এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

বুকের ভেতর মাছ !!



গত রাতে রিয়াদ যখন গ্রামে পৌঁছল তখন রাত দশটা পেরিয়ে গেছে । চিলাহাটি গ্রামে রাত দশটা মানে গভীর রাত । হাজার বছর ধরে বাড়ছে এমন রাত । রাতে বাড়িতে পৌঁছার পর কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রিয়াদও । মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে রাত দশটা মানে সন্ধ্যা । রাত শুরুই হয় দশটার পর থেকে । শরীর যতই ক্লান্ত থাকুক, ১টা –দুইটা বাজার আগে ঘুম আসে না । অথচ গ্রামে থাকলে অন্য গ্রামবাসীদের চেয়ে কিছুটা দেরি হয় বটে- কিন্তু ঘুম হয় । গভীর ঘুম ।

সকালবেলা বারান্দায় একটা চেয়ার নিয়ে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল রিয়াদ । রিয়াদের কাছে চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার মত বিনোদন আর নাই । দিনে সাত আট কাপ চা খায় রিয়াদ । গল্পের চা-খোরের মতই । প্রতিই ঘন্টায় চায়ের পিপাসা মাথায় চক্কর দেয় যেন !

এই লিটন লিটন, এদিকে আয় । ছোটবেলার বন্ধু লিটনকে ডাক দেয় রিয়াদ । কাশতে কাশতে এগিয়ে আসে লিটন । কাচুমাচু মুখে কাছে আসলে ওকে বসতে বলে রিয়াদ এই এক সমস্যা হয়েছে- রিয়াদ ডাক্তার হবার পর থেকে, বলতে গেলে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে এলাকার বন্ধু বান্ধবরা কেমন যেন সমীহ করে ওকে । পুরনো দিনের মত মন খুলে আর কথা বলা হয়না ।

গ্রামের বেশিরভাগ বন্ধু, যাদের সাথে প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেছে সে- তাদের বেশিরভাগই ঝরে পড়েছে । কেউ রিক্সা চালায়, কেউ ক্ষেতে কাজ করে, কেউ মুদির দোকানি । বিয়ে করেছে প্রায় সবাই- বাচ্চাও আছে কয়েকজনের ।

সকাল থেকে গ্রামের অনেককেই দেখেছে কাশতে । কাশি কি গ্রামে মহামারি আকারে ছড়ালো নাকি ?
লিটন বসলে তাকে জিজ্ঞেস করে রিয়াদ- কিরে কাশি কতদিন ?
‘এই মাসখানেক’ । জবাব দেয় লিটন ।
‘এক মাস ? জ্বর আছে ?’
‘হ্যা, সন্ধ্যাবেলা জ্বর আসে’ ।
‘চিকিৎসা করাস নাই ?’
‘ করছি, মন্টুর দোকানে গিয়া অষুধ নিছি’ ।
‘হাতে কী ? পানি নাকি ?’ 

লিটনের হাতে একটা বোতল । বোতল ভরা পানি ।  লিটন জানালো এইটা সাধারণ পানি না । ‘মাছ বাবা’র পড়া পানি । বউয়ের সাথে ঝগড়াঝাটি হয় , বউকে বশ করানোর জন্য তার কাছ থেকে পানি পড়া নিয়ে এসেছে । মাছ বাবা সম্পর্কে লিটন বেশ কিছু তথ্য দিল । মাছ বাবার বহুত কেরামতি । তার বুকে একটা জ্যান্ত মাছ আছে । মাছটা যখন ফাল দেয়- তখন বাবার কাশি হয় ।

এসব বিষয়ে রিয়াদের আগ্রহ ছিলনা কখনোই । দুঃখ হয় গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য । এদেরকে কতজনে যে কতভাবে ঠকাচ্ছে ! এরা সরলমনে যাকে তাকে বাবা ডেকে নিজের সর্বনাশ করছে ।
কিন্তু একটা ব্যাপারে মনে খটকা লাগলো রিয়াদের । মাছ বাবার কাছ থেকে পানিপড়া আনতে যাওয়া লোকদের কাশি এবং জ্বর । ক্রাইটেরিয়া তো টিউবারকুলার (যক্ষা)  ইনফেকশনের মত । ঘটনা কী ? এই ‘মাছ বাবা’র আসল কাহিনী উদ্ধার করতে হবে । এভাবে চলতে থাকলে তো অনেক মানুষ মারা যাবে । এরা বুঝতেও পারবে না , কীভাবে কী হয়ে গেছে । রিয়াদ সিদ্ধান্ত নিল- আগামীকাল সে যাবে মাছ বাবার কাছে

........................

লিটনকে নিয়ে মাছ বাবার বাড়িতে ঢুকে রিয়াদ দেখলো-  বারান্দায় মাদুর পেতে বসে আছেন মাছ বাবা একজন ডাক্তার এসেছে শুনে মাছ বাবা তাকে ভেতরে নিতে বললেন । দর্শনার্থীদের অপেক্ষা করতে বলা হল ।
মাছ বাবার সাথে কথা বলে রহস্য উদ্ধার করলো রিয়াদ । খোলামনেই সবকথা বললেন মাছবাবা । এটুকু ভেদবুদ্ধি  অন্তত আছে- একজন ডাক্তারের কাছে কথা  গোপন করে লাভ নাই ।

মাছ বাবার আসল নাম বহর আলী । তিনি এভাবেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উঁচু  বারান্দায় বসে থাকেন । অনেক লোক দেখতে আসে তাঁকে । তার কাছে দোয়া চায় সবাই । অনেকেই বোতলে করে পানি আনে । পানিতে ফু দিতে হয় বহর আলীকে ।
প্রথম কয়েকদিন বিরক্ত লাগলেও এখন বেশ ভালোই লাগছে । তার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে- সত্যিই, তার মধ্যে বুজুর্গী এসেছে । সবই আল্লাহর দান । আল্লাহ কখন কাকে কী দেন, কে বলতে পারে ?

