এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬

কে খায় গরীবের টাকা?

ডাক্তার সবগুলা কসাই। আমার মতন গরীবের থাইকাও তিন হাজার টেকা নিলো। বকরিটা বেইচ্চা এই টেকা জোগাড় দিলাম।
হাসপাতালের বাইরে চায়ের দোকানে পেছনের টেবিলে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুর সাথে গল্প করছিলো ডাঃ মুনীর। এমন সময় এমন একটা মন্তব্য কানে আসে তার। উৎসুক চোখে লোকটাকে ভালো করে খেয়াল করে মুনীর। হ্যা, এই লোকের রোগীকে আজকেই ছুটি দেয়া হয়েছে। তার স্ত্রীই ছিলেন রোগী।
কিন্তু এই মুহূর্তে তার মুখে এই কথা শুনে মুনীরের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। কারণ, গরীব বলে এই লোকের সবগুলো ইনভেস্টগেশান ফ্রি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সে। পুওর ফান্ড থেকে ব্যবস্থা করে দিয়েছে সব ওষুধের। বলা বাহুল্য, এই পুওর ফান্ড কোন সরকারী ফান্ড নয়। ডাক্তাররা নিজেরা চাঁদা দিয়ে, ঔষধ কোম্পানির কাছে ওষুধ অনুদান নিয়ে বানিয়েছে এই পুওর ফান্ড। যাদের আসলেই কিছু নেই, তাদেরকে এখান থেকে সাহায্য করা হয়।
অথচ এখন এই লোক বলে কিনা তার তিন হাজার টাকা ডাক্তাররা নিয়েছে!!
ব্যাপারটা কী?

লোকটা যখন বাইরে বেরুবে তখনই তাকে পেছন থেকে ডাক দিলো মুনীর।
চাচা আছেন কেমন? আচ্ছা ব্যাপারটা কী একটু আমাকে খুলে বলেন তো! শুনলাম ডাক্তাররা নাকি আপনার তিনহাজার টাকা নিয়েছে?
চাচীর চিকিৎসা তো আমি করলাম। কই, আমারে তো কিছু দিলেন না!
মুনীরের কথায় থতমত খেয়ে গেল বেচারা। চেহারায় ফিরে এলো পুরনো কাচুমাচু ভাবটাও।
- না বাবা, আপ্নেই তো সব ব্যবস্থা কইরা দিলেন। তয় আপ্নাগো কথা বইলা তো ওয়ার্ড বয়ে টেকা নিলো। আয়া ২০০ টেকা নিলো ক্যাথেটার করাইয়া । সিট দেয়ার জইন্যে একজনে নিল ৫০০ টেকা, আর আপনেগো ফি বাবদ একজন লোকে নিছে তিনদিনে দেড়হাজার টেকা। কইছে টেকা দিলে আপনেরা ভালা কইরা দেখপেন। না দিলে নাকি সমস্যা হইবো।
আর ট্রলিতে কইরা যে এক্সরে করতে নিছিলাম হেরা নিছে ৫০০ ট্যাকা।
কইছে, এই টেকা ডাক্তারগো দিতে অইবো।
মুনীর হতবাক হয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কাকে দোষ দেবে?? গ্রাম থেকে আসা এইসব অবুঝ মানুষকে, নাকি কর্মচারীদেরকে, নাকি হাসপাতাল প্রশাসনকে!
হাসপাতালে রোগী চিকিৎসা ঠিকই ফ্রি পাচ্ছে, কিন্তু নানাভাবে তার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক গোষ্ঠি- যার একটা বড় অংশের সাথে জড়িত হাসপাতালের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা।
আর সব প্রতারকই খাচ্ছে ডাক্তারের নাম ভাঙ্গিয়ে।
মুনীর জানে, এরকম হয়। তবু নতুন করে কিছুটা হতাশা বোধ করে সে। বিনামূল্যে খেটে, দরদ নিয়ে রোগীর জন্য কাজ করেও শেষমেষ বদনামটা ডাক্তারকেই কাঁধে নিতে হয়। কারণ, সাধারণ মানুষ হাসপাতাল প্রশাসন চেনে না। তারা জানেনা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্ব হাসপাতাল প্রশাসনের।
তাদের কাছে হাসপাতাল মানেই- "ডাক্তার"।

সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬

প্রস্তুতি

চিরন্তন অনিশ্চয়তার মাঝে ছুটছে জীবন।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হালখাতায়
যোগ আর বিয়োগের হিসাব ক্রমাগত ওঠানামা করে
থার্মোমিটারের পারদ স্তম্ভের মত।
শত উত্থান পতনের শেষে
টিকে আছি আজো বহাল তবিয়তে;
তবু
প্রায়শই নিজেকে শুধাইঃ আসন্ন পরাজয়ে-
কতটুকু জলের জোয়ার সইতে পারবে
আমার এই দুর্বল চোখ?
কতটুকু শক্ত করলে এই নরম হৃদয়
নিরন্তর সয়ে যাওয়া যাবে-
স্বপ্নভঙ্গের শোক?

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

সন্তানেরও আছে অধিকার

ওয়াবিল ওয়ালিদাইনে ইহসানা। তোমরা পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। এইটুকু সবাই জানে। কারণ, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের শিক্ষা সবাইকে দেয়া হয়। কিন্তু সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব কী- এইটা কোথাও শিক্ষা দেয়া হয় না।
সন্তানের ওপর পিতামাতার অধিকার কী তা নিয়া অনেক ওয়াজ নসিহত হয়, কিন্তু সন্তানের অধিকার কী- সেটা নিয়া কোন নসিহত পাওয়া যায় না। কোন বয়ান শোনা যায় না।
ফলে বাস্তব অবস্থাটা হতাশাজনকই থাকে। গাছের নিকট সবাই ফল প্রত্যাশা করে, সবাই জানে- আমগাছের উচিৎ ভালো ভালো আম উপহার দেওয়া। কিন্তু আমগাছকে যে গোড়ায় পানি দিয়ে, যত্ন করে বাড়তে দিলে তবেই ভালো ফল পাওয়া যাবে এইটা আমাদের সমাজের পিতামাতারা বোঝেন না। আর দিনশেষে সব দোষ ঐ ছেলেমেয়েদের ঘাড়েই বর্তানোর ধান্দায় থাকেন। ছেলেটা বিগড়ে গেছে, মেয়েটা বেয়াদব হয়ে গেছে এইসব বলে তাঁরা নিজেদের দায় এড়িয়ে যান।
কোন কোন বাবা-মা সন্তানদেরকে ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্রের মত একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন, জড়বস্তুর মত মনে করেন। নিজের সিদ্ধান্তই সর্বেসর্বা, দুইদিনের বাচ্চা- এরা আর কী বুঝবে (!) এইরকম মনোভাব পোষণ করেন। তারা হয়ে ওঠেন সংসারের স্বৈরাচারী শাসক।
নিজের পছন্দ অপছন্দকে সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেন। ওরাও যে একেকজন স্বতন্ত্র মানুষ এই সত্যটা একদম স্বীকার করতে চান না।
সমাজের যতসব বিশৃঙখলা অরাজকতা, তার পেছনে বাবা-মায়েদের এইসব দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি অনেকাংশে দায়ী মনে করি। আসলে, বাচ্চাদের শিক্ষার পাশাপাশি বাপ-মায়েদেরও শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটাই- বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?

বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬

পরিচয়

প্রেমিকেরা কবি হয়? নাকি
কবিই প্রেমিক?
এই নিয়ে নিরন্তর মতভেদ
আজো হয়নি অবসান।

আর
আমিও পারিনি চিনতে নিজেকে।
দিনভর তপস্যার পরিশেষে
এখনো হয়নি জানা-
কোথায় দাঁড়ালো গিয়ে আমার পরিচয়?
কবি? নাকি প্রেমিক?
নাকি,
কোনটাই নয়!!!

শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৬

মায়া

"সালাম ছার। আপনারে দুইদিন ধইরা দেখি নাই। কুনু অসুবিদা হয় নাই তো ছার?"
"আসি ছার, দোয়া কইরেন। আমরার লাগি অনেক কষ্ট করছেন ছার। ভুল তুরুটি হইলে মাফ কইরা দিয়েন।"
হাসপাতালে রোগীদের মুখে এইসব কথা শুনে বড় মায়া লাগে। একটু আন্তরিকভাবে খোঁজখবর নেয়া, সম্মান দিয়ে কথা বলা, সামান্য সহানুভূতি আর ভালো ব্যবহারের বিনিময়ে এমন নিষ্পাপ ভালোবাসা, সহ্য করা যায় না।

উপদেশগুলো বুঝিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানাই। বলি- যান, সাবধানে থাকবেন। ঠিকমত ওষুধ খাবেন। আমাদের জন্যে দোয়া করবেন।

হাসপাতাল প্রস্থানরত মানুষের দিকে চেয়ে থাকি। হায়রে মায়ার পৃথিবী!! ক'দিনের পরিচয়ে, কত অল্পতেই মানুষ কী অদ্ভুত মায়ায় পড়ে যায়!!

এক রাতের গল্প

ঘোর অমাবশ্যা ছিল সেই রাত।
পথের প্রতিটি কিনারে, ঝোঁপে ঝাড়ে,
পরম আনন্দে ঘর বেঁধেছিলো
গাঢ় অন্ধকার।
একটা ফুলও ছিঁড়তে পারিনি,
অথচ
কাঁটায় কাঁটায় ছিন্নভিন্ন হয়েছিলো শরীরের
সবগুলো লোমকূপ।

তবু আমরা হেঁটেছিলাম, ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে-
ক্রমাগত হেঁটেছিলাম রাত্রির দীর্ঘ পথ।
তারপর ভোর হলে দেখা গেল
পৌঁছেছি গিয়ে এক অদ্ভুত ঠিকানায়।
যেখানে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য ম্লান মনে হয়।
যেখানে চাঁদকে মনে হয় ঘরের পিদিম,
যেখানে পুরোপুরি বদলে গিয়েছিলো
সুখ ও সৌন্দর্যের পুরনো সংজ্ঞা।

সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬

ডাক্তারের কমিশন খাওয়াঃ বাস্তবতা কী?

