এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৭

ভুল মানদন্ডে 'সফল' হবার 'উস্কানি !!

তুমিই পারবে। তুমিও জিতবে। হাল ছেড়ো না, লেগে থাকো। 'দেখিয়ে দাও' যে তুমিও পারো।
এগুলোই হলো বর্তমান সময়ের সব ধরণের সো-কলড মোটিভেশনাল বই-পুস্তক-প্রবন্ধ-লেকচারের মূলকথা। শিব খেরা থেকে শুরু করে নব্য মোটিভেশানিস্ট, যারাই অন্য কাউকে মোটিভেশন দিতে চান, দিনশেষে এইসব কথাই হয়ে দাঁড়ায় তাদের বক্তব্যের সারমর্ম।
এইসব তথাকথিত মোটিভেশন আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভেতর সত্যিকার কোন স্পিরিট তো দিচ্ছেই না, বরং হতাশাই বাড়াচ্ছে। কারণ, প্রচলিত মোটিভেশন মূলক কথাবার্তাগুলোতে দুটি মৌলিক ও গুরুতর সমস্যা আছে। একটা হচ্ছে, সাফল্যের সংজ্ঞাটা এখানে কেবলই টাকার অংকে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই ভুল মানদন্ডে 'সফল' হবার জন্য সবাইকে 'উস্কানি' দেয়া হচ্ছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। অবাস্তব স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। যার ফলে বেশিরভাগ তরুণই একটা সময় গিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে।
মোটিভেশনাল বই পড়ে, বক্তব্য শুনে কেউ কোনদিন সফল হয়নি, হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে, চাইলেই সবাই 'সফল' হতে পারে না। চাইলেই সবাই জয়ী হতে পারে না। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস, মন থেকে চাওয়া, লেগে থাকা, কঠোর পরিশ্রম, কেবল এগুলোই সাফল্যের একমাত্র নির্ণায়ক নয়। পরিশ্রম করলেই সবাই ধনী হয় না, লেগে থাকলেই সবাই টপে ওঠে না, পড়ালেখা করলেই সবাই ভালো চাকরি পায় না।
ব্যবসা করলেই সবাই ফুলে ফেপে ওঠে না, রাজনীতি করলেই সবাই প্রেসিডেন্ট হয় না, লিখলেই সবাই জনপ্রিয়তা কিংবা নোবেল প্রাইজ পায় না।
আপনি একটা ক্লাসের সব ছাত্রকে মোটিভেশন দিলেন- তুমিই ফার্স্ট হতে পারবে। তোমাকেই ফার্স্ট হতে হবে। পড়ো পড়ো পড়ো!! You Can Win!!
অথচ বাস্তবতা হলো, মাত্র একজনই ফার্স্ট হবে। আর কেউ ফার্স্ট হতে পারবে না। আপনি যদি শুধু ফার্স্ট হওয়াকেই সাফল্য বলেন, তাহলে কি বাকি সবাই ব্যর্থ!! আপনার এই মোটিভেশন দিনশেষে বেশিরভাগ ছাত্রের মনেই হতাশা ছড়াবে।
ভালো চাকরি করা, ব্যবসা করে অনেক টাকা কামানো, কেবল এগুলোকেই এখন সফলতা হিসেবে তুলে আনা হচ্ছে। আলীবাবা, মার্ক জুকারবার্গ, স্যামসন এইচ, এদেরকেই এখন সাফল্যের আইকন হিসেবে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। যেকোনভাবেই হোক, অগুণতি টাকা উপার্জন করতে পারাটাই যেন 'সাফল্য'।
কিন্তু আসলে কি সবারই ধনী হওয়া সম্ভব? ব্যবসায় কি সবাই তরতর করে ওপরে উঠতে পারবে? সবাই কি উচ্চ বেতনের চাকরি পাবে?
তার মানে কি এই যে, ঐ গুটি কয়েকজন মানুষ ছাড়া বাকি সবাই অসফল? ব্যর্থ? ক্লাসের ফার্স্ট বয়টাই শুধু সফল? বাকিরা ব্যর্থ?
এই ধরণের ফালতু মোটিভেশন বন্ধ করা দরকার। এগুলো মোটেই মোটিভেশন না, সত্যিকার অর্থে এগুলো হলো চরম মাত্রার দীর্ঘমেয়াদী ডিমোটিভেশন।
২.
আসলে সফলতা কী?
আমি বলবো, ভালো মানুষ হওয়াটাই সাফল্য। সৎ মানুষ হওয়াটাই সাফল্য। বিনয়ী হওয়াটাই সাফল্য, ভালো ব্যবহার করতে জানাটাই সাফল্য।
নিজের সীমা ও সামর্থের মধ্যে সবচেয়ে ভালোটুকু করার পর, ফলাফল যাই হোক- সেটাই সাফল্য। সেটাকেই মেনে নেয়ার মোটিভেশান চালানো দরকার।
অন্যের দোকানে কাজ করে কেরোসিনের অভাবে পড়তে না পারা ছেলেটা যদি কোনমতে মেট্রিক পাশ করে- সেটাই সাফল্য। অক্ষম বাপ মায়ের একমাত্র অবলম্বন ছেলেটা যখন রিকশা চালিয়ে সংসারের জন্য উপার্জন করে- সেটাই সাফল্য। অনেক কষ্ট করে বিধবা মায়ের যে ছেলেটা গ্রামের ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়েছে- সেটাই তার সফলতা।
ছয় ডিজিটের স্যালারি, আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস, কর্পোরেট সিইও- এইসব হওয়াকেই যদি সাফল্যের মাপকাঠি ধরেন, তাহলে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষকেই ব্যর্থ বলতে হয়। যে কৃষক বাবা তার ঘামের টাকায় ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছেন, আপনার কি তাকে ব্যর্থ মনে হয়?
কেন সাফল্যের এই অবাস্তব সংজ্ঞা ফেরি করে বেড়াচ্ছেন? কেন তরুণদের মিথ্যা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন?
একজন মানুষের জন্য, ভালো মানুষ হওয়াটাই হলো সফলতা। কেউ যদি সৎ থাকে, মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করে, মানুষের ক্ষতি না করে, পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে তার নিজের দায়িত্বটুকু পালন করে, আমার দৃষ্টিতে সে-ই সফল। সে যেই হোক। মুচি, রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, অফিসের দারোয়ান, বাদাম বিক্রেতা গরীব ছেলেটা।
মোরওভার, একজন মুসলিমের কাছে সফলতার সংজ্ঞাটা আরো চমৎকার। পৃথিবীর জীবনের কোন লাভ, ক্ষতি, প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিতে তাদের জীবনের সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ধারিত হয় না। তাদের কাছে পৃথিবীর সবকিছুই আপাত। পরকালে পুরস্কৃত হওয়াটাই হলো একজন মুসলিমের জন্য সত্যিকার সফলতা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন