এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কবিতা পড়ার প্রহর

মানুষের ভাষা যখন সমৃদ্ধ হতে শুরু করলো, তখন মানুষ তার মনের ভাব আরো সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে চাইলো । সে থেকেই কবিতার উৎপত্তি । ঠিক কবে , কোথায় কবিতার শুরু সেটা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় । কারণ, কবিতা শুরুর দিকে নিশ্চিতভাবেই লিখিত ছিলনা । ছিল মুখে মুখে রচিত, কানে কানে শ্রুত এবং এভাবেই সেগুলো হয়তো কবির মৃত্যুর সাথে সাথে হারিয়ে গেছে । লিখিত আকারে কবিতা প্রথম কবে কোথায় লেখা হয়েছিল তাও বলা সম্ভব নয় । হয়তো প্রথম কবিতাটি লেখা হয়েছিল আঙ্গুল দিয়ে, ধুলোর ওপর । দখিনা হাওয়ায় নাকি পুবালী  মিলিয়ে গেছে সে কবিতা , তাও বলবার জো নেই ।
যেকোন ভাষাতেই সাহিত্যের শুরু হয়েছে কাব্য দিয়ে । বাংলা ভাষায় যেমনটা ‘চর্যাপদ’কে মনে করা হয় । এরপর সাহিত্যের অন্যান্য দিক- অর্থাৎ গদ্যরুপ বিকশিত হয়েছে । লেখা হয়েছে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমনকাহিনী, জীবনী ইত্যাদি ।

আজকাল নাকি কেউ কবিতা পড়েনা । শুধু গান শোনে- ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’ । কিন্তু আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি – মানুষ আগামীতে উপন্যাস-গল্পের দিকে না তাকিয়ে কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়বে । কবিতার সাথে গল্প-উপন্যাসের মূল যে পার্থক্যটা সেটা হলো , কবিতায় অনেক অনেক গভীর ভাব, তত্বকথা, জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলা হয় অল্প কিছু শব্দে । পাঠকের ভেতর জাগিয়ে তোলা হয় ‘অনুভূতি’টাকে । মানুষের একটা অনন্য অসাধারণ ব্যাপার আছে যাকে মানুষ নাম দিয়েছে ‘অনুভূতি’ । অন্য প্রাণীদেরও হয়তো অনুভূতি আছে , কিন্তু মানুষেরটা সত্যিই অন্যরকম অনন্য । এই অনুভূতিকে আরো অনবদ্য করে তোলে কবিতা । আর পরিবেশটাকে পাঠক কল্পনায় সাজিয়ে নিতে পারেন নিজের মত করে ।
গল্প-উপন্যাসে অনেক অনেক শব্দের মাধ্যমে বোঝানো হয় ছোট্ট একটি মর্মার্থকে । পাঠককে খাইয়ে দেয়া হয় । গল্প-উপন্যাস পড়তে পাঠকের নিজেকে কোন চিন্তাভাবনার দরকার হয়না , গল্পের সাথে , বর্ণনার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেই চলে যায় সময়, ভাটির টানে ।
মানুষ দিনদিন খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছে । ফলে যেটা হবার সম্ভাবনা আমি দেখছি- মানুষ বিশাল উপন্যাস-গল্প পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে । তারা চাইবে অল্প কথায় কীভাবে পাওয়া যায় সাহিত্যের আনন্দ, আন্তরিক সুখ । আর সেটা সবচেয়ে বেশি সম্ভব কবিতার মাধ্যমে ।
কবিতা পড়ার আগে একজনকে মানসিকভাবে তৈরি হতে হয়- এখন আমি একটি কবিতা পড়বো । কিন্তু গল্পের আগে সেটা করার প্রয়োজন নেই । কবিতার পাঠককে থাকতে হয় –সচেতন । কবি কোন শব্দটি ব্যবহার করছেন, কোন উপমাটি টেনে আনছেন , নিজের জীবনের সাথে এর কী মিল বা অমিল আছে । একটা নিরস কবিতার পুরোটা হঠাৎ করেই অসাধারণ অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে সামান্য ক’টি শব্দে । সাধারণ কিছু কথা হঠাৎ করেই অসাধারণ হয়ে ওঠে দু-একটি শব্দের কারণে ।

কবিরা কবিতা কেন লিখেন ? কবিতা কি ইচ্ছে করলেই লেখা যায় ? আমার ধারণা, কবিদের মাথায় আগে কবিতা আসে, তারপর তারা সেটা লিখেন । খাতা কলম নিয়ে বসে কবিতা হয়না । জানিনা , আমার ধারণা কতটুকু ঠিক । আমি তো কবি নই ।
মাঝে মাঝে আমিও যে কিছু লিখিনা তা নয় । কিন্তু সেগুলোকে আমি কবিতা বলিনা । আমি লিখি আমার ‘মনের কথা’ । কেউ যদি আমাকে কবি বলেন , আমি প্রত্যুত্তরে বলি –‘ওহে ভ্রাতঃ, নহি আমি কবি । যাহা আসে মনে , তাই শুধু লিখে যাই’ । এবং যতদূর সম্ভব সরল ভাষায় । ভাষাকে সহজ করতে হবে , সরল করতে হবে । যেন একজন মানুষ- যিনি শুধু বানান করে করে পড়তে পারেন , তিনিও যেন বুঝতে পারেন কী বলা হচ্ছে ।
গল্পের প্লট মাথায় আসে । কিন্তু গল্প-উপন্যাস লেখাটা আসলে অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার । এত সময় কই ?
কেউ পড়ছে কিনা সেটাও খুব একটা ভাবার বিষয় নয় । কোন লেখকই সেটা খুব বেশি ভাবেন বলে আমার মনে হয় না । আমার মনের কথা, আমার উপলব্ধি, আমার অনুভূতি আমি লিখে গেলাম । কেউ পড়লেই কি , আর না পড়লেই কী ? তবে হ্যা , যদি কোনদিন বিয়ে করি , যদি কেউ আসে আমার উত্তরাধিকার– আমি তাদের বলবো- পড় । এই তোমার পিতার চিন্তাধারা । পড়, এই তোমার পিতামহের চিন্তাধারা । সেসময় আমরা এভাবেই ভাবতাম !  ভাষা নয়, শব্দের গাঁথুনি নয়- বোঝার চেষ্টা করো, আমি কী বলতে চেয়েছিলাম ।

মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

অদ্ভুত অসীম ভালোবাসা



নীল আকাশ ভালোবাসি
ভালোবাসি সে আকাশ ঢেকে দেয়া মেঘ
ভালোবাসি মেঘভাঙ্গা রোদকেও ।

ভালোবাসি চাঁদ । ভালোবাসি চাঁদের কলঙ্কও ।
ভালোবাসি পুর্ণিমা । এবং অমাবশ্যা রাত ।
ভালোবাসি
আমার অবুঝ মনে শিহরণ জাগানো
রাতজাগা  প্যাঁচাকেও ।

মাটিকে ভালোবাসি । ভালোবাসি কাদা ।
ভালোবাসি বৈশাখ । বৈশাখী হাওয়া ।
ভালোবাসি
সে হাওয়ায় উড়ে আসা পথের ধুলোকেও ।

ভালোবাসি আমাকে । ভালবাসি আপনাকে । ভালোবাসি তোমাকে ।
ভালোবাসি একে, ওকে, তাকে । ভালোবাসি তোকেও ।

এইতো এভাবেই এগিয়ে চলেছে আমার ভালোবাসার ফর্দ
মাসের শুরুতে কাঁচুমাচু মুখের গরীব স্বামীর হাতে ধরিয়ে দেয়া
বেহিসেবি গিন্নীর বাজারের লিস্টির মত – এযেন অফুরান এক তালিকা ।

আমি তালিকাটাকেও ভালোবাসি ।

পথকে ভালোবাসি । পথে হাঁটতেও ভালোবাসি ।
হাঁটতে হাঁটতে এই পৃথিবীর বুকে -
অদ্ভুত অসীম এক ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েছি অজান্তে অকারণে ।

যে দড়িতে বাধা আমি, সেটাকেও ভালোবাসি । তাই
ছিড়তে পারিনা কিছুতেই ...



রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

হে কবি বিদ্রোহ করো



হে কবি বিদ্রোহ করো আজ  
লিখে যাও বিদ্রোহের গান  
আমি কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক এক । জানি  
বিপ্লবে আসেনা প্রাণ  
রক্তে আসেনা ঘ্রান  
যতক্ষণ না বিদ্রোহ করে ওঠে কবির কলম ।


অনেক লিখেছ প্রেয়সীর রুপ-স্তুতি 
প্রতিটি লোমকূপের দিয়েছ বর্ণনা  
ঝর্ণা ও সাগরের প্রতিবিন্দু জল   
পাহাড় ও পথের প্রতিটি ধূলিকণা   
সুর্য ও চাঁদের প্রতিটি আলোকরশ্মি    
ফুল-পাখি-আকাশ, মাটির সবুজ ঘাস ; পায়নি রেহাই কেউ  
সবকিছু নিয়ে লিখে গেছ আজীবন  । আজ এসো এই ফাল্গুনে  
আগ্নেয়গিরির আগুন নিয়ে লিখে ফেলো দু’কলম  
বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ প্রবেশ করুক  
আমাদের এঁটেল হৃদয়ে ।

হে কবি নীরব কেন , ফাগুন যে এসেছে ধরায়  
শিমুলের ডালে লাল রং শিমুল ফুলে  
কৃষ্ণচূড়া ফুলে লাল হয়ে আছে কৃষ্ণচূড়াও  
পিচঢালা  রাজপথও দেখো হয়ে গেছে অবিশ্বাস্য লাল  
তোমার ভাইয়ের রক্তে ভিজে ।

আগ্নেয়গিরির লালচে লাভা নিয়ে তুমি তাই লিখে দাও একটি পংক্তি   
যাতে আমাদের কুম্ভকর্ণ বিবেক জেগে ওঠে  
কোমা হতে ।  

ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়ের মত বিক্ষুব্ধ হও   
ভগবানের বুকে এঁকে দাও পদচিহ্ন ;  নজরুলের মত ।   
হেলাল হাফিজের মত বলে দাও- ‘মিছিলের সব হাত, কন্ঠ, পা এক নয়’ 
ফরহাদ মজহারের পথ ধরে লিখো নতুন এক  
‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল ট্রাক’ ।   

আমি কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক এক । জানি  
বিপ্লবে আসেনা প্রাণ  
রক্তে আসেনা ঘ্রান  
যতক্ষণ না বিদ্রোহ করে ওঠে কবির কলম ।  

[ হে কবি বিদ্রোহ করো / ২৩-০২-২০১৪ ] 

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

হে তরুণ, লজ্জিত হও



বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত হিসেবে আমি যেটাকে  বিবেচনা করি তা হলো তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার বিষয়টিকে ।
এই সময়ের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সংকট কী ? গনতন্ত্রহীনতা । জনগনের ওপর জোর জবরদস্তি করে সরকার ক্ষমতায় থাকা । জনগনের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো । রাজনৈতিক দলগুলোকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া । রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যালয় বন্ধ করে রাখা । সরকারবিরোধী পত্রপত্রিকা বন্ধ করে রাখা । এই সবগুলো করছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার স্বৈরাচারীভাবে । আর এগুলোর মূল সূত্র হলো তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা ।
আমাদের , তরুণদের করণীয় কী হওয়া উচিৎ ছিল ?
যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলো তখন কেন আমরা তরুণরা এর প্রতিবাদে নামতে পারলাম না ? আদালতের রায় ? কিসের আদালত ? বিচারপতি খায়রুল  একাই আদালত ? তাহলে যেসব বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা  ছিলেন তাদের বিচার হবেনা কেন ? যদি অবৈধ হয় , তাহলে আগের বিচারপতিরা কীকরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হলেন ?

তরুনরা সবসময় ন্যায়ের পক্ষে থাকার কথা ছিল । কিন্তু আজ তা না হয়ে সবাই হয়ে পড়েছে- দলপন্থি । বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তরুণেরা নেমে এসেছিল প্রতিবাদ আন্দোলনে । সবাই রাস্তায় নেমেছে তা নয়- কিন্তু ভুমিকা রেখেছে যে যেভাবে যতটুকু সম্ভবকবিরা কবিতা লিখেছে , সাংবাদিকরা সংবাদ লিখেছে । প্রয়োজনে সংবাদ লেখা লেখা থেকে বিরত থেকেছে । ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করেছে , রাস্তায় নেমে মিছিল সমাবেশ করেছে ।

বর্তমান বাংলাদেশে তরুণ সমাজ নানাভাবে বিভক্ত হয়ে আছে । বিভক্তি আগেও ছিলনা তা নয় , কিন্তু এখন মনে হয় আমরা খুব বেশি প্রান্তিকভাবে বিভক্ত । আজকের তরুণ সমাজের কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি, কেউ জামায়াত , কেউ বাম দল সমর্থক । কেউ কেউ ‘রাজনীতি ঘৃণাকরি’ দলের । হতে পারে , কিন্তু দুঃখজনক বিষয়টি হলো নিজ দলীয় স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন ন্যায়ানুগ ব্যাপারেও কাউকে কথা বলতে দেখা যায় না । বরং উল্টো কিছু তরুণ এতটাই দলান্ধ যে, তারা সরকারী দলের পক্ষে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনে হামলা চালায় । সেটা আমরা দেখেছি ঢাকা ভার্সিটিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স বিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় ।
আপনি যুদ্ধাপরাধের বিচার চান , কিন্তু গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখার দাবি করায়  সমস্যা কী ? যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার অর্থ কি গনতন্ত্র হত্যাকে সমর্থন করা ?

শিবিরের ছেলেরা সরকারের নানান অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে কিন্তু সে আন্দোলন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠার সার্বজনীন আন্দোলন ছিলনাতবুও  বলতে হয় - তারাই তারুণ্যের কিছুটা দাবি পুরণ করেছে ।  কিন্তু ছাত্রদল বা অন্যান্য ছাত্রসংগঠন গুলো কোন আন্দোলনেই নামেনি প্রয়োজন ছিল, এখনো রয়েছে- সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একই দাবিতে আন্দোলনে নামা ।
ছাত্রলীগকে নিয়ে আমি আশাবাদী হতে পারছি না , কিন্তু সকল তরুণের এখন এগিয়ে আসা উচিৎ । সর্বদলীয় সার্বজনীন সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জনগনের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামা ছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায় নেই ।

হে তরুণ লজ্জিত হও । এই দেশের , এই দেশের মানুষের দুর্দশার কারণ তুমিও ।
একজন তরুণ হিসেবে আমি লজ্জিত ।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা কী অর্জন করেছিলাম ? মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার । কিন্তু আজ কোন ভাষাতেই জনগনের ‘কথা বলার অধিকার’ই নেই । একের পর এক পত্রপত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে, টিভি বন্ধ করা হয়েছে , ৫৭ ধারার নামে একটি কালো আইন করা হয়েছে । ফেসবুকে  সরকারবিরোধী লেখার ‘অপরাধে’ (!) গ্রেপ্তার করা হয়েছে ।
আর আমরা তরুণরা – সবাই, কী করেছি ? কী করছি ? আমাদের চেতনা আজ শুধু  গুন্ডে সিনেমার বিরোধিতা । পাকিস্তানের বিবৃতির প্রতিবাদ । আমাদের চেতনা হয়ে পড়েছে ‘হাওয়াই’ চেতনা । মন্ডা-মিঠাই চেতনা ।
আমরা বাংলার ইতিহাসকে কলংকিত করছি । আমরা আমাদের পুর্বপুরুষের ইতিহাসকে কলংকিত করছি ।
হে তরুণ, লজ্জিত হও ।

বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাংলাদেশে আল কায়েদার ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশে আল কায়েদার প্রভাব যে একদম নেই তা আমি বলবো না । ইসলাম নিয়ে নির্দিষ্ট ক্রমধারা অনুসরণ করে, নির্দিষ্ট সিলেবাস অনুসরণ করে পড়াশুনা না করে যখন কিছু তরুণ হঠাৎ করে কিছু পড়াশোনা করে ইসলামের অনুপম সৌন্দর্যমন্ডিত সমাজের কথা জানতে পারে তখন তাদের মনে আকাংখা তৈরি হয় তেমন সমাজ প্রতিষ্ঠার । আর সেই সময়টিতে তারা ইসলামের মক্কী যুগের সুন্নাহ , ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক কর্মপন্থার প্রাথমিক অংশগুলো সম্পর্কে না জেনে ‘কিতাল’ বা যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়গুলো জানতে পারে বা তাদের জানানো হয় । তাদের কাছে মনে হয় – সব অন্যায়-অনাচার যেন এক মুহূর্তে খতম করে ফেলবে । ধীরে ধীরে মানুষের জন্য , মানুষের মাঝে কাজ করে মানুষের ও সমাজের সার্বিক পরিবর্তনের কর্মপন্থা অনুসরণের ধৈর্য তাদের কুলায় না ।

