ক্ষেত্র ফল শূন্য
চান্দের
গাড়ি থেকে রুমা বাজারে নেমেছি , এদিক ওদিক তাকাচ্ছি । এরই মাঝে ছোটখাটো
চেহারার লুঙ্গি- শার্ট পরা একজন এসে জিজ্ঞেস করলো- আপনারা কোথায় যাবেন ?
বললাম , আমরা বগা লেক যাবো । কেওক্রাডং যাবো । রাইখ্যং লেক যাবো ।
সে বললো- আমি আপনাদের গাইড !
আমরা তো অবাক । বলা নেই কওয়া নেই, আমাদের পছন্দ অপছন্দের বালাই নেই - সে নিজে নিজেকে আমাদের গাইড নিয়োগ দিয়ে ফেললো !
আমরা বললাম , আপনার নাম কী ?
উত্তরে সে বললো, ক্ষেত্র বাবু ।
আমরা বললাম , আমরা তো বেলাল গাইডকে খুঁজছি ।
ক্ষেত্র জানালো, বেলাল নাই । অন্য টুরিস্ট নিয়ে পাহাড়ে গেছে । আমিই আপনাদের গাইড ।
গাইডদের
সমিতি আছে , সমিতির অফিসে গেলাম আমরা । ক্ষেত্রবাবুই নিয়ে গেল । ওটাই
নিয়ম । কোন গাইড যদি পর্যটক নিয়ে পাহাড়ে যেতে চায়, তাকে প্রথমে গাইড অফিসে
রিপোর্ট করতে হবে । গাইড সমিতির সেক্রেটারির সাথে দেখা হলো সেখানে ।
গাইডদের ফি কেমন সেটা জানলাম । বগালেক পর্যন্ত গেলে দিনপ্রতি পাঁচশ টাকা ।
আর বগালেক পার হলে প্যাকেজ বিল পাঁচহাজার টাকা । গাইডের থাকা খাওয়ার বিল
টুরিস্টের ।
গাইড সমিতির সেক্রেটারি জাকির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন , আমরা এই গাইডকে পছন্দ করেছি কিনা ।
আমরা
বললাম , আমরা তো গাড়ি থেকে নামার পর উনাকে পেয়েছি । কিন্তু আমরা আসলে
বেলাল নামে একজনকে খুজছিলাম । সে আমাদের পরিচিত । আমাদের বন্ধুদের গাইড
হিসেবে আগে সে কাজ করেছে ।
ক্ষেত্রবাবু বললেন, আমি এদের প্রথমে ‘ধরেছি’, আমিই গাইড হবো !
আমরা
বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম । এরই মাঝে বেলাল চলে এলো । কেউ একজন তাকে
খবর দিয়েছে যে আমরা তার খোঁজ করছি । বেলালকে দেখেই আমাদের পছন্দ হলো ।
প্রায় আমাদের সমবয়সী । ইয়াং, এনার্জেটিক ম্যান । ওকে নিয়ে দীর্ঘ পথ হাঁটা
সম্ভব । ওদিকে ক্ষেত্র বাবু মধ্যবয়স্ক , দুর্বল মানুষ । তারওপর এরই মধ্যে
আমরা জেনে গেছি- ক্ষেত্রবাবু আসলে একজন মাদকাসক্ত । তার কাজকর্মের ঠিক নাই
। এর আগেও পর্যটক নিয়ে গিয়ে সে ভজঘট করেছিল ।
আমরা এরপর
গেলাম আর্মি ক্যাম্পে । পাহাড়ে রওয়ানা দেবার আগে অবশ্যই আর্মি ক্যাম্পে
গাইডসহ রিপোর্ট করতে হয় । সেখানে সৈনিকদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম
আমরা । আমাদের ডাক্তার পরিচয় দিলাম , আর্মিতে থাকা আমাদের বন্ধুদের পরিচয়
দিলাম ।
বেলাল এবং ক্ষেত্রবাবু দুজনেই আমাদের সাথে এসেছে । এখানেই
চূড়ান্ত ফায়সালা হবে – কে হবে আমাদের গাইড । আর্মির সিপাহী আমাদের জিজ্ঞেস
করলেন – আপনারা কাকে নিতে চান ? আমরা বললাম – বেলালকে ।
ক্ষেত্রবাবু বললে – আমি আগে ধরেছি , আমিই গাইড হবো ।
সিপাহী বললেন – এখানে ধরাধরির তো কিছু নাই । ট্যুরিস্ট যাকে পছন্দ করবে- সেই হবে গাইড ।
আর্মি ক্যাম্পের রেজিস্টার খাতায় আমরা আমাদের পাঁচজনের নাম ঠিকানা লিখলাম । বেচারা ক্ষেত্রবাবুর গাইড হওয়া হলো না ।
ক্ষেত্র হলো ফলশূন্য !