ভাগ্যে থাকলে কী না হয় ! তার মত একজন জেলেকে শেষ বয়সে আল্লাহ এত সম্মান দিবেন তিনি ভাবতেও পারেন নাই । সবাই তাকে দরবেশ ভাবছে । তার ফু দেয়া পানিপড়া খেয়ে নাকি কতজনের রোগ ভালো হয়ে যাচ্ছে ! স্ত্রীকে বশ করা, জ্বীন-ভুত তাড়ানো , বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো, বুক ধরফর করা – আরো কত অসুখ যে নিরাময় হচ্ছে । চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে – ‘বহর বাবা’র পানিপড়ার গুণের কথা !

ভালোই নজরানা-তোহফা পাচ্ছেন  বহর আলী । এখন তিনি লম্বা পাঞ্জাবী, লম্বা পাগড়ি পড়ে থাকেন । শরীরটা অবশ্য দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে । কাশিটাও ভালো হচ্ছে না । নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় কখনো ।

বহর আলী এসবকে পাত্তা দেননা এখন আর । শরীরটা আসলেই ভালো যাচ্ছে না । কিন্তু সেকথা তো আর বাইরে বলা যাবে না ! কাশি হলে লোকজনকে বলেন - ‘মাছটা’ ফাল দিতাছে তো, সেজইন্যে কাশি হয়’ ।

কেউ বলে ‘বহর বাবা’, কেউ বলে ‘মাছ বাবা’ । আয় উপার্জন দিন দিন বাড়ছে । দিনশেষে গুনে গুনে টাকাগুলো সিন্দুকে রাখেনএকটা সিন্দুক বানিয়ে এনেছেন  বহর আলী । মাছের আকার সিন্দুকস্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো হয়েছে সিন্দুকটা ।

মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে চিন্তা করেন বহর আলী । ছোটবেলা থেকে মাছ ধরে- বাজারে বিক্রি করেন , দাদার আমল থেকে তারা জেলে । মাছ ধরাই পেশা । সেই পাচ-ছ’বছর বয়স থেকে মাছ ধরার কাজ করেন বহর । নদীতে পাওয়া যায় – অথচ বহর আলী চেনেন না এমন মাছ নাই । বিয়ার পর বউটাকে প্রতিদিন নতুন নতুন মাছ চেনাতেন । মাস্টারের মত । জীবনে কত মাছের স্বাদ যে পেয়েছেন তার ইয়ত্তা নাই ।  কিন্তু মাছ বুকের ভেতর ঢুকলো কীকরে ? একি যা-তা কথা ? এমন কথা কেউ জীবনে শুনেছে নাকি যে-  বুকের ভেতর মাছ ঢুকে গেছে !

অবিশ্বাস করারই বা উপায় কী ? তিনিতো নিজ কানে শুনেছেনবৌটাও শুনেছে – যে তার বুকে একটা মাছ আছে !

বহর আলীর বয়স এখন পঞ্চাশের উপরে । নামাজ রোজা করেন ছোটবেলা থেকেই । লেখাপড়া করতে পারেননি, বাপ-মাও মুর্খ ছিল । জেলের আবার পড়ালেখার কী দরকার ? তেমন কোন বদভ্যাসও ছিল না বলতে গেলে ।  বিড়ি অবশ্য খান কিশোর বয়স থেকেই । সবাই বিড়ি খায়- বাপকে বিড়ি বানিয়ে দিতে হত ছোটবেলায় । তখন থেকেই এক টান – দুই টান দেয়ার অভ্যাস । এইটাকে বদভ্যাস বলার কোন কারণ খুঁজে পাননা বহর আলী ।

জীবনে দুঃখ একটাই- ছেলেপুলে নাই । একটা মেয়ে , তারও বিয়ে দিয়েছেন । মেয়ের জামাইও জেলে ।

বেশ কিছুদিন ধরে শরীরটা দুর্বল লাগছিল । কাশি হয়, বুকে ব্যাথা লাগে । মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্টও হয় । শরীরের ওজনটাও কমে যাচ্ছিল । গলার স্বরটাও কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল । ফ্যাসফ্যাসে লাগে । কিছুদিন এক কবিরাজের কাছে চিকিৎসা করিয়ে কোন ফল পেলেন নাপরে ভেবেচিন্তে গেলেন শহরের হাসপাতালে । বিশাল বড় বিল্ডিং এ সরকারি হাসপাতাল, ডাক্তাররা সকাল বিকাল দেখেন । বুকের ছবি তুললেন ডাক্তাররা । আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন

একদিন সকালে ডাক্তাররা এসে যখন তার অসুখ নিয়ে কথা বলছিলেন, তখনই বহর আলী শুনতে পেলেন একজন ডাক্তার বলছে- এই পেশেন্টের Chest Mass Lesion আছে । আরো অনেক কথাই বলেছিল – কিন্তু চেস্ট এ  ‘মাছ’ আছে এইটা ছাড়া বাকি কথাগুলো ঠিকমত বুঝতে পারেনি বহর আলী । একজন শিক্ষিত লোক দেখে জিজ্ঞেস করেছিল – চেস্ট মানে কি ? লোকটা বলেছিল- চেস্ট মানে বুক ।

কী হয়েছে তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলেন বহর আলী । ডাক্তাররা বুকের ফটো দেখে বুঝতে পেরেছে যে তার বুকে একটা ‘মাছ’ আছে ! হায় হায় ! এই ছিল কপালে ! বুকের ফটোটা বের করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বহর আলী । হ্যা, মাছের মতই তো লাগছে ! সত্যিই তার বুকের ভেতর একটা মাছ ঢুকে আছে ! হায় হায় !

কাউকে কিছু না বলে সেদিনই বিকাল বেলা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসেন বহর আলী । সাথে করে নিয়ে আসেন বিশাল যন্ত্র দিয়ে তোলা বুকের ফটোখানি ।

.....................

রিয়াদ মাছবাবাকে বুঝিয়ে দেয় যে - এই মাছ সেই মাছ না । এটা অসুখ ।  চিকিৎসা করলে ভালো হবে, নাহলে এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে ।
এক সপ্তাহের মধ্যেই মাছ বাবা তার বাবাগিরি ছেড়ে হাসপাতালে আবার ভর্তি হলেন । জীবনের মায়া সব মানুষেরই আছে । সে এক মূহুর্তের জন্য হলেও । বহর আলীও তার ব্যতিক্রম নয়

মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

শূকর দর্শন

ছোটবেলার কথা আমার খুব মনে পড়ে । তখন
মাঝে মাঝে নদীর তীরে তাঁবু গেঁড়ে বাস করতো বেঁদের দল
আর – কখনো কখনো মেঠোপথ ধরে এগিয়ে আসতো
শুকরের পাল । একটুখানি বিষ্ঠার খোঁজে মাটি চষে যেত
শুকরের খাড়া নাক । ঘোঁত ঘোঁত শব্দ শোনা যেত কাছ থেকে ।

মা বলতেন -
খালি পায়ে শুকরের বিষ্ঠা মাড়াতে নেই , দূর থেকে দেখিস বাপ ।

সেই কবে ছেড়েছি গ্রাম , ছেড়েছি নদীর তীর
বহুদিন পেরিয়ে গেছে – দেখা হয়নি শুওরের ছানা
শুনেছি বানরের মতই হয়েছে তাদেরও বিবর্তন –
খসে পড়েছে লেজ, সামনের পা
তাদেরও হয়েছে শরীর মানুষের মত , কথাও বলতে পারে
মাঝে মাঝে তাদের দেখা যায় – এই শহরেও
বেশি নয়- গুটিকয়েক ।

হ্যা, আজ আবার দেখতে যাবো শুকরের পাল
এই শহরেই, শাহবাগের মোড়ে । ওরা আসবে খাদ্যের লোভে
ওখানে নাকি মানুষের বিষ্ঠার অফুরন্ত যোগান !!
.................................
শূকর দর্শন / ১৭-০৯-২০১৩

রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

এ কেমন জীবন

ভেবেছিলাম সময়কে কাজে লাগাবো    
মুখে লাগাম বেঁধে জুড়ে দেবো টমটমের সামনে  
তারপর মাঝে মাঝে চাবুক মেরে  
হৈ হট হট চল চল করে চিৎকার করে উঠবো  
মনের সুখে । আর 'সময়'- চিঁহি চিঁহি করে    
ছুটবে আমাকে নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে -    
গন্তব্যের পানে !  

আমার অভিপ্রায় সে কি জেনে গেছে ?      
দড়ি ছিড়ে বেয়াড়া ষাঁড়ের মত  
ছুটছে ছুটছে ছুটছে । ছুটছি আমিও পেছন পেছন  
সেই কবে থেকে ! মাঝে মাঝে হঠাৎ থমকে দাঁড়াই  
আর কতকাল ছুটবো এভাবে ? হয়তো একদিন  
সময়ের লাগাম ধরে হাতের মুঠোয়; ফিরে এসে দেখবো  
খুলে নিয়ে গেছে কেউ, আমার  
টমটমের সবক'টি চাকা !
.................................
এ কেমন জীবন / ০৯-০৯-২০১৩ 

শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

পতিতাপল্লীতে হামলা কি মানবাধিকারের লংঘন ?

কয়েকদিন আগে একটা খবর পড়ে আমি ক্ষুব্ধ হই ।

খবরটার মূলকথা হচ্ছে-
‘২৭ আগস্ট মাদারীপুর শহরের পুরান বাজারের যৌনপল্লিতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। দিনদুপুরে ‘ইসলাহে কওম’ পরিষদ নামের একটি সংগঠন উচ্ছেদ ও হামলায় নেতৃত্ব দিলেও তাদের পাশে ছিল প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সমাজের ‘গণ্যমান্যরা’। লুটপাটে অংশ নিয়েছে স্থানীয় লোকজন। আক্রমণে আহত হয়েছেন ৩০-৪০ নারী। বিস্ময়কর ব্যাপার যে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল যৌনকর্মীদের হয়রানি না করতে এবং তাঁদের পেশা চালিয়ে যেতে প্রশাসন যেন কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না করে। আড়াই শ বছর ধরে যৌনকর্মীরা সন্তানসন্ততি নিয়ে ওই জায়গায় বাস করছেন। বর্তমানে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৫০০। তাঁদের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে এমন বর্বরোচিতভাবে উচ্ছেদ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ফৌজদারি অপরাধ। মূল উদ্দেশ্য ছিল ভূমি দখল’ ।

এ নিয়ে বামপন্থি বুদ্ধিজীবিরা কলামও লিখেছেন । তারা এটাকে মানবাধিকারের চরম লংঘন বলেছেন ।

পুরো প্রক্রিয়াটা নিয়েই আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি ।

প্রথমতঃ ‘ইসলাহে কওম’ নামের যে সংগঠন এই হামলা চালিয়েছে আমি তাদের কাজকে সমর্থন করিনা । যারা এই নিকৃষ্ট পেশায় জড়িয়েছে , মানবতার জন্য অপমানজনক পেশায় জড়িয়েছে সম্ভবত তারা কেউই এরকম জীবন চায়নি । বিভিন্ন পরিস্থতিতে পড়ে বাধ্য হয়েই তারা তাদের জীবনটাকে এই অভিশপ্ত পেশার সাথে জড়িয়েছে বা বাধ্য হয়েছে ।