এভাবেই আল কায়েদার মত সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা শুরু করে অনেকেই । ইচ্ছে পোষণ করে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার । অথচ এটা ভাবেনা – কার অস্ত্র ? কেন অস্ত্র ?
আমেরিকা ইসরাইল রাশিয়ার কাছে অস্ত্র কিনে সেই অস্ত্র দিয়ে তাদের দুই-একজন আর্মি সদস্য মারতে পারাতেই কি সফলতা ?
রাসুলের (সাঃ) যুগে যে যুদ্ধগুলো হয়েছিল (অবশ্যই মক্কী যুগের পর) তাতে সৈন্যসংখ্যার তারতম্য থাকলেও , মুসলিমদের সৈন্য ও অস্ত্রসংখ্যার কমতি থাকলেও সেইসব অস্ত্রের গুণগত মান ছিল সমপর্যায়ের । ওদেরও উট আছে, মুসলিমদেরও আছে । ওদের ঘোড়া ছিল , মুসলিমদেরও । ওদের তরবারি ছিল, মুসলিমদেরও । ওদের তীর ধনুক বল্লম ছিল, মুসলিমদেরও ।
আজ ইসলামবিরোধীদের (আল কায়েদার মূল শত্রু আমেরিকা) হাতে যা আছে, মুসলিমদের হাতে তার কোনটি আছে ? কতটুকু আছে ? কিছুই নেই । অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করবেন , সেই অস্ত্রও তো কিনতে হয় আমেরিকা রাশিয়া ইসরাইলেরই কাছে ।

আপনি অনেক মুত্তাকী বান্দা হতে পারেন , কিন্তু ডাক্তারি করতে গেলে আপনাকে ডাক্তারিবিদ্যাই জানতে হবে । নাহলে নাকের সার্জারি করতে গিয়ে হয়তো গলা কেটে ফেলবেন । আর গলা কেটে ফেললে আল্লাহর কুদরত দিয়ে সেই রোগী বাঁচাতে পারবেন না । আল্লাহ্‌ বাঁচাতে পারেন , কিন্তু এভাবে বাঁচানো আল্ললাহর সুন্নাত না ।
রাসুল (সাঃ) যুদ্ধ কামনা করতে নিষেধ করেছেন । কিন্তু যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলে সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে বলেছেন । সেজন্য আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন এসব জায়গায় যে সশস্ত্র যুদ্ধ চালাচ্ছে আল কায়েদা এবং হামাস- সেগুলো ঐ স্থানের জন্য যথার্থ । এর কোন বিকল্প নেই । সারাবিশ্বের মুসলমান এটাকে সমর্থন করে ।

কিন্তু বাংলাদেশে ? বাংলাদেশে আল কায়েদা কী করবে ? যে দেশের চারদিক ভারত মিয়ানমার দ্বারা বেষ্টিত , আশেপাশে কোন মুসলিম দেশ নেই সেখানে কোত্থেকে আসবে অস্ত্র ? ভারতের অস্ত্র দিয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধ ? আফগানিস্তানের মত চারিদিকে মুসলিম দেশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় ক্ষমতা টেকানো যায় নাই , সেখানে বাংলাদেশে তো অচিন্তনীয় ।

প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ায় সফলতা পেতে চাইলে সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে । জ্ঞানে-বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে নিজেদের যোগ্য করতে হবে ।
আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে উদার গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন ছাড়া ইসলামপন্থীদের কোন বিকল্প নেই । সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা ছাড়া আল কায়েদা বা অন্য কোন সশস্ত্র গোষ্ঠীর এদেশে কোন ভবিষ্যৎ নেই ।

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেশকে ?

কোন একটি পুরো গোষ্ঠীর ওপর মানুষের বিতৃষ্ণা বা ঘৃণা একদিনে তৈরি হয়না । এর জন্যে দীর্ঘদিনের কর্মকান্ডকে নজরে আনে মানুষ । একটু একটু করে , একজন একজন করে পুরো একটা গোষ্ঠীর ওপর ধীরে ধীরে বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে মানুষের মন ।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় যে বেহাল নীতি-নৈতিকতাবিহীন , দায়বোধহীন অবস্থা চলছে , অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে এর ফলে ধীরে ধীরে সাংবাদিকদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে মানুষ ।
কথা ছিল সংবাদপত্র হবে জাতির বিবেক । কিন্তু তা না হয়ে এখন হয়েছে জাতির বিবেক হরণকারী । দিনের পর দিন বিনাবিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে , আর ইনিয়ে বিনিয়ে সেগুলোকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে একশ্রেণীর মিডিয়া ।

আল কায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরির নামে তৈরিকৃত ভুয়া বক্তব্য প্রচারের মাধ্যমে আরো একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশের মিডিয়া গোষ্ঠী । প্রথমে কী করা উচিৎ ছিল ? উচিৎ ছিল এটির সত্যমিথ্যা যাচাই করা । তারপর সত্য হলে সেটা সরকারের কাছে জানানো । আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে জানানো । জনসমক্ষে বারবার প্রচার করা কোনভাবেই উচিৎ হয়নি । আর ভুয়া হলে তো কথাই নেই । এই বক্তব্য মহা উৎসাহে বারবার প্রচার করে জনগনের ভেতর আতংক ছড়ানো ছাড়া দেশের কী লাভ হয়েছে ? জনগনেরই বা কী লাভ হয়েছে ? বরং এতে করে আল কায়েদার প্রচার হয়েছে মাত্র ।

এখন এটা অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে যে, এই প্রচারণাটা করা হয়েছে যাতে এই ডামাডোলের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের তেল গ্যাস নিয়ে ভারতের সাথে যে চুক্তি তা চুপেচুপে সম্পন্ন করা যায় । সেটাই করা হয়েছে ।
আরেকটা ব্যাপার হলো- একের পর এক প্রোপাগান্ডা দিয়ে বিরোধী জোটকে চাপে রাখার যে সরকারি কৌশল সেটা একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল । সেই জায়গায় একের পর এক বন্দুকযুদ্ধের নামে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসছিল । সেটিকেও আড়াল করে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেয়ার অপকৌশল হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে এটিকে ।
সংবাদপত্র , টিভি, মিডিয়া এখন জনগনের কাছে দায়বোধ করেনা , দায়বোধ করে পছন্দনীয় রাজনৈতিক দলের প্রতি ।
এভাবে চলতে থাকলে একসময় সাংবাদিক , সংবাদপত্র গনশত্রুতে পরিণত হবে । সাংবাদিকদেরকেই বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে নিজেদের স্বার্থেই ।

রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কবিতার যক্ষা !



মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কবি হয়ে যাই  
অভিধানের শব্দগুলোকে ব্যবহার করে
কবিতায় লিখে যাই সময়
স্রষ্টা ও মানবের যত জীবনেতিহাস , 
ভালোবাসা প্রেম মৃত্যু ও হাহাকার  । মানবমনের
যত নিগূঢ় রহস্য !


ইচ্ছে করে মানবদেহের প্রতিটি কোষকে ব্যবচ্ছেদ করি বাংলায়
স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণে ।
ফিজিওলজি বায়োকেমিস্ট্রি কার্ডিওলজি হয়ে যাক কবিতা
গণিতের জটিল সমীকরণ
হয়ে যাক কিষাণ মাঝির দয়ালু কন্ঠে
ভাওয়াইয়া আর ভাটিয়ালি গান !

কিন্তু


আমি পারিনা  কবিদের মত দুর্বোধ্য শব্দ লিখে যেতে
সহজ বিষয়কে কঠিন করে না লিখলে
কবিতা তো বিমূর্ত হয় না ! অথচ,  যদিওবা লিখে ফেলি -
কঠিন শব্দগুলোকে আমি
উকুনের মত বেছে বেছে মুছে ফেলি কীবোর্ডের ব্যাকস্পেস চেপে  ।



আমার কবি হওয়ার ইচ্ছেটা তাই
যক্ষায় ভুগে ভুগে মরে যায় ।

শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

জোৎস্নালোকে পুরুষের মন

জোছনায় নারীর মনে হয় নাকি কোন আলোড়ন ; জানা নেই
কোনদিন জানা হবে কিনা
তাও জানা নেই  !


তবে
ভরা জ্যোৎস্নায় পুরুষের মনে আসে উত্তাল জোয়ার  
পদ্মা মেঘনা ব্রহ্মপুত্র নয়  , ইনানী সৈকতের প্রবাল ছাপিয়ে আসা
বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মত  !

হাবুডুবু খেতে খেতে সে জোয়ারে প্লাবিত পুরুষ
জোত্‍স্নার অথই জলের ভেতর আতিউতি খোঁজে অবলম্বন
খড়কুটো নয় , নৌকার গলুই কিংবা উদ্ধারকারী জাহাজ হামজাও নয়
খোঁজে একটি হাতের আশ্রয় !
হোক নরম সে হাতের আঙ্গুল , হোক দুর্বল

না থাকুক টেনে তুলবার শক্তি । শুধু যেন  
সে হাতে হাত রাখা যায় পরম বিশ্বাসে ! আর
এতটুকু ভালোবাসায় !



প্রতি দ্বাদশীতে একজন পুরুষ ফতুর হয়ে যায়
শহরে নতুন এসে
ছিনতাইকারীর হাতে সর্বস্ব খোয়ানো করিমের মত
হাহাকার করতে ইচ্ছে হয় তার  ।

অডিটরি হ্যালুসিনেশনের মত চারিদিকে নেই নেই রব ওঠে  
নিজেকে মনে হয় -  ইভ সৃষ্টির আগে
বেহেশতের অকল্পনীয় নহরের বালুকাবেলায় বসে থাকা
নিঃসঙ্গ আদম !


