গত রাতে
রিয়াদ যখন গ্রামে পৌঁছল তখন রাত দশটা পেরিয়ে গেছে । চিলাহাটি গ্রামে রাত দশটা মানে
গভীর রাত । হাজার বছর ধরে বাড়ছে এমন রাত । রাতে বাড়িতে পৌঁছার পর কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে
পড়েছিল রিয়াদও । মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে রাত দশটা মানে সন্ধ্যা । রাত শুরুই হয়
দশটার পর থেকে । শরীর যতই ক্লান্ত থাকুক, ১টা –দুইটা বাজার আগে ঘুম আসে না । অথচ
গ্রামে থাকলে অন্য গ্রামবাসীদের চেয়ে কিছুটা দেরি হয় বটে- কিন্তু ঘুম হয় । গভীর
ঘুম ।
সকালবেলা
বারান্দায় একটা চেয়ার নিয়ে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল রিয়াদ । রিয়াদের কাছে চায়ের
কাপে চুমুক দেয়ার মত বিনোদন আর নাই । দিনে সাত আট কাপ চা খায় রিয়াদ । গল্পের
চা-খোরের মতই । প্রতিই ঘন্টায় চায়ের পিপাসা মাথায় চক্কর দেয় যেন !
এই লিটন
লিটন, এদিকে আয় । ছোটবেলার বন্ধু লিটনকে ডাক দেয় রিয়াদ । কাশতে কাশতে এগিয়ে আসে
লিটন । কাচুমাচু মুখে কাছে আসলে ওকে বসতে বলে রিয়াদ । এই এক সমস্যা হয়েছে- রিয়াদ ডাক্তার হবার পর থেকে, বলতে গেলে
মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে এলাকার বন্ধু বান্ধবরা কেমন যেন সমীহ করে ওকে ।
পুরনো দিনের মত মন খুলে আর কথা বলা হয়না ।
গ্রামের
বেশিরভাগ বন্ধু, যাদের সাথে প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেছে সে- তাদের বেশিরভাগই
ঝরে পড়েছে । কেউ রিক্সা চালায়, কেউ ক্ষেতে কাজ করে, কেউ মুদির দোকানি । বিয়ে করেছে
প্রায় সবাই- বাচ্চাও আছে কয়েকজনের ।
সকাল
থেকে গ্রামের অনেককেই দেখেছে কাশতে । কাশি কি গ্রামে মহামারি আকারে ছড়ালো নাকি ?
লিটন
বসলে তাকে জিজ্ঞেস করে রিয়াদ- কিরে কাশি কতদিন ?
‘এই
মাসখানেক’ । জবাব দেয় লিটন ।
‘এক মাস
? জ্বর আছে ?’
‘হ্যা,
সন্ধ্যাবেলা জ্বর আসে’ ।
‘চিকিৎসা
করাস নাই ?’
‘ করছি,
মন্টুর দোকানে গিয়া অষুধ নিছি’ ।
‘হাতে
কী ? পানি নাকি ?’
লিটনের
হাতে একটা বোতল । বোতল ভরা পানি । লিটন
জানালো এইটা সাধারণ পানি না । ‘মাছ বাবা’র পড়া পানি । বউয়ের সাথে ঝগড়াঝাটি হয় ,
বউকে বশ করানোর জন্য তার কাছ থেকে পানি পড়া নিয়ে এসেছে । মাছ বাবা সম্পর্কে লিটন
বেশ কিছু তথ্য দিল । মাছ বাবার বহুত কেরামতি । তার বুকে একটা জ্যান্ত মাছ আছে ।
মাছটা যখন ফাল দেয়- তখন বাবার কাশি হয় ।
এসব বিষয়ে
রিয়াদের আগ্রহ ছিলনা কখনোই । দুঃখ হয় গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য । এদেরকে
কতজনে যে কতভাবে ঠকাচ্ছে ! এরা সরলমনে যাকে তাকে বাবা ডেকে নিজের সর্বনাশ করছে ।
কিন্তু একটা
ব্যাপারে মনে খটকা লাগলো রিয়াদের । মাছ বাবার কাছ থেকে পানিপড়া আনতে যাওয়া লোকদের
কাশি এবং জ্বর । ক্রাইটেরিয়া তো টিউবারকুলার (যক্ষা) ইনফেকশনের মত । ঘটনা কী ? এই ‘মাছ বাবা’র আসল
কাহিনী উদ্ধার করতে হবে । এভাবে চলতে থাকলে তো অনেক মানুষ মারা যাবে । এরা বুঝতেও
