‘বাবা একটু আসবেন, রোগীর খুব শ্বাসকষ্ট হইতাছে’ ।
চোখ তুলে তাকালো মুনির । দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ । বেড নাম্বার তেত্রিশ, মনে পড়লো মুনিরের । ঐ রোগীরই শ্বাসকষ্ট হবার কথা ।
হাসপাতালে নাইট ডিউটিতে আছে ডাঃ মুনির । কয়েক মিনিট হলো, সবগুলো রোগী দেখা শেষ করে ডক্টরস রুমে এসে বসেছে । এরই মধ্যে বৃদ্ধ চলে এসেছেন ডক্টরস রুমের দরজায় ।
বৃদ্ধের স্ত্রীই তেত্রিশ নম্বর বেডের রোগী । মায়মুনা বেগম । অনেকক্ষণ ধরেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তাঁর । মুনির এসে কিছু জরুরি ব্যবস্থা নেয়ায় শ্বাসকষ্ট কমেছিল কিছুটা । কিন্তু এরই মধ্যে আবার বেড়ে গেছে । রোগীর যা অবস্থা, শেষমেষ হয়তো তাকে বাঁচানো যাবেনা । বাঁচানোর জন্য আরো কিছু চেষ্টা করা যায়, কিন্তু সেটা এইখানে, সরকারি হাসপাতালের এই জেনারেল ওয়ার্ডে সম্ভব নয় ।
বৃদ্ধের সাথে আবারো রোগীর কাছে গেল মুনির । আরো একবার পরীক্ষা করে দেখে দায়িত্বরত নার্সকে নতুন কিছু নির্দেশনা দিল । তারপর বৃদ্ধকে একপাশে ডেকে নিলো সে।
‘বাবা, আপনাকে তো আমি আগেও বলেছি, আপনার রোগীর অবস্থা খুব খারাপ । তাঁর কিডনিতে সমস্যা আছে, কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না । ফুসফুসে জীবাণু সংক্রমণ হয়েছে, পানি জমে গেছে । সেকারণে ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছেন না । শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে । হার্টের ওপর চাপ বাড়ছে । যেকোন সময় হার্ট এটাক হতে পারে । যেকোন কিছু ঘটে যেতে পারে । আইসিইউ তে নিতে পারলে শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে । কিন্তু এই হাসপাতালের আইসিইউ তে এই মুহূর্তে কোন বেড খালি নাই । আপনি কি অন্য কোথাও নিতে পারবেন?’
বৃদ্ধ কোন জবাব দিলেন না।
মুনির খেয়াল করলো, বৃদ্ধের চোখ ছলছল করছে । অদ্ভুত শুন্যতা সেখানে । মুখে বলার প্রয়োজন নেই, কখনো কখনো চোখের ভাষাই সব বলে দেয় । বুঝে ফেললো মুনির, এখানেই যা হবার হবে, এর চেয়ে বেশি কিছু করার সামর্থ বৃদ্ধের নেই ।
সুযোগ-সামর্থের মধ্যে যা করার আছে, সবকিছু করে ডিউটি রুমের দিকে পা বাড়ালো মুনির । একবার পেছন ফিরে দেখলো, বৃদ্ধ গিয়ে বসেছেন স্ত্রীর বিছানায় ।
আবেগের একটা তরঙ্গ যেন ছুঁয়ে গেল মুনিরকেও । 'বৃদ্ধ' ! আমরা কত সহজেই শব্দটা উচ্চারণ করি! অথচ একদিনে কেউ বৃদ্ধ হয়না, হওয়া যায়না। বৃদ্ধ হতে হলে পৃথিবীর মাটিতে একটা সম্পূর্ণ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়।
তেত্রিশ নম্বর বেডে বসে থাকা এই দু’জন মানুষ কতবছর একসাথে কাটিয়েছেন কে জানে ! কয়েক যুগ তো হবেই । অথচ কী অদ্ভুত! আজ রাতেই হয়তো চিরবিচ্ছেদ হয়ে যাবে দু’জনের মধ্যে । একজন চিরতরে হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে, আরেকজন অপেক্ষা করবে এমনই কোন দিনের । এমনই কোন রাতের । আর কখনো এই দুজনের দেখা হবে কিনা, কেউ জানে না ।
মুনির ভাবলো, এই মুহূর্তে বৃদ্ধের যে অনুভূতি, পৃথিবীর কোন কবি কিংবা কোন ঔপন্যাসিক কি কখনো তা বর্ণনায় তুলে আনতে পারবে?
বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মুনিরের । এরকম সময়ে নিজেকে খুব অসহায় লাগে তার । নিজেকে পরাজিত মনে হয়, ব্যর্থ মনে হয়।
মানুষের 'ডেথ সার্টিফিকেট' লেখা কোন সহজ কাজ নয়। কিন্তু এটাও সত্য, মানুষ অমর নয়। মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না। প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।
ডক্টরস রুমের পুরনো কাঠের চেয়ারটিতে বসে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় মুনির- ‘আমরা রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি; মৃত্যু নয়’।
চোখ তুলে তাকালো মুনির । দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ । বেড নাম্বার তেত্রিশ, মনে পড়লো মুনিরের । ঐ রোগীরই শ্বাসকষ্ট হবার কথা ।
হাসপাতালে নাইট ডিউটিতে আছে ডাঃ মুনির । কয়েক মিনিট হলো, সবগুলো রোগী দেখা শেষ করে ডক্টরস রুমে এসে বসেছে । এরই মধ্যে বৃদ্ধ চলে এসেছেন ডক্টরস রুমের দরজায় ।
বৃদ্ধের স্ত্রীই তেত্রিশ নম্বর বেডের রোগী । মায়মুনা বেগম । অনেকক্ষণ ধরেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তাঁর । মুনির এসে কিছু জরুরি ব্যবস্থা নেয়ায় শ্বাসকষ্ট কমেছিল কিছুটা । কিন্তু এরই মধ্যে আবার বেড়ে গেছে । রোগীর যা অবস্থা, শেষমেষ হয়তো তাকে বাঁচানো যাবেনা । বাঁচানোর জন্য আরো কিছু চেষ্টা করা যায়, কিন্তু সেটা এইখানে, সরকারি হাসপাতালের এই জেনারেল ওয়ার্ডে সম্ভব নয় ।
বৃদ্ধের সাথে আবারো রোগীর কাছে গেল মুনির । আরো একবার পরীক্ষা করে দেখে দায়িত্বরত নার্সকে নতুন কিছু নির্দেশনা দিল । তারপর বৃদ্ধকে একপাশে ডেকে নিলো সে।
‘বাবা, আপনাকে তো আমি আগেও বলেছি, আপনার রোগীর অবস্থা খুব খারাপ । তাঁর কিডনিতে সমস্যা আছে, কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না । ফুসফুসে জীবাণু সংক্রমণ হয়েছে, পানি জমে গেছে । সেকারণে ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছেন না । শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে । হার্টের ওপর চাপ বাড়ছে । যেকোন সময় হার্ট এটাক হতে পারে । যেকোন কিছু ঘটে যেতে পারে । আইসিইউ তে নিতে পারলে শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে । কিন্তু এই হাসপাতালের আইসিইউ তে এই মুহূর্তে কোন বেড খালি নাই । আপনি কি অন্য কোথাও নিতে পারবেন?’
বৃদ্ধ কোন জবাব দিলেন না।
মুনির খেয়াল করলো, বৃদ্ধের চোখ ছলছল করছে । অদ্ভুত শুন্যতা সেখানে । মুখে বলার প্রয়োজন নেই, কখনো কখনো চোখের ভাষাই সব বলে দেয় । বুঝে ফেললো মুনির, এখানেই যা হবার হবে, এর চেয়ে বেশি কিছু করার সামর্থ বৃদ্ধের নেই ।
সুযোগ-সামর্থের মধ্যে যা করার আছে, সবকিছু করে ডিউটি রুমের দিকে পা বাড়ালো মুনির । একবার পেছন ফিরে দেখলো, বৃদ্ধ গিয়ে বসেছেন স্ত্রীর বিছানায় ।
আবেগের একটা তরঙ্গ যেন ছুঁয়ে গেল মুনিরকেও । 'বৃদ্ধ' ! আমরা কত সহজেই শব্দটা উচ্চারণ করি! অথচ একদিনে কেউ বৃদ্ধ হয়না, হওয়া যায়না। বৃদ্ধ হতে হলে পৃথিবীর মাটিতে একটা সম্পূর্ণ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়।
তেত্রিশ নম্বর বেডে বসে থাকা এই দু’জন মানুষ কতবছর একসাথে কাটিয়েছেন কে জানে ! কয়েক যুগ তো হবেই । অথচ কী অদ্ভুত! আজ রাতেই হয়তো চিরবিচ্ছেদ হয়ে যাবে দু’জনের মধ্যে । একজন চিরতরে হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে, আরেকজন অপেক্ষা করবে এমনই কোন দিনের । এমনই কোন রাতের । আর কখনো এই দুজনের দেখা হবে কিনা, কেউ জানে না ।
মুনির ভাবলো, এই মুহূর্তে বৃদ্ধের যে অনুভূতি, পৃথিবীর কোন কবি কিংবা কোন ঔপন্যাসিক কি কখনো তা বর্ণনায় তুলে আনতে পারবে?
বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মুনিরের । এরকম সময়ে নিজেকে খুব অসহায় লাগে তার । নিজেকে পরাজিত মনে হয়, ব্যর্থ মনে হয়।
মানুষের 'ডেথ সার্টিফিকেট' লেখা কোন সহজ কাজ নয়। কিন্তু এটাও সত্য, মানুষ অমর নয়। মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না। প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।
ডক্টরস রুমের পুরনো কাঠের চেয়ারটিতে বসে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় মুনির- ‘আমরা রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি; মৃত্যু নয়’।