তাদের উত্তম শিক্ষাসহ যথাযথ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা দরকার । এটা সমাজের দায়িত্ব । সেই দায়িত্ব পালনের জন্য কার্যকরী কোন পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু হামলা চালিয়ে উৎখাত করা কোন সমাধান নয় ।

দ্বিতীয়তঃ এইসব নারীদের ওপর হামলা করা সহজ । কিন্তু যাদের ছত্রছায়ায়, যাদের প্রয়োজনে এদেরকে এভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে, জিইয়ে রাখা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা কথা বলার সাহস রাখি না কেন ? এদের আশ্রয়দাতা, পৃষ্ঠপোষক,আসল ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা করতে হবে । তবেই আসবে সমাধান । নইলে আজ এদের ওপর হামলা করে সাময়িক উৎখাত করা গেছে, কিন্তু এদের দিয়ে যারা ব্যবসা করে খুব শীঘ্রই তারা এদেরকে নতুন স্থানে জায়গা করে দেবে । ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই অভিশপ্ত জীবনে ।

তৃতীয়তঃ দেশের উচ্চ আদালত নাকি নির্দেশনা দিয়েছে যৌনকর্মীদের হয়রানি না করার ! এবং পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে বলেছে ।

ছিঃ ছিঃ । আদালত কি নির্দেশনা দিতে পারতোনা সরকারকে যে , পতিতাবৃত্তি কোন পেশা নয়, এটা মানবতার জন্য চরম অপমানজনক । এইসব নারীকে পুনর্বাসন করে তাদের এই অভিশপ্ত জীবন থেকে উদ্ধার করা হোক ?

এই আদালতকে বাধ্য করতে হবে এরকম নির্দেশনা দিতে । নারীদের ওপর হামলা করে স্থায়ী সমাধান আসবে না ।

চতুর্থতঃ আবুল মকসুদ সহ যেসব বুদ্ধিজীবি এই হামলাকে ‘মানবাধিকার লংঘন’ বলেছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন – নারীদের বাধ্য করে ভোগ করার ব্যবস্থাটা কি আপনাদের মানবাধিকার ? পতিতা হিসেবে কাজ করা কি মানবাধিকার ? একজন নারীকে স্বাভাবিক জীবনের বাইরে পতিতা হিসেবে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে- এটাই তো মানবাধিকারের লংঘন । মানবাধিকার লংঘন তো আপনারা আগেই করেছেন- এইসব নারীকে ভোগের সামগ্রী হতে বাধ্য করার মাধ্যমে । পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাদের যৌনকর্মী নাম দিয়ে ভোগ করার জন্য আদালতের নির্দেশনা শুধু মানবাধিকারের চরম লংঘনই নয়, মানবতার চরম অপমান ।

পতিতারা সবাই যে পরিস্থিতির শিকার তাও হয়তো নয় । তারাও চাইলে হয়তো পারতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে । কিন্তু তারাও চায়নি, তাদের হৃদয় কলুষিত হয়ে গেছে । তাদেরকে তাদের কাজের খারাপ দিক বোঝাতে হবে, তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে । এরপরও যদি তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়- তাদের শাস্তি দিতে হবে , অবশ্যই পুরুষ-পতিতাকে সহ ।

বাংলাদেশে যেহেতু ইসলামী শাসনব্যবস্থা চালু নেই , তাই ইসলামী দন্ডবিধি প্রয়োগেরও সুযোগ নেই ।

পতিতাদের ওপর হামলা না করে তাদের দিয়ে যারা ব্যবসা করছে তাদেরকে ধরতে হবে । সেই সাহস কি আছে ?

দুর্বল নারীর ওপর হামলা নয়, পুরো সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে । বাম, সেক্যুলার,ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতার অপমানকারীদের হাত থেকে দেশ, আদালত ও মানুষকে বাঁচাতে হবে । সতিকারভাবে এসবকে উচ্ছেদ করতে চাইলে ইসলামের আদর্শের আলোকে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের বিকল্প নাই ।

..........................
পতিতাপল্লীতে হামলা কি মানবাধিকারের লংঘন ?/ ০৬-০৯-২০১৩

পৈশাচিক আনন্দ !

ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে কলিমউদ্দিনের । নামাজে মন বসছে না । বহুদিন পরে একটা উপলক্ষ পাওয়া যাবে । এসব কাজে সে সবসময় সামনের সারিতে থাকে । একধরণের পৈশাচিক আনন্দ তার মাথায় কিলবিল করতে থাকে ।

তিনমাস আগে সর্বশেষ এই গ্রামে একজন চোর ধরা পড়েছিল । চোরটাকে বটগাছের গোড়ায় বেঁধে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পালা করে পিটিয়েছে সে । পেটাতে পেটাতে নিজের হাতে ফোস্কা পরে গিয়েছিল

আজ মনে হয় আরেকটা উপলক্ষ পাওয়া যাবে । এটাতো চোর নয়, তাঁর ওপর মেয়ে । এরে পিটানোর স্বাদটা নিশ্চয়ই ভিন্ন রকম হবে !


