বঙ্কিমের উপন্যাসগুলোর মধ্যে রাজসিংহ ও আনন্দমঠ সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ । মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিতে এ দুটি উপন্যাস অনন্য । উপন্যাস দুটি প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে ।
'আনন্দ মঠ' এর কিছু অংশ দেখুন-
ভবানন্দ মহেন্দ্রকে বলছে ,"..কোন্ দেশের মানুষের সিন্দুকে টাকা রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঘরে ঝি-বউ রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঝি-বউয়ের পেটে ছেলে রেখে সোয়াস্তি নাই? পেট চিরে ছেলে বার করে। সকল দেশের রাজার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের সম্বন্ধ; আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্তও যায়। এ নেশাখোর দেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?
ম। তাড়াবে কেমন করে?
ভ। মেরে।.."
"...দিনে দিনে শত শত, মাসে মাসে সহস্র সহস্র সন্তান আসিয়া ভবানন্দ জীবানন্দের পাদপদ্মে প্রণাম করিয়া, দলবদ্ধ হইয়া দিগদিগন্তরে মুসলমানকে শাসন করিতে বাহির হইতে লাগিল। যেখানে রাজপুরুষ পায়, ধরিয়া মারপিট করে, কখন কখন প্রাণবধ করে,..যেখানে মুসলমানের গ্রাম পায়, দগ্ধ করিয়া ভস্মাবশেষ করে।.."
"..তার পর, তাহারা গ্রামে গ্রামে চর পাঠাইতে লাগিল। চর গ্রামে গিয়া যেখানে হিন্দু দেখে, বলে, ভাই, বিষ্ণুপূজা করবি? এই বলিয়া ২০/২৫ জন জড় করিয়া, মুসলমানের গ্রামে আসিয়া পড়িয়া মুসলমানদের ঘরে আগুন দেয়। মুসলমানেরা প্রাণরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়, সন্তানেরা তাহাদের সর্বস্ব লুঠ করিয়া নূতন বিষ্ণুভক্তদিগকে বিতরণ করে। লুঠের ভাগ পাইয়া গ্রাম্য লোকে প্রীত হইলে বিষ্ণুমন্দিরে আনিয়া বিগ্রহের পাদস্পর্শ করাইয়া তাহাদিগকে সন্তান করে। লোকে দেখিল, সন্তানত্বে বিলক্ষণ লাভ আছে।.."
“..সাহেব, আমি স্ত্রীলোক, কাহাকেও আঘাত করি না। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, হিন্দু মোছলমানে মারামারি হইতেছে, তোমরা মাঝখানে কেন? আপনার ঘরে ফিরিয়া যাও।”
সাহেব। টুমি কে?
শান্তি। দেখিতেছ সন্ন্যাসিনী ।.."
"..ভবানন্দ তখন নিজে গিয়া কাপ্তেন টমাসের চুল ধরিলেন। কাপ্তেন শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করিতেছিল। ভবানন্দ বলিলেন, “কাপ্তেন সাহেব,তোমায় মারিব না, ইংরেজ আমাদিগের শত্রু নহে। কেন তুমি মুসলমানের সহায় হইয়া আসিয়াছ? আইস–তোমার প্রাণদান দিলাম, আপাতত: তুমি বন্দী। ইংরেজের জয় হউক, আমরা তোমাদের সুহৃদ|..”
"..সেই রজনীতে হরিধ্বনিতে সে প্রদেশভূমি পরিপূর্ণা হইল। সন্তানেরা দলে দলে যেখানে সেখানে উচ্চৈ:স্বরে কেহ “বন্দে মাতরম্” কেহ “জগদীশ হরে” বলিয়া গাইয়া বেড়াইতে লাগিল। কেহ শত্রুসেনার অস্ত্র, কেহ বস্ত্র অপহরণ করিতে লাগিল। কেহ মৃতদেহের মুখে পদাঘাত, কেহ অন্যপ্রকার উপদ্রব করিতে লাগিল।কেহ গ্রামাভিমুখে , কেহ নগরাভিমুখে ধাবমান হইয়া, পথিক বা গৃহস্থকে ধরিয়া বলে, “বল বন্দে মাতরম্, নহিলে মারিয়া ফেলিব |” কেহ ময়রার দোকান লুঠিয়া খায়, কেহ গোয়ালার বাড়ী গিয়া হাঁড়ি পাড়িয়া দধিতে চুমুক মারে, কেহ বলে, “আমরা বজ্রগোপ আসিয়াছি, গোপিনী কই?” সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল,মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্তকণ্ঠে হরি হরি বল| গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, “মুই হেঁদু |”
দলে দলে ত্রস্ত মুসলমানেরা নগরাভিমুখে ধাবিত হইল।.."