আমরা হলাম ‘বন্দু’
গাইডের
সাথে পরামর্শ করে আমরা পাহাড়ে আগামী চারদিনের খাওয়ার জন্য চাল ডাল তেল
মরিচ পেঁয়াজ কিনলাম । পাহাড়ে হাঁটার জন্য কিনলাম বিশেষ ধরণের প্লাস্টিকের
স্যান্ডেল । দাম দেড়শ টাকা প্রতি জোড়া । দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিলাম একটা
হোটেলে । খারাপ না । একটা ল্যান্ড রোভার ভাড়া করলাম বগা লেক পর্যন্ত । আড়াই
হাজার টাকা । সব ব্যবস্থা অবশ্য আমাদের সাথে পরামর্শ করে গাইডই করছিলো ।
কিছুক্ষণের
মধ্যেই খেয়াল করলাম – আমাদের গাইড বেলাল সবাইকে ‘বন্দু’(উচ্চারণটা
‘বন্ধু’ নয় কিন্তু ! ) বলে সম্বোধন করছে ! বুঝলাম , পাহাড়ে ‘বন্দু’
সম্বোধনটা বেশ চলে । যে কয়দিন পাহাড়ে আছি, আমরা এদের ‘বন্দু’ হয়েই থাকবো !
পথের বাপই বাপরে মনা...
মেডিকেল
কলেজ থেকে পাশ করে বের হবার পর বন্ধুরা বেশ বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছিলাম ।
মান্না দে'র 'কফি হাউজ' গানের মত । নিখিলেশ প্যারিসে, মইদুল ঢাকাতে । আমরা
ছিলাম কেউ ঢাকায় , কেউ চট্টগ্রামে, কেউ ফেনীতে । ছাত্র থাকা অবস্থায়
চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রায় সবখানেই ঘুরেছি । বান্দরবানেও গেছি , কিন্তু
চিম্বুক পর্যন্ত । বগা লেকটা যাওয়া হয়নি । কেওক্রাডং বিজয় বাকি ছিল । এবার
বের হয়েছি সেই অভিযানে । এপ্রিলের আট তারিখ ঢাকা থেকে আমি এবং মাসুম গিয়ে
পৌঁছলাম চট্টগ্রামে । সেখানে রাতে থেকে বন্ধু জনি, জুয়েল এবং ইয়াসিনকে
সাথে নিয়ে ভোরবেলা বহদ্দারহাট বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে উঠে পড়লাম বান্দরবানের
বাসে । তখন সকাল সাড়ে সাতটা প্রায় । সকালের নাস্তা বাসেই করলাম । বাসভাড়া
জনপ্রতি ১১০ টাকা ।
এগারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম বান্দরবান শহরে ।
সেখানে আমাদের দুবছরের জুনিয়র সাইফের বাসা । সেসময় সাইফ বাসাতেই ছিল, ওকে
ফোন করে ডেকে নিলাম । আরেকদফা নাস্তা করে আমরা সাইফের সাহায্যে একটা
চান্দের গাড়ি ভাড়া করলাম রুমা বাজার পর্যন্ত । চান্দের গাড়ি হলো পাহাড়ে
চলার উপযোগী খোলা জিপ । ভাড়া ২২০০ টাকা লাগলো । বান্দরবান থেকে আমাদের
বিদায় দিল সাইফ ।
বান্দরবান থেকে রুমা বাজারের পথটাও
অসাধারণ । আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ । গাড়ি চলেছে ঝড়ের বেগে । আর আমরা গাইছি –
পথের বাপই বাপরে মনা ... পথের মা-ই মা ! পথের মাঝেই খুঁজে পাবি, আপন
ঠিকানা !