মসজিদের সামনের দিকে দ্বিতীয় কাতারেই বসেছে কলিমউদ্দিন । পাঁচ অয়াক্ত নামাজ পড়ে এমনটা বলা যাবে না, তবে জুমার নামাজ, ঈদের নামাজ কিংবা কোন প্রোগ্রাম-মাহফিলে সে ঠিকঠাকমত হাজির থাকে । এবং তাঁর উপস্থিতি জানান দেয় হম্বিতম্বি করে ।

ঈমাম সাহেব খুতবা দিচ্ছেন । নামাজ শুরুর আগেই ঈমাম সাহেবের সাথে কথা বলেছে কলিম ও তাঁর সাথের দুই-তিনজন । ঈমাম সাহেব ঘটনা শুনে খুবই রেগে আছেন । তিনি বার কয়েক নাউযুবিল্লাহ পড়েছেন । নামাজ শেষ হলেই মুসল্লীদের সামনে রহস্যভেদ করা হবে । গ্রামের ভেতর এরকম বেলেল্লাপনা ঢুকে পড়েছে , অথচ কেউ জানেই না ! যুবকদের চরিত্র ধ্বংসের উপক্রম । এর একটা বিহিত আজকে করতেই হবে । ঈমাম সাহেব আজকের খুতবায় চরিত্র সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপুর্ণ কথা বললেন । যেকোন রকম চরিত্র বিধ্বংসী কার্যকলাপ যেন গ্রামে হতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানালেন ।


কলিম বুঝলো , ঘটনা ঠিকভাবেই আগাচ্ছে । সিদ্ধান্ত হবে নামাজের পর । ঈমাম সাহেবের বক্তব্যে এলাকার লোকজন আগে থেকেই একটা প্রেরণা পেয়ে থাকলো । আজকের সিদ্ধান্তটা কী হতে যাচ্ছে কলিম যেন টের পাচ্ছে । সে ও তাঁর দুই সহযোগী সামনের দিকেই বসেছে । সিদ্ধান্ত যেন তাদের মনমত হয় সেজন্য তারা চেষ্টা করবে ।


নামাজ শেষ হলো । ঈমাম সাহেব মিম্বরে দাঁড়ালেন । ভাইসব , একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় আমাদের সামনে এসেছে ।

আমার কাছে খবর এসেছে যে , পুবপাড়ার সাহাবুদ্দিন চোরা তার বাড়িতে এক নষ্ট মেয়ে এনেছে । রাত বিরাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবক ছেলেরা তার বাড়িতে আসছে , সেখানে ব্যভিচার হচ্ছে । আমাদের গ্রামে এইটা চলতে দেয়া যায় না । এর একটা বিহিত ব্যবস্থা করা দরকার । আপনারাই বলেন, কী করা যায় ?

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো কলিম । কী এত বড় সাহস ? চলেন সবায় । ঐ শাবুদ্দিনের ঘর ভাঙ্গি ফেলা লাইগবে । আর ঐ মাগীর চুলের মুটি ধরি মারতে মারতে গেরাম থাকি বাইর করি দিবার লাইগবে । কী কন সবায় ?

কলিমউদ্দিনের দুই সঙ্গীসহ বেশ কিছু অতিউতসাহী লোক এবার চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো । হা হা , কলিম ঠিক কতা কইছে । ঐ মাগীর চুলের মুটি ধরি গ্রাম থাকি বাইর করা লাগবে । চলেন সবায় একসাথে ।

ঈমাম সাহেব অনেক কষ্টে লোকজনের চিৎকার চেচামেচি থামালেন । তিনি বললেন , ঠিক আছে । আমরা সবাই মসজিদে থাকবো । আমাদের মধ্যে দুইজন মুরুব্বী যাবেন , গিয়ে তাকে এই মুহুর্তে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলবেন । তাকে এলাকার বাইরে বের করে একটা বাসে তুলে দিয়ে তারা ফিরে আসবেন । ঐ মেয়ের আশ্রয়দাতা চোরা শাবুদ্দিন বা অন্য কেউ কোনরকম বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে আমরা সবাই মিলে যাব ।

ঠিক হলো মনছুর সাহেব এবং গফুর সাহেব যাবেন । তারা চলে গেলেন । ঈমাম সাহেব গেলেন টয়লেটে । ঈমাম সাহেব টয়লেট থেকে ফিরে দেখেন- মসজিদ ফাকা । এতবড় উত্তেজনাকর একটা বিষয়, কেউ কি ঘরে বসে থাকতে পারে ? সবাই গেছে ঐ নষ্ট মেয়েকে গ্রামছাড়া করতে ! সবার চেয়ে বেশি উৎসাহ কলিমের ।

ঈমাম সাহেব কুরআন তেলাওয়াত করতে বসলেন ।

কিছুক্ষণের মধ্যে হৈ হৈ রব তুলে কলিম তার দলবল নিয়ে হামলে পড়লো চোরা শাবুদ্দিনের ঘরে । দরজা ভেঙ্গে চুলের মুঠি ধরে টেনে হিচড়ে বের করে আনল একটা মেয়েকে । বয়স কত হবে ? ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে হয়তো ! তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বড় রাস্তার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো ছেলেরা । শরীরের বিভিন্ন স্থানে পেটাতে লাগলো তারা । এ যেন এক অন্যরকম পৈশাচিক আনন্দ ! কাপড় ইতোমধ্যেই এলোমেলো হয়ে গেছে । যে যেখানে পারে  কে যে কোথায় হাত দিল ঠাওর করা গেল না ।

বড় রাস্তায় নিতে নিতে মেয়ে আধামরা হয়ে গেল, প্রায় লুটিয়ে পড়ছিল সে । একটা বাসে তুলে দেয়া হলো তাকে । কলিম ফিরে এলো বিজয়ির বেশে , ঠোটের কোণে এক চিলতে হাসি । হ্যা, মনের মত হয়েছে । যা যা ছিল মনে, গোলমালের সুযোগে সবই করেছে সে !
……………………