পারবে না , কীভাবে কী হয়ে গেছে । রিয়াদ সিদ্ধান্ত নিল- আগামীকাল সে যাবে মাছ বাবার
কাছে ।
লিটনকে
নিয়ে মাছ বাবার বাড়িতে ঢুকে রিয়াদ দেখলো- বারান্দায়
মাদুর পেতে বসে আছেন মাছ বাবা । একজন ডাক্তার এসেছে শুনে মাছ বাবা তাকে
ভেতরে নিতে বললেন । দর্শনার্থীদের অপেক্ষা করতে বলা হল ।
মাছ
বাবার সাথে কথা বলে রহস্য উদ্ধার করলো রিয়াদ । খোলামনেই সবকথা বললেন মাছবাবা ।
এটুকু ভেদবুদ্ধি অন্তত আছে- একজন
ডাক্তারের কাছে কথা গোপন করে লাভ নাই ।
মাছ
বাবার আসল নাম বহর আলী । তিনি এভাবেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উঁচু বারান্দায় বসে থাকেন । অনেক লোক দেখতে আসে তাঁকে
। তার কাছে দোয়া চায় সবাই । অনেকেই বোতলে করে পানি আনে । পানিতে ফু দিতে হয় বহর
আলীকে ।
প্রথম
কয়েকদিন বিরক্ত লাগলেও এখন বেশ ভালোই লাগছে । তার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে- সত্যিই,
তার মধ্যে বুজুর্গী এসেছে । সবই আল্লাহর দান । আল্লাহ কখন কাকে কী দেন, কে বলতে
পারে ?
ভাগ্যে
থাকলে কী না হয় ! তার মত একজন জেলেকে শেষ বয়সে আল্লাহ এত সম্মান দিবেন তিনি ভাবতেও
পারেন নাই । সবাই তাকে দরবেশ ভাবছে । তার ফু দেয়া পানিপড়া খেয়ে নাকি কতজনের রোগ
ভালো হয়ে যাচ্ছে ! স্ত্রীকে বশ করা, জ্বীন-ভুত তাড়ানো , বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো, বুক
ধরফর করা – আরো কত অসুখ যে নিরাময় হচ্ছে । চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে – ‘বহর বাবা’র
পানিপড়ার গুণের কথা !
ভালোই
নজরানা-তোহফা পাচ্ছেন বহর আলী । এখন তিনি
লম্বা পাঞ্জাবী, লম্বা পাগড়ি পড়ে থাকেন । শরীরটা অবশ্য দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে ।
কাশিটাও ভালো হচ্ছে না । নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় কখনো ।
বহর আলী
এসবকে পাত্তা দেননা এখন আর । শরীরটা আসলেই ভালো যাচ্ছে না । কিন্তু সেকথা তো আর
বাইরে বলা যাবে না ! কাশি হলে লোকজনকে বলেন - ‘মাছটা’ ফাল দিতাছে তো, সেজইন্যে
কাশি হয়’ ।
কেউ বলে
‘বহর বাবা’, কেউ বলে ‘মাছ বাবা’ । আয় উপার্জন দিন দিন বাড়ছে । দিনশেষে গুনে গুনে
টাকাগুলো সিন্দুকে রাখেন । একটা সিন্দুক
বানিয়ে এনেছেন বহর আলী । মাছের আকার
সিন্দুক । স্পেশাল অর্ডার
দিয়ে বানানো হয়েছে সিন্দুকটা ।
মাঝে
মাঝে খুব অবাক হয়ে চিন্তা করেন বহর আলী । ছোটবেলা থেকে মাছ ধরে- বাজারে বিক্রি করেন
, দাদার আমল থেকে তারা জেলে । মাছ ধরাই পেশা । সেই পাচ-ছ’বছর বয়স থেকে মাছ ধরার
কাজ করেন বহর । নদীতে পাওয়া যায় – অথচ বহর আলী চেনেন না এমন মাছ নাই । বিয়ার পর
বউটাকে প্রতিদিন নতুন নতুন মাছ চেনাতেন । মাস্টারের মত । জীবনে কত মাছের স্বাদ যে
পেয়েছেন তার ইয়ত্তা নাই । কিন্তু মাছ
বুকের ভেতর ঢুকলো কীকরে ? একি যা-তা কথা ? এমন কথা কেউ জীবনে শুনেছে নাকি যে- বুকের ভেতর মাছ ঢুকে গেছে !