দুপুর একটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম রুমা বাজারে ।
পা পিছলে আলুর দম !
রুমা
বাজার পার হয়ে কিছুদূর পরেই পুলিশ চেক পোস্ট । পুলিশ চেক পোস্টেও রিপোর্ট
করতে হয় । একটা লেকের ওপর পুলিশ চেক পোস্টটি । আমরা ওখানে নেমে আবার
আমাদের নামধাম লিখে দিলাম । গাড়ি আবার ছুটলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে । চরম
রিস্কি পথ । গাড়ির চাকা পিছলে গেলেই অক্কা পাবার সমূহ সম্ভাবনা । গাড়ি
গিয়ে পড়বে গভীর খাদে । দূরে দেখা যাচ্ছে আঁকাবাঁকা সাঙ্গু নদী । শো শো
বাতাস । সে এক অন্যরকম অনুভূতি ।
পাহাড়ের ফাঁকে বয়ে চলেছে সাঙ্গু নদী ।
প্রায় দুঘন্টা পর আমরা বগালেকের নিচের পাহাড়ে এসে পৌছলাম । এখান থেকে আরো আধা ঘন্টার পথ ।
বগা
লেকের নিচ থেকে ওঠা এই রাস্তাটা আরো বেশি রিস্কি । প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাড়া
পাহাড়ের গা বেয়ে গাড়ি উঠবে । মনে হবে যেন গাড়ি উল্টেই যাবে ! আমরা সবাই
শক্ত করে গাড়ির সিট ধরে রেখেছি । মনে হচ্ছিলো যেন ঝুলে আছি । লা ইলাহা
ইল্লা আনতা সোবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন দোয়া পড়ছি । এরই মাঝে
একবার একটা বাঁক নেয়ার সময় গাড়ি আটকে গেল ! গাড়ির চাকা শুন্যের ওপর ঘুরতে
লাগলো । এখন যদি গাড়ি পেছনের দিকে পড়ে যায় – কমপক্ষে দুই হাজার ফুট নিচে
গিয়ে পড়বে ।
আমরা কালেমা পড়া শুরু করলাম ।
কয়েক
মিনিট পরে আল্লাহর রহমতে কীভাবে যেন আবার গাড়ি সামনে এগুতে শুরু করলো ।
অল্পের জন্য আমরা পা পিছলে ‘আলুর দম’ হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম ।
অবশেষে বগা লেক
অবশেষে
যখন বগা লেকে পৌছলাম , তখন বিকেল হয়ে গেছে । ওখানে পৌঁছেও আর্মি ক্যাম্পে
রিপোর্ট করতে হলো । বগা লেকের পাড়ে আমরা উঠলাম লারামের কটেজে । এখানে আরো
দুএকটা কটেজ আছে ।
পাহাড়ের ওপরে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে তৈরি করা হয়েছে
পর্যটকদের জন্য এইসব কটেজ । ভাড়া যথেষ্ট কমই বলা যায়- প্রতিরাত জনপ্রতি
একশ টাকা । আমাদের গাইড জানালো- এদের কাছে একশ টাকাই অনেক কিছু ।
দেখা হয়ে গেলো কটেজের মালিক লারাম দাদার সাথেও । ব্যাগপত্র রেখে আমরা লেকে নেমে গেলাম গোসল করতে ।
বগা লেকে ফুটে আছে শাপলা ফুল ।
বগা
লেকের প্রকৃত নাম - বগাকাইন হ্রদ । স্থানীয়রা সংক্ষিপ্ত করে বগা লেক বলে
থাকে । অবশ্য তাদের বাংলা এক্সেন্টে এটার উচ্চারণ শোনায় 'বুগা লেক' !