বাসের পেছনের একটা সিটে কোনরকমে গা এলিয়ে রইলো রেশমা । সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে । এরকম পরিস্থিতিতে তাকে কখনো পড়তে হয়নি এর আগে । শহরের ভেতর এক মালকিনের অধীনে সে এই পেশায় ভালোই কাটাচ্ছিল দিনগুলি । প্রথম প্রথম বাবা-মা, ছোট ভাইটার কথা মনে আসতো । অনেক কষ্ট, অনেক লজ্জা, অনেক অপমানে বুকটা হাহাকার করে উঠতো । ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো লজ্জা । নতুন নতুন পুরুষ আসে , কাচা টাকা হাতে আসে । ভালোই লাগা শুরু করলো একসময় । ধীরে ধীরে বাবা মার কথা ভুলে যেতে লাগলো সে । কী লাভ পেছনে তাকিয়ে ? এই ছিল হয়তো কপালে । মাঝে মাঝে রাতে খুব কান্না পেত তার ।   অনেক কেঁদেছেও । তারপর ধীরে ধীরে সময় বয়ে যায় । একসময় আর কান্না আসে না । সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে ।

বাসের সিটে বসে আজ অনেক দিন পর চোখ ফেটে কান্না আসছে । এই বাসটা কোথায় যাবে সে জানেনা । ঝাপসা চোখে বাবা –মার কথা মনে পড়ছে । কেমন আছে ওরা ?  কেমন আছে আদরের ছোট ভাইটা ? কোথায় আছে ওরা ?

এমন জীবন তো চায়নি রেশমা কোনদিন । ছোটবেলা থেকেই সে খুব সেজেগুজে থাকতো । গরীবের মেয়ের জন্য যতটুকু সম্ভব ।  খুব ভালো করে রান্নাবান্না শিখেছিল । মা মাঝে মাঝে বলতেন, স্বামীর বাড়িতে গিয়ে আমার বদনাম করবি না । ও বাড়ির লোকেরা যেন বলতে না পারে- বাপ মা কিছু শেখায় নাই । স্বামীর বাড়ির কথা শুনে লজ্জাও পেত, কিন্তু ঘরে একলা বসে চুলে বেণী করার সময় কত কথাই  মনে আসত তার ! স্বামীর কথা কল্পনা করতে কত ভালো যে লাগত ! একা হলেই চিন্তা করতো-  কেমন হবে স্বামীটা ? সে কি খুব আদর করবে ওকে ?
স্বপ্ন ছিল একটা সুন্দর সংসারের । একঝাক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকবে- জানালায় দাঁড়িয়ে কত কিছুই কল্পনা করতো রেশমা ।

সেবার রেশমা কেবল ক্লাস নাইনে  উঠেছে । পাশের গ্রামেই একটা বালিকা বিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল নতুন, সেখানেই ভর্তি হয়েছিল সে ।

মেম্বারের ছেলে মিন্টুর নজরটা যে তার দিকে আছে- এটা সে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল । বেশ কয়েকদিন মিন্টু রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রেশমার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছে । বড় ভাই মনে করে রেশমাও টুকটাক উত্তর দিত কথার । মিন্টু মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যাবার জন্য প্রস্তাব দিত । রেশমা যায়নি । সে জানতো, মেম্বারের ছেলে যতই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলুক, তার সাথে কোনদিন রেশমার বিয়ে হবে না । মিন্টুর বাবা টাকাপয়সা ওয়ালা লোক, অনেক বছর ধরে এলাকার মেম্বার তিনি । রাজনীতি করেন । তার দল নাকি দেশের সবচেয়ে প্রাচীন দল, বাংলাদেশ নাকি ওনারাই স্বাধীন করেছেন এইসব কথা বলেন । ভোটের সময় যেসব সভা সমাবেশ হয়, সেখান থেকে রেশমা শুনেছে এসব ।

বালিকা মন তবু ধীরে ধীরে কিছুটা যেন বিশ্বাস করা শুরু করেছিল মিন্টুকে । মিন্টু অনেকবারই বলেছে- রেশমা, তুই রাজী থাকলে আমি তোরেই বিয়া করুম । দরকার হইলে তোরে নিয়া পলায় যামু । বিশ্বাস করতে চায়নি সে । তবু কেন যেন মনে হয়েছিল- হতেও তো পারে, মেম্বারের ছেলে আমাকে সত্যিই বিয়ে করবে ! আমার তো রুপ আছে !

একদিন স্কুল ছুটি ছিল । রেশমা তবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় । আজ সে মিন্টুর সাথে সিনেমা দেখতে যাবে । বাড়িতে বলে যায়- কাজ আছে স্কুলে, স্যার ডেকেছেঅশিক্ষিত বাবা-মা সরল মনে তাকে যেতে দেন । রেশমা চলে যায় সিনেমা হলে । মিন্টুর সাথে বসে সিনেমা দেখে সে । সিনেমা দেখে বের হয়ে তারা হাটতে থাকে । মিন্টু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে । সে বলে, চল রেশমা- আইজকা তোরে বিয়া করুম !

মিন্টুর দুই বন্ধু একটা গাড়ি নিয়ে এসেছিলরেশমাকে গাড়িতে উঠিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে তারা । এরপর কোথায় নিয়ে গেল- সে জানেনা ।
একটা তালাবদ্ধ বাসায় তাকে আটকে রেখেছিল ওরা ।
তারপরের দুইদিন রেশমার ওপর দিয়ে যে কী ঝড় বয়ে গেল, সেকথা সে এখনো ভাবতে পারেনা । সে বিভীষিকার কথা মনে এলে এখনো গা শিউরে ওঠে ।

কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল সে জানেনা । জ্ঞান ফিরলে দেখেছিল এক মহিলার ঘরে সে শুয়ে আছে । আরো অনেক মেয়ে-মহিলা আশেপাশের ঘর থেকে এসেছিল । সবাই তার আশ্রয়দানকারী মহিলাকে মালকিন বলে ডেকেছিল রেশমা প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি, কিসের মালকিনকিছুদিন পর সে বুঝতে পেরেছিল , কোথায় এসে পড়েছে । দুনিয়ার দোযখে ।  