"..বল হরে মুরারে! হরে মুরারে! উঠ! মুসলমানের বুকে পিঠে চাপিয়া মার! লক্ষ সন্তান টিলার পিঠে |..”
কিন্তু তিনি যখন এসব লিখেন, তারও ১০০ বছর আগে মুসলিমদের রাজত্ব শেষ হয়েছিল ।
মৃণালিনী উপন্যাসে ব্রাক্ষ্মণ মাধবাচার্য হেমচন্দ্রকে ডেকে বলছেন , "তুমি দেবকার্য না সাধিলে কে সাধিবে ? তুমি যবনকে না তাড়াইলে কে তাড়াইবে ? যবন নিপাত তোমার একমাত্র ধ্যান হওয়া উচিত্ ।"
রাজসিংহ রচিত হয় মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিয়ে । এতে আওরঙ্গজেবকে বিকৃতচরিত্র , ইসলাম ও মুসলমানদের কদর্য রুপ এবং হিন্দু রাজপুতদের সাহসিকতা ,সংগ্রাম ও ঔদার্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । কিছু অংশ দেখুন-
"..এসো, একটু আমোদ করা যাক ।
..“কি আমোদ বল বল!”
রাজপুত্রী বলিলেন, আমি এই আলমগীর বাদশাহের চিত্রখানি মাটিতে রাখিতেছি। সবাই উহার মুখে এক একটি বাঁ পায়ের নাতি মার। কার নাতিতে উহার নাক ভাঙ্গে দেখি |..
ভয়ে সখীগণের মুখ শুকাইয়া গেল।..
হাসিয়া রাজপুত্রী চিত্রখানি মাটিতে রাখিলেন, কে নাতি মারিবি মার |.."
"..চঞ্চলকুমারী ধীরে ধীরে অলঙ্কারশোভিত বাম চরণখানি ঔরঙ্গজেবের চিত্রের উপরে সংস্থাপিত করিলেন–চিত্রের শোভাবুঝি বাড়িয়া গেল। চঞ্চলকুমারী একটু হেলিলেন–মড়মড় শব্দ হইল–ঔরঙ্গজেব বাদশাহের প্রতিমূর্তি রাজপুতকুমারীর চরণতলে ভাঙ্গিয়া গেল।.."
"..পরদিন চঞ্চলকুমারী ক্রীত চিত্রগুলি একা বসিয়া মনোযোগের সহিত দেখিতেছিলেন। নির্মলকুমারী আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া চঞ্চল বলিল, নির্মল ! ইহার মধ্যে কাহাকেও তোমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে?
নির্মল বলিল, যাহাকে আমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, তাহার চিত্রত তুমি পা দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ |
চ। ঔরঙ্গজেবকে!
নি । আশ্চর্য হইলে যে?
চ। বজ্জাতের ধাড়ি যে? অমন পাষণ্ডযে আর পৃথিবীতে জন্মে নাই?
নি । বদ্জাতকে বশ করিতেই আমার আনন্দ। তোমার মনে নাই, আমি বাঘ
পুষিতাম? আমি একদিন না একদিন ঔরঙ্গজেবকে বিবাহ করিব ইচ্ছা আছে।
চ। মুসলমান যে?
নি । আমার হাতে পড়িলে ঔরঙ্গজেবও হিন্দু হবে।
চ। তুমি মর।.."
"..ইহার একমাত্র কারণ, ঔরঙ্গজেব মহাপাপিষ্ঠ ছিলেন। তাঁহার ন্যায়ধূর্ত্, কপটাচারী, পাপে সঙ্কোচশূন্য, স্বার্থপর, পরপীড়ক,প্রজাপীড়ক দুই একজন মাত্র পাওয়া যায়। এই কপটাচারী সম্রাট জিতেন্দ্রিয়তার ভাণ করিতেন–কিন্তু অন্ত:পুর অসংখ্য সুন্দরীরা জিতে মধুমক্ষিকা পরিপূর্ণ মধুচক্রের ন্যায় দিবারাত্র আনন্দধ্বনি ধ্বনিত হইত।
তাঁহার মহিষীও অসংখ্য–আর সবার বিধানের সঙ্গে সম্বন্ধশূন্যা বেতনভাগিনী বিলাসিনীও অসংখ্য।.."
রবিবার, আগস্ট 19, 2012
http://goo.gl/sZkm6