পাহাড়ের ওপরে এতবড় একটা লেক, আশ্চর্যই বটে । এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ
উচ্চতার স্বাদু পানির একটি হ্রদ । বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০
কিলোমিটার দূরে বগাকাইন হ্রদের অবস্থান । কেওকারাডং পর্বতের গা ঘেষে, রুমা
উপজেলায় । সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১,৫০০ ফুট ।
উপর হতে বগা লেকের চিরসবুজ দৃশ্য ।
বাংলাদেশের
ভূতাত্ত্বিকদের মতে বগাকাইন হ্রদ মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ অথবা
মহাশূন্য থেকে উল্কাপিন্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আবার
ভূমিধ্বসের কারণেও এটি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন । বগা লেকের পানি
সুপেয় । লেকের জলে প্রচুর শ্যাওলা, শালুক, শাপলা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ
এবং প্রচুর মাছ রয়েছে।
বগালেকের রুপকথা
বগালেকের
স্থানীয়রা বম, মুরং বা ম্রো, তঞ্চংগ্যা এবং ত্রিপুরাসহ অন্যান্য
আদিবাসী। স্থানীয় আদিবাসীদের উপকথা অনুযায়ী, অনেক কাল আগে পাহাড়ের
গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো । বম ভাষায় ড্রাগনকে "বগা" বলা হয়।
ড্রাগন-দেবতাকে তুষ্ট করতে স্থানীয়রা গবাদী পশু উৎসর্গ করতেন। কিন্তু
লোকেরা এই ড্রাগন দেবতাকে হত্যা করলে চূঁড়াটি জলমগ্ন লেকে পরিণত হয় এবং
গ্রামগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে ।
এই হ্রদটি তিনদিক থেকে
পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত। এর গভীরতা হচ্ছে ৩৮ মিটার (১২৫ ফুট)। এটি
সম্পূর্ণ আবদ্ধ হ্রদ— এ থেকে পানি বের হতে পারে না এবং কোনো পানি ঢুকতেও
পারে না। এর আশেপাশে পানির কোনো দৃশ্যমান উৎসও নেই। তবে হ্রদ যে উচ্চতায়
অবস্থিত তা থেকে ১৫৩ মিটার নিচে একটি ছোট ঝর্ণার উৎস আছে যা বগা ছড়া নামে
পরিচিত। হ্রদের পানি কখনও পরিষ্কার আবার কখনওবা ঘোলাটে হয়ে যায়। কারণ
হিসেবে অনেকে মনে করেন এর তলদেশে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। এই প্রস্রবণ
থেকে পানি বের হওয়ার সময় হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়।
স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা এই হ্রদের আশেপাশে দেবতারা বাস করে। এজন্য তারা এখানে পূজা দেন ।
জীবনটা কত ঠুনকো !