গ্রামে বান্ধবীর কাছে চিঠি লিখেছিল রেশমা । বান্ধবী ফিরতি চিঠিতে লিখেছিল- রেশমা, তুই আর গ্রামে আসিস না । মেম্বারের ছেলে গ্রামে রটিয়ে দিয়েছে- তুই নষ্টপল্লিতে গেছিস । সে নিজে তোকে এক লোকের সাথে যেতে দেখেছে । তোর বাপ-মাকে ওরা একঘরে করে দিয়েছে । তোকে এখন সবাই ‘নষ্টা মেয়ে’ বলেই জানে । তুই আর আসিস না রেশমা যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস ।

অনেক কেঁদেছিল রেশমা । যথেষ্ট সুন্দরী সে । মালকিন তাকে ছাড়বে না । খেয়াল করেছে, সবসময় কেউ না কেউ তার ওপর চোখ রাখে !  হয়তো পালিয়ে যেতে পারতো, কিন্তু কোথায় যাবে ?

একদিন তাকে মালকিন খুব করে সাজিয়ে দিল । সব বুঝতে পারছিল রেশমা । কিন্তু তার কিছু করার ছিল না । সে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল । সেদিন যার ঘরে তাকে পৌছিয়ে দেয়া হল- উনি একটা দলের যুব সংগঠনের নেতা । রেশমা খবর নিয়ে বের করেছিল- মেম্বারের ছেলে যে দল করতো, এই লোকও সেই দলেরই । এরা ধর্মকর্ম তেমন একটা মানে না । ধর্মনিরপেক্ষতা, যুদ্ধ, চেতনা- এইসব শব্দ প্রায়ই উনার মুখ থেকে শোনা যায় । এইখানকার আয়ের একটা অংশ দিতে হয় উনাকে । উনাদের সন্ত্রাসী বাহিনী আছে, সরকারে লোক আছে । কেউ তাদের কিছু বলে না । এলাকার লোকজন অনেকেই জানে এখানে কী হয়, অনেকেই পছন্দ করে না । কিন্তু এদের ভয়ে কেউ কিছু বলতেও পারে না । মন্ত্রী-এমপি-বুদ্ধিজীবিও আছে তাদের । রেশমা নিজেই দেখেছে অনেককে তাদের মালকিনের ঘরে আসতে ।

রেশমার নতুন জীবন শুরু হয়েছিল । চলছিলও সেভাবে । অভিশপ্ত এক জীবন । কিন্তু গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল সেসব । আজ তার জীবনে একটা অন্যরকম দিন । আজ আবার সব কথা মনে পরছে । নতুন করে জীবনকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে ।  এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে , সে ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবেনি । এই গ্রামে তাকে এনেছিল স্থানীয় চেয়ারম্যান । এই চেয়ারম্যানও ঐ দলের লোক । কিন্তু চেয়ারম্যান সাবধানতা বশত তাকে নিজের বাড়িতে না রেখে এক চোরের বাড়িতে রাখে ।
রেশমা ভেবেছিল – চেয়ারম্যানের কাছে যাচ্ছে, চিন্তা কী ? চেয়ারম্যান তার মালকিনের পুরাতন খদ্দের । মালকিনও তাই চেয়ারম্যানের অনুরোধ ফেলতে পারেনি । গতরাতেও চেয়ারম্যান এসেছিলেন । আজ কীভাবে যে কী হলো, কোথা হতে একদল লোক এসে তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে পেটাতে লাগলো । শুধু কি পেটানো ? আরো যতভাবে সম্ভব নাজেহাল করলো ।

না , আর ভাবতে পারছে না সে এই অভিশপ্ত জীবনের কথা ।
কোমড়ে হাত দিয়ে পুটলিটা অনুভব করলো রেশমা । হ্যা, ঠিকঠাকমত আছে ওটা । লোকজনের ধ্বস্তাধস্তিতেও ওটা কোথাও পড়ে যায়নি । বেশ মোটা অংকের- হ্যা , এতদিনের জমানো সবগুলো টাকা আছে এখানে ।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেশমা । সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে । আর রেশমা ফিরে যাবে না ঐখানে । অভিশপ্ত আস্তানায় । অন্য কোথাও গিয়ে সে নতুন করে বাঁচার সংগ্রামে নামবে । যা আছে কপালে ।
.........................................................

পৈশাচিক আনন্দ / ০৬-০৯-২০১৩ 

বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কষ্টের প্রত্যাবর্তন

কষ্টগুলো কীভাবে আসে ?
উড়ে উড়ে, হেঁটে হেঁটে, নাকি হামাগুড়ি দিয়ে !

যেভাবেই আসুক,
ওরা কীভাবে যেন ঢুকে যায় ঠিকঠিক  
বুকের ভেতরটায় !
কখনোবা গলার কাছে আটকে থাকে
মাছের কাঁটার মত !  

একদিন -
নানান বর্ণের কষ্টগুলো স্তরে স্তরে জমাট বেঁধে
পুর্ণ হয়ে গেলে হৃদয়ের সবক’টি  অলিন্দ-নিলয় ;
কষ্টের ভারে কষ্ট পায় কষ্টেরাই; কেউ কেউ  
উপচে পড়ে রাতের আঁধারে – সীতাকুন্ডের উষ্ণ ঝরণার মত  
নিমীলিত চোখের কোণ বেয়ে !  

ধীরপদে দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিই আমি । জানি
যেভাবেই আসুক ;
ওরা  ফিরে যাবে উড়ে উড়ে-
সুর্য ওঠার আগে, ভোরের হিমেল হাওয়ায় !  