অবিশ্বাস
করারই বা উপায় কী ? তিনিতো নিজ কানে শুনেছেন । বৌটাও শুনেছে – যে তার বুকে একটা মাছ আছে !
বহর
আলীর বয়স এখন পঞ্চাশের উপরে । নামাজ রোজা করেন ছোটবেলা থেকেই । লেখাপড়া করতে
পারেননি, বাপ-মাও মুর্খ ছিল । জেলের আবার পড়ালেখার কী দরকার ? তেমন কোন বদভ্যাসও
ছিল না বলতে গেলে । বিড়ি অবশ্য খান কিশোর
বয়স থেকেই । সবাই বিড়ি খায়- বাপকে বিড়ি বানিয়ে দিতে হত ছোটবেলায় । তখন থেকেই এক
টান – দুই টান দেয়ার অভ্যাস । এইটাকে বদভ্যাস বলার কোন কারণ খুঁজে পাননা বহর আলী ।
জীবনে
দুঃখ একটাই- ছেলেপুলে নাই । একটা মেয়ে , তারও বিয়ে দিয়েছেন । মেয়ের জামাইও জেলে ।
বেশ
কিছুদিন ধরে শরীরটা দুর্বল লাগছিল । কাশি হয়, বুকে ব্যাথা লাগে । মাঝে মাঝে
শ্বাসকষ্টও হয় । শরীরের ওজনটাও কমে যাচ্ছিল । গলার স্বরটাও কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে
যাচ্ছিল । ফ্যাসফ্যাসে লাগে । কিছুদিন এক কবিরাজের কাছে চিকিৎসা করিয়ে কোন ফল
পেলেন না । পরে ভেবেচিন্তে
গেলেন শহরের হাসপাতালে । বিশাল বড় বিল্ডিং এ সরকারি হাসপাতাল, ডাক্তাররা সকাল বিকাল দেখেন । বুকের ছবি
তুললেন ডাক্তাররা । আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন ।
একদিন
সকালে ডাক্তাররা এসে যখন তার অসুখ নিয়ে কথা বলছিলেন, তখনই বহর আলী শুনতে পেলেন
একজন ডাক্তার বলছে- এই পেশেন্টের Chest এ Mass Lesion আছে । আরো অনেক কথাই বলেছিল – কিন্তু
চেস্ট এ ‘মাছ’ আছে এইটা ছাড়া বাকি কথাগুলো
ঠিকমত বুঝতে পারেনি বহর আলী । একজন শিক্ষিত লোক দেখে জিজ্ঞেস করেছিল – চেস্ট মানে
কি ? লোকটা বলেছিল- চেস্ট মানে বুক ।
কী
হয়েছে তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলেন বহর আলী । ডাক্তাররা বুকের ফটো দেখে বুঝতে পেরেছে যে
তার বুকে একটা ‘মাছ’ আছে ! হায় হায় ! এই ছিল কপালে ! বুকের ফটোটা বের করে ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে দেখে বহর আলী । হ্যা, মাছের মতই তো লাগছে ! সত্যিই তার বুকের ভেতর একটা মাছ
ঢুকে আছে ! হায় হায় !
কাউকে
কিছু না বলে সেদিনই বিকাল বেলা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসেন বহর আলী । সাথে করে নিয়ে
আসেন বিশাল যন্ত্র দিয়ে তোলা বুকের ফটোখানি ।
.....................
রিয়াদ
মাছবাবাকে বুঝিয়ে দেয় যে - এই মাছ সেই মাছ না । এটা অসুখ । চিকিৎসা করলে ভালো হবে, নাহলে এভাবে ধুঁকে
ধুঁকে মরতে হবে ।
এক
সপ্তাহের মধ্যেই মাছ বাবা তার বাবাগিরি ছেড়ে হাসপাতালে আবার ভর্তি হলেন । জীবনের
মায়া সব মানুষেরই আছে । সে এক মূহুর্তের জন্য হলেও । বহর আলীও তার ব্যতিক্রম নয় ।