রাতে
বগা লেকের পাড়ে বসে আমরা পাঁচ বন্ধু অনেক জমানো গল্প করলাম । এক ফাঁকে
হয়ে গেল জম্পেশ ঝালমুড়ি খাওয়া । নয়টার দিকে ভাত খেয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম ।
শরীর ক্লান্ত ছিল সারাদিনের জার্নির শারীরিক ও মানসিক ধকলে । আর তাছাড়া
পরদিন সকালেই আমাদের রওনা দিতে হবে কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে ।
সকালে
খুব ভোরে উঠে নাস্তা করেই আমরা আমাদের ব্যাগ কাঁধে নিলাম । কেওক্রাডং
যাবার আগে আমরা হারমুন পাড়া নামে একটি পাড়ায় বিরতি দেবো । সেটাই হবে আমাদের
পরবর্তী স্টেশন । ওখানে ব্যাগ রেখে কেওক্রাডং যাবো , ফিরে এসে রাতেও
সেখানেই থাকবো । পরদিন সেখান থেকেই রওনা হবো রাইখ্যং লেক – স্থানীয় ভাষায়
'পুকুর পাড়ে'র উদ্দেশ্যে ।
বগা লেক থেকে কেওক্রাডং এর দূরত্ব
প্রায় ১৫ কিমি । আমরা একটা ট্রাকে উঠলাম । ট্রাক যাবে হারমুন পাড়া
পর্যন্ত, ৫-৬ কিলোমিটার পথ । সে আরেক ভয়ংকর জার্নি । ৬০-৭০ ডিগ্রি খাড়া
পাহাড় বেয়ে উঠছে ট্রাক , আবার নামছেও খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে । ভয়ে আত্মারাম
খাঁচাছাড়া হবার জোগাড় ।
দুর্বল চিত্তের কারো পক্ষে এই পথে গাড়িতে
যাওয়া অসম্ভব । অজ্ঞান হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে । এইসময় মনে হচ্ছিলো-
জীবনটা কত ঠুনকো । যেকোন সময় এইসব পাহাড়ের কোন এক খাদে আমাদের সলিল সমাধি
হয়ে যেতে পারে ।
কেওক্রাডং চূড়ায় আমরা
হারমুন
পাড়ায় গিয়ে আবার কটেজ ভাড়া করলাম আমরা । একটা কাঠের ঘরের মেঝেতে থাকার
ব্যবস্থা । ওখানে ব্যাগ রেখে আমরা হাঁটা শুরু করলাম কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে
।
একের পর এক পাহাড় পেরিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি । মাঝে মাঝে
জিরিয়ে নিচ্ছি । সবাই হাতে একটা করে লাঠি নিয়েছি । হাঁটার সময় লাঠিটা অনেক
মানসিক শক্তি যোগায় ।
চলছি পাহাড় ডিঙ্গিয়ে কেওক্রাডং এর পথে । লেখক কালো পোষাকে ।
পথে
পড়লো দার্জিলিং পাড়া । দার্জিলিং পাড়ায় বম উপজাতিদের বাস । ধর্মে তারা
খ্রিস্টান । বমরা অন্যান্য উপজাতির তুলনায় বেশ অগ্রসর । বমদের নিজস্ব ভাষা
আছে । তবে নিজস্ব বর্নমালা নেই । ইংরেজী বর্ণমালাতেই বম ভাষায় লিখতে হয় ।
খ্রিস্টান মিশনারীরা বম ভাষায় বাইবেল ট্রান্সলেট করে দিয়েছেন ।
দার্জিলিং পাড়ায় বম ভাষায় লিখিত একটি নোটিশ ।
দার্জিলিং
পাড়ায় বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম । প্রত্যেক পাড়ায় একটা করে দোকান আছে
পাহাড়িদের । দোকানে বসে পাহাড়ী কলা খেলাম পেট পুরে । সাথে ঝালমুড়ি ।
ক্যাসেট প্লেয়ারে একটা গান বাজছিল – ঝিরি ঝিরি লাসাই লাসাই... এই কথাটা
কেন যেন মাথায় ঢুকে গেল । বাকি পথটা আমরা বম ভাষার এই গানের কলি আওড়াতে
আওড়াতে হাঁটতে লাগলাম ।