........................

কষ্টের প্রত্যাবর্তন/ ০৫-০৯-২০১৩ 

জাফর ইকবাল কি লজ্জা রাখার জায়গা পেয়েছেন ?

বেচারা জাফর ইকবাল একজন ‘আজিব চিড়িয়া’ । তিনি মনে করেন গল্পের মত যা ইচ্ছা তাই বলে যাবেন , আর মানুষজন সেগুলো শিশুতোষ গল্পের মত গোগ্রাসে গিলবে !

গত ৩০ আগস্ট পত্রিকায় তাঁর একটা লেখা প্রকাশিত হল- ‘এ লজ্জা রাখি কোথায়’ ! অত্যন্ত যৌক্তিক কথা !  তারতো এমনিতে কখনো লজ্জা ছিল না – তিনি বাঙ্গালিত্বের ডুগডুগি বাজান কিন্তু ভার্সিটির মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে হিন্দি গানের তালে তালে নাচেন , তাঁর মেয়ে নিজের  উল্টাপাল্টা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে, তিনি সর্বদা দালালীতে লিপ্ত থাকেন । আর তাছাড়া, লজ্জা হলো ঈমানের অংগ । কিন্তু তিনি তো নাস্তিক, তাঁর লজ্জা থাকাটা তো বেমানান তাইনা ?  

তো হঠাৎ কিছু লজ্জা কোত্থেকে যেন এসে তাঁর ঘাড়ের ওপর পড়েছে ।  কী বিপদ ! এখন এই লজ্জা তিনি কোথায় রাখবেন ? যেই ভাবা সেই কাজ, লজ্জাটা তিনি আমাদেরকেই দেয়ার ব্যবস্থা করলেন !

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি , যাকে সরকার দালালীর পুরস্কার হিসেবে বাইরে থেকে পুশ করে জাবির ভিসি বানিয়েছে, যিনি ছাত্রলীগের একাংশকে নিয়ে গোপন বৈঠক করে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁকে শিক্ষকরা অফিসে অবরুদ্ধ করায় একটুকরো বেওকুফ ‘লজ্জা’ বেমক্কা জাফর ইকবাল সাহেবের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে । কী বিপদ কী বিপদ !

তিনি লিখেছেন-
‘শিক্ষকরা বলছেন, তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। ভাইস চ্যান্সেলর বলছেন, তদন্ত কমিটি করে সেই অভিযোগ যাচাই করা হোক। তারপরও সেখানে শিক্ষকরা কেন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে আটক রেখেছেন, সেটা আমার মোটা বুদ্ধিতে ধরতে পারছি না’ ।

তিনি দাবি করছেন, ‘তদন্ত হোক’ । অথচ কয়েকদিন আগে যখন মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমানকে কোন রকম তদন্ত ছাড়াই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলো, তিনি সাফাই গেয়ে বলেছিলেন- ‘ঠিক আছে’ !

তিনি লিখলেন-
‘পৃথিবীর যে কোনো দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্ভবত সেই দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী ও গুণী মানুষ, সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী, সবচেয়ে বড় মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাসী মানুষ এবং সম্ভবত জাতির সবচেয়ে বড় বিবেক। তাই সাধারণ মানুষ যখন দেখে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন দেশের একজন নাগরিককে জেলখানার মতো একটা ঘরে আটকে রাখছে, তখন তারা নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে যায়’ ।

জনগণও অবাক হয় – যখন মাহমুদুর রহমান, আদিলুর রহমান সহ হাজার হাজার ‘স্বাধীন দেশের নাগরিক’কে জেলখানার মত ঘর নয়- সত্যিকার জেলখানায় বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা হয়েছে তখন জাফর সাহেব হাততালি দিয়েছেন ।
 বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তিনিই শাহবাগে গিয়ে গলাবাজি করে এসেছেন ।

তিনি আরো লিখলেন,
‘অভিযোগ থাকলে তদন্ত হবে, শাস্তি হবে। কিন্তু আগেই নিজেরা শাস্তি দিয়ে একজনের মানবাধিকার লংঘন করা হবে, সেটি কোন দেশের বিচার?
সেই একই কথা । কয়কেদিন আগেই যখন আদিলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হল কোনরকম ‘তদন্ত’ ছাড়া, তখন এই বেচারাই সাপোর্ট দিয়েছিলেন । কীভাবে পারে ? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে কী করে আনোয়ার হোসেন পারেন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের ওপর গুণ্ডা লেলিয়ে দিতে ? কী করে আনোয়ার হোসেন পারেন আল্লামা সাঈদীকে ‘কুত্তার বাচ্চা’ গালি দিয়ে মারতে যেতে ?  কীকরে জাফর ইকবাল পারেন নিরপরাধ মানুষকে বিনাবিচারে কারাগারে আটক রাখার পক্ষে সাফাই গাইতে ?

আমাদের লজ্জা হয় । অবশ্য আমাদের লজ্জা রাখার জায়গারও অভাব নেই । কারণ, আমাদের আগে থেকেই লজ্জা আছে !


জাফর ইকবাল কি অবশেষে লজ্জা রাখার জায়গা পেয়েছেন ? সেরকম খবর অবশ্য এখনো পাইনি । তবে আমি নিশ্চিত, লজ্জা তাঁর কাছ থেকে পালিয়েছে । সত্যিই তো, তাঁর মত নির্লজ্জ লোক লজ্জা কোথায় রাখবেন ?  তিনিতো জনগনকে একের পর এক লজ্জা দিয়েই যাচ্ছেন ! কিংবা  ‘লজ্জা’ হয়তো  নিজেই ‘লজ্জা’ পেয়ে গেছে ! হু নোজ ?