগীর উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। একবার এমন হলো, বয়স্ক এক রোগী হাত ধরে বলে, বাবা আপনি আমার পাশে থাকেন, আপনি গেলে আমি বাঁচবো না। সত্যিই দেখা গেলো, মুনীর সেই রোগীর কাছে থাকলে তার শ্বাসকষ্ট কমে যায়, আবার দূরে গেলে বাড়ে। সাইকোলজিকাল ব্যাপার স্যাপার।
ঘড়ির কাঁটায় তিনটা অতিক্রম করে গেছে। হেঁটে হেঁটে রোগীদের অবস্থা দেখছে মুনীর। রাতের এই প্রহরে প্রায় সব রোগীই ঘুমিয়ে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে মুনীর আবার এসে দাঁড়ায় তেইশ নাম্বার বেডের পাশে। এক বেডেই মা মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। একটু আগে কী কষ্টই না পাচ্ছিলো মা-টা। আর বাচ্চাটার মুখে ফুটে উঠেছিল কী সীমাহীন উৎকন্ঠা!
আজ বাইরের পূর্নিমা চাঁদ দেখা হয়নি মুনীরের। কিন্ত এই মুহূর্তে হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে ঘুমন্ত রোগীদের মুখ যেন একেকটা চাঁদ হয়ে ধরা দেয় মুনীরের চোখে। ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলো এই প্রশান্তির কাছে ম্লান হয়ে যায়।