দার্জিলিং পাড়া পার হয়ে কেওক্রাডং । দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম কেওক্রাডং চূড়ায় । উড়িয়ে দিলাম বাংলাদেশের পতাকা ।
কেওক্রাডং পর্বতের ঢালে এভাবেই লেখা আছে তার নাম ।
কেওক্রাডং
বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এক সময় এটিই বাংলাদেশের
সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ছিল । আমরা ছোটবেলায় বই-পুস্তকে এটার কথাই পড়েছি । তবে
বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তাজিং ডংকে ধরা হয় । যদিও বাংলাদেশের
বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক এবং সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকে এখনও একে সর্বোচ্চ
পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
বান্দরবান জেলা
প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী কেওক্রাডং এর উচ্চতা ৪৩৩০ ফুট । কেওক্রাডং চূড়ায়
একটি সেনা ক্যাম্প আছে । সেনাবাহিনীর ফলকে কেওক্রাডং এর উচ্চতা লেখা
হয়েছে- ৩১৭২ ফুট ।
কেওক্রাডং শব্দটি মারমা ভাষা থেকে এসেছে। মারমা
ভাষায় কেও মানে 'পাথর', ক্রো মানে 'পাহাড়' আর এবং ডং মানে 'সবচেয়ে
উঁচু'। অর্থাৎ কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়।
কেওক্রাডং পেরিয়ে
কেওক্রাডং
বিজয় শেষে আমরা রওনা হলাম কেওক্রাডং পেরিয়ে আরো সামনে । পাসিং পাড়া ।
পাহাড়ের পাড়া গুলো সাধারন লোকালয়ের মত নয় । এসব পাড়ায় ১০ থেকে সর্বোচ্চ ২০
টি পরিবার থাকে । পাসিং পাড়ায় আছে ১৮ টি পরিবার । পাসিং পাড়ার প্রতিষ্ঠাতা
পাসিং দাদার সাথে দেখা হল । কথাও হলো । তার বাসায় বসে আমরা আবার ঝালমুড়ি
এবং পাহাড়ি কলা দিয়ে পেটপুজো করলাম । প্রায় ঘন্টাখানেক রেস্ট নিয়ে ফিরতি
পথ ধরলাম হারমুন পাড়ার উদ্দেশ্যে ।
হারমুন পাড়ায় এসে গোসল
করার জন্য আমাদের নামতে হলো পাহাড়ের নিচে ঝিরিতে । ঝিরি হলো পাহাড়ের নিচ
দিয়ে প্রবাহিত ঝরণার পানির গতিপথ । সেগুলোই পাহাড়ে পানির উৎস ।
দুই
আড়াই হাজার ফুট নিচে নেমে গোসল করে এলাম । গভীর রাত পর্যন্ত কাটালাম
বারান্দায় চেয়ার পেতে । চারিদিকে নিস্তব্ধ । মোবাইলে নেটয়ার্ক নেই ।
বারবার শুধু মনে হচ্ছিল- এই পাহাড়ে , এইভাবে বসে বসে আর কি কখনো আকাশের
তারা দেখা হবে ?
রাইখ্যং লেকের উদ্দেশ্যে
সকালে
উঠেই নাস্তা সেরে আমরা আবার রওনা দিলাম । এবারের লক্ষ্য রাইখ্যং লেক ।
এবার ব্যাগসহ হাঁটতে হবে আমাদের । কারণ , আমরা আর এই পথে ফিরবো না ।
রাইখ্যং লেক থেকে ভিন্ন পথে আমরা চলে যাবো রুমা বাজারে ।
ব্যাগ কাঁধে, হাতে লাঠি । সারি বেঁধে গাইডসহ আমরা ছয়জন হাঁটতে লাগলাম । হাঁটছি হাঁটছি আর হাঁটছি । পাহাড় পেরিয়ে পাহাড় ।
হাঁটতে
হাঁটতে পথে আরেকটি পাড়া পড়লো । মুরং অধ্যুষিত মেনতক পাড়া । মেনতক পাড়ার
উঠোনে দেখলাম বেশ কিছু শূকর ছানা ঘোরাফেরা করছে । মনের আশ মিটিয়ে ওদেরকে
ডাক দিলাম- ঐ শুয়োরের বাচ্চা ! এদিকে আয় !