১৫-০২-২০১৪ 

বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কেউ কি পারবেন ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালনের একটাও ভালো দিক দেখাতে ?

দিবস পালন করা যেতে পারে যদি সেই দিবস পালন ভালো কোন উদ্দেশ্যে হয় , যদি সেই দিবস পালন সমাজের জন্য ভালো কোন ফল বয়ে আনে । যেমন স্বাক্ষরতা দিবস, মানবাধিকার দিবস ইত্যাদি । কিন্তু অনেক ভেবেও আমি ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালনের কোন ভালো উদ্দেশ্য কিংবা কোন ভালো ফল পেলাম না । সেজন্য আমি এই দিবস পালনকে সমর্থন করতে পারছি না । না একজন মুসলিম হিসেবে , না একজন বাঙালি হিসেবে , না একজন বাংলাদেশি হিসেবে ।

বাংলা, বাংলাদেশ এবং মুসলিম সংস্কৃতির কোন অংশের সাথেই এটি মেলে না । এছাড়া এর কোন গৌরবোজ্বল ইতিহাসও নেই ।

এক নোংরা ও জঘন্য ইতিহাসের স্মৃতিচারণের নাম বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এর ইতিহাস বেশ পুরনো হলেও ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ নামে এর চর্চা শুরু হয় সাম্প্রতিক কালেই। দু'শ সত্তুর সালের চৌদ্দই ফেব্রুয়ারির কথা। তখন রোমের সম্রাট ছিলেন ক্লডিয়াস। সে সময় ভ্যালেন্টাইন নামে একজন পুরোহিত , প্রেমিক- প্রেমিকাদেরকে গোপনে বিয়ে দিত । এ অপরাধে সম্রাট ক্লডিয়াস ভ্যালেন্টাইনের শিরশ্ছেদ করেন। তার এ ভ্যালেন্টাইন নাম থেকেই এ দিনটির নাম করণ করা হয় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ যা আজকের ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’। অন্য একটি ঘটনাও এর ইতিহাস হিসেবে প্রচলিত আছে ,কিন্তু সেটিও গৌরব করার মত কিছু নয় ।

বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। সেসময়ের 'যায় যায় দিন' পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান বাংলাদেশে এর পথিকৃৎ । এছাড়া এই দিবস পালনের পেছনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যই প্রধান ।

এই দিবসের ভালো কোন দিক আছে কি ? বরং এর মাধ্যমে নারী নির্যাতনের পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে । নৈতিক অবক্ষয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে ।

অশ্লীলতার প্রসার ঘটানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে ।

আর মুসলিমদের জন্য , যারা আল্লাহর ওপর ঈমান আনার দাবি করেন তাদের জন্য কুরআনের একটি আয়াতই এই দিবসের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সতর্ক হবার জন্য যথেষ্ট-

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ

‘‘ যারা মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি..।’’(সূরা আন-নূর :১৯)

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সেইযে আমার লাল টুকটুক শিমুলরঙ্গা দিনগুলি...

ফাল্গুন মানে আমার চোখে লাল লাল শিমুলের ফুল । আর ভোরবেলা কোকিলের কুহু ডাক । উত্তরবঙ্গে ফাগুন মাসেও শীতের আমেজ থেকে যায় । ফযরের নামাজ শেষে কেডস পায়ে আমরা ছোটরা দৌড়াদৌড়ি করতাম । বাড়ির পেছনেই প্রকান্ড শিমুল গাছ । আঙ্গিনায় দাঁড়ালেই চোখে আসে সুর্যের আলোয় চকচক করছে লাল টুকটুকে অগুণতি শিমুল ফুল । গাছতলায় ঝরে পড়া শিমুল ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা হত আমাদের ভেতর । কার মালা কত বড় হয় ! দিনশেষে সে মালা হয়তো গরুর খাদ্য হত অথবা গরুর গলায় ঝুলতো ! তবু পরদিন আবারো মহা উৎসাহে ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথার অকারণ প্রতিযোগিতায় নামতাম আমরা ।

ফেব্রুয়ারির শুরু । গ্রামের স্কুলে তখনো পুরোপুরি ক্লাস শুরু হয়না । পড়ার চাপও নেই বললেই চলে । বাঁশের কঞ্চির একাংশ সূঁচালো করে সেখানে বিঁধে নিতাম শিমুল ফল । আমরা বলতাম মোচা । তারপর চলতো মোচা নিক্ষেপের প্রতিযোগিতা । কারটা কত দূরে গিয়ে পড়ে ! মার্বেল আর ডাংগুলি খেলার বাইরে এ ছিল এক মজার খেলা ।

ছোটবেলার বসন্ত মানেই তাই আমার কাছে শিমুল ফুলের মালা । গাছের ডালে  দোয়েল-শালিকের ওড়াউড়ি । মধ্য দুপুরে ঘুঘুর অন্তরভেদী ডাক ।

চৈত্র মাসে তৈরি হয় আরেক অসাধারণ দৃশ্যের । শিমুলের মোচা ফেটে সাদা সাদা তুলা উড়ে বেড়ায় আকাশে । আমাদের বাড়ির আকাশে সবসময় ঘুরে বেড়াত তুলোর মেঘ !
মাঝে মাঝে আমরা ছোটরা বাতাসে ভেসে বেড়ানো তুলা ধরবার চেষ্টা করতাম । ধরতে ধরতে ছোট হাতের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেত তুলোর টুকরা । হাতে নিলে  সদ্য ডিম ফোটা মুরগীর বাচ্চার মত লাগতো সাদা পেজা তুলো !



এরই মাঝে কখন যেন আম গাছে মুকুল আসা শুরু হয় । আমের মুকুলের গন্ধে এক অন্যরকম মাদকতা । বাড়ির চারপাশ ঘিরে আমের গাছ , চোখে আমের মুকুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য , নাকে আমের সুগন্ধ ! কী যে ভালো লাগতো !

বাড়ির সামনে খোলা জায়গা । ওখানে এক বিঘা জমিতে সরিষার ক্ষেত । দিগন্তজোড়া না হলেও সে দৃশ্যটাও ছিল অসাধারণ ।

মেডিকেল কলেজে আমার হোস্টেলে , ঠিক আমার রুমের পেছনেই কৃষ্ণচূড়ার গাছ ছিল । আমার জানালায় কৃষ্ণচূড়ার ফুল জানিয়ে দিত ফাগুনের আগমন বার্তা । বিকাল হলে গল্পের বই হাতে ছাদের ওপর কৃষ্ণচূড়ার ফুলের মাঝে বসে কত বই পড়েছি !

নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয় । কৃত্রিম উচ্ছ্বাসে নয় - সত্যিকারের ফাল্গুন, সত্যিকারের বসন্ত পেরিয়ে এসেছি জীবনে ।

দিন গেছে । হয়ে গেছি যান্ত্রিক । আজও এসেছে ফাগুন । এসেছে বসন্ত । আজ আমার কৃষ্ণচূড়াও নেই , শিমুল ফুলের মালাও নেই । স্মৃতির মাঝে শুধু আছে- সেইযে আমার লাল টুকটুক শিমুলরঙ্গা দিনগুলি...

মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সোনার খাঁচায় নতুন পায়রা



অচিন গুহায় লুকিয়ে রাখা
তালাবদ্ধ ‘সোনার খাঁচা’টার নড়বড়ে ডালা খুলে
আবার নতুন করে সাজাতে হবে , নবসজ্জ্বায় ।

আরো কিছু মায়াভরা দিন জমা হয়েছে জীবনের ঝুলিতে
আরো কিছু নতুন মুখ যুক্ত হয়েছে- ‘প্রিয়’দের সারিতে
সযত্নে রেখে দিতে হবে উড়ুক্কু এইসব নতুন পায়রা  
সোনার খাঁচায় ।

▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
জানিনা বারবার কোথা হতে আসে
বজ্জাত ইদুরের দল । ক্রমাগত ছিদ্র করে চলে সোনার খাঁচা
কুটকুট করে কাটতে থাকে অবিরাম ; সোনালী ডায়েরীর পাতা
পলকা হাওয়ায় উড়ে যায় আমার স্বপ্নময় দিনগুলি
খাঁচা খুলে দেখতে পাই শুধুই
একরাশ শূন্যতা...



তবুও অবুঝ শিশুর মত আমি গড়ে যাই ধুলোর সংসার
অলৌকিক সোনার খাঁচায় যত্ন করে রাখি
রুক্ষ শীতে ঝরে যাওয়া পাতার মত
ফেলে আসা মায়াবী দিন
আর প্রিয় মুখগুলি...

শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

শাট ইওর মাউথ !

