রবি, জলদি আয় বাপ ।
মায়ের ডাক শুনে রবি চিন্তায় পড়ে যায় । গত রাতে খবরটা পাবার পর থেকেই সে বেশ উত্তেজিত । কিন্তু কী করে আজকের স্কুল কামাই দেবে সেই উপায় বের করতে পারছে না ।
একবার ভাবলো একটা কোন মিথ্যা অজুহাত দেবে । পেট ব্যথা, মাথা ব্যাথা , ডায়রিয়া । কিন্তু পরক্ষণেই আবার নিজেকেই ধিক্কার দিলো । ছিঃ ছিঃ । মিথ্যা বলে যারা তারা হলো পঁচা । মিথ্যাবাদী । তাদের পরিণতি হবে মিথ্যাবাদি রাখালের মত । আর তাছাড়া একটা মিথ্যা বললে সেটার জন্য আরো অনেক মিথ্যা বলতে হয় । মিথ্যা কখনো একা চলতে পারেনা । মিথ্যা বলার শাস্তি আল্লাহর কাছে ভয়ংকর । আম্মার কাছেও ভয়ংকর । মিথ্যা বলাটা আম্মা একদমই সহ্য করতে পারেন না ।
রবি বারান্দায় এসে খেজুর পাতার চাঁটাইয়ে বসে । এটাই ওদের ভাত খাওয়ার জায়গা । সন্ধ্যাবেলায় কখনো কখনো চেয়ার টেবিল ছেড়ে এখানে বসে পড়াশোনাও করে রবি । বড় ভাই শহরে চলে যাওয়ায় বাড়িতে এখন রবি একা । আম্মাও সবসময় চোখে চোখে রাখেন ওকে ।
ভাত নাড়াচাড়া করতে থাকে রবি । আলুভর্তা , ডাল, ডিমভাজি, লালশাক । ওর ভাবভঙ্গি আম্মার চোখ এড়ায় না । ছেলের চেহারা দেখলেই মায়েরা বুঝতে পারেন- কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা অস্বাভাবিক । না বুঝবেনই বা কেন ? মায়ের রক্তেই তো পুষ্ট হয় সন্তানের প্রতিটি কোষ ।
‘কিরে, আবার কী চাস ?’
‘আম্মা , আইজ স্কুল না যাই ?’
‘কেন ? বলেছি না, বিনা কারণে স্কুল কামাই করা ভালো না’ ।
‘বিনা কারণে কে বললো ? আজকে পুকুরে মাছ ধরবে না ?’
‘পুকুরে মাছ ধরবে , তোর কী ?’
‘আমিও মাছ ধরবো । স্কুল তো প্রতিদিন যাই । প্রতিদিন কি মাছ ধরতে পারবো ?’
মায়ের কন্ঠে রাগ দেখে রবির কান্না পায় । কান্না দেখে আম্মা দমে যান । ভেজা চোখ এক বিশাল অস্ত্র । ছেলের কান্না মায়েরা সহ্য করতে পারেন না ।
চুপ থাকেন আম্মা । ছেলের কথায় নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে সাহেরা বেগমের । বাড়ির পাশেই ছিল ছোট নদী । বড় ভাই মাছ ধরতেন, তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন খলুই হাতে । ভাইদের ছুড়ে দেয়া মাছ ডাঙ্গায় এসে পড়তো । সেই মাছ ধরে ধরে খলুইয়ে রাখতেন । ভাইরা পানিতে মাছ ধরেন , আর তিনি ছোট্ট খুকি তখন- ডাঙ্গায় মাছ ধরেন । ঠিকমত ধরতে না পারায় দু-একটা মাছ আবার পানিতেই নেমে যেত । ভাইরা অবশ্য সেজন্য রাগ করেনি কোনদিন । নিজেও কখনো সখনো দুএকটা মাছ ধরেছেন নদীর কিনারে , সে কতদিন আগের কথা ।
বড় ছেলেটার কথাও মনে পড়লো । ছেলেটা কতদিন হলো শহরে গেছে । হিসাব করলে হয়তো দু’মাসের বেশি হবেনা , কিন্তু মায়ের কাছে দু’মাস যে অনেক বেশি সময় । কলেজে ছুটি পায় না । বাড়িতে আসতে পারেনা । শেষ চিঠিতেও লিখেছে – আম্মা, পুকুর সেঁচা হবে কবে ? ইস , এবার মাছ ধরতে পারবো না । পুকুর সেচলে আমার জন্য খলসে মাছের শুটকি করে রাখবেন । বড় বড় চিংড়ি রাখবেন । বোয়াল মাছ তো রাখা যাবে না । চিন্তা কি, আমি এসে নিজের হাতে বোয়াল মাছ ধরবো এবার’ ।
ক্লাস ফাইভে উঠেছে রবি । আর ক’টা বছর পর হয়তো ওকেও শহরে পাঠিয়ে দিতে হবে । ভালো কলেজ কোথায় এই মফস্বলে ? ছেলেটা চলে গেলে কীকরে যে থাকবেন – সে চিন্তায় মাঝে মাঝে ঘুম হারাম হয়ে যায় সাহেরা বেগমের ।
প্রতিবছর একবার রবিদের পুকুরে শ্যালো মেশিন লাগিয়ে সব পানি তুলে ফেলা হয় । তখন শুধু হাঁটুসমান পানি থাকে । কাদায় ডুবে যায় পায়ের পাতা । সেই পানিতে হাত ডুবালেই উঠে আসে মাছ । কত মাছ ! পুটি মাছ, চিংড়ি মাছ, রুই মাছ , কাতল মাছ, টেংরা মাছ, খলসে মাছ, শিং মাছ, কই মাছ, বোয়াল মাছ , বাইম মাছ , বেলে মাছ , টাকি মাছ । চাচাতো ভাইরা সহ পাড়ার সব ছেলেমেয়ে মাছ ধরতে নেমে যায় । মাছগুলো স্তুপ করে রাখা হয় পুকুরের পাশে । ডালাভরে বাড়ির আঙ্গিনায় নেয়া হয় সেইসব মাছ । দুপুর হতে না হতেই মাছ শুন্য হয়ে যায় পুকুর । বড়রা থাকে বড় মাছ ধরার চেষ্টায় । পুটিমাছ-চিংড়ি মাছে তাঁদের আগ্রহ নেই । গর্তে হাত ঢুকিয়ে বাইম মাছ বের করে আনেন । বোয়াল মাছের সাথে যুদ্ধ করে বোয়াল মাছ ধরেন । শিং মাছ ধরার বিশেষ কায়দা আছে । কায়দামত না ধরলে মাছের কাটা লাগবে । বিষাক্ত কাঁটা । খুব ব্যথা হয় । বড়রা সেই কায়দা জানেন ।
কখনো কখনো মাছের গর্তে সাপ লুকিয়ে থাকে । একবার তো জাহেদ ভাই একটা আস্ত সাপ ধরে বের করেছিলেন । সাপ ধরারও কায়দা আছে । সবাই পারেনা ।
গতবছর রবি জানতো না কবে পুকুর সেঁচা হবে । কেউ ওকে কিছু বলেনি । স্কুল থেকে ফিরে দেখে ডালাভরা মাছ । মা-কে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এত মাছ কোত্থেকে এলো আম্মা ?’ মা ভান করে বলেন, কেন পুকুর সেচেছে আজকে । তুই জানিস না ?
মন খারাপ করে দু’দিন মাছই খায়নি রবি । নিজের হাতে মাছ ধরতে না পারলে সে মাছ খেয়ে মজা আছে ?
এবার তক্কে তক্কে ছিল । কান খাড়া করে রেখেছিল । আমান চাচার ছেলে আশিককে বলে রেখেছিল আগেই , পুকুর সেঁচার কথা উঠলেই যেন ওকে জানায় । বিনিময়ে দুই ডজন মার্বেল কিনে দেবে রবি । আমান চাচাকে ছাড়া কখনো পুকুর সেঁচা হয়না । আমান চাচা হলেন আব্বার ফুফাতো ভাই । এ বাড়ির কোন কাজই হয়না তাঁকে ছাড়া । আর আমান চাচা জানা মানেই আশিক জানবে । এই হলো সমীকরণ । সমীকরণ কাজে দিয়েছে । ঠিক ঠিক কাল রাতেই খবর পেয়ে গেছে রবি ।
আম্মার চুপ থাকা দেখে রবিও চুপচাপ খায় । মনে কিছুটা আশা জেগেছে । আম্মাও একটা প্লেটে ভাত তুলে নেন । আম্মা সবসময় সবার শেষে ভাত খান । দাদী বলতেন, বাড়ির বউকে নাকি সবার শেষে খেতে হয় । কথাটা রবির একদম ভালো লাগেনা । এ আবার কেমন কথা ? এ নিয়ে দাদীর সাথে প্রায়ই বাগবিতন্ডা হত রবির । তিনবছর হলো , দাদী ইন্তেকাল করেছেন । দাদির কথা খুব মনে পড়তে লাগলো এই মুহূর্তে । আজ দাদী থাকলে নিশ্চিত রবির পক্ষ নিতেন । দুনিয়ায় দাদী নানীদের কাজই হলো ছেলেমেয়ের কাছ থেকে নাতি নাতনীদের স্বার্থ আদায় করা । আদর দিয়ে মাথায় তোলা ।
সাধারণত আম্মাকে ছাড়া রবি খায় না । মাঝে মাঝে স্কুলে দেরি হবে বলে আগে আগে খেয়ে নেয় , আম্মা ব্যস্ততার অজুহাত দেখান । না শুনে তখন আর উপায় থাকেনা ।
******
-কিরে বাপ, বসে আছিস ক্যান ?