মেনতক পাড়ায় অবাক চোখে আমাদের দেখছে মুরং শিশু ।
ঝিরিঝিরি লাসাই লাসাই
ঘন্টা
তিনেক হাঁটার পর ঝিরিপথের দেখা পেলাম । পাহাড়ের ঝরণা থেকে নেমে আসা পানির
গতিপথকেই ঝিরি বলা হয় । ঝিরিপথ তুলনামূলক সহজ । ঝিরির পথে ছড়িয়ে আছে বড়
বড় সব প্রকান্ড পাথর । মাঝে মাঝে ছোট ছোট ডোবার মত জলাশয় । এরই একটাতে
নেমে ঠান্ডা পানিতে গোসল সেরে নিলাম আমরা । আমাদের গাইড সেখানেই ঝালমুড়ির
আয়োজন করলো । কলাও সাথে নিয়েছিলাম আমরা । কলা এবং ঝালমুড়ি ভোজনটা অমৃতের
মত লাগলো ।
আধাঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হলো পথচলা । ঝিরিঝিরি লাসাই লাসাই । লাসাই লাসাই মানে – ধীরে ধীরে ।
ঝিরির পথ ।
রাইখ্যং লেকে
আরো
ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পর শেষ হয়ে এলো ঝিরির পথ । ভাবছেন- রাইখ্যং লেকে চলে
এসেছি ? নাহ । এরপর শুরু হলো আবার পাহাড় ডিঙ্গানো । পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পায়ে
চলার পথ । পথ বললে ভুল হবে- এই পথে শুধু একজনই যেতে পারবে সতর্কতার সাথে ।
কোথাও কোথাও একসাথে দুইপা রাখারও সুযোগ নেই । পাশেই দুই হাজার ফুট নিচু
খাদ । একবার পা পিছলে গেলে আর রক্ষে নেই । অনেক বেশি মানসিক শক্তি আর গুড
লাক ছাড়া এই পথ মাড়ানো অসম্ভব ।
কিছুদূর এগিয়ে রেস্ট , আবার পথচলা ।
এভাবে আরো প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা হাঁটতে হলো । রাইখ্যং লেকে যখন
পৌঁছলাম, তখন বিকাল প্রায় চারটা বাজে । প্রায় দশ ঘন্টা হেঁটেছি । রাইখ্যং
লেকের পাশে পুকুর পাড়ায় সুজন মাস্টারের কটেজে গিয়ে উঠলাম আমরা । আগের মতই,
কাঠের ঘরের মেঝেতে থাকার ব্যবস্থা । প্রতিরাত জনপ্রতি একশ টাকা ভাড়া ।
গাইড
দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করলো । কিছু খেয়ে নিয়েই আমরা রাইখ্যং লেকে চলে
গেলাম গোসল করতে । তবে এখানেও আর্মি ক্যাম্প আছে । ওটাই বাংলাদেশের ঐ
সীমানায় শেষ ক্যাম্প । নিয়ম অনুযায়ী আর্মি ক্যাম্পে আমাদের রিপোর্ট করতে
হলো । সুবেদার সাহেব আমাদের দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন – ‘আমাদের আসতেই অবস্থা
খারাপ হয়ে যায়, আপনারা এলেন কী করে ?’