আমরা অনেকসময়েই অন্য কারো সম্পর্কে হুট করে মন্তব্য করে বসি । এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই- বিরুপ মন্তব্য করার দিকেই আমাদের ঝোঁক বেশি ।
কোন মানুষের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গেলে তার সম্পর্কে জানতে হয় । কিন্তু একজন মানুষ সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানতে পারি ? বন্ধু বান্ধব কিংবা পরিচিতজনের সম্পর্কেই বা কতটুকু জানি আমরা ?
এমনকি বাবা মাও তার সন্তানের ব্যাপারে পুরোটা জানেন না । বড় হতে হতে প্রত্যেক মানুষের একটা নিজস্ব জগত তৈরি হয় , নিজস্ব চিন্তাধারা গড়ে ওঠে যেটা বাবা – মাও যার পুরোটা বুঝতে পারেন না ।
কোন একজনের ক্ষেত্রে কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক বলা মুশকিল । আমার অবস্থান থেকে যেটা ভুল , তার অবস্থান থেকে হয়তো আর কোন বিকল্প নেই !

কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক , আসলে পুরোটাই আপেক্ষিক । যার যার ভুল শুদ্ধের হিসাব তার তার কাছে , আরেকজনকে বিচার করার দায়িত্বটা আমাকে কে দিয়েছে ?

মুখ বন্ধ রাখার অভ্যাসটা বেশ ভালোই আয়ত্ব করেছি । (একসময় কথা বলে বলে সবাইকে বিরক্ত করে ফেলতাম, দমিয়ে না রাখলে এখনো কম বকোয়াজ নই ।) কিন্তু এখন হয়তো দিনের পর দিন কোন কথা না বলেই কাটিয়ে দিতে পারবো । তবু যা বলি , পরে মনে হয় - এটা না বললেও তো চলতো !
মুখের কথা নিক্ষিপ্ত তীরের মত । যা একবার ছুটে যায়, তা আর ফেরানো যায়না । তাই মাঝে মাঝে নিজেকেই বলি -শাট ইওর মাউথ !

মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

লাইন হয়ে যায় আঁকাবাঁকা...

আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
ভালো না হাতের লেখা
আসো যদি বাঁশবাগানে , আসো যদি বাঁশবাগানে
আবার হবে দেখা বন্ধু , আবার হবে দেখা ...

হঠাৎ বাঁশিতে টান পড়লে চমকে উঠলো রইচ । সত্যি সত্যি বাঁশবাগানের একপাশে বসে বাঁশি বাজিয়ে একমনে গান গাইছিল সে । মাথা ঘুরিয়ে দেখে জুলেখা দাঁড়িয়ে আছে । চোখ মুখ অন্ধকার । হাত ধরে জুলেখাকে পাশে বসালো রইচ ।

আশ্বিনের মাঝামাঝি । কোথাও কোন কাজ নেই । চারিদিকে অভাব অনটন । মঙ্গা শুরু হয়েছে । জুলেখার মুখ কেন অন্ধকার রইচ জানে । আবার নিশ্চয়ই চাল ফুরিয়ে গেছে । কয়েকদিন থেকেই সামান্য একটু করে চাল দিয়ে চলছে । ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনে সামান্য একটু করে ভাত আর বেশি করে ভাতের ফেন খেয়েই কাটাচ্ছে গত তিন দিন । কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা , চার বছর বয়স , আর ছোট মেয়েটা দুই বছর বয়স । ওদের তো না খাইয়ে রাখা যায় না ।


এই গ্রামে গেরস্ত পরিবার বেশি নাই । দুই-তিনটি পরিবার স্বচ্ছল আছে । কিন্তু ওরাই বা কয়জনকে সাহায্য করবে ? তবু ওদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে এরই মাঝে কয়েকবার চাল আনা হয়ে গেছে ।
কামলা খাটা ছাড়া কোন কাজ জানা নেই রইচের । আর জানলেও বা কী হতো ? মুচি কামার কুমার সবার বাড়িতেই তো এখন অভাব অনটন ।

-     ‘ কলিমের বাপ, এক বাটি চাউল আছে, রাইতটা কোনমতে চইলবে । কাইল কী খামো ?’

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জুলেখা বলেই ফেলে কথাটা । কলিম ওদের ছেলের নাম ।

রইচ বাঁশিটা হাতে নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করে । বাঁশবাগানের ভেতর একটা ঘুঘু ডাকছে । বুকটা হাহাকার করে ওঠে রইচের ।
জুলেখাকে কত আশা দিয়েছিল । কোনদিন কষ্ট দেবে না । রক্ত পানি করে হলেও জুলেখার মুখের হাসি ধরে রাখবে । আজ কোথায় সেসব আশ্বাস ! এখন কী করবে রইচ ?

পাশের গ্রামেই জুলেখার বাপের বাড়ি । বিয়ের আগের কথা, সেসময় বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করতে যেত রইচ । যাওয়া আসার পথে চোখ পড়েছিল জুলেখার ওপর । জুলেখাও কেন  যেন তাকিয়ে থাকতো রইচের দিকে ! পড়ন্ত বিকেলে কাজ শেষে ফেরার পথে দরাজ গলায় গান গাইতো রইচ । আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...

‘ভাইজান , মোর  বুবু তোমাক ডাকায়’ । একদিন রইচকে ডেকে বলেছিল জুলেখার ছোটবোন ।
ভীরু পায়ে ছনের চালার নিচে গিয়ে দাড়িয়েছিল সে । বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিলো তার । ভালোলাগা নারীর সামনে কি সব পুরুষেরই এমন হয় ? কে জানে ! হয়তো মহাপুরুষদের হয়না । রইচ তো আর মহাপুরুষ নয় ! সে পুটিমারী গ্রামের সাধারণ কৃষকের ছেলে – রইচ উদ্দিন ।


সেই থেকে প্রতিদিন একটি দুটি করে কথা হয় যাওয়া আসার পথে । জুলেখাই কথা বলে, রইচ একনিষ্ঠ শ্রোতা । কথার পিঠে কথা খুঁজে পায় না সে । শোনে, আর মাঝে মাঝে মাথা তুলে জুলেখার খিলখিল হাসি দেখে অবাক হয় ।

কাজের ফাঁকে বাঁশি বাজাত রইচ । বাঁশি বাজানো শুরু করলে পৃথিবীর সবকিছু ভুলে যায় সে । ভাওয়াইয়া গানের বিরহী সুর তার বাঁশির সুরে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে ।   দূর থেকে সে বাঁশির সুর কান পেতে শুনতো জুলেখা । রইচের প্রতি তার আকর্ষণ বেড়ে যায় দিনকে দিন । কথাচ্ছলে বান্ধবীদের সে বলেও ফেলে সে কথা ।

এসব কথা গোপন থাকেনা । একান ওকান করে কথা চলে যায় রইচের বাবার কানে । রইচের বাবা তাঁর একমাত্র ছেলের কোন সাধ অপূর্ণ রাখেন না – যতটুকু সাধ্যে কুলায় । তিনি কথা বলেন জুলেখার বাপের সাথে । ছেলেরও তো বয়স হয়েছে । কথা পাকাপাকি হলে এক চৈত্রের রাতে জুলেখার সাথে বিয়ে হয়েছিল রইচের ।

 -‘কী হইলো , কিছু কওনা ক্যানে ?’  জুলেখার তীক্ষ্ণ স্বর আবার কানে আসে ।
বর্তমানে ফিরে আসে রইচ । কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় জুলেখার চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে ।


***
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে দুজনে । ঘুঘুটাও একটানা ঘু-ঘু করে ডেকে যায় । এই ভরদুপুরে সে ডাক অদ্ভুত লাগে । প্রকৃতির নিস্তব্ধতা যেন আরো গভীর করে তোলে ।
হঠাৎ করে রফিকের কথাটা মনে পড়ে গেল রইচের । পুবপাড়ার রফিক । রফিকের চুরির অভ্যাস আছে । অনেকেই জানে ব্যাপারটা , কিন্তু কোনদিন সে ধরা পড়ে নাই । তার বাড়িতে আহামরি কোন জিনিসপত্রও নাই । কোনদিন রফিকের বাড়ি থেকে কোন চুরির জিনিস উদ্ধারও হয় নাই । কিন্তু তার সংসারে অভাব জিনিসটাও নাই । এই মঙ্গায়ও রফিকের বাড়িতে নিয়মিত চুলায় হাড়ি ওঠে ।

দুইদিন আগে মন খারাপ করে নদীর ধারে হাটছিল রইচ । রফিকের সাথে দেখা । রফিকই এগিয়ে এসেছিল রইচকে দেখে ।