-আব্বা , আমার মাথা ঘুরাচ্ছে । পায়ে শিং মাছের কাঁটা লেগেছে । ব্যথা ।
-তাইলে বাড়ি যা এখন ।
পুকুরের পাড়ে বসে আছে রবি । মাথা আর মুখ ছাড়া প্রায় পুরো শরীরে কাদা লেপ্টে আছে । ডান পায়ের গোড়ালির কাছে একটু একটু ব্যথা হচ্ছে । কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ মনে হলো, পায়ে কিসের যেন ঠোকর লাগলো । তারপর থেকেই ব্যথা । ধীরে ধীরে ব্যথাটা বাড়ছে ।
অনেকক্ষণ হলো পুকুরে মাছ ধরতে এসেছে রবি । ধরেছেও অনেক মাছ । একটা ছোট বালতি ভরা মাছ । পুটি, চিংড়ি আর টাকিমাছের সংখ্যাই বেশি । পুকুরের পানি প্রায় শুকিয়ে এসেছে । সকাল থেকেই শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে পানি তোলা হচ্ছে ।
আনিস এসে বসলো রবির পাশে । রবির দুঃসম্পর্কীয় চাচাতো ভাই । ওদের কয়েকবাড়ি পরেই আনিসদের বাড়ি । ওরা প্রায় সমবয়সি । আনিস অবশ্য স্কুলে যায় না । সে ওর বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করে ।
- কিরে আনিস , তুই উঠলি ক্যান ? আনিসকে উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করে রবি ।
- কামড়াইছে, কিছু একটা কামড়াইছে পায় । ব্যাথা লাগে ।
- চল বাড়ি যাই ।
বাড়িতে এসে জোহরের নামাজ পড়ে ভাত খেয়ে নেয় রবি । শরীরটা ধীরে ধীরে আরো দুর্বল হয়ে আসছে যেন ওর । একবার বমিও করলো ।
মাছ ধরা শেষ করে আব্বাও ফিরে এসেছেন । 'ছেলেটার কী হলো একটু ভালো করে দেখেনতো' । আম্মা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন ।
আব্বা মনোযোগী হন । রবির পায়ে যেখানে ব্যথা তার চারপাশটা একটু ফুলে উঠেছে । পুকুরপাড়ে বেশি গুরুত্ব দেননি, শিং মাছের কাঁটাই ভেবেছিলেন । একটু ব্যথা করবে- তারপর এমনি এমনিই ঠিক হয়ে যাবে । তাছাড়া তখন পায়ে কাদা লেপ্টে থাকায় ঠিকমত দেখারও উপায় ছিলনা । এবার ভালো করে খেয়াল করে তিনি দেখলেন – দুটি চিহ্ন দেখা যায় ।
তাঁর মনে পড়ে গেলো এরকম চিহ্ন তিনি আগেও দেখেছেন । একবার সাপ মারতে গিয়ে হাতে সাপের কামড় খেয়েছিলেন । হ্যা, ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে । আজ পুকুরের পানি পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে একটা মরা সাপকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে । মাছুয়া আলাত । বিষাক্ত সাপ । ইয়া আল্লাহ্ । ইয়া মাবুদ ।
দেরি করা যাবেনা । এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে । ওঝা-ফকিরে বিশ্বাস করেন না রবির আব্বা । বিষ ঢুকেছে রক্তে, বাইরে ঝাড়ফুঁকে কী হবে ? জেলা সদর হাসপাতাল প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে । একটা কাপড় দিয়ে রবির হাঁটুর ওপরে শক্ত করে বেঁধে ভ্যান চালক করিমকে ডাকতে গেলেন তিনি । রবি দুর্বল কন্ঠে বললো- আব্বা, আনিসরেও কামড়াইছে ।
ভ্যানে শুয়ে আছে রবি । পেছনে আরেকটা ভ্যানে নেয়া হচ্ছে আনিসকেও । আম্মার কোলে রবির মাথা । ভ্যানের পেছনে সাইকেল চালিয়ে আসছেন আব্বা । মুখ শুকনো, গম্ভীর । বাবাদের কখনো ভেঙ্গে পড়তে নেই । তাঁদের মুখ গম্ভীর করে রেখে সব বিপদ মোকাবেলা করতে হয় । সামাল দিতে হয় । আব্বা একটু পরপর উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করছেন- রবি, কেমন লাগছে বাপ ?
আম্মা একটা করে সুরা পড়ছেন আর রবির গায়ে হাত বুলাচ্ছেন । ইয়া আল্লাহ্, জীবনে যদি কোন ভালো কাজ করে থাকি তার উসিলায় আমার ছেলেরে ভিক্ষা দাও ।
রবির মাথা ঘুরছে । নিস্তেজ লাগছে । চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে ওর ।