দূরে পুকুর পাড়া ও রাইখ্যং লেক । পাহাড়ের ওপর থেকে তোলা ছবি ।
রাইখ্যং
লেক বগা লেকের চেয়ে বড় পরিসরের লেক । দিনাজপুরের রামসাগরের মত অনেকটা ।
খুব দুর্গম হওয়ায় পর্যটকরা তেমন একটা যেতে পারেন না ঐ পর্যন্ত । রাইখ্যং
লেকে গোসল করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । আমরা উঠে এলাম আমাদের কটেজে ।
রাইখ্যং
লেকের দুরত্ব রুমা বাজার থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটারের মত । তবে পুরোটাই
পাহাড়ি রাস্তা । পাহাড়িদের ৮-১০ ঘন্টা হাটার রাস্তা । সাধারন মানুষের
লাগে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা ।
যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন ,
সেই সাথে উঁচু নিচু পাহাড়ী রাস্তা ও খাল অতিক্রম করার শারীরিক ও মানসিক
সামর্থ রাখেন তারাই কেবল রাইখ্যং যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন ।
অন্যথায় চরম বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির শিকার হতে হবে দলের সবাইকে ।
ফিরতি পথেঃ চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক
পরদিন
ভোরে উঠেই ভাত খেয়ে নিলাম । গাইড এবং সুজন মাস্টারের বৌ মিলে রান্না
করেছে । গাইডকে দিয়ে আমরা দুটি পাহাড়ি মোরগ কিনেছিলাম । বেশ ভালোই খাওয়া
হলো ।
সকালে বের হয়ে এবার ভিন্ন পথে হাঁটতে লাগলাম আমরা । একের পর
এক পাহাড় ডিঙ্গিয়ে চলছি, উদ্দেশ্য রুমা বাজার । আকাশে গনগনে সূর্য ,
পাহাড়ের পথ যখন শেষ হলো তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । বগা লেকের নিচে বগামুখ
পাড়ায় এসে পৌঁছেছি আমরা । বগামুখপাড়ায় আবার কলা , রুটি খেয়ে নিলাম ।
দুপুরে এক পাহাড়ের ঢালে কিছু কাঠুরের দেখা হয়েছিল । তাদের সাথে ঘন্টাখানেক
রেস্ট নিয়েছি । তাদের হাড়ি পাতিলে আমাদের সাথে নেয়া চাল রান্না ও আলুর
ভর্তা করে কিছুটা ভাত খেয়েছিলাম । জোহরের নামাজটাও সেখানেই সেরে নিয়েছি ।
এছাড়া বাকি সময়টা শুধু হেঁটেছি । বিকালে পড়েছিলাম আরেক বিপদে । জুম চাষ
করার জন্য পাহাড়িরা পাহাড়ের ঢালে শুকনো গাছপালায় আগুন লাগিয়ে দেয় । আমরা
পড়লাম সেই আগুনের ফাঁদে । সামনে পেছনে আগুন । যাবার উপায় নেই । সাহস করে
আগুনের ভেতর দিয়েই লাফিয়ে পার হতে হলো । এক ঝলকের জন্য শরীর যেন ঝলসে গেল
আমাদের ।
জুম চাষের জন্য পাহাড়ের ঢাল পুড়িয়েছে পাহাড়িরা । ফিরছি আমরা পুকুর পাড়া হতে ।
বগামুখ
পাড়া পার হয়ে মাগরিব নাগাদ আমরা একটা ঝিরিপথ পেয়ে গেলাম । ততক্ষণে সূর্য
ডুবে গেছে । চারিদিকে সুনশান । আকাশে চাঁদ উঠেছে । কাঁধে ব্যাগ, হাতে লাঠি
– সারি বেঁধে পায়ে হাঁটা সমতল রাস্তায় আমরা হেটে হেটে ফিরছি । চারদিনের
হাঁটার ধকল , শেষ দিনে টানা চৌদ্দ ঘন্টা হাঁটার ধকলে শরীর অসাড় হয়ে আসছিল ।
শুধু মনের জোরে হাঁটছিলাম । চাঁদের আলো কিছুটা ভালো লাগার অনুভূতি
দিচ্ছিল আমাদের । আরো তিনঘন্টা হেঁটে রাত নটা নাগাদ আমরা রুমা বাজারে এসে
পৌঁছলাম ।
রাতে একটা হোটেল ভাড়া করে থাকলাম । পরদিন সকাল
আটটায় আবার মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করলাম- আমরা ফিরে এসেছি ।
আমাদের গাইড বেলালকে বিদায় দিয়ে সকাল ন’টার বাসে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে
ফিরতি পথ ধরলাম আমরা । ক্লান্ত শরীর । অনুভব করছিলাম, এ কয়দিনে আমরা
‘রুমা’কে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি । রুমার কথা কোনদিন ভুলতে পারবো না ।