-      ও রইচ , মন খারাপ নাকি ?
-      রফিক ভাই, এইভাবে কয়দিন চলমো ? ঘরত চাউল নাই । ধার দেনা করি কয়দিন খামো কন ? আর এত ধার দিবে কায় হামাক ?
-      মোর সাথে কাম করবু নাকি রে রইচ ?
-      কী কাম ভাই ? কোন বাড়িত তো কাম কাজ নাই ।
-      দিনের কাম নায় রে রইচ , রাইতের কাম । করবার চাইলে কও , তোক একদিন সাথে নিয়া যাইম । ভালো থাকার উপায় কি কও, প্যাটত ভাত না থাকলে সব কামই করা যায় । অভাব থাইকলে স্বভাব কয়দিন ভালো রাখবার পারবু কও ? তুই ভাই বেরাদর । তোর কষ্ট সইজ্য হয় না ।


ইঙ্গিতটা রইচ বোঝে । কিন্তু তার মন সায় দেয় না । ব্যবস্থা একটা না একটা হবেই । সেদিন রইচ শক্তকন্ঠেই বলেছিল – ‘না রফিক ভাই, ঐগুলা কাম মোর দ্বারা হইবে না’ ।

রইচ এখন জুলেখাকে কী বলবে ভেবে পায় না । কাঁচুমাচু করে বলে-
-      ‘জুলেখা , আর একবার মেম্বার চাচার বাড়িত যাইয়া দেখনা । চাচীর হাত পাও ধরি এক সের চাউল দিবার কও’ ।
-      ‘সে মুই সকালে গেছিনু । চাচী কইল, আর চাউল দেওয়া সম্ভব নায়’ ।
চোখ ছল ছল করে জুলেখার ।
আরো কিছুক্ষণ কোন কথা না বলে আবার বাঁশি বাজাতে শুরু করে রমিজ ।

আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
ভালো না হাতের লেখা, আসো যদি বাশবাগানে...
আবার হবে দেখা বন্ধু... আবার হবে দেখা...


বাঁশি বাজাতে বাজাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রমিজ । আর বোধহয় ভালো থাকা সম্ভব না । বাচ্চাকাচ্চার কষ্ট আর সহ্য হয় না । বিকালেই রফিক ভাইর সাথে দেখা করে সম্মতির কথাটা জানাতে হবে । হ্যা, রইচ করবে- রাইতের কাজ করবে রফিকের সাথে ।


২।
-    ‘উফ কী গরম ! জুলেখা, যাই একটু গায় হাওয়া লাগায় আসি । তুই ঘুমা’ ।

মধ্যরাত । রইচ ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় । সন্ধ্যাবেলায় চাঁদ উঠেছিল এক ফালি , এখন কোন চিহ্ন নেই । চারিদিকে অন্ধকার । গাঁয়ের সবাই গভীর ঘুমে অচেতন । মাঝে  মাঝে দু-একটা প্যাঁচার গা হিম করা ডাক শোনা যাচ্ছে । বাশবাগানের ওপাশ থেকে কোন একটা খেকশিয়ালের হুয়া হুয়া শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ পরপর । রইচের এক দফা ঘুম হয়ে গেছে । ছোট বাচ্চাটা একটু পরপর কেঁদে উঠছিল । জ্বর এসেছে , গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে রইচ । আজ যদি ভালোয় ভালোয় কাজটা করে ফেলতে পারে , বাচ্চাটার জন্য ঔষধও কিনতে পারবে ।

চুপচাপ মাঠ পার হয়ে তিন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায় রইচ । রাস্তার ধার থেকে উঠে আসে রফিকও । বিকালেই সব প্ল্যান করেছে । রইচের যেহেতু প্রথম দিন , ওকে বেশ কিছু কায়দা কানুন শিখিয়ে দিয়েছে রফিক ।

হেঁটে হেঁটে দুই মাইল পেরিয়ে এলো ওরা । এই এলাকার করিম সাহেব বেশ ধনী লোক । তার গোলাঘরটা বাড়ির একপাশে । সেখান থেকে ধান চুরি করে ওরা রাতেই চলে যাবে দূরের বটতলা হাটে । কাল হাটবার । সকাল সকাল বিক্রি করে ফেলবে ধান । টাকাটা ভাগ করে নিয়ে দুইজন ভিন্ন ভিন্ন পথে বাড়ি ফিরবে ওরা । এরকমই পরিকল্পনা করা আছে ।

-      ‘রফিক ভাই, মোর ভয় নাগচে যে’...
-      ‘ধুর, এই কামে ভয় হইলো এক নম্বর শত্রু বুঝলি রইচ । ভয় ডর বিন্দুমাত্র মনে রাখলে চইলবে না । তোক যা যা কইছিনু মনত আছে তো ? কোন শব্দ করা চইলবে না । শব্দ হৈছে দুই নম্বর শত্রু’ ।

খড়ের গাদার পেছনে লুকিয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশের অবস্থা দেখলো ওরা । কুকুর নাই এ বাড়িতে এটা আগে থেকেই জানা আছে রফিকের । বাড়ির চাকরটাও আজ থাকার কথা না । তার মায়ের অসুখ , বাড়িতে গেছে । খোঁজখবর নিয়ে রেখেছে রফিক আগেই । রইচ না এলেও অবশ্য আজ রফিক আসতো চুরি করতে । বিকালে রইচ এসে বলাতে তাকেও সাথে নিতে হয়েছে । নতুন লোক নিয়ে এইসব কাজে নামা খুব রিস্কের ব্যাপার । কিন্তু এই মঙ্গায় রইচের কষ্ট সত্যিই রফিককে ব্যথিত করেছে । আর তাছাড়া কোন না কোনদিন তো ‘শুরু’ করতেই হবে । কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে সব শিখে ফেলবে রইচ ।


অবস্থা অনুকূলে বুঝে ধীরে ধীরে ওরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে । এইদিকটাতে কয়েকটি লেবুগাছ ঝোপের সৃষ্টি করেছে । লেবুগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বেড়ার বাঁধন আলগা করে দিল রফিক । বের হবার সময় বড় জায়গা লাগবে ।


এবার আসল কাজের পালা । ধানের গোলা মাচানের ওপর । মাটি থেকে কোমর সমান উঁচু পর্যন্ত ফাঁকা । বস্তা নিয়ে দুজনেই ঢুকে পড়লো মাচানের নিচে । নিচ থেকে ছিদ্র করে দিলেই ধান পড়া শুরু হবে । নিচে মুখ খোলা বস্তা ধরলেই হবে ।

ভালো কায়দা জানে রফিক । ধারালো চাকু দিয়ে কীভাবে কীভাবে জানি ছিদ্র করে ফেললো সে । রইচ বস্তা মেলে ধরলো । আধা ঘণ্টার মধ্যে ধানে ভরে গেল বস্তা ।


৩।
ফযরের আযান হচ্ছে । আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার...আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম... মুয়াজ্জিনের কন্ঠটা খুব ক্ষীণ । খালি গলার আজান । এই গ্রামে এখনো মাইক আসে নাই । তবু আযানের সময় হলেই জুলেখার ঘুম ভাঙ্গে । ছোট বাচ্চাটা আবার কাঁদছে ।

-      ‘কলিমের বাপ, ছাওয়াটাক থামান তো’ ।

উঠে বসে জুলেখা । রইচ বিছানায় নেই দেখে কিছুটা অবাক হয় । পরক্ষণে ভাবে, হয়তো বাইরে গেছে । জুলেখা উঠে অযু করে নামাজ পড়ে । বাচ্চাটার জ্বর আরো বেড়েছে । মাথায় পানি ঢালতে হবে । সকালের খাবারও জোগাড় নাই । কারো বাড়ি থেকে একটু পান্তাভাত চেয়ে বাচ্চাদুটাকে খাওয়াতে হবে । জুলেখা আজ রোযা রাখবে । উপায় নাই । নিয়াত করে ফেললো সে ।

থালা বাসন ধুয়ে বারান্দায় বসেছে জুলেখা । লোকটা গেল কৈ ? তার মনে পড়লো , রাতে শরীরে হাওয়া লাগানোর জন্য ঘর থেকে বের হয়েছিল রইচ । তাইলে কি আর ঘরে ফেরে নাই কলিমের বাপ ?

-     ‘ কই গো মা জুলেখা , রইচ আছে নাকি বাড়িত ?’
-      ‘নাই চাচা, কাইল রাইতত একবার ঘর থাকি বাইর হছিল, আর দেখা নাই । কোনটে যে গেল লোকটা ?’
-      ‘মাগো, একটা খবর পাইনু মা । কাইল্কাপুর গ্রামত নাকি একটা চোর ধরা পড়ছে, তার নাম নাকি রইচ । হামার রইচ তো ভালো ছাওয়া, কিন্তু এই মঙ্গায় কারো মাথার ঠিক থাকে ? মুই একবার দেখি আসিম নাকি মা ?শুনিনু  কাইল্কাপুর বাজারত নিয়া আসছে চোরটারে’ ।


মসজিদের মুয়াজ্জিন রহমান চাচার কথা শুনে জুলেখার বুকটা ধ্বক ধ্বক করে উঠলো । আবার নিজেকেই নিজে বোঝালো সে । না , কলিমের বাপ এমন কাম কইরবার পারেনা ।
তবু মন মানেনা জুলেখার, নামটা যে রইচ !
আর তাছাড়া কাল রাতে বের হবার পর রইচ এখনো ঘরে ফেরে নাই । তাহলে কি...ভাবতে গিয়ে মাথা দুলে ওঠে জুলেখার । না না । এ কীভাবে হয় ?

বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে সে নিজেই বাজারের দিকে পা বাড়ালো ।


৪।
কাইল্কাপুর গ্রামের বাজারের বটগাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে চোরটাকে । সবাই ইচ্ছামত পেটাচ্ছে । কেউ খালিহাতে , কেউ লাঠি দিয়ে , কেউ গাছের ডাল ভেঙ্গে পিটাচ্ছে । প্রতিযোগিতা করে পেটাচ্ছে । 
কে কত জোরে , কতক্ষণ ধরে পেটাতে পারে তার প্রতিযোগিতা হচ্ছে যেন । এই দেশে চোর পেটাতে আর বউ পেটাতে কেউ ক্লান্ত হয়না ।

নিঃসাড় হয়ে আসছে রইচের শরীর ।

সবকিছু ঠিকই ছিল । কিন্তু বিপত্তি বাঁধে মাচানের নিচ থেকে বের হবার সময় । ইদুর মারার একটা ফাঁদ বসানো ছিল , ওটায় পা পড়ে যায় রইচের । সইতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে সে । লোকজন জেগে উঠে তাড়া করে ওদের । রফিক পালিয়ে যায় । রইচের পায়ে ইদুর মারার ফাঁদটা আটকে যাওয়ায় সে বেশিদূর দৌড়াতে পারেনি । ধরা পড়ে যায় ।

***
বেধড়ক পিটুনিতে প্রথম প্রথম খুব চিৎকার করলেও ধীরে ধীরে ব্যথার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে রইচ । একটা চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না । ডান কান থেকে রক্ত পড়ছে । হাত পায়ের একটা করে হাড় ভেঙ্গে গেছে । মাংস থেতলে গেছে । এখন আর কিছুই গায়ে লাগছে না তার । জুলেখা আর বাচ্চা দুটার চেহারা ভেসে আসছে ঝাপসা চোখের সামনে । মাঝে মাঝে মাগো, বাবাগো, জুলেখা- বলে গোঙ্গাচ্ছে রইচ ।

হাত পা বাধা রইচের । কতক্ষণ এভাবে কেটেছে হুঁশ নেই ।
হঠাৎ পরিচিত কন্ঠের ও আল্লা ও আল্লা চিৎকার শুনে চোখ খুললো সে । জুলেখা এসেছে । জুলেখা চিৎকার করে কাঁদছে – ‘কলিমের বাপ, ক্যানে এই কাম কইরবার গেইলেন । সবায় না খেয়া মরি গেইলেও ভালো আছিলো । ক্যানে এই কাম কইরবার গেইলেন...ও আল্লারে, কী হয়া গেলো রে...ও আল্লারে...’
কে একজন জুলেখাকে ধরে রইচের কাছ থেকে সরিয়ে দিল । দু’একজন পেছন থেকে বলে উঠলো – আইছে, চোরের বউ আইছে । 

রইচের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । ব্যথায়, কষ্টে , দুঃখে , অবসাদে ।

চোখ বন্ধ করার আগে অনেক কষ্টে শেষ কথাটা বললো রইচ- ‘জুলেখা, মোকে তুই মাফ করি দেইস গো বউ ...’।

সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ঝগড়া করবো বলে ...

ছোটবেলা থেকেই আমি একটু ‘প্রতিবাদী’ । কারো কোন কথা পছন্দ না হলে অথবা আমার বিরুদ্ধে গেলে প্রতিবাদ করতাম । ছোটবেলার প্রতিবাদগুলো ঠিক প্রতিবাদ ছিলনা । সেগুলো হয়ে উঠত ‘ঝগড়া’ । জীবনে সবচেয়ে বেশি ঝগড়া করেছি আমার দুবছরের বড় ভাই এর সাথে ।

বড় ভাইয়ের সাথে ঝগড়াগুলো বেশিরভাগ সময়েই শেষ হয়েছে হাতাহাতিতে । রাতদুপুরে অন্ধকারে ঘুষাঘুষি কম হয়নি । একসময় বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলো । সে এক কঠিন জেদ । অভিমান । অনেকদিন চলেছিল কথা বন্ধ অবস্থা । একসময় হাদীসে পড়লাম নিকটাত্মীয়দের সাথে তিনদিনের বেশি কথা না বলে থাকার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি । তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে ফেললাম । খুব কষ্ট হয়েছে জেদ ভেঙ্গে নতুন করে কথা শুরু করতে ।  স্বাভাবিক হতে সময়ও লেগেছে দীর্ঘদিন ।

এসএসসি পাস করে বাড়ি ছাড়লাম । তারপর থেকে ‘ঝগড়া’ বলতে যা বোঝায় তা আর হয়নি । অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি  । কিন্তু সেগুলো আসলে ছিল সত্যিকারের ‘প্রতিবাদ’ , ‘ঝগড়া’ নয় ।

আজ মেজাজ খারাপ ছিল । অনেকদিন পর দুই বন্ধু দেখা করতে এসেছে, অকারণে তাঁদের ওপর ঝাড়লাম । কিন্তু ঝগড়া হলো না । ঝগড়া করার বয়স নাই ।

মাঝে মাঝে মনে হয় ‘ঝগড়া’ করাটা সবসময় খারাপ না ! ইচ্ছা হয় কারো সাথে ‘ঝগড়া’ করি  !  ঝগড়াটা হবে খুব তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে । ঝগড়ায় খুব চেঁচামেচি হবে ! মারামারি হবে !   কেউ কাউকে ছাড় দেবো না । ঝগড়াটা শেষ হবে অমীমাংসিত অবস্থায় । আর 'ঝগড়া' শেষ করার পর হঠাৎ চোখে পানি চলে আসবে । খুব অনুতপ্ত হবো । বারবার শুধু মনে হবে ‘ইস ! সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে কেন এত বাড়াবাড়ি করতে গেলাম ?’ 

রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

একটি ভয়ংকর বন্দুকযুদ্ধের গল্প !

১।
জিপটাতে মোট এগারো জন । দুইজন আসামী । সাতজন স্পেশাল ফোর্সের সদস্য । সবার পরণে কালো পোষাক । টপ টু বটম কালো । কামাল বসেছেন সামনের সিটে , ড্রাইভারের পাশে । গাড়ি চলছে ফাঁকা কোন জায়গার উদ্দেশ্যে ।
রাত তিনটা বাজতে দশ মিনিট বাকি আছে । জিপের আর সাতজনের কাউকেই ভালো চেনেন না কামাল । ওরা সবাই বিশেষ বাহিনীর সদস্য । র্যা বের ৫ জন , বিজিবির ২ জন । মোট সাত জন , গতকাল এসেছে । আগে এদের কারো সাথে কোনদিন দেখাও হয়নি । খুব বেশি কথা বলেনি ওরাও । কথা কম , কাজ বেশি । এখনো সবাই চুপচাপ । অবশ্য কথা বলার মত পরিবেশও নয় এখন । জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি । বাংলা মাস কি পৌষ না মাঘ মনে করার চেষ্টা করলেন কামাল । কিন্তু কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারলেন না । অন্য সময় হলে মাকে ফোন করে জেনে নেয়া যেত । মা এখনো বাংলা মাসের হিসাব রাখেন । এখন এত রাতে তো মাকে ফোন করা যাবে না ।
প্রচন্ড ঠান্ডা আর কুয়াশা পড়েছে । হেডলাইটের আলোতেও  বেশিদূর সামনে চোখ যাচ্ছে না । মনে হয় মাঘ মাসই হবে । সামনে বসায় গায়ে বাতাস লাগছে বেশি । ব্যাপার না । মাঘের শীতে নাকি বাঘেও  কাঁপে ।

এটা সেটা ভেবে মনটাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন কামাল । জিপের ভেতর যে দুইজন আসামীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে , তাদের কথা মনে করতেও ভয় হচ্ছে । কিন্তু বারবার ঘুরেফিরে তাদের কথাই মনে আসছে । কে জানে , হয়তো সারাজীবন তাদের কথা তাড়া করবে ।

২।
পরশু সকালে কেবল অফিসে গিয়ে পৌঁছেছেন , এমন সময় ফোন ।
-    কামাল সাহেব , এস পি বলছি ।
-    স্যার , জ্বি স্যার । চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান কামাল সাহেব । এই থানার ওসি ।
-    আপনার এলাকায় তো বেশি ঝামেলা হচ্ছে , ঘটনা কী ? এভাবে চললে তো আপনার ব্যাপারে আমাদের চিন্তা ভাবনা করতে হবে ।
-    স্যার স্যার । আপনি তো জানেন, এখানে তো স্যার বিএনপি জামায়াতের ঘাটি স্যার । আমি স্যার চেষ্টা করছি স্যার ।
-    দুইজনের নাম বলেন যাদেরকে ঠান্ডা করলে এলাকা ঠান্ডা হয়ে যাবে । কারা এইসব কাজ করছে ?
-    স্যার এখানে তো স্যার ওদের অনেকেই এক্টিভ । তবে জামায়াতের আরিফ আর বিএনপির  মারুফকে মিছিল মিটিং অর্গানাইজ করতে দেখা যায় স্যার ।
-    ঠিক আছে, আমি কাল লোক পাঠাবো । ওদের সহযোগিতা করবেন ।
-    স্যার, ইয়েস স্যার । 