ডাক্তাররা কমিশন খাওয়া বন্ধ করলে চিকিৎসা ব্যয় ৪০% কমে যাবে। এই ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের সাম্প্রতিক একটি খবরের শিরোনাম। প্রফেসর প্রাণ গোপাল স্যারকে উদ্ধৃত করে তারা এই সংবাদটি করেছে। আমি নিশ্চিত এটা প্রাণ গোপাল স্যারের বক্তব্যের একটা খন্ডিত অংশ মাত্র। তিনি নিশ্চয়ই আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। কিন্তু সাংবাদিক মহাশয় সেসব বাদ দিয়ে এই খন্ডিত অংশটিকে হাইলাইট করেছেন।
এবং বলা বাহুল্য, খবরটি বংগ জনতার খুবই "মনে ধরেছে"!! কোন এক অদ্ভুত কারণে এদেশের মানুষের একটা অংশ ডাক্তারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পৈশাচিক আনন্দ বোধ করেন।
যাহোক, প্রশ্ন হচ্ছে, সমস্যাটা আসলে কি "ডাক্তারদের কমিশন খাওয়া"?
সম্পূরক প্রশ্নগুলো হচ্ছে, ডাক্তাররা কীভাবে কমিশন খায়? ডাক্তাররা কি কাউকে কমিশন দিতে বাধ্য করতে পারে? আর কীভাবে এটা বন্ধ করা যায়?
প্রথমত, ডাক্তারদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনরকম কমিশন খান না। বরং যেখানেই সম্ভব, চেষ্টা করেন রোগীর ল্যাব খরচ কমাতে।
গুটিকয়েক অসাধু ডাক্তার কমিশন খান। তারা এটা খান "ডাক্তার" হিসেবে না, মন্দ মানুষ হিসেবে। প্রত্যেক প্রফেশনে যেমন কিছু মন্দ মানুষ আছে, তেমনই।
দ্বিতীয়ত, কোন ডাক্তারই কমিশন দিতে কাউকে বাধ্য করেন না। বরং, ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোই অনেকসময় ডাক্তারকে বাধ্য করে কমিশন নিতে। কারণ, তারা ল্যাব টেস্টের দাম কমায় না। বরং, রেফারেলের জন্য বরাদ্দ টাকাটা ডাক্তার না নিলেও ল্যাবেরই কেউ না কেউ ডাক্তারের নাম করে মেরে দেয়। এজন্য অনেক ডাক্তারই আছেন, রেফারেল ফি নামে যে টাকা ডায়াগনোস্টিকগুলো দেয়, সেটা তারা পুরোপুরি গরীব রোগীদের জন্য ব্যয় করেন।
আর বড় হাসপাতালগুলোতে যারা বসেন, তারা আসলে কোনভাবেই এইসব কমিশন টমিশন পান না। এইসব ঘটে মূলত ছোটখাটো নামকাওয়াস্তে হাসপাতাল ও ডায়াগনোস্টিক গুলোতে।
তৃতীয়ত, মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এই কমিশন প্রথার জন্য দায়ী কে? ডাক্তার, নাকি অন্য কেউ? এটা বন্ধ করার উপায়টাই বা কী?
আসলে এই প্রথা কোনভাবেই ডাক্তারদের তৈরি নয়। এটা তৈরি করেছে ব্যবসায়ীরা, যারা মানুষের অসুস্থতাকে ব্যবসার পুঁজি করেছে টাকা বানানোর উপায় হিসেবে। তারা বিভিন্ন ল্যাব টেস্ট এর মূল্য অস্বাভাবিক বেশি রেখে মুনাফা করছে, আরো বেশি মুনাফার লোভে ডাক্তারদের পেছনে টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করে, আর কিছু কিছু ডাক্তারকে খাওয়াতেও পেরেছে।
এটা বন্ধ করার উপায় কী? ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে নসিহত কিংবা উষ্মা প্রকাশে কোন সমাধান আসবে কি?
মোটেও না। গোড়ায় হাত দিতে হবে। এইযে ল্যাব টেস্টগুলোর অস্বাভাবিক মূল্য, এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন টেস্টের মূল্য বেঁধে দিতে হবে। ডায়াগনোস্টিক সেন্টার যদি অতিরিক্ত মূল্য নিতে না পারে, তাহলে তারা কোথা থেকে কমিশন দেবে? ফলে অটোমেটিকালি বন্ধ হয়ে যাবে এই তথাকথিত কমিশন প্রথা ।
একই কথা ঔষধের ক্ষেত্রেও। ঔষধের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি। এটা নিয়ন্ত্রণ করলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে।
কিন্তু এই দায়িত্ব তো ডাক্তারদের না! এটা প্রশাসনের দায়িত্ব, সরকারের দায়িত্ব। সুতরাং, "ডাক্তাররা কমিশন খাওয়া" বন্ধ করলে চিকিৎসা ব্যয় কমবে, এটা একটা অযৌক্তিক কথা। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভ্রান্তিমূলক এবং বলা যায় পরশ্রীকাতরতানির্ভর বক্তব্য। এটা প্রাণ গোপাল স্যারের বক্তব্য নয়, এটা ঐ সাংবাদিকেরই টুইস্টেড কথা। আসলে বক্তব্যটা হওয়া উচিৎ, ঔষধ ও ডায়াগনোস্টিক টেস্টের মূল্য নির্ধারণ করে দিলে চিকিৎসা ব্যয় কমবে। কিন্তু সেকথা না বলে, সমস্যার মূলে আঘাত না করে, শুধু ডাক্তারদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বক্তব্য দেয়া আসলে অসুস্থ মানসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৬

শুন্যতা

কিছু কিছু সময় আসে
অদ্ভুত অজানা অনুভূতি জাগে
সমস্ত চেতনায়,
সমগ্র অস্তিত্বে।

ভালোলাগা নয়, ভালোবাসা নয়,
সুখ - দুঃখ নয়,
প্রেম অথবা বিরহও নয়।

এ এক অন্যরকম শুন্যতার অনুভূতি।

মনে হয়,
বুকের ভেতর একদম কিছু নেই;
না ফুসফুস, না হৃদপিন্ড!

বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৬

চিকিৎসায় অবহেলার সংজ্ঞা কী?