নাম দুটি বলেও অস্বস্তিতে পড়লেন কামাল । এই মারুফ আর আরিফ, এরা রাজনীতি করলেও ভদ্র ছেলে । বয়স কম । লোকজনকে সাথে নিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে । মূল নেতারা তো সবাই প্রায় বৃদ্ধ । আন্দোলনে তেমন একটা দেখা যায় না । হরতাল অবরোধ এইসব কর্মসূচীতে এই ছেলেগুলোই রাস্তায় নামে । ওদেরকে ধরার জন্য বেশ কয়েকবার ওদের বাসাবাড়িতে অভিযানও চালানো হয়েছে , কিন্তু ধরা যায়নি ।
আন্দোলন তো করবেই । এটাই তো গনতন্ত্রের নিয়ম । বিরোধী দল আন্দোলন করবে । এটা তো নতুন কিছু না ।

২০০৯ সালে যখন তিনি এই থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন তখন পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে থানায় কোন অভিযোগ ছিল না । ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত এদের নামে বেশ কিছু মামলা হয়েছে । সবগুলোতেই অবশ্য সরকার, মানে পুলিশ বাদী । কোথাও কোন ঘটনা ঘটলেই আওয়ামী লীগের নেতারা এসে বলেন , এদের নামে মামলা দিতে হবে । কী আর করা , ওদের কথা না শোনার উপায় কী ? মামলা দেয়া হয় ।

৩।
এসপি সাহেবের লোক এসেছে গতকালই । এরা যৌথ বাহিনীর সদস্য । মারুফ এবং আরিফের ব্যাপারে সমস্ত তথ্য তাদের হাতে দিয়েছেন কামাল ।
মারুফ, বয়স ৩২ । যুবদলের সেক্রেটারি । বিবাহিত । একটা বাচ্চা আছে, বাচ্চার বয়স ২ বছর । গ্রামের বাড়ির ঠিকানা, নিকটাত্মীয়দের নাম ঠিকানা ।
আরিফ, বয়স ৩০ । জামায়াতের এই থানার কমিটির সহকারি সেক্রেটারি । বিবাহিত । বাবা মা মারা গেছে । দুই ভাই । বাড়ির ঠিকানা , নিকটাত্মীয়দের বাড়ির ঠিকানা ।

এই বাহিনী বেশ কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে । প্রথমে সংগ্রহ করা হল মারুফের বউয়ের মোবাইল নাম্বার । সেই মোবাইল নাম্বারের সকল ইনকামিং ও আউটগোয়িং কল বিশ্লেষণ করে সনাক্ত হল কোনটি আসলে মারুফের কল  । এরপর সেই নাম্বারের কললিস্ট ও অবস্থান বের করা হলো ।  সেই এলাকায় গোপনে খোঁজ খবর নেয়া শুরু হলো ।
আরিফের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো । দেখা গেল, ওরা দুজনেই জেলার ভেতরেই আছে ।

কামালের কিছু করার নেই । ওরা যা যা চায়, শুধু সেগুলোর তথ্য সরবরাহ করেন । প্রয়োজনে লোক পাঠান ।
রাত দুটা বাজার পর সাতজনের টিম নিয়ে বিশেষ বাহিনী অভিযানে বের হলো ।  একঘন্টার মধ্যে মারুফ এবং আরিফ দুজনকেই ধরে ফেলা হলো । দুজনকেই ঘুমন্ত অবস্থাতেই ধরা হয়েছে । মারুফ ঘুমিয়েছিল তাঁর শ্যালকের শ্বশুরবাড়িতে । আর আরিফ ঘুমিয়েছিল একটা দোকানের ভেতর । দুজনেরই চোখ মুখ বেঁধে নিয়ে আসা হয় । রাখা হয়েছিল একটা গোপন জায়গায় ।

৪।
 জিপ থামানো হলো । এই জায়গাটা একেবারে নিঃশব্দ । আশেপাশে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোন বাড়িঘর নেই । বেশ কিছু ঘন জঙ্গল আছে এদিক সেদিক ।
জিপ থেকে নামানো হলো মারুফ এবং আরিফকে । গতকাল রাতে গ্রেপ্তারের পর আজ সারাদিন ওদের ওপর টর্চার করা হয়েছে । অবশ্য গ্রেপ্তারের কথা বাইরে স্বীকার করা হয় নাই । ওদের পরিবারের লোকেরা এসেছিল , সাংবাদিকরাও এসেছিল । কারো কাছে স্বীকার করা হয় নাই । বলা হয়েছে- ওদের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ আছে । আমরা তাদের খুজছি । তবে এই মুহূর্তে তাদের ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই ।

টর্চার সহ্য করতে না পেরে মারুফ তো বিএনপির প্রায় সব তথ্যই দিয়ে দিয়েছে । র্যা বের লোকেরা টর্চারের নানান পৈশাচিক কৌশল জানে বটে । কথা না বলে কেউ থাকতে পারবে না । কামাল হলেও পারতেন না । 
তবে আরিফ ছেলেটা খুবই শক্ত । জামায়াতের ব্যাপারে ওর কাছ থেকে কোনভাবেই কোন তথ্য পাওয়া গেলনা । কোন কথাই বলে নাই । যতই পেটানো হয় শুধু আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করে ।

প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে । এবারের শীতটা অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশিই মনে হচ্ছে কামালের কাছে । আর কুয়াশাও পড়েছে ঘন । বেশিদূর তো নয়ই, এখানে কয়েকহাত সামনেই যেন দেখা যাচ্ছেনা ।

মারুফ আর আরিফের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হলো ।
-    যা শালারা । দৌড় দিয়ে চলে যা । বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো বিশেষ বাহিনীর একজন ।
কী ঘটতে চলেছে কামাল বুঝতে পারেন । পুলিশের লোক হয়েও তাঁর শরীরটা শিরশির করে ওঠে । ভাবতেও অবাক লাগছে , এরা কি এই দেশের মানুষ ? গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জেলে পাঠালেই হয় । মামলার পর মামলা দিয়ে বছরের পর বছর আটকে রাখা যাবে । কিন্তু তা না করে একেবারে...


অবাক বিস্ময় নিয়ে কালো পোষাকধারীদের দিকে তাকালো মারুফ । আরিফের কোনদিকে  ভ্রুক্ষেপ নেই । দুজনের কেউই অবশ্য নড়ছে না । বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এভাবে ছেড়ে দেয়া হবে তাদেরকে । ছেড়েই যদি দেবে, এত রাতে এভাবে কেন ?

-    কী হলো , যা । নাইলে কিন্তু গুলি করে দিমু । ধমকে উঠলো আবার কালো পোষাক পড়া একজন ।

ধীরে ধীরে পা বাড়াতে শুরু করে মারুফ । আরিফও চেষ্টা করে হাঁটার । ওদের কারোরই পায়ে শক্তি নেই দৌড়াবার মত ।

১০ গজের মত হেটেছে । পেছন থেকে হঠাৎ করেই দুটি করে গুলি এসে লাগলো দুজনকেই । একটা পিঠে, একটা মাথায় । ঢলে পড়লো ওরা । মৃত্যুর আগে মনে মনে কালেমা তৈয়েবা পাঠ করলো । মুখে উচ্চারণের শক্তি নেই ।


৫।
একদিন পর ।
ওসি কামাল বসে আছেন বাসার ড্রয়িংরুমের সোফায় । চায়ে চুমুক দিতে দিতে আজকের পত্রিকার পাতায় নজর দিচ্ছিলেন । সামনের পাতায় ডান দিকে বক্স নিউজ করেছে । বন্দুকযুদ্ধে জামায়াতকর্মী ও যুবদল নেতা নিহত । স্থানীয় থানার ওসি কামাল উদ্দিন জানান, গতকাল গভীর রাতে যুবদল নেতা মারুফ ও জামায়াতকর্মী আরিফকে গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে ওৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা অতর্কিতে হামলা চালায় । এসময় পুলিশ ও র্যা ব পাল্টা গুলি ছুড়লে নিহত হয় মারুফ ও আরিফ । সকালে তাদের লাশ ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে ।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে হঠাৎ  কেমন যেন বিস্বাদ লাগলো কামালের । তাঁর মনে হলো , এ যেন চা নয় – মারুফ আর আরিফের রক্ত ।