স্বাস্থ্যসেবা আইন' ২০১৬ নামে আইনের একটি খসড়া আইন কমিশনের বিবেচনাধীন আছে। এতে বারোটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত ৫২ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
জনগনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনের প্রয়োজন আছে। তবে আইন হতে হবে যৌক্তিক, যাতে সব পক্ষের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকে। এই আইনে অনেক ভালো দিক রয়েছে, কিন্তু চিকিৎসায় অবহেলাকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সুযোগ আছে। এখানে পেশাগত অবহেলা বলতে বোঝানো হয়েছে- 'ভুল চিকিৎসা' যা দ্বারা 'রোগ মুক্তি ঘটে না' বা 'বিলম্বিত হয়'।
যেকোন চিকিৎসার অনেক ধাপ আছে। এর যেকোন পর্যায়ে সমস্যা হলে কাংখিত ফল পাওয়া নাও যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে, চিকিৎসার শুরুটা কিন্তু রোগীর হাতেই । রোগী সঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন কিনা, রোগের কোন অবস্থায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন, ডাক্তারের কাছে ঠিকঠিক মত তার সমস্যার কথা বললেন কিনা, রোগের ইতিহাস ঠিকমত দিতে পারলেন কিনা, কোনকিছু গোপন করলেন কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতের চিকিৎসা ।
এরপর কিছু অংশ ডাক্তারের হাতে। ডাক্তার কতটা দক্ষ, কতটা অভিজ্ঞ, কতটা জ্ঞানী সেটার ওপর নির্ভর করবে তাঁর রোগ নির্ণয়ের দক্ষতা।
তারপরের কিছু অংশ প্যাথলজি বা অন্যান্য ডায়াগনোস্টিক টেস্টের ওপর। সেগুলো আবার নির্ভর করে ল্যাবের যন্ত্রপাতির গুণগত মান, টেকনিশিয়ানের দক্ষতার ওপর।
রোগ নির্ণীত হলে পরে চিকিৎসা। একই রোগের চিকিৎসা আবার সকল রোগীর ক্ষেত্রে একরকম হবে না। পার্থক্য হবে রোগীর শারীরিক অবস্থা, অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টরের উপস্থিতির ওপর। একটি রোগের সাথে অন্যান্য রোগের সহাবস্থানও চিকিৎসার বিরাট অন্তরায়। রোগীর আর্থিক সক্ষমতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
একটি রোগের চিকিৎসার বিভিন্ন পন্থা থাকে। রোগী কোন পন্থা গ্রহণ করতে চান সেটাও একটা ব্যাপার।
সবশেষে ঔষধ প্রয়োগ। ডাক্তার রোগীকে ঔষধ গ্রহণের পরামর্শ দেন। কিন্তু সেই ঔষধ রোগী সঠিক সময়মত, সঠিক পরিমাণে, সঠিক পন্থায় গ্রহণ করছেন কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ওষুধের রেসপন্স।
শুধু ওষুধ গ্রহণ করলেই চলে না, ঠিকমত মানতে হবে অন্যান্য পরামর্শও। নিয়মিত ফলো আপ করাও অত্যন্ত জরুরী। ওষুধের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজন অনুসারে ডোজ এডজাস্ট করা দরকার হয়।
এছাড়াও ডাক্তার যে ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন সে ওষুধ কিন্তু তিনি প্রস্তুত করেন না। ওষুধ কোম্পানি যথাযথভাবে ঔষধ প্রস্তুত করেছে কিনা, ফার্মেসি ঠিকমত সংরক্ষণ করেছিল কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ওষুধের কার্যকারীতা। আবার ওষুধ একই হলেও বিভিন্ন জনের শরীরে তার কার্যকারীতা বিভিন্নরকম হতে পারে।
এতগুলো ফ্যাক্টর জড়িত একজন মানুষের যেকোন একটি রোগের চিকিৎসায়। এখন রোগীর রোগ মুক্তি না ঘটলেই বা বিলম্ব হলেই কি তাকে ভুল চিকিৎসা বলা যাবে? তাই যদি হয়, তাহলে এদেশে চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতেই পারবেন না। আর বিলম্বের সংজ্ঞাটাই বা কী? এক সপ্তাহে ক্যান্সার থেকে মুক্তি না মিললে সেটাকে কি রোগ মুক্তিতে বিলম্ব বলা যাবে?